গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার (জিএসি) সহযোগিতায় এবং নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে
গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার (জিএসি) সহযোগিতায় এবং নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে

পুষ্টিতে জেন্ডার সমতা অর্জন

নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে ১৯৯৫ সাল থেকে অণুপুষ্টি–বিষয়ক অপুষ্টি বিশেষ করে ভিটামিন এ, আয়রন, জিংক, আয়োডিন ইত্যাদি ঘাটতিজনিত সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এক বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের বিশ্বাস, ভালো পুষ্টি ও জেন্ডার সমতা পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত এবং পুষ্টি উন্নয়নের জন্য জেন্ডার–সমতা অর্জন করাও গুরুত্বপূর্ণ। নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, জেন্ডার সমতাকে সব কার্যক্রমের মধ্যে যথাযথভবে বাস্তবায়ন করার জন্য এখনই সঠিক সময়, যেন জেন্ডার এবং পুষ্টির মধ্যে যোগসূত্রবিষয়ক মাঠপর্যায়ের অভজ্ঞিতাগুলো সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে শেয়ার করা যায়। তাই নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশে মা ও কিশোরী স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচির জেন্ডার–সমতা অর্জনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং সামনের দিকে কী করণীয়, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে ১৯ নভেম্বর ২০২৪ যৌথভাবে একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে।

অংশগ্রহণকারী:

শিরীন হক,

প্রধান, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন।

ডা. মোমেনা খাতুন,

হেলথ টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট, এফএসএসপি, গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (জিএসি)।

সায়কা সিরাজ

কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল।

আসফিয়া আজিম,

ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল।

ফারহানা হাফিজ

রিজিয়নাল জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যাডভাইজার (এশিয়া), নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল।

গীতা দাস

সভাপতি, নারীপক্ষ।

সালমা আক্তার,

অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ফারহানা আখতার,

পুষ্টিবিষয়ক ফোকাল ও গবেষণা কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।

জুলিয়া আহমেদ,

জেন্ডার ও এসআরএইচআর বিশেষজ্ঞ।

সোহানা শফিক

প্রজেক্ট কো–অর্ডিনেটর অ্যান্ড লিড, হেলথ সিস্টেম অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশন, আইসিডিডিআরবি।

আফসানা হাবিব শিউলী,

পুষ্টি ও স্বাস্থ্য প্রধান, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল।

ফারিয়া শবনম,

এনপিও—মাতৃ ও শিশুপুষ্টি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

নিশাত সুলতানা

পরিচালক, পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ইনফ্লুয়েন্স অ্যান্ড ক্যাম্পেইন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।

মাসুমা বিল্লাহ,

প্রোগ্রাম হেড, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক।

লায়লা করিম,

প্রকল্প পরিচালক, আয়াত এডুকেশন।

মনজুন নাহার

ব্যবস্থাপক, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন, মেরী স্টোপস বাংলাদেশ।

সার্বিক সমন্বয়:

সিনা হাসান,

কমিউনিকেশন কনসালট্যান্ট, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল। 

সঞ্চালনায়:

ফিরোজ চৌধুরী,

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।

শিরীন হক

প্রধান, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন

পুষ্টি ও জেন্ডার সমতাকে একত্রে বিবেচনা করার দৃষ্টিভঙ্গিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খাবার ও পুষ্টিসংক্রান্ত বিষয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে একধরনের ক্ষমতার বিভেদ রয়ে গেছে। এ বিভেদ অবস্থা, ক্ষমতার পার্থক্যে ও এর পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। দরিদ্র পরিবারগুলোতে নারীরা পর্যাপ্ত পুষ্টি ও যথাযথ খাবার পাচ্ছেন না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে পুষ্টির ঘাটতি আরও প্রকট হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, পারিবারিক পর্যায়ে, ঘরে কী রান্না হবে, তার সিদ্ধান্ত পুরুষই দেয়, এতে করে নারী ও শিশুদের পুষ্টির দিকটা বিবেচিতই হয় না। একজন নারী বা মা ঠিক করবেন, তিনি বা তাঁর সন্তান কী খাবেন, তাঁর নিজের শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খাবার কেনার বা খাওয়ার অধিকার না থাকলে তিনি কীভাবে নিশ্চিত করবেন তাঁর নিজের ও সন্তানের পুষ্টি!

পুষ্টিসমতা অর্জনে বিভিন্ন খাতের যুক্ততা গুরুত্বপূর্ণ। বহু খাতভিত্তিক বা অনেক খাতের সমন্বয়ে যেসব কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড সাজানো বা তৈরি করা হয়, তা নারীদের জন্য সহায়তামূলক। এখানে নির্যাতনের শিকার নারীরা যেন যথাযথ সহায়তা পান, সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়। বর্তমানে কন্যাশিশুরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যা পুষ্টি ও জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করার পথে বড় বাধা

হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল নির্যাতন নয়, নির্যাতনের হুমকিও পুষ্টিসমতা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।

আজকের মূল প্রেজেন্টেশনের যে দিকটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তা হলো ‘এজেন্সি, রিসোর্স আর অপরচুনিটি’—এই তিনটার যোগসূত্রের যে কাঠামো, সেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রকল্প পরিকল্পনা করা। এটাকে আমরা অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারি। আমরা যদি এই কাঠামোকে মাথায় রেখে সামনের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি পরিকল্পনা করি, তাহলে পুষ্টিসমতা নিশ্চিত ও টেকসই আরও কার্যকর করা সহজ হবে।

ডা. মোমেনা খাতুন

হেলথ টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট, এফএসএসপি, গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (জিএসি)

গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে  অর্থায়নের ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক পলিসি ফলো করে, যা হলো ‘ফেমিনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসিস্ট্যান্স পলিসি (ফিআপ)’, এ নীতিমালায় মানুষের মর্যাদার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর অন্যতম কার্যক্রম হলো ‘হেলথ, নিউট্রিশন, এডুকেশন অ্যান্ড জেন্ডার-রেসপন্সিভ হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাকশন প্ল্যান’। ফিআপের লক্ষ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র হলো অতি দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের মধ্যে জেন্ডার-সংবেদনশীল পুষ্টি কার্যক্রমকে বেগবান করা। তাই গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা স্বাস্থ্য প্রকল্পসমূহে  অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রোগ্রাম ডিজাইনে জেন্ডার সমতা, পুষ্টি, জীবনচক্র—এ বিষয়গুলোকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়। নারী ও কিশোরীদের পুষ্টি-উন্নতির জন্য কানাডা অর্থায়নের স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলো কাজ করে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে কানাডা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বিত ভাবে কাজ করে। তাই প্রত্যাশা যে জেন্ডারবিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বাজেট বরাদ্দের দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন।

সায়কা সিরাজ

কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল

জেন্ডারকে এ দেশে এতদিন আমরা যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছি, তা কখনই ‘বাস্তব কাঠামোগত রুপান্তরের’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়নি। এটা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করতে হবে। তাই এখানে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীসহ সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

দুটি বিষয় আমি উল্লেখ করতে চাই, প্রথমত শহরাঞ্চলের মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করতে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল ও বাংলাদেশ পুষ্টি কাউন্সিলের সঙ্গে গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার অর্থায়নে আমরা ‘মাল্টিসেক্টরাল নিউট্রিশন’ প্রকল্প শুরু করেছি। এ প্রকল্প র্কাযক্রমে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, ওয়াশ ও স্থানীয় সরকার রয়েছে। এখানে আমরা জেন্ডার ও পুষ্টিকে যুক্ত করতে বিশেষ প্রাধান্য দিচ্ছি। দ্বিতীয়ত, আমরা বাংলাদেশে জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সঙ্গে একত্রে  গত দুই বছর ধরে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের ওপর কাজ করেছি। এখানে আমরা সূচক ও পরামর্শ নির্ধারণ করেছি যেন চলমান ১২৭টি জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের কার্যক্রমগুলোয় নানান স্তরে জেন্ডারকে যুক্ত করা যায়।

