‘সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য: সমতা ও টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক এই বৈঠকের আয়োজক ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে, এফআইভিডিবি ও প্রথম আলো।
নিরাপদ খাদ্য প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের দেশে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হলেও নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে উৎপাদক, বিপণনকারী থেকে ভোক্তা—সব পর্যায়ের অংশীজনকে সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে।
গতকাল বুধবার সকালে ‘সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য: সমতা ও টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে খাদ্য ও পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা এই অভিমত দিয়েছেন। জার্মানভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে, এফআইভিডিবি ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এফআইভিডিবির ‘স্ট্রেংদেনিং স্মলহোল্ডার ফার্মস অ্যান্ড রুরাল এন্টারপ্রাইজেস টু বেটার কোপ উইথ ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন দ্য ভালনারেবল হাওর রিজিয়ন অব বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রকল্পের অধীন এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে পাওয়ার পয়েন্টে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের প্রকল্পপ্রধান মামুনুর রশিদ। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৮.৮ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টির শিকার, যা মোট জনসংখ্যার ১১.৪ শতাংশ। নারী ও শিশুদের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩৬.৭ শতাংশ নারী অ্যানিমিয়ায় (রক্তশূন্যতা) আক্রান্ত। আর ৫ বছরের কম বয়সী ৯.৮ শতাংশ শিশু এখনো কৃশকায়। এই পরিস্থিতিতে ভেজাল ও দূষিত খাদ্য মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে। ২০২১ সালের বিএফএসএর জরিপ অনুসারে দেশের ৪০ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল রয়েছে। এই ভেজাল খাদ্য ৩৩ শতাংশ বয়স্ক মানুষ ও ৪০ শতাংশ শিশুর অসুস্থতার কারণ। প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বাজারের ৬০ শতাংশ শাকসবজিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ও ৬৭ শতাংশ বোতলজাত সয়াবিন তেলে ট্রান্সফ্যাট এবং অধিকাংশ জেলার মাটিতে প্রয়োজনীয় জৈব উপাদানের অভাবের কারণে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে। তারা সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় ১০০টি গ্রামে ২০ হাজার প্রান্তিক কৃষককে জলবায়ুবান্ধব, টেকসই জৈব প্রযুক্তির সাহায্যে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
বৈঠকে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি মানুষের মৌলিক অধিকার। উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত খাদ্যনিরাপত্তার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। প্রতিটি স্তরেই এই নিরাপত্তার মান নিশ্চিত করা গেলেই সঠিকভাবে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এ জন্য কাজ করছে। খাদ্যনিরাপত্তার আইন ও প্রবিধানের আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। খাদ্যের বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশন বন্ধ করা, পণ্যের মোড়কে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, পুষ্টিমান উল্লেখ করা—এসব নিয়ে কাজ করছে। হোটেল-রেস্তোরাঁর রন্ধন ও পরিবেশনকর্মীদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মান অনুসারে হোটেল-রেস্তোরাঁর গ্রেডিং করা হচ্ছে। তবে খাদ্যনিরাপত্তা একটি ব্যাপক বিষয়। এ জন্য উৎপাদক থেকে ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা—সর্বস্তরের অংশীজনের প্রয়াস প্রয়োজন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্রপস উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শওকত ওসমান বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে এসডিজিতে যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, ইতিমধ্যে তার অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। নিরাপদ খাদ্যের জন্য “উত্তম কৃষি”র প্রচেষ্টা চলছে। প্রকৃতি, ফসল ও চাষাবাদের ধরনের ওপর ভিত্তি করে দেশের কৃষিচর্চাকে ৬টি অঞ্চলে ভাগ করে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের সঠিক মাত্রা ও নিয়ম সম্পর্কে কৃষকদের মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে “স্মার্ট কৃষি কার্ড” দেওয়া হচ্ছে। তবে কেবল কৃষিপণ্যের উৎপাদন নিরাপদ করলেই হবে না, ভেজালমুক্ত রাখা, দূষণমুক্ত রাখার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।’
বাংলাদেশ অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার নেটওয়ার্ক, বারির কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন খাদ্যনিরাপত্তার জন্য উৎপাদক থেকে ভোক্তা—সবার আচরণগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পঙ্কজ কুমার বলেন, জার্মানির সরকার বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা দূর করা ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং এ লক্ষ্যে কাজ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এতে উৎপাদন বেড়েছে, তবে এই খাদ্য যেন নিরাপদ দূষণমুক্ত হয়, পুষ্টিমান বজায় থাকে, সেই দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে ওয়েল্ট হাঙ্গার সেই লক্ষ্যে কাজ করছে।
সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও এফআইভিডিবির কার্যকরী সদস্য আবু জায়েদ বলেন, নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার যে আইনটি আছে, তার বিষয়ে কার্যকারিতা দেখা যায় না। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। কৃষকদের জৈব পদ্ধতিতে চাষে উৎসাহিত করতে তাদের পণ্যের মূল্যও নিশ্চিত করতে হবে।
নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর আসফিয়া আজিম খাদ্যের পুষ্টিমানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, নারী ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা বেশি। নিরাপদ খাদ্যের মতো সবার জন্যই পুষ্টি সমতারও প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আলী আব্বাস মোহাম্মদ খোরশেদ বলেন, সাধারণত চকচকে বা উজ্জ্বল ধরনের সবজিকে টাটকা বলে ভাবা হয়, এগুলোতে রাসায়নিক সার বেশি প্রয়োগ করা হয়। জৈব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত শাকসবজি দেখতে এতটা ভালো দেখায় না বলে ক্রেতাদের আগ্রহ কম থাকে। এসব বিষয়ে ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবীর ভূঁইয়া বলেন, শুধু কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করেই খাদ্য নিরাপদ হবে না। পোলট্রি ও মাছ চাষের ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে মানবদেহে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
আরও বক্তব্য দেন গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশনের (গেইন) প্রতিনিধি জি এম রেজা, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি মো. ওসমান গনি, রাইট টু ফুড নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক কানিজ ফাতেমা, বাংলাদেশ সেফ ফুড অ্যালায়েন্সের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও তরুণ উদ্যোক্তা তাহমিনা শৈলী। হাওর অঞ্চলের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদক মো. কামাল উদ্দিন তাঁর চাষাবাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক, সঞ্চালনা করেন সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।