হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা, বাংলাদেশের আয়োজনে ও প্রথম আলোর সহযোগিতায় গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বা মা থেকে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই হেপাটাইটিস ভাইরাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে গর্ভাবস্থার শুরুতেই অন্তঃসত্ত্বা নারীকে পরীক্ষা করা উচিত। গর্ভাবস্থার ১২ সপ্তাহ পর মা এবং জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে হেপাটাইটিস বি টিকার প্রথম ডোজ দিলে মা ও সন্তান দুজনেরই ঝুঁকি কমে। আজ ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে গতকাল শনিবার হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা, বাংলাদেশের আয়োজনে ও প্রথম আলোর সহযোগিতায় এক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন লিভারবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তাঁরা স্কুলে স্কুলে গিয়ে হেপাটাইটিস টিকা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করার ওপর জোর দেন।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘মা থেকে শিশুতে হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণ প্রতিরোধ: এসডিজি-২০৩০ পরিপ্রেক্ষিত’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বক্তারা বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হেপাটাইটিস বি ও সি নির্মূলের লক্ষ্য নিয়েছে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস শনাক্তে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের পরীক্ষা সরকারিভাবে বিনা মূল্যে করা প্রয়োজন।
অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, সুই, সিরিঞ্জ ব্যবহার ও অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্ক, নাক-কান ফুটো করা, সেলুনে একই ব্লেড দিয়ে একাধিক ব্যক্তিকে শেভ করা ইত্যাদির মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ও সি সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। খাদ্য ও পানিবাহিত কারণে এ ও ই ভাইরাস ছড়ায়। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে চাকরির ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা না করার ওপর জোর দিয়ে বক্তারা বলেন, এই ভাবনা অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক।
গোলটেবিল বৈঠকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার বলেন, ২০০৩ সাল থেকে দেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু শিশুদের এই টিকা দেওয়া শুরু হয় দেড় মাস পর। এই দেড় মাস শিশুরা অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে। যেসব অন্তঃসত্ত্বা মায়ের হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থাকে, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সে মায়ের নবজাতককে স্থায়ী ও তাৎক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য হেপাটাইটিস বি টিকার পাশাপাশি ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন দিতে হবে। স্কুল স্বাস্থ্য কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে স্কুলে স্কুলে গিয়ে হেপাটাইটিস পরীক্ষা ও টিকা নেওয়ার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
হেপাটোলজি সোসাইটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) লিভার বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, হেপাটাইটিস ভাইরাসের কারণে লিভারে প্রদাহ হয়। এ, বি, সি, ডি ও ই—এই পাঁচ ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাস রয়েছে। হেপাটাইটিস ভাইরাসে মৃত্যুর ৯০ শতাংশের বেশি ঘটে বি ও সি ভাইরাসের কারণে। ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সরকারকে বেসরকারি সংস্থা, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
হেপাটোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং বিএসএমএমইউর হেপাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান মো. শাহিনুল আলম বলেন, অনেকে হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও তা জানেন না। এ জন্য স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা বাড়ালে বেশিসংখ্যক শনাক্ত হবে ও শুরুতে চিকিৎসা দেওয়া যাবে। এই রোগের চিকিৎসা ব্যয় সরকারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। হেপাটাইটিসের জন্য একটি জাতীয় নির্দেশিকা দ্রুত তৈরি ও প্রচার করতে হবে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার জন্য একটি নিবেদিত কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার।
হেপাটোলজি সোসাইটির বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও বারডেমের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম আযম বলেন, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের দীর্ঘসূত্রতার জটিলতা নিয়ে বসবাস করছেন। দীর্ঘসূত্রতার কারণে লিভার ক্যানসার, লিভার সিরোসিস ও লিভার অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। বছরে ১১ লাখ মানুষ এ দুটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
প্রতিরোধের ওপর জোর দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। স্কুলগুলোতে গিয়ে সপ্তম শ্রেণির কিশোরী মেয়েদের লক্ষ্য করে সচেতনতা সৃষ্টি করলে ভবিষ্যৎ মা হিসেবে মেয়েটি টিকা নেওয়া ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হবে। একইভাবে পরিবারকেও সচেতন করতে পারবে।
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, একজন অন্তঃসত্ত্বা মাকে ১২ সপ্তাহের পর হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া যায়। গর্ভধারণের পরামর্শ নিতে এলেও ওই নারীকে দুই ডোজ টিকা দেওয়া যেতে পারে। আরও সতর্কতা হিসেবে কিশোরী বয়সে ধনুষ্টংকারের টিকার ৫ ডোজ দেওয়ার সময় ২ ডোজ হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া যেতে পারে।
ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, হেপাটাইটিস বি টিকায় মা ও সন্তান দুজনেরই প্রাণ বাঁচে। আক্রান্ত মা থেকে সন্তানের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধে ‘বার্থ ডোজ’ বা জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে হেপাটাইটিস বি টিকা দিতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা মা ও নবজাতকদের এই টিকা দেওয়া নিয়ে ভীতি দূর করতে হবে। দেশে হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা নির্ণয় করা দরকার। হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা এবং ব্যয়বহুল ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন সহজলভ্য করা দরকার।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন আদ-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের অধ্যাপক মো. আকমত আলী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) লিভার বিভাগের চিকিৎসক মো. সাইফুল ইসলাম এলিন, কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস কে এম নাজমুল হাসান, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের লিভারবিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ কামরুল আনাম।
গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।