আমার মুক্তিযুদ্ধ

শাহাবুদ্দিন আহমেদ, ছবি: প্রথম আলো
শাহাবুদ্দিন আহমেদ, ছবি: প্রথম আলো

আমাদের অস্তিত্বজুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের কথা দিয়েই আমার কথা শুরু করি। ১৯৭১ সালে আমার ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার কথা ছিল। কলেজের শুরু থেকেই আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। আমি তখন থেকেই পোস্টার–ফেস্টুন করতাম। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমি ভারতে চলে যাই। আমাদের সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল আগরতলায়। আমার সৌভাগ্য, ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে পেয়েছিলাম খালেদ মোশাররফকে। তাঁর কোনো তুলনা হয় না। আমাদের সেক্টরে ক্যাপ্টেন হায়দারও ছিলেন। তাঁর কথাও মনে পড়ে। তাঁরা দুজনেই আমাকে খুব স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন।
ক্যাম্পে আমরা যোগ দিয়েছিলাম মে মাসের প্রথম দিন। জোরদার প্রশিক্ষণ হলো। এরপর কিছুদিন কোনো কাজ ছিল না। তখন একদিন জঙ্গলে বসে বঙ্গবন্ধুর পোট্রে৴ট এঁকেছিলাম। আমার এই ছবি আঁকার খবর রটে যায়। শওকত ভাই (বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা শওকত আলী, সে সময় তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন) আমাকে ডেকে ২১ টাকা দেন হাতে। বলেন, ‘আগরতলা থেকে রংতুলি কিনে আনো। তুমি আঁকার কাজটা থামিয়ো না।’
যুদ্ধ একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, কিন্তু তার পরতে পরতে কত যে সুখস্মৃতি থাকে, তা বলে বোঝানো যায় না, শুধু নিজের মনেই তা লালন করতে হয়। এটাও আমার সে রকম একটি অভিজ্ঞতা। আমি ছুটি নিয়ে আগরতলায় গেলাম। সেখানে কিছু পুরোনো ক্যালেন্ডার পেলাম। সঙ্গে চোখে দেওয়ার কাজল, আই ব্রো পেনসিল, আলতা কিনে আনলাম। ক্যালেন্ডারের উল্টো দিকে কিছু ছবি আঁকলাম। বেশ কিছু ছবি এঁকে ফেলার পর শওকত ভাই উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘আমরা বনভোজন করব। সে সময় তোমার ছবিগুলোও সবাইকে দেখাতে পারব।’
আমি ছিলাম ১৭ নম্বর প্লাটুনে। সংগীতশিল্পী আজম খান তখন ১৩ নম্বর প্লাটুনে। ঠিক হলো, আমার ছবির প্রদর্শনীর পাশাপাশি আজম খানের গানের অনুষ্ঠান হবে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফকে পরিকল্পনাটা জানানো হলো। তিনি সানন্দে অনুমতি দিলেন। সে কী উৎসাহ আমাদের! আমরা জঙ্গলের ভেতরেই গাছে রশি বেঁধে ঘরের মতো তৈরি করলাম। জাম্বুরাগাছের কাঁটা দিয়ে সে ঘরের দেয়ালে টানানো হলো আমার ১২টি ছবি। আগরতলা থেকে হারমোনিয়াম এল। আজম খান সেদিন ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটি গেয়েছিলেন। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমার এখনো মনে আছে, আমার ওই প্রদর্শনীতে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান। সেদিন খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সুলতানা কামাল, সাঈদা কামাল। মনে পড়ে গেল, আমরা গানবাজনা নিয়ে থাকতাম বলে খালেদ মোশাররফ আমাদের ‘ফুর্তি বাহিনী’ বলতেন।
আমরা জোরদার ট্রেনিং নিয়েছিলাম, কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত অস্ত্র আমাদের ছিল না। তাই মাঝেমধ্যে আমরা অস্থির হয়ে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইতাম। অবশেষে একদিন সেক্টর কমান্ডার বললেন, ‘ফুর্তি বাহিনী, সালদা নদীতে গিয়ে যুদ্ধ করে দেখিয়ে দাও, কী করতে পারো!’
সেদিন আমাদের হাতে ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। দিনটি ছিল ১৪ আগস্ট—পাকিস্তান দিবস। সালদা নদীর রেলস্টেশনে ছিল পাকিস্তানিদের ঘাঁটি। আমরা সীমান্ত পার হয়ে এসেছিলাম। নিজের দেশে এসেছি, ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। মনে আছে, প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে নদী সাঁতরে আমরা এসেছিলাম। রাত আড়াইটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীকে আমরা আক্রমণ করেছিলাম। সে ছিল সফল আক্রমণ। এলাকাটি আমরা দখল করে নিয়েছিলাম।

আমি ছিলাম ১৭ নম্বর প্লাটুনে। সংগীতশিল্পী আজম খান তখন ১৩ নম্বর প্লাটুনে। ঠিক হলো, আমার ছবির প্রদর্শনীর পাশাপাশি আজম খানের গানের অনুষ্ঠান হবে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফকে পরিকল্পনাটা জানানো হলো। তিনি সানন্দে অনুমতি দিলেন। সে কী উৎ​সাহ আমাদের!

সালদাতে হয়েছিল তুমুল যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা ছিল ব্রিটিশ আমলের রেলস্টেশনে। আমরা একটা মাটির ঘরের পাশে। ঘরের কাছে ছিল কলাগাছের বাগান। আর্টিলারির সাপোর্ট ছিল প্রথমে। তাই পাকিস্তানিরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, আক্রমণ করবে কি না। আমরা তো ছিলাম জনা পঁয়ত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল আমরা অনেকজন। আমাদের ঘিরে ধরেছিল ওরা। আমাদের পেছনে নদী। আমরা মাঝেমধ্যে স্লোগান দিচ্ছি ‘জয় বাংলা’। ওরা উর্দুতে কথা বলছিল। গালাগাল করছিল। নদীর কারণে আমরা পেছনেও যেতে পারছি না। ওরা বলছিল, ‘সব শালাকো মার দেগা’। সারেন্ডার করতে বলত। এরই মধ্যে পানিতে পড়ে আমাদের অয়্যারলেসটাও অকেজো হয়ে গেল। ফলে ক্যাপ্টেন হায়দারের (পরে ব্রিগেডিয়ার) সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ওরা মনে করল, আমরা বুঝি আর বেঁচে নেই। আমরা আসলে ওখানে আটকে গেলাম। এ সময় মেজর সালেক জানতে পারলেন আমরা এখানে আটকে আছি। ১৪ দিন আমাদের পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। খুবই খারাপ অবস্থা। মেজর সালেক একটা ১৪ বছরের ছেলের হাতে ৩০টা আটার রুটি পাঠালেন। সেদিন ছিল তুমুল তুফান। প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে ছেলেটা রুটি নিয়ে এল। প্রথমে আমরা ভড়কে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ওদিক দিয়েও পাকিস্তানিরা আসছে। পরে দেখলাম, একটা ছেলে। রুটি আর বৃষ্টির পানি খেলাম আমরা। বাঙ্কারের পাহারায় ছিল কাদের নামে একটি ছেলে। ওকে রুটি খেতে ডাকলাম। ও মাথা উঁচু করেই বাঙ্কারের দিকে আসতে লাগল। ও ভেবেছিল, কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। কিন্তু এরই মধ্যে পাকিস্তানিদের গুলি এসে ওর পেটে লাগে। রক্তে ভেসে যায় ও। আমরা লুঙ্গি বা গেঞ্জি দিয়ে ওর ক্ষত থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করার চেষ্টা চালাই। ও ছিল বাবা–মায়ের একমাত্র সন্তান। ও বলছিল, ‘আমি মরে গেলে বাবা–মাকে বলবেন, আমি এখানে মারা গেছি।’

রুটি খেয়ে শরীরে একটু শক্তি পেলাম আমরা। এবার নদী পার হতেই হবে। বর্ষণকে ভয় পেত পাকিস্তানিরা। তুমুল বর্ষণের মধ্যে আমরা নদী পার হয়ে চলে আসি। কাদেরকে বিশ্রাম নগরের হাসপাতালে ভর্তি করি। ও বেঁচে যায়।
যুদ্ধ শেষে সরকারি নির্দেশ ছিল, ইস্কাটনের সেক্টর কমান্ডারদের অফিসে যেন আমরা অস্ত্র জমা দিই। সে সময় সে অফিসটা ছিল এখনকার লেডিস ক্লাবে। কিন্তু তখন আমার কোম্পানি কমান্ডার নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ আমরা কমান্ডারেরা সিদ্ধান্ত নিলাম, বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেব। ঠিক করি, আমাদের অস্ত্র আমরা বঙ্গবন্ধুর হাতে জমা দেব। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর গণভবনে গিয়ে তাঁর কাছে আমরা অস্ত্র সমর্পণ করি।
বঙ্গবন্ধু আমাকে ভালোবাসতেন। ১৯৭৪ সালে আমি দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি প্রদর্শনী করেছিলাম। সে প্রদর্শনীতে ২৭ হাজার টাকার ছবি বিক্রি হয়েছিল। ওই টাকা আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘টাকাটা তোর বাবাকে দে।’ বঙ্গবন্ধু আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিনিই আমাকে প্যারিসে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে। আমি অভিভাবক হারিয়েছিলাম। এরপর আবার আমি ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেছি। নিজস্ব একটা আঙ্গিক তৈরি করার চেষ্টা করেছি। আমার ছবি দেখলেই আপনারা বুঝতে পারবেন, মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশই আমার আঁকার মূল বিষয়বস্তু।
এ কালের তরুণদের কাছে আমার চাওয়া হলো প্রকৃত শিক্ষা। আমি বাঁধাধরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলছি না। মানুষ হওয়ার জন্য যে পড়াশোনা দরকার, সে পড়াশোনার কথা বলছি। যদি কেউ শিল্পী হতে চায়, তাহলে তার সততা, একাগ্রতা আর সাধনা থাকতে হবে। শিল্পের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। মানুষের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে কেউ শিল্পী হতে পারে না।
আমি বহু বছর ধরে ফ্রান্সে বসবাস করছি। কিন্তু আমি বাংলাদেশি পাসপোর্ট বহন করি। সুযোগ ছিল ফরাসি পাসপোর্ট নেওয়ার। কিন্তু সেটা আমাকে কখনোই টানেনি। যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, যে দেশ আমার অন্তরে বিরাজমান, সেই দেশের পাসপোর্ট নিয়েই আমি বেঁচে থাকতে চাই। এটা আমার গর্ব।

লেখক পরিচিতি
শাহাবুদ্দিন আহমেদ চিত্রশিল্পী। ঢাকায় ১৯৫০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্ম। বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে যাওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়েছেন। প্যারিসপ্রবাসী এই শিল্পী ২০০০ সালে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক।


সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: