সাও পাওলোর অ্যারেনা করিন্থিয়ানসের সামনে লম্বা লাইন। আমার ঠিক সামনেই তিনি। ‘গুড আফটারনুন’ বলায় পরিচিত সেই দেঁতো হাসি। ইন্টারভিউ চাইতেই বললেন, ‘পরে কোনো এক সময়’। যে ভঙ্গিতে বললেন, তাতে প্রতিশ্রুতির চেয়ে এড়িয়ে যাওয়ার সুরটাই কি কানে বেশি বাজল!
পরে বুঝেছি, আমার ধারণাই ঠিক। ওই ‘পরে কোনো এক সময়’টা নিছক ভদ্রতা করেই বলা। বিশ্বকাপে কলাম লেখা এবং কমেন্ট্রি দেওয়ার জন্য ব্রাজিলিয়ান এক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চুক্তির বাধ্যবাধকতা তাঁর অন্য কোথাও কথা বলার সুযোগ রাখেনি।
অ্যারেনা করিন্থিয়ানসের লিফট বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির স্বীকৃতির দাবিদার। উঠতে-নামতে একটা ফুটবল ম্যাচ হয়ে যায়, এমন অবস্থা! পরে ইন্টারভিউ হয় কি হয় না সংশয় থেকে মনে হলো, এই সুযোগে টুকটাক কিছু কথা বলে নিই। তা কী বলা যায়?
সুখস্মৃতি দিয়েই শুরু করা ভালো ভেবে বললাম, ‘যে ম্যাচে আপনি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড করলেন, সেই ম্যাচে আমি মাঠে ছিলাম।’
রোনালদো দা লিমা নাজারিও আবারও হাসলেন, ‘ডর্টমুন্ড! এই রেকর্ডটা তো মনে হয় আর আমার থাকবে না।’
থাকেওনি। যেদিনের কথা বলছি, তা ২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া উদ্বোধনী ম্যাচের আগের দিন বিকেল। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডটি কেড়ে নিয়েছেন রোনালদোর কাছ থেকে। কাকতালই বলতে হবে, ২০০৬ বিশ্বকাপে যে ঘানার বিপক্ষে ১৫তম গোলটি করে জার্ড মুলারের ৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ডটি ভেঙেছিলেন রোনালদো, ক্লোসার ১৫ নম্বর গোলও সেই ঘানার জালেই। সেদিন রোনালদোকে ছুঁলেন, ছাড়িয়ে গেলেন পরের সেমিফাইনালে। বেলো হরিজন্তের অ্যাটলেটিকো মিনেইরোর সেই অবিশ্বাস্য সেমিফাইনাল! যেখানে ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় রোনালদোর নিজেকেই বর্ণনা করতে হলো তাঁর রেকর্ড হারিয়ে ফেলার কাহিনি। নিজের রেকর্ড হারানোর দুঃখ হয়তো পরে ভুলেই গেছেন ব্রাজিলের চরম অপমানে।
জীবনে বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করেছি মাত্র দুটি। আট বছরের ব্যবধানে ওই দুটি বিশ্বকাপ—জার্মানি ২০০৬ আর ব্রাজিল ২০১৪। প্রথমটিতে জার্ড মুলারের রেকর্ড ভেঙে রোনালদোর বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে যেতে দেখেছি, দ্বিতীয়টিতে দেখেছি মিরোস্লাভ ক্লোসার রোনালদোকে ছাড়িয়ে যাওয়া। সৌভাগ্য ছাড়া আর কী! যখনই এই রেকর্ড নিয়ে আলোচনা হয়, আমি কপট নিরাসক্ত ভঙ্গিতে জানিয়ে দিই, দুটিই আমি মাঠে বসে দেখেছি। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকার গর্বটা বোধ হয় তাতে গোপন থাকে না।
২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের আগের দিন রোনালদোর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলছিলাম। ঘটনাচক্রে রোনালদোকে আমার প্রথম খেলতে দেখাও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। যদিও ম্যাচ শেষে রোনালদো খেলেছেন কি না, এ নিয়েই মনে সংশয় জাগার মতো অবস্থা। বিশ্বকাপে যাওয়ার পর থেকেই ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকদের মুখে রোনালদোকে নিয়ে বিরূপ আলোচনা শুনছিলাম। আনফিট, শুধুই নামের জোরে খেলে যাচ্ছেন, নইলে এই বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলে তাঁর জায়গাই হয় না ইত্যাদি। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে তত দিনে রোনালদো-রাজ শেষ হয়ে রোনালদিনিও-রাজ শুরু হয়ে গেছে। ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকেরা কি তাহলে ‘সবাই উদিত সূর্যের ভক্ত’ কথাটাকেই সত্যি প্রমাণ করছেন? নইলে ১৫ ম্যাচে ১০ গোল করে রোনালদোই তো বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইংয়ে দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলের সর্বোচ্চ স্কোরার।
ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের আগের দিন দূর থেকে প্র্যাকটিসে আর প্র্যাকটিস শেষে মিক্সড জোনে কাছ থেকে রোনালদোকে দেখার পর অবশ্য বুঝলাম, ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকেরা কথাটা এমনিতেই বলছেন না। বড্ড মুটিয়ে গেছেন ‘দ্য ফেনোমেনন’। একদা যিনি ইংলিশ কোচ ববি রবসনের কাছ থেকে ‘বল পায়ে দ্রুততম ফুটবলার’-এর স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, এখন যেন তিনি স্লো মোশনের ছবি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে এমনই অদৃশ্য হয়ে ছিলেন যে বিশ্বকাপে এটা ‘কোনো সুপারস্টারের জঘন্যতম পারফরম্যান্স’ কি না, এই আলোচনা উঠে গেছে। ব্রাজিলের বিখ্যাত পত্রিকা ও’গ্লোবো প্লেয়ার রেটিংয়ে রোনালদোকে ১০-এর মধ্যে শূন্য দিয়েছে। ৭০ মিনিট শেষে কোচ কার্লোস আলবার্তো পাহেইরা যখন রোনালদোকে তুলে নিতে বাধ্য হলেন, তীব্র শিস বাজিয়ে দুয়ো দিয়েছে হলুদ রঙের জার্সিতে গ্যালারিকে শর্ষেখেত বানিয়ে ফেলা ব্রাজিল সমর্থকেরাই।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচেও অবস্থা তথৈবচ। রোনালদো কিছুটা স্বরূপে দেখা দিলেন জাপানের বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচে। সেই ম্যাচ নিয়ে মজার একটা স্মৃতি আছে। প্রেস ট্রিবিউনে আমার পাশেই বসেছেন এক ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক। অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড থেকে নামটা জেনেছি। কথাবার্তা যা হচ্ছে, তার সবই ইশারা-ইঙ্গিতে। কারণ রিকার্ডো গোমেজ এক বর্ণ ইংরেজি বলতে পারেন না। আমি এক বর্ণ পর্তুগিজ না। জাপান শুরুতেই গোল দিয়ে বসার পর তাঁর বিষণ্ন মুখ দেখে কী ভেবে একটা কাগজে লিখলাম—ব্রাজিল ৪ : জাপান ১। রোনালদোর নাম দুই আঙুল দেখিয়ে বোঝালাম, রোনালদো আজ ২ গোল করবেন। বিশ্বাস করবেন কি না, সেটাই সত্যি হলো। আমি নিজেই যেখানে ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে নিজের ‘প্রতিভা’ দেখে একটু হকচকিয়ে গেছি, রিকার্ডো গোমেজ তো যাবেনই। এতটাই যে ম্যাচ শেষে ইংরেজি জানা এক ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিককে ডেকে এনে আমার একটা ইন্টারভিউও নিয়ে ফেললেন। যাতে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটাই প্রশ্ন—কীভাবে আমি নির্ভুলভাবে ম্যাচের রেজাল্ট বলে দিলাম? সঙ্গে রোনালদো ২ গোল করবে, এটাও? এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানলে না দেব! আমি তাই ‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে’ কথাটার ইংরেজিতে অনুবাদ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেলাম।
জাপানের বিপক্ষে ওই ২ গোলে রোনালদো পেলেকে ছাড়িয়ে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলেছিলেন জার্ড মুলারকে। ঘানার বিপক্ষে ব্রাজিলের পরের ম্যাচের আগে সব আলোচনাতেই তাই ঘুরেফিরে রোনালদো। আজই কি সেই ইতিহাস?
