অন্তর্জালে বাংলা

ইন্টারনেটে বাংলার মুক্ত আকাশ

মেহদী হাসান খান
মেহদী হাসান খান

বাংলাদেশে অনলাইন ইন্টারনেট ব্যবহারের তখন কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। বাংলা ওয়েবসাইট তৈরিও হয়ে গেছে। কিন্তু ওয়েবে বাংলা লেখা বা বাংলায় কোনো ওয়েবসাইট তৈরি করা রীতিমতো যুদ্ধ করার মতো। বাংলা লেখা ছবি আকারে মানে পিডিএফ করে ওয়েবে দিতে হতো। ফলে সেটা ভারী হয়ে যেত। সে সময় ইন্টারনেটের গতি খুব ধীর। আর ওদিকে এমনিতেই এক কম্পিউটারে বাংলা লিখে অন্য কম্পিউটারে নিয়ে গেলে সেটা পড়া যায় না। বাংলা ফন্ট সঙ্গে করে পাঠাতে হয়। ই–মেইলে বা ওয়েবে সহজেই সরাসরি ইংরেজি লেখা গেলেও বাংলা লেখা যায় না। এমনই একসময়ে ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ এল অভ্র। তৈরি হলো সে সময়ে উচ্চমাধ্যমিকপড়ুয়া ছাত্র মেহদী হাসান খানের হাতে। ছোট একটি প্রোগ্রাম, ই–মেইলের মাধ্যমে হাতে পেলেন অনেকেই। অভ্র দিয়ে সরাসরি ই–মেইলে বাংলা লেখা যায়। ইন্টারনেটে বাংলা লেখার জন্য, বাংলা সহজে পড়ার জন্য পাওয়া গেল মুক্ত আকাশ।

ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করেন মেহদী । ২০০১ সালে মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হলেন নটর ডেম কলেজে। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় গেলেন একদিন। সেখানে দেখলেন বাংলা ইনোভেশন থ্রু ওপেন সোর্স—বায়োসের স্টল। ‘ওই স্টলে প্রথম “ভেজাল” ছাড়া বাংলা ওয়েবসাইট দেখলাম। ইউনিকোডে বাংলা লেখাও দেখলাম। ইউনিবাংলা নামে ওদের পুরো একটা অপারেটিং সিস্টেমও দেখা হলো। তবে এটা লিনাক্সের জন্য।’ বললেন মেহদী। বাসায় এসে ওদের ওপেন টাইপ ফন্ট নামালেন। কিন্তু এ বাংলা লিনাক্সের জন্য। ক্যারেক্টার চার্টে মাউস দিয়ে ক্লিক করে করে বাংলা লিখতে হয়। জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজের জন্য নেই। ‘তাই ভাবলাম বানাই।’

ভাবনা থেকেই বানানোর শুরু। সে সময়ের প্রোগ্রাম লেখার জনপ্রিয় সফটওয়্যার ভিজ্যুয়াল বেসিক ডটনেট দিয়ে লিখে ফেললেন ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা সফটওয়্যার, যা উইন্ডোজে কাজ করবে। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশ করলেন অভ্র নামের সফটওয়্যারটি।

অভ্র নাম কেন? ‘সফটওয়্যারের একটা নাম তো দিতে হবে। অভিধান ঘেঁটে অভ্র শব্দটা পছন্দ হলো। অভ্র মানে আকাশ। একে ইউনিকোড, তার মধ্যে আবার বিনা মূল্যে এটা ব্যবহার করা যাবে। তাই আকাশের প্রতিশব্দ বেছে নিলাম।’ মেহদী বললেন। একটা ওয়েবসাইটও বানিয়ে ফেললেন। অভ্রর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়েবসাইটের নাম–ঠিকানা হলো www.omicronlab.com। মেহদী বলে চলেন, ‘মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওমিক্রনিক রূপান্তর বই পড়ে তখন আমি মুগ্ধ। ওখান থেকে নিলাম ওমিক্রন। আর ল্যাব শব্দ যোগ হলে একটা ভাবভারিক্কি আসে।’

খেয়ালের বসে বা কিছুটা ভাব আনতে ওমিক্রন ল্যাব নাম দিলেও অভ্র কিন্তু সাড়া ফেলে দিল। ই–মেইলে চলে যেতে থাকল অনেকের হাতে। অভ্রর প্রথম সংস্করণ লেখার জন্য বিজয় লেআউটই থাকল। কি–বোর্ড মুখস্থ না করে সহজে বাংলা টাইপ করার জন্য মেহদী নিজেই বানিয়ে ফেললেন অভ্র ইজি। অনলাইন ফোরামের যুগ সে সময়। তাই ওমিক্রেনর ওয়েবসাইট ফোরাম খোলা হলো। এখানেই পরিচয় অভ্র দলের অন্যদের সঙ্গে। অভ্রের সঙ্গে যোগ হলেন রিফাত উন নবী, তানবিন ইসলাম সিয়াম, শাবাব মুস্তাফা, ওমর ওসমান—আরও পরে সারিম খান। তাঁরা সবাই অভ্রের জন্য কাজ করতে লাগলেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে।

উচ্চমাধ্যমিক শেষে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়তে গেলেন মেহদী। এ সময় সচল রাখলেন অভ্রর যাত্রাও। ধীরে ধীরে অভ্রতে যোগ হলো অভ্র ইজি, ন্যাশনাল, প্রভা, মুনীর অপটিমা, ইউনি বিজয় (২০১১ সাল থেকে এটা নেই) বাংলা লেআউট। মেডিকেলে পড়ার সময় সবই ঠিক ছিল, কিন্তু ক্লাসে মেহেদীর উপস্থিতির হার অতি নগণ্য। রাত জেগে প্রোগ্রাম লেখেন, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়, ক্লাসে যেতে পারেন না সময়মতো। তাই ছয় মাস করে পিছিয়ে থাকতেন নিজের ব্যাচের চেয়ে। ২০১০ সালে ইন্টার্ন করলেন, বিয়েও করলেন। সহপাঠী সুমাইয়া নাজমুনকে।

ইন্টার্ন তাঁর ভালোই লাগত। এরপর এল প্রশ্ন, কোন পেশায় যাবেন তিনি? স্ত্রী বললেন, ‘তুমি যেহেতু প্রোগ্রামিং বেশি ভালোবাসো তাই দুই বছর তথ্যপ্রযুক্তি পেশায় চেষ্টা করো। ওখানে কিছু না হলে আবার তো ডাক্তারিতে ফিরে আসবে।’

এখন প্রোগ্রামিং নিয়েই মেহদীর যত ব্যস্ততা। অভ্রতে বড় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না শিগগির, তবে সচল রাখছেন মেহদী এবং তাঁর সঙ্গীরা। অবসর যেটুকু পান তা দেন ছেলে অর্ক হাসান খানকেই।

১৯৮৬ সালের ২৩ জুলাই ঢাকায় জন্ম নেওয়া মেহদীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন তিনি প্রচারবিমুখ তো বটেই, পাশাপাশি অন্তর্মুখী। তিনি বললেন, ‘আমি অন্তর্মুখী। আমার কাজের জন্য এটা পারফেক্ট।’

যে কাজটা মেহদী হাসান খান ১৫ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন, আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই অভ্র ইন্টারনেটে বাংলা লেখার স্বাধীনতা দিয়েছে, যেকোনো কম্পিউটারে বাংলা লেখাকে সহজ, সর্বজনীন করেছে। ভাষা হয়েছে উন্মুক্ত—ওমিক্রন ল্যাবের ওয়েবসাইটে যেমনটা লেখা আজও, ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’।


পল্লব মোহাইমেন, প্রথম আলোর উপফিচার সম্পাদক