অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান মারা গেছেন। বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে আসা আকবর আলি খান দীর্ঘদিন সংকটকালে জাতিকে দিশা দিয়েছেন। স্পষ্টবাদী হিসেবে পছন্দের ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া আকবর আলি খানের লেখাও সমাদৃত হয়েছে। গত মে মাসে প্রথম আলো ঈদসংখ্যায় তাঁর এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। আকবর আলি খানের মৃত্যুতে সাক্ষাৎকারটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।
আকবর আলি খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইতিহাস, কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি। পিএইচডি গবেষণাও অর্থনীতিতে। আমলা হিসেবে পেশাজীবনের প্রধান ধারার পাশাপাশি চলেছে শিক্ষকতাও। অবসর নিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে। এরপর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন, দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিবন্ধকতার মুখে করেছেন পদত্যাগ। অবসরের পর তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে পূর্ণকালীন লেখক হিসেবে। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, সাহিত্য—বিচিত্র বিষয়ে তাঁর গবেষণামূলক বই পাঠকের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।
মতিউর রহমান: আপনার সর্বশেষ প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বই পুরানো সেই দিনের কথা গত ফেব্রুয়ারিতে বের হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে পঞ্চম মুদ্রণ ছাপা হয়ে গেল। এই পাঠকপ্রিয়তার কারণ কী?
আকবর আলি খান: আমি নিজেও অবাক হয়ে গেছি, কারণ, আমার ধারণা ছিল যে এই বইয়ের পাঠক পাওয়া যাবে না। বইটির একটি বড় অংশজুড়ে আমার জীবনের শৈশব-কৈশোর ও আমার পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে লেখা রয়েছে। কোথায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানা, সেখানকার অজ পাড়াগাঁয়ের গ্রাম রসুল্লাবাদ এবং সেই রসুল্লাবাদে কীভাবে আমাদের পরিবারের উৎপত্তি হয়েছে—এসব আমি বিস্তারিতভাবে লিখেছি। আমি সত্যিই মনে করেছিলাম যে এগুলোর পাঠক পাওয়া যাবে না।
তবু এই সব লেখার কারণ হলো আমার মেয়ে নেহরীন খানের খুব আগ্রহ ছিল আমার পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে যেন আমি লিখি। আমার মেয়েটা মারা গেছে। তার স্মৃতি রক্ষার্থে আমি একটু বিস্তারিতভাবে পরিবারের ইতিহাস লিখেছি। কেন এসবের পাঠক পাওয়া গেছে, সেটি আসলেই রহস্য। তবে আমার মনে হয়, পাঠক সত্য কথা খোঁজে। তাদের কাছে হয়তো মনে হয়েছে যে আমি কোনো কিছু বানিয়ে লিখিনি। কোথাও মুনাফেকি করিনি।
মতিউর: আপনি তো অসত্য কথা বলেন না।
আকবর আলি: এখানে আমি অসত্য বলিনি, এটা বলাও বোধ হয় পুরোপুরি ঠিক হবে না। কারণ, আত্মজীবনী লিখতে গেলে অনেক কিছু লেখা যায়, আবার অনেক কিছু লেখা যায় না। মুনাফেকির একটি উদাহরণ দিই। লাহোরে সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আমাদের পরিচালক ছিলেন মজিদ সাহেব। তার সম্পর্কে লিখেছি বইয়ে। তো আমার ব্যাচমেটরা তার সম্পর্কে অনেক তথ্য জানত না। আমার ব্যাচমেট মহিউদ্দিন আহমদ (মুক্তিযোদ্ধা, ফরেন সার্ভিসে ছিলেন) আমাকে বললেন, ‘তোমার বই পড়ে তো আমি মজিদ সাহেব সম্পর্কে অনেক কিছু নতুন করে জানলাম।’ আমি বললাম, কী জানলেন? তিনি বলেন, ‘তুমি বলেছ যে তিনি রাজশাহীতে ও ময়মনসিংহে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। আইয়ুব খান তাঁকে পছন্দ করত না দেখে তিনি সেক্রেটারি হতে পারেননি।’ আমি বললাম, এটা তো সত্যি। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি তো তোমার সাথে ছিলাম, কিন্তু আমি এগুলো জানতাম না।’ আমি বললাম, মজিদ সাহেব সম্পর্কে কিন্তু এটাই সব জানা নয়। তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়েও আমি লিখিনি যে তিনি যখন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, সে সময় তেভাগা কৃষক আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রকে অ্যারেস্ট করা হয়।
মতিউর: রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জে…
আকবর আলি: হ্যাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ইলা মিত্রের ওপরে যে বর্বর অত্যাচার চালানো হয়, তার মূল হোতা বা খলনায়ক কিন্তু মজিদ সাহেব। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশেই ইলা মিত্রের ওপরে নির্যাতন চালানো হয়েছিল।
মজিদ সাহেব আমাকে মোটেও দেখতে পারতেন না। বাঙালিদের অপছন্দ করতেন তিনি। তিনি প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন, ‘তোমার উর্দু উচ্চারণ খুবই বিদঘুটে ধরনের। তুমি ময়মনসিংহের লোকদের মতো উর্দু উচ্চারণ করো।’ আমি বললাম, স্যার, কী রকম? তিনি বললেন, ‘ময়মনসিংহের লোক কখনো জিন্নাহকে জিন্নাহ বলতে পারত না। জিন্নাহকে বলত জেনা। জিন্নাহ পার্ককে বলত জেনা পার্ক। তোমার উচ্চারণ অনেকটা ওই রকমই।’ আমি বলতাম, কী করব স্যার!
এসব কিন্তু আমি লিখিনি। আমার মনে হয়েছে সব মিলিয়ে মানুষটি ভদ্রলোক ছিলেন, স্নেহশীল ছিলেন। আর কত কথা তার সম্পর্কে লেখা যায়? এ রকম আরও অনেকের সম্পর্কে অনেক কিছুই আমি লিখিনি। এ কারণে মনে হয় যে মোনাফেকি হয়েছে। এই যে ভদ্রলোকের মুখোশ এঁদের, সেটা সম্ভবত আমার ছিঁড়ে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি পারিনি।
মতিউর: আমি কিন্তু দেখলাম, আপনার সমসাময়িক বা আপনার বন্ধুদের সম্পর্কেও যথেষ্ট রূঢ় কথা আপনি বলেছেন।
আকবর আলি: না। আসলে আমি যেটা উপলব্ধি করেছি, সেটাই লিখেছি। কিন্তু কোথাও কোথাও আরও অনেক রূঢ় কথা লেখা উচিত ছিল। তবে অতখানি নির্মম আমি হতে পারিনি।
মতিউর: আপনার মেয়ের কথা জেনে ভালো লাগল। তার আগ্রহে আপনি আপনার পরিবারের ঐতিহ্য অনুসন্ধান করেছেন। আপনার মধ্যে যে সেই বামুন খাঁর ব্রাহ্মণ রক্ত প্রবাহিত—আমার মনে হয় এই ইতিহাসও এ বইয়ের একটা আলাদা আকর্ষণ তৈরিতে সাহায্য করেছে। কারণ, আমাদের দেশে কেউ আত্মজীবনীতে নিজের অতীত জীবনকে এভাবে খুঁজে দেখাননি। ২০০ বছরের ইতিহাস বের করে দেখাননি।
আকবর আলি: আমার মেয়ে যা চেয়েছিল, আমি হয়তো সে দিক থেকে সফল হয়েছি। এ জন্য বইটি জনপ্রিয়তার দিক থেকেও কিছুটা সফল বলা যায়।
মতিউর: জনপ্রিয়তার দিক তো পরে। আপনি ধারাবাহিকভাবে এত বছর ধরে এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছেন। হয়তো অন্যের সাহায্য নিয়েছেন বা সাহায্য পেয়েছেন। প্রশাসনের কাজে দেশে-বিদেশে থাকতে হয়েছে, তার মধ্যেও কাজগুলো করে গেছেন। এসব তো সহজ ছিল না।
আকবর আলি: কিন্তু আমার যদি আগে প্রস্তুতি থাকত যে আমি এ রকম লিখব, তাহলে তো আরও অনেক তথ্য জোগাড় করতে পারতাম। আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার মুরব্বিরা বেশির ভাগই মরে গেছেন। মাত্র দুজন মানুষকে পেলাম যারা নব্বই-ঊর্ধ্ব। কিন্তু আরও আগে যদি অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতাম, তাহলে আরও অনেক তথ্য নিশ্চয়ই দিতে পারতাম।
মতিউর: আপনি বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে এই বই লেখালেখিতে আপনি ঢুকলেন বয়স ৫০ বছর পার হওয়ার পরে। স্বাভাবিকভাবেই জীবনের সবকিছু সব সময় সঠিক সময়ে হয় না। তবে ৫০ বছরে শুরু করার ফলে তত দিনে আপনি যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, জ্ঞান অর্জন করেছেন, বই পড়েছেন, তারপর লেখা শুরু করেছেন।
আকবর আলি: একমাত্র পিএইচডি থিসিস ছাড়া আর কোনো লেখাই আমি অল্প বয়সে লিখিনি।
মতিউর: পুরানো সেই দিনের কথায় আপনি লিখেছেন যে কোনো কোনো বিষয়ে প্রায় ৩০, ৪০ বা প্রায় ৫০ বছর গবেষণা, চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তারপর বই লিখেছেন। কোনো একটি বই করতে গিয়ে অন্ততপক্ষে ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত সময় নিয়েছেন। অর্থাৎ কোনো বই-ই আপনি চট করে দ্রুত লেখেননি। তো এই যে এত বিচিত্র সব বিষয়ে আপনার আগ্রহ, এত যে পরিশ্রম করেছেন আপনি…
আকবর আলি: আখেরে হয়তো মনে হবে যে এত কিছু করে আমি মোটেও ভালো করিনি। এত সব যা লিখেছি, সেগুলো হয়তো তুলনামূলকভাবে অনেক হালকা। শুধু একটি বিষয়ের ওপরে মনোনিবেশ করলে হয়তো আরও গভীর কিছু লিখতে পারতাম। কিন্তু সবকিছুর উত্তরে আমি বলব, আমার প্রকৃতিই এ রকম। এক ধরনের বই পড়তে বেশি দিন ভালো লাগে না আমার। একটা বিষয়ের ওপর বই পড়লাম, সেটা ছেড়ে আবার আরেকটা বিষয় ধরলাম—এভাবে বিভিন্ন বিষয় পড়তে আমার ভালো লাগে।
আরেকটি কারণ হলো, যেখানেই আমি চাকরি করেছি, সেখানেই ওই চাকরি-সম্পর্কিত তাত্ত্বিক বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছি। যেমন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে থাকতে পানিসম্পদ সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা করেছিলাম আমি। এত গবেষণা করেছিলাম যে আমাকে নিউইয়র্কের ইউএনডিপি তাদের পানিসম্পদের ওপরে দুটি প্রবন্ধ লেখার জন্য কনসালটেন্সি দিয়েছিল। একটি জাতিসংঘের ইকোনমিকাল সোশ্যাল কাউন্সিলের সভায় উত্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
মতিউর: আবার পরে সেই প্রবন্ধটি আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল ন্যাচারাল রিসোর্স ফোরাম-এ প্রকাশিত হয়েছে।
আকবর আলি: এটা বিলাত থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। আরও একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিসোর্স ট্রেনিং সেন্টারে থাকতে সেখানে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনের ওপর ট্রেনিং করতে গিয়ে গভর্ন্যান্স ও পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে আমি গবেষণা শুরু করি। পরবর্তীকালে সেটি আরও অনেক বই লিখতে সহায়তা করেছে।
মতিউর: আপনার যে আগ্রহ—অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ; আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশের কবিতা, বাংলায় ইসলাম প্রচার, বাংলাদেশের অভ্যুদয়—এত সব বিষয়, আপনি এর গভীরে ঢুকলেন…
আকবর আলি: আরও অনেক বিষয় রয়ে গেছে, যেগুলো এখনো আমি লিখে উঠতে পারিনি। জানি না পারব কি না। নানা সময়ে নানা কারণে বিচিত্র বিষয়ে আমার আগ্রহ হয়েছে। তবু আরও অনেক বিষয় ছিল, যেগুলোতে আগ্রহ হলে ভালো হতো। বিশেষ করে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে খুব পড়াশোনা করিনি, সেটা আমার একটা বড় দুর্বলতা। আপনি যেমন বিজ্ঞান পড়েছেন, আমি পড়তে পারিনি। যদিও প্রবেশিকা পরীক্ষায় আমার অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট ছিল বিজ্ঞান। প্রায় ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলাম আমি। আমার মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি যেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। অনায়াসে আমি হয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারতাম। কিন্তু পড়িনি। বিজ্ঞানের অধিকাংশ জগৎ আমার কাছে অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞানের যে পদ্ধতি, সেটা আমাকে শিখতে হয়েছে। সেই পদ্ধতিতেই আমি কাজ করি।
মতিউর: আপনি গণিতে দুর্বল ছিলেন। পিএইচডি করায় স্ত্রীর সাহায্য নিয়েছিলেন?
আকবর আলি: হ্যাঁ। গণিতে বেশ দুর্বল ছিলাম আমি। পিএইচডি করার সময় আমার স্ত্রী হামীম খান আমাকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি অনার্সে (পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ) প্রথম শ্রেণিতে পাস করেছিলেন তিনি। তবে আমি পিএইচডি করতে বিদেশ যাওয়ায় আমার স্ত্রী এমএসসি সম্পন্ন করতে পারেননি। তিনি সানবীমস স্কুলে ২০ বছর গণিতের শিক্ষক ছিলেন।
মতিউর: আপনার তো আরও চিন্তা আছে। এই বইয়েও লিখেছেন যে বাংলাদেশের পানিসম্পদ-বিষয়ক একটি বই লিখতে চান। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে চান। আপনার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড লেখা বাকি। এগুলো তো আপনার চিন্তার মধ্যে আছে। আপনি কি কোনোটা শুরু করেছেন ইতিমধ্যে?
আকবর আলি: বাংলাদেশের ইতিহাসের ওপরে কিছু কাজ আমি শুরু করেছি।
মতিউর: আপনি তো এর আগেও বাংলাদেশ নিয়ে একটি বই লিখেছেন—ডিসকভারি অব বাংলাদেশ।
আকবর আলি: হ্যাঁ। এ ছাড়া বাংলাদেশে ইসলামের অভ্যুদয় সম্পর্কে একটা বই আছে—বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ।
মতিউর: আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড পেলাম আমরা। দ্বিতীয় খণ্ড কবে পাব?
আকবর আলি: দ্বিতীয় খণ্ড লিখতে বছর দুয়েক সময় লাগবে বলে ধারণা করি। কারণ, প্রথম খণ্ড যেখানে শেষ হয়েছে, তার পরের ৪০–৪৫ বছরের জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। এগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণার পর লিখতে হবে। সে জন্য আমার একটু সময় লাগবে। সবশেষে এর প্রকাশকাল ইত্যাদি নির্ধারণ করতে পারব।
মতিউর: তাহলে আবার ওই প্রশ্ন, আপনি লেখক হিসেবে জনপ্রিয়। আপনার পাঠক কেন বইগুলো গ্রহণ করছে? আমাদের প্রকাশিত একটা বই ১৭তম মুদ্রণ হয়েছে। এভাবে ৫, ৬, ৯, ১১ ইত্যাদি-সংখ্যক মুদ্রণ হয়েছে। এই হিসাবকে কিন্তু একজন লেখকের জনপ্রিয়তার বড় একটি মাপকাঠি বলতে পারি আমরা। আপনার ব্যক্তিপরিচয় এখানে বেশ ভূমিকা রেখেছে। দেশের নানা পরিস্থিতিতে আপনি আপনার স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এগুলো মানুষ জানে। তারা এটা গ্রহণ করেছে। সে জন্য আপনার এই জনপ্রিয়তা বলে আমার মনে হয়…
আকবর আলি: হয়তো তা-ই। আপনি পাঠক, আপনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করছি, আমার মনে হয়, বাংলাদেশের পাঠক বিশ্বাস করে যে আমি যথাসাধ্য সত্য কথা বলার চেষ্টা করি। এটাকেই মূলত তারা পছন্দ করে।
মতিউর: পুরানো সেই দিনের কথার প্রথম অংশেও আপনি আপনার ও আপনার পরিবারের যে পরিচয় দিয়েছেন বা আপনার আত্মীয়স্বজনের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে যা উপস্থাপন করেছেন, পাঠক হিসেবে বলব, কোনো রাখঢাক না রেখে আপনি সত্য বলেছেন। অন্যদিকে বন্ধুদের কথা বা বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের আভ্যন্তরীণ নানা বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সরকারের ভেতরে টানাপোড়েন, এমনকি বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরেও আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের ঘটনা ইত্যাদি সম্পর্কে উল্লেখ করে কিন্তু সত্য বলার পরিষ্কার প্রমাণ আপনি দিয়েছেন।
আকবর আলি: এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত করি। যদি কোনো বিষয়ে আমার নিজের কোনো বক্তব্য না থাকে, তাহলে সেটি নিয়ে আমি লিখি না। আমার প্রতিটা বই-ই আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। আমার নিজস্ব বক্তব্যটি কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, না-ও হতে পারে। কিন্তু সেটি পাঠককে আকর্ষণ করে। যেমন ধরুন, আমি তো বাংলা সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন বইটা এ কারণেই জনগণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে যে আমি নতুন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনানন্দ দাশকে দেখার চেষ্টা করেছি।
মতিউর: বিগত ২০ বছরের কথা যদি বলি, চাকরিজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর আপনার তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অংশগ্রহণ, পদত্যাগ, তারপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্য, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কতগুলো পরিষ্কার স্বচ্ছ বক্তব্য এবং দলনিরপেক্ষ স্বাধীনভাবে মত দিয়েছেন বলেই জনপ্রিয়তা। এটা নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
আকবর আলি: জনগণের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে তারা আমার বক্তব্য গ্রহণ করেছে। আমি এখন সেই অঙ্গন থেকে অবসর গ্রহণ করেছি। শারীরিক অসুস্থতার জন্য টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা আমার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। দ্বিতীয়ত, প্রতিটা বিষয়ই টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। সেখানে নিজের মত প্রকাশের সেই সুযোগটা আমি পাই না, যে কারণে এই মাধ্যম থেকে আমি দূরে সরে এসেছি।
তবে সিভিল সমাজের বহু মানুষ এখনো তাঁদের বক্তব্য পেশ করে যাচ্ছেন, যেটা শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হই। তবে অনেক সময় সিভিল সমাজের কোনো কোনো সদস্য যথেষ্ট গবেষণা না করে বিভিন্ন বক্তব্য দেন। সিভিল সমাজের যে ভূমিকা, আমার মনে হয় এতে সেটি ক্ষুণ্ণ হয়। এসব জায়গায় যারা অংশ নেন, তাঁদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
মতিউর: বই এমন একটা বিষয়, যেটা লেখা হলে থেকে যায়। কখন কোন বইয়ের কী প্রয়োজন পড়ে, আমরা জানি না। কিন্তু প্রয়োজন পড়ে। এর সুদূর প্রসারী প্রভাব থাকে। কিন্তু দেশে-বিদেশে এত ব্যস্ততা, এত রকম কার্যক্রমে যুক্ততা ছিল আপনার। এসবের মধ্যে আপনি এগুলো করলেন কীভাবে? সময় কীভাবে পেলেন?
আকবর আলি: কীভাবে ঠিক জানি না। তবে শেষ পর্যন্ত যতটুকু পেরেছি, সে জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আরও কাজ করতে পারি যেন, সেই দোয়া করবেন।
মতিউর: আপনার এই বিপুল পরিশ্রম করার ক্ষমতা বা ধৈর্য—এর উৎস কী?
আকবর আলি: বই পড়া। আমার বই পড়তে ভালো লাগে। এবং বই পড়তে গেলেই বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে, যার উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে আমি আরও একটি বই লিখে ফেলি। এই বই পড়ার জন্যই আমার সারা জীবন এভাবে কেটেছে।
মতিউর: আপনি লিখেছেন যে ছোটবেলা থেকেই আপনার বই পড়ার খুব আগ্রহ ছিল। আপনার বাড়ি থেকে ১০ মাইল দূরে গরু-ছাগলের হাট, সেখানে একপাশে পুরোনো বই বিক্রি হতো, আপনি সেখানে যেতেন বই কিনতে। আবার মায়ের কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়ে অনেক দূরে আপনার ফুফুর বাড়িতেও থেকেছেন লাইব্রেরি থেকে বই কেনার জন্য। ছিলেন গ্রন্থকীট, হলেন লেখক। এটাই এখন আপনার বড় পরিচয়। এই পরিচয়টি কেমন লাগে?
আকবর আলি: খুব ভালো লাগে আমার। এই যে গ্রন্থকীট থেকে গ্রন্থ-লেখক হতে পেরেছি, এটা না পারলে আমার মনে খেদ থেকে যেত যে আমি কাজটি করতে পারিনি।
মতিউর: আপনার এই বইগুলো যদি একত্রে দেখি, তাহলে এসবের বিষয়, আকৃতি, পৃষ্ঠাসংখ্যা এবং স্বল্প সময়ে এতগুলো বই—ভবিষ্যতের জন্য আকরগ্রন্থ হয়ে থাকবে এগুলো। যারা প্রশাসনের কাজ করবে; অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজের জন্য কাজ করবে, তাদের গবেষণায় এগুলো কাজে লাগবে। এ কারণে আমরা আপনার পেছনে লেগে থাকি। আপনার বই করতে চাই।
আকবর আলি: এ জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। প্রথমার মতো প্রকাশনা যদি বাংলাদেশে না থাকত, তাহলে এত বই আমার পক্ষে লেখা হয়তো সম্ভব হতো না। তবে এই যে এত ধরনের বই, আমি যদি সুস্থ থাকতাম এবং সময় পেতাম, তাহলে হয়তো আরও বিস্তারিত করা সম্ভব ছিল। বিশেষ করে একটি বিষয়ের কথা বলব, যেটি নিয়ে আমি যা লিখেছি, সেটা যথেষ্ট নয়। সেটি হলো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্বন্ধে আমার অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইয়ে যে প্রবন্ধটি আছে, সেখানে আমি শুরু করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে বাংলাদেশের ফৌজদারি মামলা মিথ্যা দিয়ে শুরু হয়, মিথ্যা দিয়ে শেষ হয়। এর সবই মিথ্যা। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রধান দুর্বলতা হলো, এখানে মিথ্যাকে বের করার কোনো উপায় নেই। এই সম্পর্কে আরও গবেষণা করলে বোধ হয় দেশের লোক উপকৃত হতো।
আপনি শুনে অবাক হবেন যে আমার এই প্রবন্ধ পড়ে উচ্চ আদালতের একজন মহামান্য বিচারক আমার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি সত্যি লিখেছেন। আমরা লোকজনকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দিই, কিন্তু কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয়, সেটা নির্ণয় করার ক্ষমতা আমাদের নেই। শুধু আইনের ভিত্তিতে এগুলোর আদেশ দেওয়া হয়।’
মতিউর: আমি নিজে বই সংগ্রহ করি। অনেককে বই উপহার দিই। বই আসলে থেকে যায়। আপনার বইগুলোও থেকে যাবে। মানুষের চিন্তা-চেতনা–প্রশ্ন জাগাতে, তাদের মাঝে পরিবর্তন আনতে, তাদের সংগঠিত করতে, কিংবা আরও বড় অর্থে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনে চিন্তা-মনন গঠনে বই কাজে লাগে। নিজের বইগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আকবর আলি: আমিও এখনো ভালো বইয়ের সন্ধান পেলে কিনে ফেলি। সব তো পড়া হয়ে ওঠে না, হয়তো বইয়ের নির্যাসটা নেওয়ার চেষ্টা করি। আবার যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সেটা লাইন বাই লাইন পড়ার চেষ্টা করি। আমার প্রথম জীবনে যেসব বই সংগ্রহ করেছিলাম—ছাত্রাবস্থাতেই, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেই বইগুলো হারিয়ে যায়। এরপর পেশাগত কারণে আমেরিকা-কানাডা-বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করেছি, তাতেও অনেক বই হারিয়ে গেছে। এর পরও প্রায় হাজার পাঁচেক বই আমার কাছে জমা হয়েছিল। শুনে খুশি হবেন যে বইগুলো আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে দিয়েছি। তারা সেটা গ্রহণ করেছে। আমার মনে হয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠান হবে। তাদের লাইব্রেরি এই বইগুলো গ্রহণ করায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। বইগুলো হয়তো এখনকার অনেক গবেষক ও লেখকের কাজে দেবে।
মতিউর: এমনিতে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাব সম্পর্কে কিছু বলবেন? কেন মানুষ বই পড়বে, বই পড়া উচিত?
আকবর আলি: এখনকার মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত হচ্ছে। তারপরও সবাই কিন্তু সমানভাবে বই পড়ে না। কিছুসংখ্যক মানুষ বই পড়েন এবং যারা বই পড়েন, তাদের বেশির ভাগ গবেষণার জন্যই পড়েন। তবে যেটা দেখা যায়, যাঁরা ঐতিহাসিক বিষয়ে গবেষণা করেন না, তাঁরা ছাড়া অন্যরা পুরোনো বই খুব বেশি খোঁজ করেন না। অর্থনীতি-বিষয়ক পুরোনো বই পড়েন, যখন অর্থনীতিবিদেরা বৃদ্ধ হয়ে যান। বেশির ভাগ বৃদ্ধ অর্থনীতিবিদ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অর্থনৈতিক চিন্তার ইতিহাস সম্পর্কে বই লেখেন। অর্থাৎ কারা কারা আগে চিন্তা করেছে, কেন চিন্তা করেছে—সেটা বোঝার চেষ্টা করেন। আমার মনে হয়, অর্থনীতির মতো হয়তো সোশিওলজি বা অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার।
মতিউর: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র, এসএম হলে থাকতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে বেশি দিন থাকেননি। পরিবার, জীবন পরিচালনা ইত্যাদি কারণে রাজনীতি আপনার জীবনযাপনের সঙ্গে মেলেনি। তবে আমরা দেখি যে সারা জীবন আপনার কার্যক্রমে বামপন্থার একটা প্রভাব রয়ে গেছে। আপনার যে সততা, একই সঙ্গে সক্রিয়তা, সহযোগিতা, শ্রম দেওয়া…কিন্তু আপনি লিখেছেন যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বা ওই বাম ধারার আদর্শের প্রতিফলন, আবার আপনার জীবনযাপন—এটা নিয়ে আপনার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। আপনার লেখায় দুঃখবোধ প্রকাশ পেয়েছে।
আকবর আলি: এটা আমার সারা জীবনের দুঃখ। এটাই আমার জীবনের একমাত্র হিপোক্রেসি। আমি বিশ্বাস করতাম সমাজতন্ত্রে। এখনো বিশ্বাস করি, দুর্বল মানুষকে সহায়তা করা দরকার। সমাজের অর্থনীতিতে কোনো জনগোষ্ঠীর অনগ্রসর থাকা উচিত নয়। কিন্তু তাদের জন্য আমি যথেষ্ট কাজ করতে পারিনি। শুধু যে করতে পারিনি, তা-ও নয়। যখন করতে পারতাম, তখন মনে হয়েছে যে এটা করলে আমার সিগারেট খাওয়ার কী হবে, আমার বই পড়ার কী হবে, আমার খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? এই সব চিন্তা করে আমি সরাসরি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে যেতে পারিনি। আমার যেসব বন্ধুবান্ধব সরাসরি সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে, যেমন শামসুজ্জোহা মানিক, সে সরাসরি চলে গিয়েছিল লড়াই করতে। আমার ধারণা, ইচ্ছা করলেই সে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সার্ভিসে একজন কর্মকর্তা হতে পারত। কিন্তু সব ছেড়ে দিয়ে সে চলে গেছে সমাজতন্ত্র করতে। হয়তো পারেনি, কিন্তু সেটা নিয়ে সে কাজ করেছে। এটাই তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
মতিউর: শামসুজ্জোহা তো কোনো সংগঠন দাঁড় করাতে পারেননি। অন্যদিকে আপনি প্রশাসনে অংশ নিয়ে সততার সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজগুলো (সৎ থাকার বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ) করা, প্রশাসনের ভেতরে সরকারি নীতি প্রণয়ন অথবা নিম্নপর্যায়ের মানুষের উপকারে লাগা বা বিপদ থেকে মুক্ত করার যে কাজগুলো আপনি করেছেন, এগুলো তো ভালো কাজ। এতে মানুষ উপকৃত হয়েছে, সমাজ উপকৃত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বড় নীতিতে হয়তো আপনি বড় পরিবর্তন আনতে পারেননি, কিন্তু যে পরিবর্তনগুলো এনেছেন, তা-ও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এগুলোকে সফলতা বলব। আপনি তো সফল একজন মানুষ।
আকবর আলি: কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি সফল হয়েছি। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তো আমি সফল হইনি। অতি সামান্য ক্ষেত্রে হয়তো প্রভাব রাখতে পেরেছি। কিন্তু যদি সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন করতে হবে। সেই সামগ্রিক পরিবর্তনের কোনো প্রয়াস বাংলাদেশ কখনো দেখিনি।
মতিউর: এটা তো আপনার একক বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর প্রথম সরকার, তার পরের সরকার—সব সরকারের সময়ে আপনি ছিলেন। আপনি দেখেছেন যে সরকারগুলো কতটুকু সত্যিকারের পরিবর্তন চেয়েছে আর কতটুকু পেরেছে। সেখানে আপনার ভূমিকা সেই তুলনা থেকেই কিন্তু বিবেচিত হবে। বড় পরিবর্তনের জন্য যেখানে দাবি নেই, চাহিদা নেই, সে দিক থেকে আপনার এই দুঃখবোধটা কেন? নিজের ভূমিকাকেই-বা আপনি ছোট করে কেন দেখছেন?
আকবর আলি: হয়তো রোমান্টিকতা। আমার মনে হয় যে হায়দার আকবর খান রনো সারা জীবন মানুষের মুক্তির পেছনে সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাঁর জীবনের জন্য আমার ঈর্ষা হয়। আমি তো অমনটা হতে পারিনি। আমি শামসুজ্জোহার মতো হতে পারিনি, রনোর মতোও হতে পারিনি।
মতিউর: কিন্তু আপনি যে বইগুলো রেখে গেলেন, সত্য অনুসন্ধান করে গেলেন, মানুষকে পথ প্রদর্শন করলেন, এটা তো আগামী দিনের ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে কাজে লাগবে। খুব বড় ভূমিকা রাখবে। তারা তো এমনটি করতে পারেননি। তাহলে আপনার দুঃখবোধ কেন?
আকবর আলি: তাঁরা তাদের কাজ করেছে। আমি আমার কাজ করেছি। একটা সমাজ গঠনে বহু ধরনের উপাদান লাগে। শামসুজ্জোহা বা রনো যে ধরনের উপাদান দিয়েছেন, সেটাও আমাদের সমাজের জন্য প্রয়োজন। আমি যা করেছি, হয়তো সেটাও সমাজকে উপকৃত করতে পারে।
মতিউর: আপনি যে কাজ করলেন, এ ধরনের কাজের (পড়াশোনা বা গবেষণা) প্রতি বামপন্থীদের গুরুত্ব কম ছিল। দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যক্রম, সংগঠনের কার্যক্রম, মিটিং-মিছিল-সমাবেশ—প্রধানত এগুলো নিয়ে আমরা ব্যস্ত ছিলাম।
আকবর আলি: শুধু তা-ই নয়। আমাদের বামপন্থীদের প্রধান দুর্বলতা হলো, সবাই লেনিন হতে চায়। সেটা তো সম্ভব নয়। এই দুর্বলতার জন্যই কদিন পরপর দল ভাঙে। যদি চারজন কর্মী থাকে, সেটা ভেঙে দুটি দল হয়ে যায়। দেখুন, এখনো দল ভাঙছে। সবাই নেতা হতে চায়।
মতিউর: আসলে আমরা যাঁরা মস্কোপন্থী বা চীনপন্থী ছিলাম, তাঁরা মূলত মস্কো প্রদর্শিত পথ বা চীন প্রদর্শিত পথকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করেছি। অর্থাৎ দেশীয় কোনো পথ বা পদ্ধতির কথা কেউ চিন্তা করিনি। এবং ওই চিন্তাধারাগুলোর জন্যই কিন্তু আপনার মতো গবেষকের প্রয়োজন ছিল। এটি আমাদের ছিল না।
আকবর আলি: চিন্তা তো করতামই না, চিন্তা করা যে সম্ভব—এটাই আমরা চিন্তা করতে পারিনি। আমরা মনে করতাম যে চিন্তা চীন থেকে আসবে বা মস্কো থেকে আসবে, সে অনুসারে আমরা কাজ করব। আমাদের যে চিন্তা করে নিজেদের পথ বের করার প্রয়োজন আছে, সেটা বের করা যে সম্ভব—এটাই আমরা ভাবিনি। এ ধরনের অনেক দুর্বলতা ছিল। তবু যারা দক্ষিণ এশিয়ায় বামপন্থী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। শুধু যাঁরা বামপন্থী থেকে এসে ডানপন্থীদের চেয়েও বেশি সুযোগসন্ধানী হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমার ভিন্নমত রয়েছে।
মতিউর: সেদিক থেকে এই যে গত ৩০ বা ৫০ বছরে বিশ্বে বিরাট একটি পরিবর্তন হয়ে গেল—সমাজতন্ত্র ভেঙে যাওয়া, একনায়কতান্ত্রিক বিশ্ব হয়ে যাওয়া এবং মার্কিন ও অন্য রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য তৈরি হয়ে যাওয়া—চীন একধরনের শক্তি, রাশিয়া আরেক ধরনের শক্তি, এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি আমরা কখনো কল্পনা করিনি।
আকবর আলি: আমরা করিনি, কিন্তু ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। গ্লোবালাইজেশন ও টেকনিক্যাল ইম্প্রুভমেন্টস এমনভাবে বিশ্বকে আঁটসাঁটভাবে জড়ো করে ফেলেছে যে জোর করে এই বিশ্বের একলা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনটা হয়তো আসবে। কার্ল মার্ক্স মনে করতেন যে সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হবে এবং সেখানে সাফল্য পাবে। আমার এখনো মনে হয় যে নতুন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হবে উত্তর আমেরিকায়। কারণ, সেখানে বেকারত্ব ও অন্য যেসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সেগুলোর কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো আজ নয়, হয়তো ২০-৩০ বছর পরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও ভাঙন ধরবে।
মতিউর: তাহলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো যেখানে ব্যর্থ হয়ে গেল, সেখানে আমেরিকায় এই পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখেন?
আকবর আলি: সমাজতন্ত্র মানে লেনিন যে ধরনের রাষ্ট্র বলেছিলেন, সেটা নয়। সমাজতন্ত্র মানে সাধারণ মানুষ যে সমাজ পরিচালনা করবে, যেখানে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এই অর্থে যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, সেটি হয়তো উত্তর আমেরিকাতে শুরু হবে। তারা নতুন নতুন কৌশল দেখাবে। কীভাবে হবে? যেমন ধরা যাক সবকিছু সমাজতান্ত্রিক না হলেও চিকিৎসাব্যবস্থা রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে হবে। বেকারদের সমস্যাও রাষ্ট্রকে সমাধান করতে হবে। শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। এ ধরনের বিষয়গুলো সামনে আসবে।
মতিউর: স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, যেখানে তারা এই বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্যসমস্যা, সামাজিক বৈষম্য দূর করে এনেছে…
আকবর আলি: এ ধরনের সমাজের দিকে আমরা যাব। কিন্তু সেটার বিপক্ষে এখনো বিরাট শক্তি কেন্দ্রীভূত রয়েছে। উত্তর আমেরিকা থেকেই হয়তো এটার ভাঙন শুরু হবে।
মতিউর: আমাদের দেশকে এখন কেমন দেখেন?
আকবর আলি: আপাতদৃষ্টে এখন মনে হয় যে দেশের পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা আসলে একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ভেতরে ভেতরে পরিবর্তন ঘটছে। আমাদের এখানেও হয়তো আগামী ২০-৩০ বছরে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে। তবে আজ কিংবা কাল পরিবর্তন হয়ে যাবে—এমনটি আশা করা বোধ হয় ঠিক হবে না।
মতিউর: এই পরিবর্তনের প্রস্তুতির জন্য আপনি কাকে দায়িত্ব দিবেন?
আকবর আলি: সমাজের সব স্তরের মানুষকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
মতিউর: রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ…
আকবর আলি: নাগরিক সমাজ একা কিছু করতে পারবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকেও নাগরিক সমাজের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে হবে। ছাত্র, তরুণ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মতিউর: তাহলে আমাদের জীবনের যে শ্রেষ্ঠ সময়—ষাটের দশক—তখন যেমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল অর্থাৎ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের একটা সমঝোতা, একটা জাতীয় ঐক্য—এ রকম একটা পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করা দরকার।
আকবর আলি: এটা যে শুধু আমরাই তৈরি করতে পারব, তা নয়। পরিবেশও আমাদের বাধ্য করবে।
মতিউর: সেই পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে ষাটের দশকে বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, অধ্যাপক-শিক্ষক-ছাত্রদের যে ভূমিকা ছিল, সেটা তো এখন নেই। চিন্তাটা কোত্থেকে আসবে?
আকবর আলি: অবশ্যই যাঁরা লেখক–চিন্তক–গবেষক, তাঁদের এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। আরও লিখতে হবে। ভাবতে হবে। গবেষণা ও অনুসন্ধান করতে হবে।
মতিউর: আপনি লিখেছেন যে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। দেশের ভেতরে হবিগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আবার হবিগঞ্জ, তারপর আগরতলা—এভাবে আসা-যাওয়া, সেখান থেকে বন্ধুদের সাথে একত্রে কাজ করা, কলকাতায় প্রবাসী সরকার, দায়িত্ব পালন…জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ সময়।
আকবর আলি: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমরা অত্যন্ত গর্বিত। এ জন্য গর্বিত নয় যে বাংলাদেশ হয়েছে বলে আজ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছি বা আমাদের লোকজন দেশ শাসন করছে। বরং আমি এ কারণে গর্বিত যে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার চেয়ে বড় অর্জন মনে হয় কিছু হতে পারে না। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, সে জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সব সময় গর্ব বোধ করি। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মধ্যে বিভিন্ন আন্তরাজনীতিক কোন্দল ছিল; অনেক সমস্যা ছিল, যেগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অসুবিধা সৃষ্টি করেছে। এসব সত্ত্বেও আমি মনে করি যে বাঙালি জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আপনার প্রিয় লেখক?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আপনার কাছে সেরা বই? এক বা একাধিক?
উত্তর: এটা বলা মুশকিল হবে। আমার কাছে একটি সেরা বই হলো আমার শিক্ষক স্কট গর্ডনের দ্য হিস্ট্রি অ্যান্ড ফিলসফি অব সোশ্যাল সায়েন্স। তিনি তাঁর সারা জীবন গবেষণা করে সমাজবিদ্যা সম্পর্কে এই বইটি লিখে গেছেন। আর যদি বাংলা বইয়ের কথা বলি, তাহলে বলব অন্নদাশঙ্কর রায়ের সব বইয়ের কথা। কারণ, অনেক বিষয় সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমি শুধু অন্নদাশঙ্করের ভাবধারা দিয়েই প্রভাবিত হয়েছি তা নয়, তাঁর বাক্যবিন্যাস, যে সমস্ত পরিভাষা তিনি প্রয়োগ করেছেন, সেগুলো আমি অনুসরণ করেছি।
আপনার প্রিয় কবিতা?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ থেকে শুরু করে শেষ শয্যায় লেখা ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’—এই সব কবিতা।
তাহলে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’-এর জায়গা কোথায়?
উত্তর: আমি যে শুধু সেরা কবিতেই পড়ি, তা নয়। সব ধরনের কবিতাই আমি পড়ি।
প্রিয় গান?
উত্তর: ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে’।
আপনার তো দেখি ঘুরেফিরে সব রবীন্দ্রনাথ সেরা।
উত্তর: আমি তো রবীন্দ্রনাথের যুগের মানুষ। আমার যুগের বেশির ভাগ লোক স্বীকার করুক না-করুক, রবীন্দ্রনাথ দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
প্রিয় সিনেমা?
উত্তর: কোনটা রেখে কোনটা যে বলি। প্রথমেই বলতে হবে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়ার কথা। মুক্তিযুদ্ধের আগে যখন সারা দেশের মানুষ আন্দোলন–সংগ্রামে মুখর ছিল, সে সময় সিনেমাটি সবাইকে খুব উৎসাহিত করেছিল।
আর কোনো সিনেমার কথা বলবেন?
উত্তর: সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা, বিশেষ করে অপু ট্রিলজি—পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার।
তখন তো উত্তম–সুচিত্রার সময়কাল। তাঁদের জয়জয়কার।
উত্তর: তাঁদের অনেক সিনেমা আমি দেখেছি। আমার কাছে তাঁরাই সেরা অভিনেতা–অভিনেত্রী।
বিদেশি সিনেমাও তো দেখেছেন?
উত্তর: হ্যাঁ। গন উইথ দ্য উইন্ড–এর কথা এখনো মনে পড়ে। নায়ক ক্লার্ক গেবল, নায়িকা ভিভিয়ান লেইয়ের অভিনয় চোখে লেগে আছে।