কিছু প্রতিচ্ছবি

বেলাল ই বাকি l ছবি: লেখকের সৌজন্যে
বেলাল ই বাকি l ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমার জন্ম ঢাকায়, ১৯৫০ সালে। বাবা প্রয়াত এম এ বাকি ছিলেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত কৃতী ছাত্র। আর আমার মা প্রয়াত আজমেরি রওনক আরা বেগম ছিলেন চট্টগ্রামের একটি বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে। আমার শৈশবের শুরুর দিকটা কেটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। পড়াশোনা আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও নটর ডেম কলেজে।
আমার পরিবারে পাণ্ডিত্যের কদর ও মর্যাদা ছিল, যার মাধ্যমে আমি বেড়ে ওঠার বছরগুলোতে জোরালোভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। আমার মায়ের সবচেয়ে ছোট ভাই প্রয়াত জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন দীপ্তিমান পণ্ডিত। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি অর্জন করেন। তাঁকে আমরা সবাই খুব সম্ভ্রম করতাম। আমার বাবাও ছিলেন প্রেরণার উৎস।
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা
১৯৭০ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাই এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) থেকে পদার্থবিদ্যায় বিএস ডিগ্রি ১৯৭২ সালে সম্পন্ন করি। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি অর্জন করি ১৯৭৬ সালে। ক্যালটেকে নিবিড় জ্ঞানচর্চা ও কঠোর পরিশ্রমের সুন্দর পরিবেশই আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল। সেখানে কোনো অলস আড্ডা বা উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি ছিল না। সেখানকার বিভিন্ন লেকচার থেকে যা কিছু শিখতাম, তা–ই আমার জন্য জীবন বদলে দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। ক্যালটেকের সামগ্রিক পরিবেশটাই ছিল এমন।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হই ১৯৭২ সালে। অভিসন্দর্ভটি তৈরি করি কে জি উইলসনের তত্ত্বাবধানে, যিনি ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তখন তিনি নিজের সৃজনশীল প্রতিভার তুঙ্গে ছিলেন। আর তাঁর মৌলিকতা ও কঠোর নিয়ম–শৃঙ্খলা দেখেই আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। প্রত্যক্ষ নির্দেশনার চেয়ে সেই সব গুণের প্রভাবেই যেন একেকটি সমস্যার সমাধান করতেন তিনি।

বাংলাদেশ পর্ব
আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি ১৯৭৯ সালে। এতে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন এবং সব মিলিয়ে দেশের সঙ্গে আমার যোগাযোগটা আরও সুদৃঢ় হয়। এটাই ছিল সেই প্রত্যাবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি সুফল। ১৯৮১ সালে ঢাকায় আমি বিয়ে করি। সেটা ছিল জীবনের এক সন্ধিক্ষণ। বিয়ের পরই আমি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিই। নতুনভাবে গঠিত সরকারি ব্যাংকগুলো তখন বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করছিল। আমি এতে উৎসাহিত হই এবং ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিই।
পরামর্শক এবং একটি পোশাক কারখানার অংশীদার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জনসহ বিভিন্ন রকমের ব্যবসার চেষ্টার পর আমি ১৯৮৪ সালে উপলব্ধি করলাম, শিক্ষাজগৎই আমার আসল জায়গা। তখনই আমি পদার্থবিদ্যায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

বেলাল ই বাকির দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে যোগদান
১৯৮৪ সালেই আমি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের (এনইউএস) পদার্থবিদ্যা বিভাগে যোগ দিই। এখনো আমি সেখানকার অধ্যাপক। শিক্ষকতা ও পড়ানোর পদ্ধতি বিষয়ে আমার আগ্রহ অনেক দিনের। এনইউএসের শীর্ষস্থানীয় ৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর জন্য ২০০১ সালে ‘ইউনিভার্সিটি স্কলার্স প্রোগ্রাম’ চালু করার ক্ষেত্রে আমি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করি। বিজ্ঞানের বহু বইপত্রের সহলেখক হয়েছি আমি। বইগুলো এমনভাবে লেখা হয়েছে, যেন সেগুলো পড়ে বুঝতে হলে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। মানবিক বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও এসব বই সহজেই পড়তে পারে।
এনইউএসে প্রথম ১০ বছর আমার গবেষণাকাজের কেন্দ্রে ছিল কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্ব। ১৯৯৬ সালে আমার একজন সাবেক ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়, যিনি ব্যাংকার হয়েছেন। তিনি বললেন, কিছু অর্থনৈতিক কার্য সম্পাদনে গাণিতিক পদার্থবিদ্যা ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এ বিষয়ে আরও পড়াশোনা করে আমি জানতে পারলাম, অর্থশাস্ত্র ও পদার্থবিদ্যার মধ্যেও আছে অনেক গুপ্ত সম্পর্ক।
কোয়ান্টাম ফিন্যান্স নামে পরিচিত পড়াশোনার নতুন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আমিও একজন। এ বিদ্যার সাহায্যে
কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার গণিত প্রয়োগ করে অর্থ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা হয়। আমি পদার্থবিদ্যা ও অর্থ ব্যবস্থাপনা উভয় বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রেখেছি এবং এ ব্যাপারে শতাধিক গবেষণাপত্র ও আটটি বই লিখেছি।
অসাধারণ অনেক বিজ্ঞানীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০ জন নোবেল বিজয়ীও আছেন। এই সব মেধাবী মনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তাঁদের কিছু ভাবনা আমি পর্যবেক্ষণ করেছি এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজেও লাগিয়েছে। এভাবে জ্ঞান অর্জন ও পাণ্ডিত্য লাভের সহজাত মূল্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি।

