>
সৈয়দ শামসুল হক ও রফিক আজাদ। প্রয়াত এই দুই বিখ্যাত কবিই প্রেম করে বিয়ে করেছেন। তাঁদের সেই প্রেমিকা–স্ত্রীরাও স্বনামখ্যাত কবি-লেখক। কবিদের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি এবং সে সময় প্রেমিকার উদ্দেশে কোন কবিতা লিখেছিলেন কবিরা, ঈদের আয়োজনে সেটি লিখেছেন দুই কবির প্রেয়সী-পত্নী। সঙ্গে থাকল কবিদের লেখা সেই দুটি কবিতাও।
১৯৮০ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষে হলে থাকার কথা ভেবে ভর্তি হয়েছি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ডিপ-ইন-এড কোর্সে।
ড. হালিমা খাতুন আমাদের বাংলা পড়াতেন। একদিন তাঁর কোর্সে গ্রন্থ সমালোচনার জন্য আমাকে একটি বই দিলেন। কবিতার বই—চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া। কবি রফিক আজাদ।
পত্রপত্রিকায় বিচ্ছিন্নভাবে রফিক আজাদের কবিতা পড়েছি বটে, তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’ তখনো আলোচিত-সমালোচিত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিগত রফিক আজাদকে চিনতাম না, তখনো জানি না তাঁকে। বলা যায়, আমার কবিতা লেখা এবং প্রকাশের আকাঙ্ক্ষাই তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল আমাকে।
১৯৭৭ সালে প্রকাশিত চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই বইয়ে তাঁর বেশ কিছু বিখ্যাত কবিতা রয়েছে, যা আবৃত্তিকারদের কাছেও জনপ্রিয়। সেই বইটি আদ্যোপান্ত পাঠ করে গ্রন্থ সমালোচনা লিখতে গিয়ে প্রথম কবির কবিতার গভীরে প্রবেশ করলাম। নামকবিতা ছাড়াও অন্য বেশ কিছু কবিতা পড়ে কবির সূক্ষ্ম মনোবীণায় যেন খুঁজে পেলাম আমার আপন সুরটিকে। সারা রাত জেগে অন্য কিছু নয়, শুধু বাতাসের শব্দ, যা কেবলই দীর্ঘশ্বাসময়—এই হাহাকারের সঙ্গে কখন যে মন আমার একাত্ম হয়ে গেল নিজেরই অজান্তে!
পরে ওই ১৯৮০ সালেই বাংলা একাডেমির সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার-এ প্রকাশের জন্য দুটো কবিতা দিতে গিয়েছিলাম কবি ও সম্পাদক রফিক আজাদের দপ্তরে। সেই প্রথম দেখা। ভালো লাগা দুজনের।
সেখানেই প্রথম দেখি নাদিরা মজুমদার, শামীম আজাদ, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহসহ আরও অনেককে। তাঁরাও এখানে কবিতা দিতেই আসতেন, তবে রফিক আজাদের তুমুল আড্ডা রেখে নড়তে পারতেন না কেউ।
এভাবে কবি ও কবিতার আড্ডার জাদুতে পেয়ে বসল আমাকেও। আমি তখন টাঙ্গাইলের সরকারি কুমুদিনী কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক। চার দিন টাঙ্গাইলে থাকি, বাকি তিন দিনের জন্য বাসে দুলতে দুলতে ঢাকায় ফিরে আসি, রফিক আজাদের আড্ডার নেশায়। ইতিমধ্যে তিনি আমাকে একদিন রিকশায় পাশে বসিয়ে স্টেডিয়ামের ম্যারিয়টা বইয়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার ক্লাস বইটি কিনে উপহার দিলেন। ভালো কবিতা লেখার জন্য আরও কী কী বই পড়া উচিত, সে বিষয়ে আমাকে উপদেশ দিলেন।
কিছুদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, আমাকে নিয়ে তাঁর আগ্রহের মাত্রাটি দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, কবি বোধ হয় আমার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন অজান্তে। তাঁর বয়স, ঘর-সংসার কোনো কিছুই জানা নেই আমার। শুধু জানি, তিনি একজন বিখ্যাত কবি, মুক্তিযোদ্ধা, উত্তরাধিকার–এর সুযোগ্য সম্পাদক, উপরন্তু আড্ডাপ্রিয় মানুষ। অথচ কবি হিসেবে মানুষটিকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে ক্রমেই। তাঁর কবিতা সম্মোহনী মন্ত্রের মতো টানে আমাকে। চারপাশের বাতাসে যেন কবির উষ্ণতা ভেসে বেড়ায়। প্রাণ-মন সদাই ছুটে যেতে চায় সেইখানে।
বাংলা একাডেমিতে একদিন আড্ডার পরে, যথারীতি অফিসও ছুটি, একাডেমির বটতলায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলো, তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাই।’
কোথায়? জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘খারাপ কোনো জায়গা নয়, সাকুরা, রেস্তোরাঁ সাইটে বসব তোমাকে নিয়ে। নির্জনে বসে কথা বলার জন্য জায়গাটি বেশ ভালো। ভয় নেই। আধুনিক কবি হতে হলে এত ভয় পেলে কি চলবে?’
ভাবলাম, তাই তো!
কবির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম সেদিনই প্রথম। ভেতরটা একটুবা কেঁপেও উঠেছিল। বাংলা একাডেমির বটবৃক্ষের পাতার ফাঁক গলিয়ে অপরাহ্ণের গোধূলি আলোয় অসাধারণ পৌরুষদীপ্ত মনে হলো তাঁকে। যেন তিনি আমার বহু জনমের এক কাঙ্ক্ষিত প্রেমিক পুরুষ।
হঠাৎ অন্তরের বার্তা যেন বলে দিল, এই কবিকে আমি ভালোবাসি। কিছুতেই তিনি আমার ক্ষতি করবেন না। আমি অনায়াসে যেতে পারি তাঁর সঙ্গে যেকোনো স্থানে। কাজেই তাঁকে ‘না’ বলা আর সম্ভব হলো না।
তারপর একসময় ভাবলাম, কবিকে ভালোবাসা কি ঠিক হচ্ছে আমার? তাঁর সম্পর্কে তো প্রায় কিছুই জানি না। অথচ দিনে দিনে প্রেমের গভীর খাদে পড়ে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে একদিন তাঁর কাছেই জানতে চাইলাম তাঁর নিজের কথা। সেদিন কিছু না বলে পরের দিন আবার সেই সাকুরায় বসে আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমার হলে গিয়ে পোড়ো।’ বলেই উঠে বাথরুমে চলে গেলেন।
আমি বসে আছি একা, চিঠিখানা নেড়েচেড়ে দেখলাম বার দুয়েক। হাতের লেখা দেখলাম, মনে হলো চমৎকার। তাঁর হাতের লেখাকেও যেন ভালোবেসে ফেললাম মুহূর্তেই। ফিরে এসে টেবিলে বসতে গিয়ে রফিক আজাদ হঠাৎই টুক করে আমার ঠোঁটে চুমু খেলেন। কমলালেবুর কোয়ার মতো পরিপুষ্ট তাঁর অধরোষ্ঠ আমার আরক্তিম ঠোঁটে, ঘটনার আকস্মিকতায় আমি একেবারে হতবিহ্বল। এ রকম ঘটনা যে ঘটতে পারে, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
পরবর্তী তিন দিন সেই চুমুর শিহরণ আমি অনুভব করেছি বিদ্যুচ্চমকের মতো। যখনই কোথাও একা হই, সঙ্গে সঙ্গে সেই অভূতপূর্ব অনাস্বাদিত চরম এক পুলক অনুভব করি। মনে মনে ভাবি, একটা চুমুর এত শক্তি! এর নামই কি প্রেম বা ভালোবাসা? সব সভ্যতা, জনমানব, জায়-জঙ্গল, নিন্দা–মন্দ, সমূহ কটূক্তি—সবকিছু উজিয়ে নব আনন্দে যা বয়ে চলে স্বর্গ অভিমুখে, তা-ই প্রেম।
কলেজে চাকরির পাশাপাশি তখন আমি রোকেয়া হলে সহকারী সুপার হিসেবে খণ্ডকালীন একটা কাজ করি, বিনিময়ে থাকা ফ্রি। থাকি মূল ভবনের দোতলার একটা ঘরে। ঘর ভাগ করি অঞ্জলি বণিক নামের উদ্ভিদবিদ্যার এক ছাত্রীর সঙ্গে। তার সঙ্গে আমার লেনাদেনা সিনিয়র-জুনিয়র বন্ধুর মতো। কিন্তু কবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক যে নতুন মোড় নিয়েছে, সে কথা বলি না তাকে।
কবি আমাকে যেদিন চিঠিটি দিলেন, ওই দিনই হলে ফিরে দেখলাম রান্নাবান্না করে আমার জন্য অপেক্ষা করছে অঞ্জলি। খাওয়া, গল্প—নানাভাবে সে আমাকে আটকে রাখল অনেকক্ষণ। কিছুতেই একা হতে পারছি না। এদিকে চিঠিটি পড়ার জন্য মন আকুল হয়ে উঠেছে। হলের পুকুরপাড়ে গিয়ে যে পড়ব, তারও উপায় নেই, সঙ্গে সঙ্গে সে-ও যাবে। কাজেই বাধ্য হয়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে মন খুলে পড়লাম জীবনের প্রথম চিঠিখানা।
কবি-আত্মার কুসুমের নরম পাপড়িগুলো যেন ঝরে ঝরে পড়ছে সেখানে। কবি লিখেছেন এক জায়গায়:
দিলা আমার,
তোমাকে, একমাত্র তোমাকেই আমি ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া চলবে না আমার। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অপূর্ণ। আমি একটা ঝকঝকে শাদা দেয়াল নিয়ে ঘর করতে পারি, কিন্তু বাঁচতে পারি না। বাঁচার জন্য, প্রচণ্ডভাবে বাঁচার জন্য, সৃষ্টিশীলভাবে বাঁচার জন্য তোমাকে প্রয়োজন। একটি সুন্দর স্বপ্নের জন্য তোমাকে প্রয়োজন।
কবিতাই আমার কাছে জীবন, দৈনন্দিন ক্লেশকর আটপৌরে দুঃস্বপ্নে ভরা বাস্তবতাকে মেনে নিই মাত্র, আকর্ষিত হই না। আকাঙ্ক্ষা করি না। আকাঙ্ক্ষা আমার অমৃতের জন্য, যে অমৃতের স্বাদ আমি তো এই প্রথম তোমার কাছেই পেয়েছি। সব জেনেশুনে যে তা দিতে পারে, তাকে ‘অসাধারণ’ বলব না তো কাকে বলব, বলো?