প্রকল্প পর্যায়ে অনেক সময় আমরা জেন্ডারকে উপেক্ষা করে যাই। আমাদের অনেক ‘মিসড অপরচুনিটি’ আছে, যেমন আমরা বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে, অনেকে গৃহস্থালী পর্যায়ে ডিম উৎপাদন করে শুধু বিক্রি করার জন্য। কিন্তু বাসায় মা ডিম খাচ্ছেন না। তো এই মিসড অপরচুনিটি টার্গেট করে প্রোগ্রামে নিয়ে আসতে হবে।

আমরা একটি নতুন এপ্রোচ শুরু করেছি, ‘ফরর্মেটিভ রিসার্চ’। এতে আমরা দেখেছি যে গর্ভবতী নারীর পাশাপাশি তার স্বামী গর্ভকালীন চেকআপের সময় সঙ্গে যান না। আমরা সেই গুরুত্ব বোঝানোর জন্য অনেক সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। ফলে বিভিন্ন মাঠপর্যায়ের এ ধরনের কার্যক্রমে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে।

আমাদের দেশে পুষ্টির ক্ষেত্রে কিন্তু ডায়নামিক চেঞ্জ হচ্ছে। একদিকে পুষ্টিহীনতা কমছে, আবার শারিরীক স্থূলতা বাড়ছে। এর সঙ্গে জেন্ডার রিলেটেড অনেক কাজ আছে, যেমন নারীদের খাদ্যাভ্যাস, হাঁটার জায়গার অভাব, শুধু ভাত-নির্ভর খাওয়া ইত্যাদি একসূত্রে বাঁধা। আমরা যখন নেক্সট জেনারেশন ইমার্জিন চ্যালেঞ্জ বা ক্লাইমেটের কথা বলব, তখন আমাদের এ ব্যাপারগুলোও সামনে আনতে হবে।

ভূমিকা আলোচনা:

ফারহানা হাফিজ

রিজিয়নাল জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যাডভাইজার (এশিয়া), নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল

নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে অনেক বছর ধরে কাজ করছে। ২০২২ ও ২৩ সালে আমরা জেন্ডার ও মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণবিষয়ক দুটো গবেষণা করেছি। এ গবেষণায় সহায়তা গ্রহীতাদের বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদারত্ব, জেন্ডারভিত্তিক কাজের বিভাজন ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করা হয়েছে।

দেশে প্রতি ১ লাখ সন্তান জন্ম দিতে ২৩ জন নারী গর্ভসংক্রান্ত জটিলতায় মারা যান। কম ওজনের শিশু জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ স্থানে আছে। ২৮ শতাংশ শিশু কম ওজনে জন্ম নেয়। অপুষ্টি ও খর্বাকৃতির ক্ষেত্রে কন্যাশিশুর সংখ্যা ছেলেশিশুর চেয়ে বেশি। কিশোরীদের ক্ষেত্রে একই চিত্র দেখা যায়। ২৮ শতাংশ কিশোরী ও গর্ভবতী নারীদের অর্ধেকই রক্তশূন্যতায় ভোগেন। মাত্র ৫৯ শতাংশ নারী প্রসবকালে দক্ষ ধাত্রী পান। দেশে বাল্যবিয়ের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।

পর্যাপ্ত পুষ্টি পাওয়ার সঙ্গে সমাজে বিদ্যমান জেন্ডার–বৈষম্যের সরাসরি সম্পর্ক আছে। নারী,

বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী, আদিবাসী নারী,অন্য লিঙ্গ–পরিচয়ের মানুষদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যে প্রবেশাধিকার কম।

গবেষণায় পাঁচটি চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে। প্রথমত, আমাদের সেক্স ও জেন্ডারভিত্তিক উপাত্তের অভাব আছে। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য কাঠামোগুলো জেন্ডারবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। তৃতীয়ত, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তার জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসুবিধার অভাব রয়েছে। চতুর্থত, ছেলেদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পুষ্টির ক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হয় না। পঞ্চমত, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ পুরো ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষদের কর্তৃত্ব বেশি।

সে জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জেন্ডারভিত্তিক সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনায় জেন্ডার–সমতার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোতে জেন্ডারভিত্তিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। এ ছাড়া যথাযথ তদারকি ব্যবস্থার মাধ্যমে সেবাদাতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। জেন্ডার–সমতা বিষয়ে মানুষের মনোভাব পরিবর্তনে প্রতিনিয়ত গবেষণার দরকার আছে। তা ছাড়া যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের পুষ্টিসংক্রান্ত কমিটি ও নারী অধিকার সংস্থাগুলোতে নারীদের সিদ্ধান্ত ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা কমিউনিটি পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে।

আসফিয়া আজিম

ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল

আজকের আলোচনায় আমরা অন্তত একটি বিষয়ে একমত যে ক্ষমতার কাঠামো বা সমাজে বিদ্যমান যে ব্যবস্থাগুলো চলমান আছে, তাতে শুধু পুষ্টিই নয়, যেকোনো ক্ষেত্রেই জেন্ডার সমতা অর্জন করা কঠিন। এ জন্য আমাদের একদম গোড়ায় চলে যেতে হবে, অর্থাৎ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেতে হবে। সেটা পুষ্টি হোক, খাদ্য বা শিক্ষা, যেটাই হোক।

আমরা একটু দেখার চেষ্টা করি যে আমাদের জাতীয় পুষ্টিনীতি বা কৌশলপত্রে কী আছে। জাতীয় পুষ্টিনীতি ২০১৫–তে বলা হয়েছে, মা, কিশোরী, শিশু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ জনগণের জীবনমান উন্নত ও পুষ্টি নিশ্চিত করা পুষ্টিনীতির একটি অন্যতম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুস্থ ও কাঙ্ক্ষিত ওজনের শিশুর জন্ম নিশ্চিত করতে এ নীতিমালায় গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়ের পুষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখানে শিশুর জন্মের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নারী স্বাস্থ্যের সামগ্রিক সুস্থতা ও পুষ্টির বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। পরিবারের ভেতর খাবারের অসম বণ্টন বা জেন্ডারভিত্তিক খাদ্যবৈষম্যের বিষয়টি এখানেও প্রাধান্য পায়নি এই নীতিতে। পুষ্টি উন্নয়নে সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের জন্য দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনায় ২১টি সূচক রয়েছে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন–সংক্রান্ত সূচক মাত্র একটি। ফলে আমাদের নীতিগুলোকে জেন্ডার সমতার লেন্স দিয়ে না দেখলে ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ না করলে জেন্ডার সমতা অর্জন করা কঠিন হবে।

আমরা এখন শুনছি যে তৃতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা তৈরি হবে, আগের পরিকল্পনা ও নীতিগুলো পুনর্মূল্যায়নের সময় জেন্ডার সমতাকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করার জন্য এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ হবে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বিশেষ করে যাঁরা নীতিনির্ধারণী ও কৌশলপত্র তৈরিতে সরকারকে প্রভাবিত করতে পারেন, আমার অনুরোধ থাকবে, আপনারা যেন যে যাঁর জায়গা থেকে যখনই সুযোগ পাবেন, জেন্ডার সেনসিটিভ ও জেন্ডার ট্রান্সফরমেটিভ নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ করবেন এবং আপনারাই জেন্ডার সমতার অ্যাডভোকেট হয়ে উঠবেন।

গীতা দাস

সভাপতি, নারীপক্ষ

পুষ্টিতে জেন্ডার–সমতা অর্জনের জন্য আমি জোর দিতে চাই আমাদের দৈনন্দিন চর্চার দিকে। আমাদের কিছু আবহমান চর্চা আছে, যেমন একটা প্রবাদ—‘রান্দি–বাড়ি যেবা নারী, পুরুষের আগে খায়/ ভরা কলসের জল তরাশে শুকায়’, অর্থাৎ যে নারী পুরুষের আগে খাবার খান, তিনি ‘সর্বনাশী। অনেক নারী ক্ষুধার্ত হলেও রান্না শেষ করে স্বামী, শ্বশুর তথা মুরব্বিদের আগে খেতে পারেন না। অর্থাৎ ঘরে খাবার থাকলেও যেকোনো সময় খাওয়ার যার অধিকার নেই, তার পুষ্টির প্রয়োজন মিটবে কী করে! এই জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে।