সেই ইতিহাসের মুহূর্তটা এল ম্যাচের পঞ্চম মিনিটেই। কাকার পাস পেয়ে গোলকিপারকে কাটিয়ে বিশ্বকাপে রোনালদোর ১৫তম গোল। ব্রাজিল ৩-০ গোলে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেছে। কিন্তু ম্যাচ শেষে মিক্সড জোনে সব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু রোনালদো। ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকদের ভাষায় ‘হোনালদো’। এই মিক্সড জোন ব্যাপারটা মনে হয় একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। অলিম্পিকের মতো বিশ্বকাপেও প্র্যাকটিস বা ম্যাচ শেষে খেলোয়াড়েরা যে পথে মাঠ থেকে বেরিয়ে যান, সেখানেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এই মিক্সড জোনের ব্যবস্থা। কোমরসমান উচ্চতার বেষ্টনীর বাইরে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকেরা কথা বলেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে। কথা বলা না-বলাটা অবশ্য খেলোয়াড়দের ইচ্ছা।
বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রেসবক্সের মতো মিক্সড জোনেও সাংবাদিকের সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে। বাংলাদেশের মতো ফুটবলের তৃতীয় বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্য ম্যাচের মতো মিক্সড জোনের টিকিট পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন বলেই ব্রাজিল-ঘানা ম্যাচের মিক্সড জোনের টিকিট পেয়ে গিয়েছিলাম। ম্যাচের চেয়ে এই মিক্সড জোনও কম উপভোগ্য নয়। বিশেষ করে ব্রাজিলের ম্যাচের পর। ব্রাজিলে রেডিওর এখনো খুব কদর। জার্মানি বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ২৪টি রেডিও স্টেশন অ্যাক্রিডিটেশন নিয়েছিল, এর মধ্যে ২১টিরই নিজস্ব স্টুডিও ছিল প্রেস সেন্টারে। এই রেডিও স্টেশনের প্রায় সব কটিই মিক্সড জোন সরাসরি সম্প্রচার করে। সম্প্রচার বলতে রিপোর্টার নিজে কথা বলেন, খেলোয়াড়দের কথা শোনান। এর ফাঁকে আবার অন্য সাংবাদিকদের ছোট্ট ইন্টারভিউও থাকে। এদিনই যেমন ভালমির পাহেইরা নামে এক ব্রাজিলিয়ান রেডিও সাংবাদিককে আমার ইন্টারভিউ দিতে হলো। বিষয় অবশ্যই ‘হোনালদো’ এবং বিশ্বকাপে ব্রাজিলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা।
মিক্সড জোনে সাংবাদিকেরা এদিন রোনালদোকেই অনুসরণ করে গেল। কথা বলতে বলতে রোনালদো এগোন, সঙ্গে বেষ্টনীর এপাশে সাংবাদিকদের জটলাটাও। রোনালদোর পর্তুগিজে বলা কথাবার্তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরেও আমি তাঁদের সঙ্গী। ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে রোনালদোকে একবার ছুঁয়েও দিলাম। রেকর্ড ভাঙার রাতে রোনালদোকে ছুঁয়েছি—নাতি-নাতনির কাছে গল্প করার মতো একটা ঘটনা সঞ্চয়ে থাকলে খারাপ কী!
রোনালদোর রেকর্ড ভাঙার ম্যাচের কথা ভাবলে রোনালদোর কথাই মনে হয়। কিন্তু আট বছর পর ক্লোসার সেই রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার ম্যাচে অনেক কষ্ট করে মনে করতে হয় ক্লোসাকে। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেই সেমিফাইনাল যে ৭-১ গোলের বিস্ময়ে ঢেকে দিয়েছে বাকি সব। এমনকি মিরোস্লাভ ক্লোসার ইতিহাস গড়া জার্মানির দ্বিতীয় গোলটাকেও।
যদি বলি, ব্রাজিলিয়ান ফু্টবলের চরমতম বেদনা আর পরমতম আনন্দ দুটিরই আমি প্রত্যক্ষদর্শী, পাল্টা প্রশ্ন কী হবে, তা অনুমান করতে পারি। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের চরমতম বেদনা বললে তো প্রথমেই মনে পড়ে ‘মারাকানাজো’—মারাকানা স্টেডিয়ামে ১৯৫০ বিশ্বকাপ ফুটবলের শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ব্রাজিলের ২-১ গোলে সেই পরাজয়। আমার জন্মেরও আগের সেই ম্যাচের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ কোথায়?
