ইউএসএআইডির ‘ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যাক্টিভিটি এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
বাংলাদেশে খোলা জায়গায় মল ত্যাগ করা মানুষের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। একটি টয়লেট এককভাবে ব্যবহার করে ৬৪ শতাংশ পরিবার। কিন্তু নিরাপদ টয়লেট ব্যবহার করে মাত্র ৩৯ শতাংশ পরিবার। মানসম্পন্ন নিরাপদ টয়লেটের ব্যবহার বাড়াতে হলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ।
গতকাল সোমবার রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘মানসম্পন্ন স্যানিটেশন ব্যবস্থা, উন্নত পুষ্টির নিশ্চয়তা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। ইউএসএআইডির ‘ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যাক্টিভিটি’ এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো। বৈঠকে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (বুয়েট), ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধি, স্যানিটেশন বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।
বৈঠকের শুরুতে মূল উপস্থাপনায় ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যাক্টিভিটির পানি ও স্যানিটেশন বিষয়ের কারিগরি প্রধান মাহজাবীন আহমেদ বলেন, স্যানিটেশন ব্যবস্থা দুর্বল হলে পানি দূষিত হয়, ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে, খাদ্য থেকে পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ কমে। এ কারণে অপুষ্টি দেখা দেয়, বিশেষ করে শিশুদের উচ্চতা বৃদ্ধির সমস্যা হয়, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়ে যায়, পাশাপাশি কর্মদিবস নষ্ট হয়।
বাংলাদেশে ল্যাট্রিন ব্যবহারে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেন মাহজাবীন আহমেদ। তিনি বলেন, দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবার উন্নত ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। একটি টয়লেট এককভাবে ব্যবহার করে ৬৪ শতাংশ পরিবার। এই হারকে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। অন্যদিকে দেশের মাত্র ৩৯ শতাংশ পরিবার নিরাপদ ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। এই হারও বাড়াতে হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সারা দেশের শহরে ও গ্রামে স্যানিটেশন বিষয়ে কাজ করে। এ বিষয়ে ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে অধিদপ্তর। ওই প্রকল্পের পরিচালক তবিবুর রহমান তালুকদার বলেন, মানুষকে মানসম্পন্ন স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় আনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের কোন কোন এলাকায় কী কী করা হবে, তার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্যানিটেশন মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য সরকার অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পল্লি এলাকার নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল হাসান বলেন, দেশের পৌরসভা আছে ৩৩০টি। এই ৩৩০টি পৌরসভার এক নম্বর সমস্যা স্যানিটেশন। পৌরসভাগুলোতে বাড়ির ধরন আলাদা। সেপটিক ট্যাংক নানা ধরনের। সেপটিক ট্যাংকগুলো নর্দমার সঙ্গে যুক্ত, নর্দমা যুক্ত নদীর সঙ্গে। এসব পৌরসভায় আইন প্রয়োগেরও সমস্যা আছে। পৌরসভাগুলোতে পয়োবর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা অনেক বড় সমস্যা। তিনি জানান, ১২৫টি শহরে পয়োবর্জ্য শোধন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
দুই সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্যের পর আলোচনায় অংশ নেন ইউএসএআইডির ইকোনমিক গ্রোথ অফিসের পরিচালক মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, উন্নত পুষ্টি, জীবনমানের উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬-এর অধীনে সব বাংলাদেশির জন্য পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইউএসএআইডি পুষ্টিসংক্রান্ত তার সব কার্যক্রমে পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করে। আর এই খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কীভাবে কার্যকর কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করা যায়, সেই লক্ষ্যে ইউএসএআইডি ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যাক্টিভিটি ও অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, এনজিও ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করে।