তুমি অসাধারণ, তুমি অসাধারণ, তুমি অসাধারণ। ভালোবেসে আমি তোমাকে ধুলোয় নামাতে পারি না। তুমি নিজে কবি, এবং নিরপেক্ষ থেকেই বলছি, তুমি খুব ভালো লেখো। নিজেকে অযথা ছোট করে দেখো না, দোহাই দিলা।
তোমার কষ্ট কী, আমি বুঝি না। নিজে আমি কোনো কাজই করতে পারছি না—পদ্য লেখার ইচ্ছে পর্যন্ত হয় না। সর্বদাই বুকে ব্যথা, কী যে কষ্ট! ভালো লাগে না কিছুই। সর্বদাই তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে, দেখতে ইচ্ছে করে, শুনতে ইচ্ছে করে। স্পর্শ পেতে চাই—গোপনে অন্যদের চোখ এড়িয়ে তোমার ছবিতে যে কতবার চুমু খাই, দেখি, কী বলব! আমার আর কিছুই ভালো লাগে না, তুমি ঠিকই বলেছ, ‘একজন মানুষের জন্য একজন মানুষই যথেষ্ট—পৃথিবীর অন্য সব লোক ঈশ্বরের ব্যর্থ সৃষ্টি। ভালোবাসার কাছে সবই তুচ্ছ।’
এ রকম মানসিক অবস্থায় তখন রফিক আজাদ প্রায় দিগ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ান। কখনো যান টাঙ্গাইলে মা-বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার ছলে। কখনোবা তাঁর রাত কাটে কমলাপুর রেলস্টেশনে। ওদিকে কবির ঢাকার বন্ধুরা সে সময় তাঁর দিকে অসহযোগিতার হাল ধরে আছেন। বাধ্য হয়ে ঢাকা ছেড়ে দিন কয়েকের জন্য দিনাজপুরে প্রিয় বন্ধু অলোক মিত্রের কাছে চলে গেলেন তিনি। দুই দিন থাকলেন। তাঁকে সেখানে কান্তজীউ মন্দির, রামসাগর ছাড়াও বিভিন্ন স্থান ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখালেন অলোকদা। ফেরার সময় আমার কথা বলে দিনাজপুরের চিড়া, দই আর পাঁপড় পাঠিয়ে দিলেন তাঁর হাতে।
ঢাকায় ফিরে সেইসব স্মৃতিকাতরতা নিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ’৮১-তে লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘প্রতীক্ষা’।
আমাকে চিঠিতে লিখলেন, ‘তুমি লিখেছ, “তোমার কবিতা পড়েই তোমার হৃদয় আত্মস্থ করতে হয়, যা আগেই করেছি—এখনো তা–ই করতে হবে?’ না, সখী না, প্রশ্নই ওঠে না; এখন থেকে একমাত্র তোমাকে উদ্দেশ করেই সব পদ্য রচিত হবে। ছাপার অক্ষরে অন্যরা দেখবে, আর তুমি দেখবে খসড়া থেকে শুরু করে ফাইনাল কপি। আমার সাধারণ পাঠক–পাঠিকার উদ্দেশে নয়, হৃদয়ের নিভৃতে যার নিবাস, তার জন্য, শুধুই তার জন্য লিখে যেতে চাই বাকি জীবন।’
কবির এই অঙ্গীকার আজ আমার চলার পথের পাথেয়। আমারও বাকি জীবন তাঁর ধ্যানে, অনুধ্যানে, কালজয়ী তাঁর পঙ্ক্তিমালার সাধনায় অবগাহন করেই শেষ হবে।