পৃথিবীতে মাঝেমধ্যে এমন একেকজন ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়, যাঁদের দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের চলমান ধারাকে পরিবর্তন করে দেয়। এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন সম্রাট অশোক, সম্রাট আকবর, কন্সটেনটাইন, কামাল আতাতুর্ক, আহমদ শোয়েকার্নো, গোলাম নাসের, লেনিন, মাও সে তুং, মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগান্ত সৃষ্টিকারী নেতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমার আজকের আলোচনা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এই মহৎ হৃদয়ের মানুষটি বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। তিনি বাঙালি জাতিকে তার পরিচয় দিয়েছিলেন একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি জাতীয় পতাকা ও একটি সংবিধান উপহারের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি বন্দিশিবির থেকে ফিরে এসে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে যখন তিনি ব্যস্ত, ঠিক সে সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল ঘাতক কর্তৃক সপরিবার নিহত হন।
প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতিরূপে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের শাসনযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল অনিবার্য। বাংলাদেশের জনজীবনের তিনি ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালি জাতির অপরিসীম নির্ভরশীলতার পরিচয় বহন করে। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সরকারি অবস্থান কেন্দ্র গণভবনে প্রতিদিন ভিড় জমাত বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শত শত মানুষ। কেউ তাঁর কাছে যেতেন সাহায্যের জন্য, কেউবা সামান্য অনুগ্রহ লাভের আশায়। মন্ত্রীরা যেতেন পরামর্শের জন্য, আমলারা নির্দেশ গ্রহণের জন্য। কখনো আবার বিদেশি রাষ্ট্রদূতেরা বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতেন স্বীয় দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের কোনো শুভেচ্ছাবাণী নিয়ে। কখনো আবার বিদেশি মন্ত্রীরা আসতেন পরামর্শের জন্য।
একবার মধ্যরাতে রাষ্ট্রাচারের (প্রটোকলের) সব নিয়ম ভঙ্গ করে মিসর ও আলজেরিয়ার দুই রাষ্ট্রপ্রধান আনওয়ারুস সাদাত ও হুয়ারি বুমেদিন ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত হলেন। উদ্দেশ্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার জন্য পরামর্শ করা। আরও এসেছিলেন যুগোস্লাভিয়ার মহানায়ক জোসেফ ব্রজ টিটো। উদ্দেশ্য একই। এই নতুন দেশটির নেতা শেখ মুজিবকে একবার নিজ চোখে দেখা ও পরামর্শ করা এবং পরিশেষে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস প্রদান। এমনি আরও অনেক নেতা এসেছিলেন সে সময়ের বাংলাদেশে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী গাউ হুইটলাম, আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ দাউদ। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুটোও লোভ সামলাতে না পেরে একদিন সদলবলে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর অতি সাধের মুসলিম বেঙ্গলের মাটিতে। উল্কার বেগে এসে ভুট্টো সাহেব দেখলেন তাঁর কল্পনার ‘মুসলিম বেঙ্গল’। সত্যি সত্যিই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে, যার অবিসংবাদিত নেতা তাঁর সেই চেনা মুখ—শেখ মুজিব।
এহেন ব্যক্তিত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর তাই গণভবনে ছিল অসংখ্য লোকের ভিড়। বঙ্গবন্ধু সবার সঙ্গে অবাধে দেখা করতেন। মানুষের ধারণা হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু সব সমস্যার সমাধান দিতে পারবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে রাষ্ট্রাচারের প্রয়োজনে গণভবনে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হলো। গণভবনের পশ্চিম গেটে কিছুটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলো। তখনো এসএসএফের জন্ম হয়নি।