বাংলাদেশে খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হাইসাওয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল ওসমান বলেন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল—প্রতিবেশী এসব দেশে খোলা আকাশের নিচে মল ত্যাগের হার ৫ থেকে ২৫ শতাংশ। কিন্তু এসব দেশে নিরাপদ ল্যাট্রিন ব্যবহারে হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশে ৩৪ শতাংশ পরিবার নিরাপদ ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে তা ৫০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কাজের গতি বা উদ্যোগ–আয়োজন পাঁচ গুণ বাড়াতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বুয়েটের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ নেটওয়ার্কের পরিচালক অধ্যাপক তানভীর আহমেদ বলেন, স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্রামে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, সে ব্যাপারে আইনে নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান এলাকা বা দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জন্য পৃথক প্রযুক্তির কথা ভাবতে হবে।
প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই বৈঠকে একাধিক আলোচক বলেন, গ্রাম ও শহরের সমস্যা ভিন্ন ধরনের। সমস্যার সমাধানও করতে হবে ভিন্নভাবে। মানুষ টয়লেটের বাইরের অংশ নিয়ে যতটা ভাবে, টয়লেটের বর্জ্য নিয়ে তত ভাবে না। এ ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথাও ভাবতে হবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসএনভির পানি বিষয়ের প্রধান শহীদুল ইসলাম বলেন, পৌরসভাগুলো নিজেরাই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে তাদের সেই সক্ষমতা নেই। এ ক্ষেত্রে উচিত বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা। তিনি বলেন, ল্যাট্রিন তৈরির বা অবকাঠামোর জন্য অর্থায়ন যত হয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সেই তুলনায় অর্থায়ন কম হয়।
সরকারের পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) দেশের বহু অঞ্চলে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল মতিন বলেন, মানুষকে ঋণ দিয়ে যে টয়লেট বানানো যায়, তা পিকেএসএফ দেখিয়েছে। নিরাপদ পানি নেওয়া এবং টয়লেট দেওয়ার জন্য মানুষকে বিশেষ ঋণসুবিধা দিচ্ছে পিকেএসএফ।
স্যানিটেশন খাতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও অর্থ বিনিয়োগ করছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড। গোলটেবিল বৈঠকের সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত হয়ে আরএফএলের বিজনেস অপারেশনের প্রধান আবদুল্লাহ আল জুনাইদ বলেন, মানুষ প্লাস্টিকের সেপটিক ট্যাংক ব্যবহার করছে। মানুষ সেপটিক ট্যাংকের জন্য যত খরচ করতে চায়, পয়োবর্জ্য শোধনের ব্যাপারে ততটা আগ্রহী নয়।
জাপান সাশ্রয়ী ল্যাট্রিন উদ্ভাবন করেছে অনেক আগেই। সেই ল্যাট্রিন সাতো ল্যাট্রিন নামে দেশে পরিচিতি পেয়েছে। জাপানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লিক্সিল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সাতো-বাংলাদেশের প্রধান রাশেদুল আলম সরকার বলেন, তাঁদের ল্যাট্রিনে অন্য ল্যাট্রিনের চেয়ে ৮০ শতাংশ পানি কম প্রয়োজন হয়। পানি কম লাগার অর্থ পয়োবর্জ্য কম হওয়া। তিনি জানান, তাঁরা আরএফএলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছেন।
অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আইডিইয়ের এশিয়া অঞ্চলের প্রধান ও বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সারোজা থাপা বলেন, গ্রামের মানুষের ব্যবহারের উপযোগী প্রযুক্তি তাঁরা তৈরি করেন। এ ব্যাপারে তাঁদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও আছে।
ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যাক্টিভিটির চিফ অব পার্টি রামকৃষ্ণ গণেশান বলেন, উন্নত পুষ্টি ও শতভাগ স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে যেসব জেলায় স্যানিটেশন কাভারেজ এখনো কম আছে, সেখানে কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া ক্রেতার চাহিদার কথা মাথায় রেখে উপযোগী প্রযুক্তি ও কাম্য সমাধান দিলে সবাই উপকৃত হবে।