আমরা অনেকে এলাকাভিত্তিক নীতিমালার কথা বলি। সেটা প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি আমি মনে করি, আমরা যেসব মানুষের জন্য কাজ করি, তাদের ধরন বিশ্লেষণ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আমরা চার ধরনের মানুষ পাই। প্রথম ধরনের মানুষেরা পুষ্টি সম্পর্কে জানেন না এবং মানেনও না। তাঁদের নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। দ্বিতীয় ধরনের মানুষেরা এ সম্পর্কে জানেন না, কিন্তু মানেন। সামাজিক চর্চা তাদের পরিচালনা করে। তৃতীয় ধরন জানেন, কিন্তু মানেন না, তারা সবচেয়ে বিপজ্জনক। চতুর্থ ধরনের মানুষেরা জানেন ও মানেন, তাঁদের আমাদের কমিউনিটিতে কাজে ব্যবহার করতে হবে, তাঁরা সবচেয়ে পজিটিভ।

এ ছাড়া জেলা পর্যায়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি পুষ্টি টেবিল থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে। শুধু পরিষেবা দেওয়ার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব নয়। আমাদের প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে চিন্তা করা এবং কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা জেন্ডার–সমতা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

সালমা আক্তার

অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জীবনব্যাপী (লাইফ সাইকেল) দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় শিশুর শৈশব, কৈশোর ও গর্ভধারণের আগে থেকেই সন্তান জন্মদান–পরবর্তী; মেনোপজ হচ্ছে যাদের সবার ধারাবাহিক যত্ন নিশ্চিত করা। পাশাপাশি আজকে যারা জেন-জি, যারা পরিবারে একমাত্র বা দুজন সন্তান। তারা যখন মধ্যবয়সী হবেন, তখন তাঁদের চার থেকে পাঁচজন প্রবীণ নাগরিকের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকবেন। তাঁদের জন্য সেটা কীভাবে সম্ভব ও সহজ হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের কথা যদি বলি, আমরা কিন্তু স্কুলপর্যায়ের ছাত্রীদের জন্য অনেক কর্মসূচি নিলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রীদের জন্য তেমন কিছু করতে পারিনি। অনেকে দুঃখ করে বলে যে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পাতলা ডাল খেয়েই ভালো থাকে।’

শহুরে মধ্যবিত্ত নারীদের কথা আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাই। তাঁরা সন্তানের স্কুলের বেতন, বাসাভাড়া ও অন্যান্য খরচ মেটাতে গিয়ে নিজের খাবারের জন্য ঠিকমতো বরাদ্দ রাখতে পারেন না। আবার অনেকে মনে করেন শহরের শিশুরা দামি খাবার খায়। কিন্তু দামি খাবার মানেই তো পুষ্টিকর খাবার নয়।

লাইফ সাইকেলে আমরা কিন্তু শিশুদের পরিবর্তনের এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, যেন তারা বড় হয়ে সেটা ধরে রাখতে পারে, তখন সেটা দ্বিগুণ কার্যকর হবে। পাশাপাশি পুরুষদেরও এজেন্ট হিসেবে বয়ঃসন্ধিকালীন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় যুক্ত করতে হবে। এ রকম বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন বয়সের মানুষকে পুষ্টির এজেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সামগ্রিক পুষ্টি অবস্থার উন্নয়ন হবে।

ফারহানা আখতার

পুষ্টিবিষয়ক ফোকাল ও গবেষণা কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর

জেন্ডারবিষয়ক যেকোনো কর্মশালা, মিটিং, কর্মসূচি বা আলোচনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নারী কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। জেন্ডারসংক্রান্ত আলোচনা মানে নারীরা অংশগ্রহণ করবেন, এমন ধারণা আজও বিদ্যমান। আগে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে নারীদের কেন্দ্র করেই সব কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এখন এ ক্ষেত্রে পুরুষদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। আমাদের ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (বিডব্লিউবি) কর্মসূচিতে পুষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কর্মসূচিতে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল যুক্ত রয়েছে। এখন এ কর্মসূচিতে পুরুষদেরও যুক্ত করা হচ্ছে। এ কর্মসূচিতে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে।

মাদার অ্যান্ড চাইল্ড বেনিফিট প্রোগ্রাম (এমসিবিপি) নামে আমাদের একটি বড় কর্মসূচি রয়েছে। এ কর্মসূচিতে গর্ভবতী ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, এমন নারীদের ভাতা দেওয়া হয়। দুগ্ধদানকারী মায়ের পুষ্টির বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের যাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে থাকেন, তাঁদের ওপর নির্ভর করে। সে জন্য এ বিষয়ে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা ও ইতিবাচক মনোভাব তৈরি না করে শুধু ভাতা বা প্রশিক্ষণ দিয়ে মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন।

সারা দেশে আমাদের প্রায় পাঁচ হাজার কিশোর-কিশোরী ক্লাব রয়েছে। এসব ক্লাবে কিশোরদের অংশগ্রহণ রয়েছে, যেন তারা শুরু থেকেই একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে বেড়ে ওঠে। আজকের আলোচনায় অনেক পরামর্শ এসেছে। এ পরামর্শগুলো ক্লাবভিত্তিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের পুষ্টির বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে আমরা দীর্ঘদিন কাজ করে আসছি। তবে সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থা মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তাহলেই পুষ্টির ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বিষয়গুলো অর্জন করতে পারব।

জুলিয়া আহমেদ

জেন্ডার ও এসআরএইচআর বিশেষজ্ঞ

এত বছর কাজ করার পরও আমাদের নানান ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে হয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করে আমরা এখন একটা রিফর্ম প্রসেসে যাচ্ছি। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় জেন্ডার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা প্রথম থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা ও স্টেম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিত) শিক্ষায় নারী অন্তুর্ভুক্তি নিশ্চিত করলে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য খাতে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারতাম।

খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি মন্ত্রণালয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। খাদ্যনিরাপত্তায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে কৃষির সঙ্গে নারীদের যুক্ত করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নীতিনির্ধারকদের নারীদের এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।

কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে আয়রন ট্যাবলেট ও ফলিক অ্যাসিড দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা তা ঠিকমতো গ্রহণ করছেন না। অ্যাডোলোসেন্ট হেলথ কর্নার করা হয়েছে। কিন্তু এসব কর্নারে কার্যকরী সেবা বা সুবিধা নেই।

আমাদের সব ব্যবস্থাই কাগজে-কলমে। কিন্তু বাস্তবায়নে যথাযথ কাঠামো নেই। তাই এখন জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তোলা কার্যকর নীতিমালা তৈরি এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সোহানা শফিক

প্রজেক্ট কো–অর্ডিনেটর অ্যান্ড লিড, হেলথ সিস্টেম অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশন, আইসিডিডিআরবি

আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখেছি, রোহিঙ্গা এলাকাগুলোর উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ হলেও স্থানীয় কমিউনিটিতে পুষ্টিসেবা প্রদানে ঘাটতি রয়ে গেছে। এ ছাড়া শহরাঞ্চলে পুষ্টিবৈচিত্র্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। পুরুষদের চেয়ে নারী বিশেষত প্রতিবন্ধী নারীদের খাবারে বৈচিত্রের অভাব বেশি। তা ছাড়া খাবার প্রস্তুত করেন, এমন প্রান্তিক নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা ও পুষ্টির ধারণা খুবই সীমিত।

যে নারীরা ফরমাল সেক্টরে কাজ করছেন, তাঁরা কিছুটা সেবা পাচ্ছেন; কিন্তু যাঁরা ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করেন, তাঁরা তুলনামূলক কম সেবা পাচ্ছেন।

আরেকটি ব্যাপার হলো, যাঁরা কমিউনিটি পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী, তাঁরা গ্রামে সেবা দিলেও শহরে কিন্তু এই সেবা নেই। শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্য ও খাদ্যব্যবস্থা ক্রয়নির্ভর। শহরের চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে হবে।

দেশে নীতমালা ও সেবা প্রদানে সংযোগের অভাব রয়েছে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার অভাব বড় সমস্যা। তবে নারী নেতৃত্ব এগিয়ে আসায় আমরা আনন্দিত। এটি জেন্ডার রেসপন্সিভ পলিসি তৈরিতে সহায়তা করবে।

আফসানা হাবিব শিউলী

পুষ্টি ও স্বাস্থ্য প্রধান, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল

আমাদের প্রতিটি প্রকল্পে জেন্ডার অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়। আর আমরা জেন্ডার ট্রান্সফরমেটিভ অ্যাপ্রোচ নিয়ে কাজ করি। আমাদের একটি সাম্প্রতিক কাজের উদাহরণ হলো সূচনা প্রজেক্ট।

খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে কেবল নারীদের নিয়ে কাজ করলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসবে না। এ জন্য প্রকল্প পরিকল্পনার সময় থেকেই ছেলে বা পুরুষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের প্রজেক্টে দেখেছি যে পুরুষ ও নারীরা একে অন্যকে সহায়তা করলে পারিবারিক পর্যায়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজতর হয়। এ ধরনের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রমাণ করে যে জেন্ডার ইন্টিগ্রেটেড অ্যাপ্রোচে সফলতার হার অনেক বেশি।

ফারিয়া শবনম

এনপিও—মাতৃ ও শিশুপুষ্টি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে কৌশল ও নীতিমালা পর্যায়ে কাজ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর অনুরোধ অনুযায়ী, প্রতিটি নীতিমালা ও কৌশলে জেন্ডার সমতা যুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশে নারীরা, বিশেষ করে মা ও মেয়েশিশুরা সমাজে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। মায়েদের মধ্যে রক্তাল্পতার (অ্যানিমিয়া) হার অনেক বেশি। কিন্তু এর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কারণগুলো বিশ্লেষণ না করলে কার্যকর কর্মসূচি সাজানো সম্ভব নয়।

কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। পুষ্টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পুষ্টির অবস্থা উন্নত করে লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে অন্যান্য উন্নয়ন লক্ষ্যও অর্জিত হবে না।

নিশাত সুলতানা

পরিচালক, পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ইনফ্লুয়েন্স অ্যান্ড ক্যাম্পেইন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল

আমাদের জয়েন্ট অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন আউটকাম (জানো) প্রকল্পের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের অর্থায়নে পরিচালিত এ প্রকল্প রংপুর ও নীলফামারী জেলার সাতটি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হয়েছে।

এ প্রকল্পে গর্ভবতী, সদ্য মা হয়েছেন, এমন নারী ও বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করেছি। আমরা মাধ্যমিক ও মাদ্রাসায় জেমস কর্নার প্রতিষ্ঠা করেছি। এর মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালের চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে কিশোরদের পরিচিত ও সচেতন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

স্কুলগুলোতে ক্লাইমেট স্মার্ট সবজিবাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ১৩১টি স্কুল থেকে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমের মাধ্যমে ৪ হাজার ৫৬টি সবজিবাগান স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। এ প্রকল্প পরিচালনার সময় আমরা ২২টি সরকারি মন্ত্রণালয় ও এজেন্সির সঙ্গে কাজ করেছি। জেন্ডার ও পুষ্টিকে একসঙ্গে বিবেচনা করার মতো এ ধরনের সমন্বিত প্রচেষ্টাগুলোকে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

মাসুমা বিল্লাহ

প্রোগ্রাম হেড, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক

নারীর এজেন্সি নিয়ে আমি বলতে চাই, আমরা যে নারীদের কাছে যাই, তাঁর কাছে তাঁর উপযোগী ও বাস্তবসম্মত সমাধান আছে কি না, তিনি বুঝতে পারছেন কি না, স্বল্প ব্যয়ে নিজের ও পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারছেন কি না, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সহজলভ্য খাবারকে কেন্দ্র করে নারীদের তথ্যসমৃদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ব্র্যাক কাজ করে এবং এ কাজে অন্যদের আরও সহযোগিতা চায়।

তথ্যগুলো সঠিক মানুষকে সঠিকভাবে প্রদানের পাশাপাশি নারীরা নিজেদের জীবনে এগুলো চর্চা করছে কি না, সেটাও আমাদের খেয়াল করতে হবে।

লায়লা করিম

প্রকল্প পরিচালক, আয়াত এডুকেশন

আমার দাদি তাঁর শাশুড়ির কথা বলতেন, প্রায় ১৪০ বছর আগে এ সময় বাড়ির বউদের পাতে লবণ দিয়ে ভাত খেতে দেওয়া হতো না, যেন তাঁরা বেশি খেতে না পারেন। আমরা কিন্তু সে সময় পেছনে ফেলে এসেছি। কিন্তু আমি উপলব্ধি করেছি যে মেয়েরা নিজেদের পুষ্টির ব্যাপারে উদাসীন। ছোটবেলা থেকে পুষ্টির চেয়েও তাদের পছন্দের খাবারের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বড়দের ক্ষেত্রে কর্মজীবী নারীরা সকালে নাশতা করেন না, কম পানি পান করার কারণে তাঁদের জীবনে, স্বাস্থ্যে ও পুষ্টিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। যাঁরা গবেষক আছেন, তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব, নতুন প্রজন্মের কর্মজীবী মানুষদের নিয়ে কাজ করুন; কারণ, তাঁদের জীবনের অনেকটা সময় এখনো বাকি।

বয়স্কদের প্রতি আমাদের মনোযোগ আরও বাড়াতে হবে। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁদের পুষ্টির চেয়ে ওষুধে নির্ভরশীলতা বেশি। অথচ ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবারই তাঁদের সুস্থ রাখার মূল চাবিকাঠি। সুতরাং আজকে যাঁরা যুবক, তাঁরা যেন প্রবীণ হলে বোঝা না হয়ে যান এবং আজকে যাঁরা প্রবীণ, তাঁদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকে নীতিমালায় নিয়ে আসতে হবে।

মনজুন নাহার

ব্যবস্থাপক, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন, মেরী স্টোপস বাংলাদেশ

১৯৯৪ সালে কায়রো সম্মেলনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রজননস্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ঘোষণাটি বিশ্বব্যাপী গ্রহণ করা হয় এবং বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের মতো এতে স্বাক্ষর করে নিজেদের সেক্টরাল প্রোগ্রাম ঢেলে সাজাল।

বর্তমানে চতুর্থ সেক্টরাল হেলথ ও পপুলেশন প্রোগ্রাম শেষের দিকে। আমি এই আশা রাখি, এই রাউন্ড টেবিলের সুপারিশগুলো পঞ্চম সেক্টরাল পরিকল্পনায় যেন অন্তর্ভুক্ত হয়।

কুড়িগ্রামের চর অঞ্চলের একটি মেয়ের পুষ্টির চাহিদার সঙ্গে খুলনা শহরের একটি মেয়ের পুষ্টির চাহিদা একেবারে ভিন্ন। তেমনি প্রজননস্বাস্থ্যে নারীদের অধিকার, চাহিদা অনুযায়ী তাঁদের যত্ন প্রয়োজন। আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক গর্ভবতী মা নিয়মিত চেকআপে আসেন না। প্রশ্ন হলো, তাঁরা আসেন না, নাকি তাঁরা আসতে পারেন না!

নারীর স্বাস্থ্য কর্মসূচিকে অধিকারভিত্তিক ও প্রজননস্বাস্থ্যকে বৃহত্তর স্বাস্থ্যকাঠামোর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হলে বড় অগ্রগতি হবে।