যৌক্তিক প্রশ্ন এবং সেই প্রশ্নের উত্তরও আপনি জানেন। ‘মারাকানাজো’ আমি দেখিনি। তবে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের দুঃখগাথায় ‘মারাকানাজো’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা (না সেটিকে ছাড়িয়ে যাওয়া?) ‘মিনেরেইজো’ তো দেখেছি। ‘মারাকানাজো’ কী, এটা প্রায় সবারই জানা, ধরে নিয়েও একটু কি ব্যাখ্যা করা উচিত? করিই না হয়।
১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ওই একটাই বিশ্বকাপেই ফাইনাল বলে কিছু ছিল না। তারপরও শেষ ম্যাচটা রূপ নিয়েছিল অলিখিত ফাইনালের। যে ম্যাচে ড্র করলেই ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন, উরুগুয়েকে জিততেই হবে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ব্যাপারে ব্রাজিলিয়ানরা এমনই নিশ্চিত ছিল যে শুরু হয়ে গিয়েছিল আগাম উদ্যাপন। রিওর পত্রিকা ও’মুন্দো ম্যাচের দিন ব্রাজিল দলের ছবি ছেপে ঘোষণা দিয়ে দেয়: ‘দিজ আর দ্য চ্যাম্পিয়নস’। রিওর মেয়র বিজয়ী বীরদের স্যালুট জানিয়ে দেন। এই পটভূমি জানা থাকলে মারাকানায় প্রায় দুই লাখ দর্শকের সামনে সেই ম্যাচে পরাজয়ের তাৎপর্য বুঝতে সুবিধা হবে। কেন একটা ফুটবল ম্যাচে পরাজয় ব্রাজিলের জাতীয় ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছিল, সেটাও।
২০১৪ বিশ্বকাপ কাভার করতে ব্রাজিল যাওয়ার সময়ই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, ‘মারাকানাজো’র প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে খুঁজে বের করে তাঁর ইন্টারভিউ করব। সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। খুব যে চেষ্টা করেছি, তা–ও নয়। কারণ সাও পাওলোতে ব্রাজিলে আমার প্রথম দিনেই পাওয়া একটা সতর্কবার্তা। ব্রেকফাস্ট করতে নেমে হোটেলের মধ্যবয়সী ম্যানেজারকে আমার ইচ্ছার কথা জানাতেই হেসে বলেছিলেন, ‘এমন অনেককেই পাবেন। তবে বিশ্বাস করবেন না। যতজন ব্রাজিলিয়ান ওই ম্যাচে মাঠে ছিল বলে দাবি করে, তা সত্যি হলে সেদিন মারাকানায় দুই লাখের বদলে বিশ লাখ দর্শক থাকার কথা।’
৬৪ বছর আগের কথা। এ কারণেই কি না ‘মারাকানাজো’র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে মিথ্যা দাবি করা কাউকেও পাইনি। তখন কি আর কল্পনা করেছি, মারাকানাজোকেও ম্লান করে দেওয়া এক মহাবিপর্যয়ের সাক্ষী হয়ে থাকব আমি নিজেই! ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাইকেও ছাপিয়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে কালো দিন হয়ে যাবে ২০১৪ সালের ৮ জুলাই। যেদিন বেলো হরিজন্তের অ্যাটলেটিকো মিনেইরোতে ৬০ হাজার দর্শকের সঙ্গে আমিও প্রেস ট্রিবিউনে বসে তা দেখতে দেখতে অবিশ্বাসে চোখ কচলাব।