ব্যক্তিগত যাত্রা
আধ্যাত্মিকতার প্রতি আমার আগ্রহ বহু বছরের। এ বিষয়ে বিভিন্ন রকমের বইপত্র আমি পড়েছি। এসবের মধ্যে রয়েছে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও ইসলাম। ২০০১ সালে আমি পবিত্র হজ পালন করেছি। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। নিজের এবং প্রকৃতি ও আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে তখন আমি বেশ কিছু উপলব্ধি অর্জন করি। হজ পালনের পর আমি পবিত্র কোরআন পড়েছি এবং কয়েকটি সুরা বিশ্লেষণও করেছি।
বহু বছর ধরে বিদেশে বসবাস সত্ত্বেও আমি বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি। দেশে বসবাসকারী মা–বাবার প্রতি বরাবরই আমার টান ছিল। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের প্রতিও সেই টান তৈরি হয়। কুমিল্লার কাছে পূর্বপুরুষের গ্রামের বাড়ির সঙ্গেও আমি যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে সিঙ্গাপুরে প্রচার কার্যক্রমে আমি যুক্ত হয়েছি। বাংলাদেশ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচারাল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট পদে আমি ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছি। এই ফাউন্ডেশন সিঙ্গাপুরে বাংলা ভাষার একটি বিদ্যালয় পরিচালনা করে। এটি ২০০০ সালে ৩৫ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এখন এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০০ জনের বেশি। আমি ও আমার স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম দিয়েছি। আমাদের দুটি সন্তানই সেই বিদ্যালয়ে পড়েছে। এ লেভেলের একটি বিষয় হিসেবে তারা বাংলা পড়েছে।

জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ
আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অনেক। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি। পশ্চিমে ১০ বছর, পূর্বে ৩০ বছর এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ২৫ বছর বসবাসের অভিজ্ঞতা আমাকে সব সংস্কৃতির অর্জন ও সম্পদগুলো পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিয়েছে। সব দেশ ও সব মানুষ যাতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং নিজেদের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে পারে, সে জন্য একটি আন্তর্জাতিক রূপরেখা প্রণয়ন করা জরুরি।
জ্ঞান ও চিন্তার বিশাল ব্যাপ্তি দেখে আমি বরাবরই মোহিত হয়েছি। বিশেষ করে, চিরাচরিত চিন্তাভাবনার বাইরে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা আমাকে মুগ্ধ করেছে। দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে পদার্থবিদ্যা, গণিত, জীববিজ্ঞান এবং অন্যান্য যে বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছি, সেগুলো গভীরভাবে পড়েছি আমি। সবগুলো বিষয়ই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। কারণ, এগুলো প্রকৃতির গূঢ় কার্যক্রম, মানবসমাজ এবং মানুষের মনের বিষয়ে অনেক কিছু প্রকাশ করে।
স্তবতার ধরন এবং বিভিন্ন বিষয়ের সহাবস্থানের প্রকৃতি জানার প্রয়াস আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দগুলোর একটি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে অনেকে অবসর নেওয়ার চিন্তা করে এবং বিশ্রামে যেতে চায়। কিন্তু আমি এখনো নতুন ও উত্তেজনাকর বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি হতে চাই। আর আশা করি পড়াশোনা ও গবেষণাকাজ চালিয়ে যেতে পারব, যত দিন এ কাজের জন্য সুস্থ–সমর্থ থাকতে পারি।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আশিস আচার্য

লেখক পরিচিতি
বেলাল ই বাকি অধ্যাপক ও গবেষক। জন্ম ঢাকায়, ১৯৫০ সালে। পড়াশোনা আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও নটর ডেম কলেজে। যুক্তরাষ্ট্রে যান ১৯৭০ সালে। সেখানে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক এবং পরে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। দেশে ফিরে আবার পাড়ি জমান সিঙ্গাপুরে। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। কোয়ান্টাম ফিন্যান্স বিষয়ের প্রবক্তাদের একজন। লিখেছেন বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তক।


সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: