অসংক্রামক রোগের লড়াইটাই বড়

.

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী অসংক্রামক রোগের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে ৭ কোটি ১০ লাখ লোক মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর তিন ভাগের দুই ভাগ। অসংক্রামক রোগ বলতে সেই রোগগুলোকেই বোঝানো হয়, যা সাধারণত একজনের কাছ থেকে অন্যজনের দেহে সংক্রমিত হয় না। অসংক্রামক রোগগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়। সঠিক ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেলে অসংক্রামক রোগ অতি নীরবে জটিল আকার ধারণ করে, যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে অকালমৃত্যুর অথবা দীর্ঘমেয়াদি পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়। অসংক্রামক রোগের তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এই রোগগুলো হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ), ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগ ও মানসিক রোগ।

বিশ্বে প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন এই অসংক্রামক রোগে মারা যাচ্ছে এবং শুধু হৃদ্‌রোগেই মারা যায় প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন। আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) মতলব এলাকায় প্রতিবছর ২ লাখ মানুষের ওপর যে জরিপ চালায়, তার উপাত্ত থেকে দেখা গেছে যে ১৯৯০ সালে প্রতি ১০টি মৃত্যুর মধ্যে মাত্র ৩টি মৃত্যুর কারণ ছিল অসংক্রামক রোগ এবং বাকি ৭টি মৃত্যুর কারণ ছিল সংক্রামক রোগ। আর দুই দশক পর এখন প্রতি ১০টি মৃত্যুর মধ্যে ৭টিই হচ্ছে অসংক্রামক রোগের কারণে। আর সংক্রামক রোগের কারণে মারা যাচ্ছে একজন।

অসংক্রামক রোগের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের অভ্যাস, ধূমপান, তামাক সেবন, শারীরিক ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম না করা, মাদক গ্রহণ এবং মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা—জীবনযাপনের এসব ধরন ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষাকৃত কম বয়সে হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, যা দেশের মৃত্যুর প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২০০৪ সালে উচ্চ রক্তচাপের হার ছিল ১৭ ভাগের মতো আর ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ ভাগের বেশি।

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই দুই বা তার চেয়ে বেশি অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এখানকার মানুষের আচরণগত ও খাদ্যাভ্যাসজনিত বিষয়গুলোকে প্রভাবিত করার পেছনে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নগরায়ণের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটেছে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যকাঠামোর উন্নতির ফলে মানুষের আয়ু বেড়েছে। অন্যদিকে দ্রুত নগরায়ণ, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির ফলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ঘরে তৈরি খাবার বা ফলমূল-সবজির চেয়ে বাজারের ফাস্ট ফুড বা প্রসেস করা খাবার অথবা প্যাকেটজাত খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। শহরগুলোতে পায়ে হাঁটার সুযোগ কমে যাওয়ায় সব বয়সের মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস কমে গেছে। স্কুল–কলেজে খেলার মাঠের অভাব এবং কোচিং–বাণিজ্যের কারণে শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের ওপর গুরুত্ব কমে গেছে। এসব কারণে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি ও রোগের ব্যাপকতা বেড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে যা করণীয় তা হচ্ছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অসংক্রামক রোগের সেবাকে উন্নত করা। অসংক্রামক রোগ একটি নীরব ঘাতক এবং এই রোগগুলো প্রাথমিক অবস্থায় কোনো লক্ষণ নিয়ে হাজির হয় না, তাই কেউ রোগে আক্রান্ত বা রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা না করা পর্যন্ত জানা যায় না। অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষেরই প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব রয়েছে, তাই সুস্থ অবস্থায় অধিকাংশ মানুষই আচরণগত ঝুঁকিগুলোকে গুরুত্ব দেয় না। ২০১৬ সালে উচ্চ রক্তচাপের ওপর আইসিডিডিআরবি টাঙ্গাইল ও মুন্সিগঞ্জের ১০টি উপজেলায় ৪ হাজার ৪৪২ জন চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তির ওপর এক গবেষণা চালায়। দেখা গেছে, প্রতি চারজনের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন এবং তাঁদের মধ্যে অর্ধেকেরই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। তাঁদের মধ্যে ৪২ ভাগ ব্যক্তি নিয়

অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় জনগণকে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ছবি: প্রথম আলো

মিত ওষুধ সেবন করেন না এবং প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের ডায়াবেটিস এবং প্রতি পাঁচজনের একজনের স্ট্রোক, প্রতি ছয়জনের একজনের হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। তাঁদের একটা বড় অংশ ক্রনিক কিডনি রোগে আক্রান্ত।

এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সাধারণত ওষুধের দোকান বা চিকিৎসকের চেম্বারে যান এবং সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খুবই কম যান। দীর্ঘ অপেক্ষা এবং বিনা পয়সায় ওষুধ না পাওয়া কিংবা খুবই সীমিত পরিমাণে ওষুধ পাওয়াকে তাঁরা এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নিয়মিত ওষুধ না খেলে কী ক্ষতি হতে পারে, সে ব্যাপারেও তাঁদের তেমন ধারণা নেই। তাই প্রাথমিক অবস্থায় প্রধান অসংক্রামক রোগগুলোর সঠিক নির্ণয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রার অভ্যাস তৈরির জন্য প্রতিটি উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্ধারিত গাইডলাইনভিত্তিক কর্মসূচির আওতায় আনা খুবই জরুরি। মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা যেকোনো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা রেফারেল ব্যবস্থা উপজেলা ও জেলায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

আশার কথা, ইতিমধ্যে দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বহির্বিভাগে অসংক্রামক রোগের জন্য আলাদা চিকিৎসাকক্ষ (এনসিডি কর্নার) ও চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার জন্য কিছু কিছু উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের সঙ্গে একজন নার্সও সংযুক্ত করা হয়েছে এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এমনকি রক্তের কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধও বর্তমানে বিনা মূল্যে সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর যত ভাগ অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত, তার চেয়েও বেশি অংশ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ঝুঁকির মধ্যে থাকা এই জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি নির্ণয় এবং ঝুঁকি কমানোর জন্য কম খরচে বাস্তবসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ করাই হচ্ছে অসংক্রামক রোগের ব্যাপকতা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। তাই গ্রাম ও শহরের শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবকসহ সব বয়সের নারী ও পুরুষের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ, কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস তৈরিসহ স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ, পানিতে আর্সেনিক, খাদ্যে ভেজাল, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য বেশি মাত্রায় কেমিক্যালের প্রয়োগসহ আরও যে বিষয়গুলো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, তা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নীতিমালার প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখন শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সীমিত। কিন্তু শহরগুলোর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা মূলত সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য শাখার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। শহরের সরকারি প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম এখনো যুক্ত করা হয়নি। এ জন্য শহরাঞ্চলের মানুষকে বেসরকারি চিকিৎসাসেবার ওপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেক ব্যয়বহুল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই একটি মাল্টিসেক্টরাল কমিটি গঠন করেছে এবং এর মাধ্যমে অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোকে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনে নিয়োজিত করা যাবে বলে আমরা আশা করতে পারি।

অসংক্রামক রোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে এ নিয়ে যথাযথ ও মানসম্মত গবেষণার বিষয়টি খুবই জরুরি। সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত উচ্চ মানসম্পন্ন গবেষণা পরিচালনা করে থাকে এবং গবেষণালব্ধ তথ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে আইসিডিডিআরবি, ১০ বছর ধরে অসংক্রামক রোগের ওপর বিভিন্ন গবেষণার কাজ করে যাচ্ছে এবং সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে অসংক্রামক রোগের কৌশলগত নীতি প্রণয়নসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের তথ্য–উপাত্ত উৎপাদন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। চতুর্থ হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন সেক্টর প্রোগ্রামের (২০১৭-২২) আওতায় অসংক্রামক রোগের গবেষণার জন্য কিছু বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা খুবই ইতিবাচক। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অসংক্রামক রোগের উন্নত চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। তবে যেকোনো গবেষণা থেকে ফল পেতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উচ্চ মানের গবেষণা নিশ্চিত করা জরুরি।

সবশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের জনগণ একই সঙ্গে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের দ্বৈত হুমকির মধ্যে রয়েছে। ফলে এর মোকাবিলার উদ্যোগটি হতে হবে সম্মিলিত। উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হলো ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০-৭০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অসংক্রামক রোগজনিত অকালমৃত্যুর হার ২৫ শতাংশে কমিয়ে আনা। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রোগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধের দিকে আরও বেশি নজর দিতে হবে। এলাকাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য ক্যাডারদের অসংক্রামক রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ, টিকাদান কর্মসূচি, জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবাসহ নিয়মিত অন্য সব সেবার সঙ্গেই অসংক্রামক রোগের এলাকাভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। 

ড. আলিয়া নাহিদ :( বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যখাত বিশেষজ্ঞ ও আইসিডিডিআরবির ইনিশিয়েটিভ ফর নন কমনিকেবল ডিজিজেসের প্রধান।)