আসলেই অবিশ্বাস্য। চোখের সামনেই তো ৫টি গোল, মনে আছে, তারপরও ম্যাচের ২৯ মিনিট পর মাঠের বিশাল স্কোরবোর্ডটা কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছিল! জার্মানি ৫: ব্রাজিল ০! বিশ্বকাপ ইতিহাসেই কোনো সেমিফাইনালের প্রথমার্ধে ৫ গোল হয়নি। আর এখানে খেলা হচ্ছে দুই ফুটবল পরাশক্তির মধ্যে, চোখে ‘হেক্সা’র স্বপ্ন নিয়ে ব্রাজিল খেলছে নিজেদের মাঠে—আর ম্যাচের আধঘণ্টা যেতে না যেতেই কিনা খেয়ে বসেছে ৫ গোল! মাঠের চেয়ে আমার চোখ তখন বেশি ঘুরছে গ্যালারিতে। ফুটবলের প্রেস ট্রিবিউন ক্রিকেটের মতো জগৎসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন শব্দনিরোধক কাচের ঘর নয়, খোলা গ্যালারির মাঝখানেই আলাদা করা একটা অংশ। আমি আবার বসেছি সাধারণ গ্যালারির পাশেই। দর্শক প্রতিক্রিয়া দেখতে বাঁয়ে একটু মাথা ঘোরালেই তাই চলছে।
২৩ মিনিটে মিরোস্লাভ ক্লোসা দ্বিতীয় গোল করার পরই পাশের গ্যালারিতে গায়ে হলুদ জার্সি, গালে জাতীয় পতাকা আঁকা এক তরুণীকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলতে দেখেছি। পরের ৭ মিনিটের মধ্যে জার্মানি আরও ৩ গোল করে ফেলার পর সেই কান্না সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে পুরো গ্যালারিই বলতে গেলে তখন কাঁদছে। খেলায় হার–জিত আছেই, কিন্তু এখানে যা হচ্ছে, তা তো চূড়ান্ত অপমান। পরে দেখেছি, সাও পাওলোর সবচেয়ে নামী দৈনিক অনলাইন এই লাইনেই শিরোনাম করেছিল: ঐতিহাসিক অপমান।
পরদিন ও এস্তাদো দ্য সাও পাওলোর প্রথম পৃষ্ঠায় এই ম্যাচ ছাড়া আর কিছু নেই। মাঝখানে দুহাতে মুখ ঢাকা লুই ফেলিপে স্কলারির একটা ছবি। ওপরে ব্যানার হেডলাইন: HUMILHACAO EM CASA। অর্থ? নিজের ঘরে অপদস্থ।
ওই অপদস্থ হওয়া দেখতে দেখতে ম্যাচের আগে মাঠে ঢোকার সময় যে তিন ব্রাজিলিয়ান তরুণের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তাঁদের কথা মনে পড়ছিল। হাতে মিক জ্যাগারের একটা বিশাল কাটআউট ছবি, যেটির ওপরে লেখা ‘গো, জার্মানি গো’। মিক জ্যাগারের কাহিনিটা জানতাম বলে অবাক হইনি। খেলাধুলা-অন্তঃপ্রাণ রোলিং স্টোনস তারকা যে দলকে সমর্থন করেন, সেই দলই নাকি হারে। পাছে আবার তিনি ব্রাজিলকে সমর্থন করে বসেন, সেই ভয়ে তাঁকে এমন জার্মানির সমর্থক বানিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানি যখন আরও দুই গোল দিয়ে স্কোরলাইন ৭–০ বানিয়ে ফেলল, তখন ওই তিন তরুণের মনের অবস্থা কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম। যদিও আশপাশে চমকপ্রদ সব বাস্তব ঘটনাই এত ঘটছিল যে কোনো কিছু কল্পনা করার অবকাশ অবশ্য খুব বেশি পাচ্ছিলাম না।
অল্প শোকে মানুষ কাঁদে, অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। অভাবনীয় কিছু হলে একটা সময় মনে হয় বিচিত্র আচরণ করতে শুরু করে। অ্যাটলেটিকো মিনেইরোর গ্যালারিও তখন তা–ই করছে। জার্মানদের পায়ে বল গেলে হাততালি দিচ্ছে, ব্রাজিলিয়ানদের পায়ে গেলে শিস। খেলার শেষ বাঁশি বাজার আগে অস্কার ব্রাজিলের হয়ে একমাত্র গোলটি করার পর গ্যালারি থেকে ‘গো–ও–ল’ ‘গো–ও–ল’ বলে যে গর্জনটা উঠল, তাতে কারও মনে হতেই পারত, স্কোরলাইন বোধ হয় এতে ৭–১ হয়নি, ব্রাজিল সমতা এনে ফেলেছে!
এই ম্যাচ দেখার সময় যা মনে হয়েছিল, এত দিন পরও যা মনে হয়, ঠিক সেই কথাটাই শুনেছিলাম ম্যাচের পরদিন বেলো হরিজন্তে থেকে সাও পাওলো আসার সময় বিমানবন্দরে। বিমানে ওঠার লাইনে দাঁড়িয়ে আলাপ ব্রুনো বেনজিয়ার সঙ্গে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা করছেন। এই ম্যাচটা দেখতেই কুরিতিবা থেকে বেলো হরিজন্তে এসেছিলেন। প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তখনো বিশ্বাস হয়নি, এখনো হচ্ছে না। ইতিহাসেই যা কখনো হয়নি, চোখের সামনে তেমন কিছু ঘটতে দেখলে কীভাবে তা হবে!’
আসলেই তো তাই। বিশ্বকাপ ফুটবলে কত অসম সেমিফাইনাল হয়েছে, কিন্তু এর আগে কোনো দল ৭ গোল খায়নি। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের চরম বেদনার এই গল্প নিয়ে চাইলে আরও অনেক লিখতে পারি। ওই ম্যাচের পরও তো আরও সপ্তাহখানেক ব্রাজিলে ছিলাম। যেখানেই গিয়েছি, আলোচনার বিষয় তো ছিল ওই একটাই। সেসব পরে কখনো বলা যাবে। চরম বেদনা থেকে এখন বরং পরম আনন্দে যাই।
২০১৪ বিশ্বকাপের বছর দুয়েক পর আবার ব্রাজিলে। এবার উপলক্ষ রিও অলিম্পিক। অলিম্পিকে অ্যাথলেটিকস–সাঁতার–জিমন্যাস্টিকস এমন আরও খেলার ঔজ্জ্বল্যের পাশে ফুটবল একটু মিটিমিটি করেই জ্বলে। রিও অলিম্পিককে সেদিক থেকে একটু ব্যতিক্রমই বলতে হয়। একে তো ব্রাজিল ফুটবলের দেশ। তার ওপর এই অলিম্পিক ফুটবল হয়ে আছে ব্রাজিলের চির-আক্ষেপের নাম। পাঁচবার ট্রফি জিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের সফলতম দেশ, অথচ সেই ব্রাজিল কিনা একবারও অলিম্পিক ফুটবলে সোনা জিততে পারেনি। এর আগে তিনবার ফাইনালে ওঠা শুধু স্বপ্নভঙ্গের হ্যাটট্রিকের কাজটাই করেছে। ফুটবলের সবচেয়ে বড় রহস্যই হয়ে ছিল এটি। নিজেদের দেশে প্রথম অলিম্পিকে সেই রহস্য ঘুচে যাবে, এই স্বপ্ন দেখতেও তখন ব্রাজিলিয়ানদের ভয়।
কারণ একাধিক। দুই বছর আগে বিশ্বকাপের সেই ক্ষত তখনো দগদগে। মাঝের সময়টায় কোপা আমেরিকার প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় ও বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইংয়ে ষষ্ঠ হওয়াটা সেই ক্ষতে লবণ ছিটানোর কাজ করেছে। প্রথম দুই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইরাকের সঙ্গে ড্র করার পর তো রীতিমতো গণবিক্ষোভের মুখে পড়েছে ব্রাজিল দল। চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ায় নেইমার বেলো হরিজন্তের ওই সেমিফাইনালে ছিলেন না। বিশ্বকাপ দলের মতো অলিম্পিক দলেরও প্রাণভোমরা নেইমার এবং ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দুতেও তিনি। প্রথম দুই ম্যাচে এমনই বিবর্ণ যে, নেইমারের জার্সির পেছনে ব্রাজিলের নারী ফুটবল দলের স্ট্রাইকার মার্তার নাম লিখছে সমর্থকেরা। মাঠে নেইমারের পায়ে বল গেলে চিৎকার করছে ‘মার্তা’ ‘মার্তা’ বলে।
পরের তিন ম্যাচে ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্রাজিল অবশ্য সদর্পেই ফাইনালে এবং ফুটবল–বিধাতার কী খেলা, সেই ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ দুই বছর আগে লজ্জায় ডোবানো সেই জার্মানি। বিশ্বকাপ আর অলিম্পিকের দল এক নয়—কিন্তু দেশের নাম তো একই। কমন কিছু খেলোয়াড়ও আছেন। অলিম্পিক ফুটবলে ব্রাজিল ‘ঘর পোড়া গরু’, আর প্রতিপক্ষ জার্মানি ‘সিঁদুরে মেঘ’–এর বিভ্রম নয়। ‘মিনেইরোজো’র কারণে আরও নয়। ব্রাজিলিয়ানদের মনে একটা ‘কু’ ডাক তাই দিচ্ছিলই। ১–১ গোলে শেষ হওয়া ম্যাচ যখন টাইব্রেকারে গেল, তখন আরও বেশি।
সেই টাইব্রেকারের নির্ধারক শটটা নেওয়ার দায়িত্ব পড়ল কিনা সেই নেইমারের ওপরই। গোল করলেই ঘুচে যাবে ব্রাজিলের এত বছরের আক্ষেপ—পেনাল্টি নিতে যাওয়া নেইমারকে দেখে তাঁর ওপর চাপটা কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম। এবং স্বাভাবিকভাবেই পারছিলাম না। আমরা সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝব, পুরো দেশ, পুরো জাতির স্বপ্নপূরণের ভার কেমন দুর্বহ হয়!
সেই ভারমুক্তির আনন্দটা বুঝতে অবশ্য সমস্যা হয়নি। নেইমারই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। গোলটা করেই শুয়ে পড়লেন মাঠে, দুহাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। সতীর্থরা সব ছুটে আসছে দেখে একবার উঠে বসার চেষ্টা করেছিলেন। আবারও শুয়ে পড়লেন। হয়তো কান্নার দমকেই। মারাকানা তখন পাগল হয়ে গেছে।
পুরোনো দিনের দুই লাখ দর্শক ধারণক্ষমতার মারাকানা আধুনিকায়নের পর এর অর্ধেকের মতো দর্শককে জায়গা দিতে পারে। সেই লাখখানেক দর্শক কী করছে, তারা নিজেরাই যেন তা জানে না। যে যাকে সামনে পাচ্ছে জড়িয়ে ধরছে, বেশির ভাগই আনন্দে লাফাচ্ছে। আনন্দ প্রকাশের মাধ্যমে একটু ভিন্নতা থাকলেও একটা ব্যাপার সবার ক্ষেত্রেই কমন...গলা ফাটিয়ে চিৎকার। সেই সম্মিলিত চিৎকার পরিণত হচ্ছে গর্জনে। শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়া কথাটা এর আগে শুধু শুনেই এসেছি, সেদিন তা সত্যি সত্যি বুঝেছিলাম।
সেই গর্জন যেন অনন্তকাল ধরে চলছে। ম্যাচ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পরও মারাকানার গ্যালারি দর্শকে পরিপূর্ণ। নেইমাররা যে তখনো মাঠে। শিশুর মতো আনন্দে যা ইচ্ছা তাই করছেন। দুই বছর আগে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে দুঃখের দিনটার সাক্ষী হয়ে ছিলাম। এদিনের মারাকানায় সবচেয়ে আনন্দের দিনটাও মনে হয় দেখে ফেললাম। দেখতে দেখতে প্রেস ট্রিবিউনে আমার পাশে বসা ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকের দিকে তাকালাম। ম্যাচ শুরুর আগে তাঁর কাছে থেকেই জেনেছিলাম, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ৭-১ গোলের পরাজয় ব্রাজিলিয়ান সমাজে কেমন অনুভূতি প্রকাশের একটা মাধ্যম হয়ে গেছে। কাউকে বিপর্যস্ত দেখলেই নাকি বলা হয়, ‘কী রে, মুখটা অমন ৭-১-এর মতো করে রেখেছিস কেন?’ মারাকানার শব্দকল্লোলে পাশের জনের কথাও শোনা যাচ্ছে না। কানের কাছে মুখ নিয়ে তাই চিৎকার করে বললাম, ‘এখন তো ব্রাজিলে নতুন একটা কথা যোগ হবে মনে হচ্ছে। কাউকে খুব আনন্দিত দেখলে বলা হবে, কী রে, তুই তো দেখছি মারাকানার মতো খুশি!’