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হতো। বঙ্গবন্ধুর কাছে দিনের কোনো এক সময় সেই তালিকা উপস্থাপন করা হতো। তালিকাটি তাঁর অনুমোদন লাভের পর সাক্ষাৎপ্রার্থীর প্রয়োজনের গুরুত্ব অনুযায়ী সাক্ষাতের তারিখ ও সময় দেওয়া হতো। আজ এ কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রত্যেক সাক্ষাৎপ্রার্থীর নাম পড়ে শোনানোর সময় তাঁদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেও সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দিয়ে দিতেন। সমগ্র বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মানুষ দর্শনার্থী হতেন। তিনি তাঁদের অধিকাংশের নাম জানতেন। এমন স্মৃতিশক্তি পৃথিবীর খুব কম মানুষের থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো সাক্ষাৎপ্রার্থী তাঁর সামনে আসার পর তিনি তাঁর বাবা বা ভাইয়ের কথা তাঁকে বলতেন এবং তাঁকে জানাতেন আট-নয় বছর আগে তিনি তাঁদের গ্রামে সাংগঠনিক সফরে গিয়েছিলেন এবং সেই গ্রামের কোন ব্যক্তি তাঁকে ক্লান্ত অবস্থায় প্রাণের উষ্ণতা দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এ কথা শোনার পর অনেক দর্শনপ্রার্থী অভিভূত হয়ে যেতেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তখন নানা সমস্যা ও সীমিত সম্পদ। কিন্তু তার মধ্যেও গণভবনে যেসব নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করতেন। যেসব কর্মকর্তা সে সময় গণভবনে কর্মরত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সর্বজনাব এইচ টি ইমাম, ড. আবদুস সাত্তার, আবদুর রহিম, মনোয়ারুল ইসলাম, কর্নেল জামিল, মশিউর রহমান, ড. ফরাসউদ্দিন, সৈয়দ রেজাউল হায়াৎ, ড. সৈয়দ আবদুস সামাদ, ড. ফজলুল হাসান ইউসুফ, আবদুল করিম, নুরুল ইসলাম, তোয়াব খান, আবদুল মালেক, মকবুল হোসেন, মাহফুজুস সোবহান, সৈয়দ আমিনুর রহমান অনেকে।
বঙ্গবন্ধু সরকারি বাসস্থানে বাস করতেন না। তিনি নিজের বেসরকারি বাসস্থান থেকে গণভবনে আসতেন প্রতিদিন সকাল নয়টায়। সকালে একটি ছোট অথচ সুসজ্জিত হাউস গার্ড দল তাঁকে অভ্যর্থনা জানাত। সে সময় গণভবনের (বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়) পেছনের প্রশস্ত দরজা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ওপরে যেতেন। তারপর সেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হতো। হাউস গার্ডদের অভিবাদন গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী দোতলায় তাঁর অফিসে কাজ আরম্ভ করতেন। সে সময় প্রায় প্রতিদিন সকালে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ। অতঃপর আসতেন ডিআইজি স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এরপর আরম্ভ হতো দিনের কাজ। তাঁর জীবনের শেষ সপ্তাহের দৈনিক কর্মসূচি থেকে তাঁর দৈনিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একটা ধারণা করা সম্ভব হবে।
১. বৃহস্পতিবার ৭ আগস্ট ১৯৭৫/২১ শ্রাবণ ১৩৮২, ২৮ রজব ১৩৯৫।
সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫টা ৩০ মিনিটে ও সেই দিন সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিটে। ওই দিন রাষ্ট্রপতির কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ—
সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে এটিনি সতার, সুইজারল্যান্ডের মাননীয় রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পরিচয়পত্র পেশ।
সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে মাননীয় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী।
বেলা ১১টায় মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
দুপুর ১২টায় মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী।
বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে শ্রী সমর সেন, ভারতের মাননীয় হাইকমিশনার।
সন্ধ্যা ৬টায় জনাব আবদুল আউয়াল, সদস্য, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ কমিটি।
সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে জনাব কাজী মোজাম্মেল হক, এমপি।
বেলা ১টা ৩০ মিনিটে রাষ্ট্রপতি প্রতিদিন গণভবন কমপ্লেক্সের বাসভবনে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন) যেতেন। সেখানে স্নানের পর দুপুরের আহার করতেন। এ সময় ব্যক্তিগত বাসস্থান থেকে তাঁর দুপুরের খাবার পাঠানো হতো। দুপুরের আহার ছিল অতি সাধারণ। তিনি কই মাছ অধিক পছন্দ করতেন দুপুরে। আহারের পর তিনি কিছুটা বিশ্রাম নিতেন। এ সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করতেন। তাঁদের বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার মধ্য দিয়ে তিনি দেশের হালহকিকত সম্পর্কেও একটি স্বচ্ছ ধারণা পেতেন। বিকেল চারটায় তিনি হাঁটতেন গণভবন প্রাঙ্গণে। এরপর লেকের ধারে যে ঘাট ছিল, সেখানে বড় কালো চেয়ারগুলোর একটিতে তিনি বসতেন। এ সময় গণভবন লেকে প্রচুর মাছ ছাড়া হয়েছিল। মাছকে খাবার দেওয়া হতো। কখনো কখনো তিনি নিজের হাতে মাছের খাবার ছিটিয়ে দিতেন।
প্রধানমন্ত্রী হয়েও একটি ছোট নীল রঙের টয়োটা গাড়ি ব্যবহার করতেন জ্বালানি তেলের সাশ্রয়ের জন্য। এই ছোট গাড়িটি বিমানের ট্রান্সপোর্ট পুল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
সিঁড়ির কাছে মাছের ভিড় জমত। এরূপ মাছের খেলা দেখতে বঙ্গবন্ধু অদ্ভুত আনন্দ পেতেন। বিকেলে এই লেকের ধারে কোনো কোনো সময় মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারাও আসতেন। এ সময়টায় যেহেতু বঙ্গবন্ধু অনেকটা রিল্যাক্সড মুডে থাকতেন, সে জন্য অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই অনির্ধারিতভাবে আসতেন তাঁর সঙ্গে নানা রাষ্ট্রীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ও পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত মাঝেমধ্যে এ সময় আসতেন আলোচনার জন্য। বঙ্গবন্ধু সাধারণত রাত নয়টা পর্যন্ত গণভবনে থাকতেন। অতঃপর কোনো পূর্বনির্দিষ্ট সাক্ষাৎপ্রার্থী না থাকলে ব্যক্তিগত বাসস্থানে যেতেন।
সে সময় প্রতি সোমবার বিটিভিতে একটি বাংলা ছায়াছবি দেখানো হতো। তখন এ দেশে ভিসিআর আসেনি। সে জন্য সোমবারের বাংলা ছায়াছবিটি দর্শকেরা আগ্রহভরে দেখতেন। গণভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন ওই ছবিটি দেখার সুযোগ পান, সে জন্য বঙ্গবন্ধু সোমবার আটটার আগেই বাসায় চলে যেতেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েও একটি ছোট নীল রঙের টয়োটা গাড়ি ব্যবহার করতেন জ্বালানি তেলের সাশ্রয়ের জন্য। এই ছোট গাড়িটি বিমানের ট্রান্সপোর্ট পুল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
২. শুক্রবার ৮ আগস্ট ১৯৭৫/২২ শ্রাবণ ১৩৮২, ২৯ রজব ১৩৯৫।
সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫টা ৩০ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮টা ৩৮ মিনিটে। দিনের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ—
সকাল ১০টায় প্রথম ও দ্বিতীয় কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যানদ্বয়।
সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে মাননীয় রেলওয়ে প্রতিমন্ত্রী।
বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে মাননীয় বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী।
বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান।
আমার যত দূর মনে পড়ে, সেদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার শেষ বন্দর, নৌ ও জাহাজ চলাচলমন্ত্রী ছিলেন।
উল্লেখ্য, দিনের কর্মসূচিতে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব আসতেন। তাঁরা একান্ত সচিবদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রাষ্ট্রপতির কর্মব্যস্ততা সম্পর্কে জেনে নেওয়ার পরই কোনো জরুরি নথি নিয়ে আসতেন। ড. সৈয়দ আবদুস সামাদ ছিলেন উপসচিব (নথি)। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যে নথিগুলো রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য আসত, সেগুলো ড. সামাদ রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর ও নির্দেশের জন্য উপস্থাপন করতেন।
৩. শনিবার ৯ আগস্ট ১৯৭৫/২৩ শ্রাবণ ১৩৮২, ৩০ রজব ১৩৯৫।
সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫টা ৩২ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮টা ৩৫ মিনিটে। এদিন সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিলেন—
সকাল ১০টায় ড. স্যামস্ট্রিট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধি।
বেলা ১১টায় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী প্রধান।
সন্ধ্যা ৬টায় জনাব জিল্লুর রহমান, এমপি, বাকশালের সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং অন্যান্য।
সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে অ্যাটর্নি জেনারেল।
৪. সোমবার ১১ আগস্ট ১৯৭৫/২৫ শ্রাবণ ১৩৮২, ২ শাবান ১৩৯৫।
সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫টা ৩২ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ৬টা ৩৬ মিনিটে। বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে জনাব গিয়াসউদ্দিন সাক্ষাৎ করেছিলেন।
সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে জনাব আযাহারুল ইসলাম, দ্বিতীয় কার্যকমিশন।
৫. মঙ্গলবার ১২ আগস্ট ১৯৭৫/২৬ শ্রাবণ ১৩৮২, ৩ শাবান ১৩৯৫
সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫টা ৩২ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮টা ৩৫ মিনিটে। সেদিন সাক্ষাৎপ্রার্থী খুব কম ছিলেন।
সকাল ১০টায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী।
সন্ধ্যা ৬টায় অধ্যাপক এ এফ এ হোসেন, কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট।
৬. বুধবার ১৩ আগস্ট ১৯৭৫/২৭ শ্রাবণ ১৩৮২, ৪ শাবান ১৩৯৫।
সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫টা ৩৩ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ৬টা ৩১ মিনিটে। দিনের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ—
বেলা ১১টায় জনাব এম আর সিদ্দিকী, যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত।
সন্ধ্যা ৬টায় জনাব মওদুদ আহমদ, বার অ্যাট ল।
সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে জনাব এম এ রব (চাঁদপুর)।
৭. বৃহস্পতিবার ১৪ আগস্ট ১৯৭৫/২৮ শ্রাবণ ১৩৮২, ৫ শাবান ১৩৯৫।
সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫টা ৩৩ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮টা ৩১ মিনিটে। এদিনের কর্মসূচিতে দেখা যায় তিনি বেশ ব্যস্ত ছিলেন। কর্মসূচিতে ছিল—
সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে প্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার (দক্ষিণ কোরিয়া) মহামান্য রাষ্ট্রপতি পার্ক চুং হির মাননীয় বিশেষ দূত।
সকাল ১০টায় নৌবাহিনী প্রধান।
সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে মাননীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী।
বেলা ১১টায় মাননীয় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিমানবাহিনী প্রধান।
বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে জনাব আতাউর রহমান খানের দুই কন্যা।
বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে মাননীয় উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সন্ধ্যা ৬টায় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে বঙ্গবন্ধু বেলা ১১টায় আমাকে বলেন, জনাব আতাউর রহমান খান চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছেন। তিনি যেখানে আছেন, জানার জন্য তাঁর কন্যাদের যেন আসতে অনুরোধ করা হয়। আমি টেলিফোনে জনাব আতাউর রহমান খানের বাসায় যোগাযোগ করি। তাঁর দুই কন্যা বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে রাষ্ট্রপতির কক্ষে প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু নিজের কন্যাদের মতোই তাঁদের সঙ্গে সস্নেহে কথা বলেন এবং তাঁদের বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নেন। এদিন বঙ্গবন্ধুকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। কিন্তু তথাপি তিনি জনাব আতাউর রহমান খানের কন্যাদের সঙ্গে প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বলেছিলেন।
এই দিন বিকেলে বঙ্গবন্ধু যখন লেকের ধারে বসে ছিলেন এবং মাছের জন্য খাবার ছড়ানো হচ্ছিল, সে সময় প্রায় (৪টা ৩০ মিনিট) অনির্ধারিতভাবে এসে উপস্থিত হলেন তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তাঁকে একটা চেয়ারে বসতে বলেন বঙ্গবন্ধু এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় বালক রাসেল লেকে সাঁতার শিখছিল। কিছুক্ষণ পর রাসেল ভেজা কাপড়ে এসে দাঁড়াল। তার সঙ্গে ছিলেন সাঁতার প্রশিক্ষক একজন নায়েব সুবাদার। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ইনি তোমাকে সাঁতার শেখাচ্ছেন, সে জন্য তাঁকে তোমার কিছু উপহার দেওয়া উচিত।’
কিছুক্ষণ পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর প্রস্থান করেন এবং শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোকাম্মেল হক আসেন। পরদিন বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। শিক্ষাসচিব বঙ্গবন্ধুকে একটি মানপত্র দেখান। এটি পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁর সম্মানে পাঠ করবে। কিছুক্ষণ পর পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতও এসেছিলেন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অভ্যর্থনা দেওয়ার সময় যেসব বক্তৃতা হবে, সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ড. মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী।
এ সময় রাষ্ট্রপতির অত্যন্ত স্নেহভাজন দুজন কর্মকর্তা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাচ্ছিলেন। তাঁরা হলেন মনোয়ারুল ইসলাম ও ফরাসউদ্দিন আহমদ। তাঁদের সম্মানে সেদিন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের কর্মকর্তারা একটি নৈশভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু রাত প্রায় আটটার সময় বাসায় চলে গেলেন। যাওয়ার সময় একান্ত সচিব রেজাউল হায়াৎ ও আমাকে নির্দেশ দিলেন যে ১৫ আগস্ট সকালে আমরা যেন তাঁর বাসস্থানে সরাসরি যাই। সেখান থেকে তাঁর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে আমাদের। এদিন আমরা গণভবনে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা অনেক রাত পর্যন্ত নৈশভোজের আনন্দ উপভোগ করেছিলাম। আমরা রাত প্রায় ১১টায় গণভবন ত্যাগ করি। পরে শুনেছি, সেদিন রাতে গণভবনের সামনের লেক অ্যাভিনিউয়ে অন্ধকারে বসে ছিলেন মেজর (পরে লে. কর্নেল অব.) আবদুর রশিদ। তিনি ভাবছিলেন কেন এই কর্মকর্তারা গণভবন থেকে বেরোচ্ছেন না। আমরা সবাই রাত ১১টায় নিজ নিজ বাসস্থানে যাওয়ার পর কর্নেল (অব.) রশিদ নিশ্চিত হয়ে তাঁর দোসরদের জানিয়েছিলেন, গণভবনের কর্মকর্তারা বাসায় ফিরেছেন।
আমি এ সময় সোবহানবাগ মসজিদের উল্টো দিকে সরকারি কোয়ার্টারের একটি ফ্ল্যাটে থাকতাম।
১৫ আগস্ট শুক্রবার সকালে প্রায় পৌনে পাঁচটায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দিয়ে দেখি রাস্তায় (মিরপুর সড়ক) দুটি সাঁজোয়া ট্যাংক দাঁড়িয়ে আছে মসজিদের সামনে। এ সময় আমি একটি টেলিফোন পাই। অপর প্রান্ত থেকে কর্নেল জামিল আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, মসজিদের সামনে তুমি কী দেখছ। আমি বেশ ভীত হয়ে বলি, জামিল ভাই, আমি মসজিদের সামনে ট্যাংক দেখছি। আমার ভালো মনে হচ্ছে না। আপনি জেনারেল সফিউল্লাহকে বলুন। (কর্নেল) জামিল ভাই তখনই ফোন রেখে দিলেন। এর পাঁচ মিনিট পর আমি ফরাসউদ্দিনের ফোন পাই। তিনি জানতে চান জামিল ভাই আমাকে ফোন করেছিলেন কি না এবং কী কথা হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর (কর্নেল) জামিল ভাই তাঁর লাল রঙের প্রিন্স গাড়িটি নিজেই চালিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবন ৩২ নম্বরের দিকে গেছেন। ফোন রাখার পরই আমি আবার বারান্দায় গিয়ে দেখি জামিল ভাইয়ের লাল প্রিন্স গাড়িটি সোবহানবাগ মসজিদের সামনে থামিয়েছেন সবুজ বেরেট পরা একজন অফিসার। পরে জানতে পেরেছিলাম এই অফিসারই সেই ‘সূর্যসন্তান’ মেজর নূর।
(ভোরের কাগজ, ১৫ আগস্ট ১৯৯৬)
শাহরিয়ার ইকবাল: বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ সহকারী একান্ত সচিব
বঙ্গবন্ধু: শ্রদ্ধায় ভাবনায় স্মৃতিতে গ্রন্থ থেকে (সম্পাদনা মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা )