অংশগ্রহণকারী
অধ্যাপক ডা. মো.গোলাম মোস্তফা
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সাবেক অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)।
অধ্যাপক ডা. মো.শাহিনুল আলম
সাধারণ সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
চেয়ারম্যান, হেপাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)।
ডা. মো.গোলাম আযম
বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সহযোগী অধ্যাপক, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও লিভার বিভাগ, বারডেম।
অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার
শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান
প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি)।
অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক
সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।)
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী
মহাসচিব, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ।
ডা. মো.সাইফুল ইসলাম এলিন
আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা, বাংলাদেশ। লিভার বিশেষজ্ঞ, বিএসএমএমইউ।
অধ্যাপক ডা. মো.আকমত আলী
কার্যকরী সদস্য, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, আদ-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
ডা. এস কে এম নাজমুল হাসান
কার্যকরী সদস্য,হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ।
ডা. মোহাম্মদ কামরুল আনাম
কার্যকরী সদস্য, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
লিভার বিশেষজ্ঞ, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
অধ্যাপক ডা. মো.গোলাম মোস্তফা
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সাবেক অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)
প্রতিবছর ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, হেপাটাইটিসের সংক্রমণের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা। হেপাটাইটিস নির্মূল কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া। হেপাটাইটিস হলো লিভারে প্রদাহ। এটা ভাইরাসের জন্য হয়ে থাকে। হেপাটাইটিসের এ, বি, সি, ডি এবং ই—এই পাঁচ ভাইরাস রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হলো হেপাটাইটিস-বি এবং সি ভাইরাস। দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীর লিভার সিরোসিস, ক্যানসার ও লিভার ফেইলিাোর হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ অবস্থাগুলো প্রাণঘাতি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর হেপাটাইটিসে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ নতুন করে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হন। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। তাই হেপাটাইটিসের বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
আমাদের আজকের গোলটেবিল আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মা থেকে শিশুতে হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণ প্রতিরোধ: এসডিজি-২০৩০ পরিপ্রেক্ষিত’। গর্ভবতী মায়েরা যদি হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে একই সঙ্গে মা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি মায়ের গর্ভের সন্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে এবং পৃথক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ হতে পারে: স্কুল ও মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীদের বিনা মূল্যে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এটা অর্জনের জন্য আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, যেমন: গণমাধ্যমকর্মী, জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, সমাজকর্মী ও সরকারের নির্বাহী বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে আশা করি। এই প্রত্যাশা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
অধ্যাপক ডা. মো.শাহিনুল আলম
সাধারণ সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
চেয়ারম্যান, হেপাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)
বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও সি নির্মূলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১৬ সালে গৃহীত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নতুন ভাইরাস আক্রান্তের হার ৯০ শতাংশ ও মৃত্যুর হার ৬৫ শতাংশ কমাতে হবে। ইতিমধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের আক্রান্তের হার কমানোর ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। অবশিষ্ট অর্জনের জন্য মা থেকে শিশুতে হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ প্রতিরোধ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য ১৮ লাখ প্রজনন সক্ষম নারীকে এবং তাদের পরিবারকে পরীক্ষা, চিকিৎসা ও টিকা দেওয়ার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শিশুদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর পরীক্ষা ও চিকিৎসা সরকারিভাবে বিনা মূল্যে করা প্রয়োজন।
হেপাটোলজি সোসাইটি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা শুরু করেছে। আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত নারীদের হেপাটোলজি সোসাইটির কার্যালয়ে প্রেরণের অনুরোধ করছি। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনের জন্য মা থেকে সন্তানের সংক্রমণ রোধ করে হেপাটাইটিস বি নির্মূল করতে বাংলাদেশের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপের সুপারিশ করছি:
১. প্রসবকালীন যত্নের সময় সব গর্ভবতী নারীর মধ্যে হেপাটাইটিস বি পরীক্ষার জন্য একটি কৌশল তৈরি করতে হবে।
২. নিশ্চিত করতে হবে যে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন জন্মের ডোজের সঙ্গে জাতীয় টিকাদানের সময়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৩. হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি মৃত্যুহার, ঘটনা ও প্রাদুর্ভাব পর্যবেক্ষণের জন্য একটি জাতীয় কমিটি তৈরি করা দরকার।
৪. নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোর সঙ্গে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য সহযোগিতা জোরদার করার উদ্যোগ নিতে হবে।
৫. জেলা ও উপজেলা স্তরসহ এইচবিভি এবং এইচসিভি পরীক্ষা ও চিকিত্সার বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রসারিত করা জরুরি।
৬. এইচবিভি এবং এইচসিভি পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগার সুবিধাগুলোর সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
৭. এইচবিভি এবং এইচসিভি পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিশেষ করে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ প্রণোদনা করা দরকার।
৮. হেপাটাইটিস চিকিৎসায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থায়নের অতিরিক্ত উৎস চিহ্নিত করতে হবে।
৯. ভাইরাল হেপাটাইটিসের জন্য জাতীয় নির্দেশিকা সম্পূর্ণ এবং প্রচার নিশ্চিত করা জরুরি।
১০ ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার জন্য একটি নিবেদিত কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার।
১১.এইচবিভি এবং এইচসিভির সঙ্গে বসবাসকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য বৈষম্যবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি।
অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার
শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস বিশ্বব্যাপী মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা। শিশুর জন্মের সময় যদি মা এ রোগে আক্রান্ত থাকেন, তবে নবজাতকের দেহে এর বিস্তার হতে পারে। এই দুটি ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার যত পথ আছে, সেগুলোর মধ্যে জন্মের সময় মা থেকে শিশুর শরীরে প্রবেশের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে ২০০৩ সালে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিশুদের ইপিআই কার্যক্রমে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা অন্তর্ভুক্তির পর এর সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য কমে গেছে। এখন প্রায় ৯৫ শতাংশ শিশু হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের প্রতিরোধক টিকার আওতায় এসেছে; কিন্তু শিশুদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয় দেড় মাস পর। এই দেড় মাস শিশুরা অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে। যেসব গর্ভবতী মায়ের হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থাকে, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সে মায়ের নবজাতককে স্থায়ী ও তাৎক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য হেপাটাইটিস বি এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন টিকা দেওয়া উচিত। টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য যে অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে হয়, তা এখনো তেমন করে প্রচারে আসছে না। কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টেস্ট আরও বেশি প্রয়োজন, বিশেষ করে ১৬-১৮ বয়সীদের। কারণ, এরাই ভবিষ্যৎ মা।
যেসব শিশু ভ্যাকসিনের আওতায় আসেনি বা ভ্যাকসিনের অকার্যকারিতায় পড়েছে অথবা ইতিমধ্যেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের প্রতি ৫ বছর অন্তর টেস্টের আওতায় এনে বুস্টার ডোজিং এবং ফ্রি মেডিসিন নীতিমালায় নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য শিশুস্বাস্থ্য সংগঠনগুলোর হেপাটোলজি সোসাইটির সঙ্গে একটি কর্মপন্থা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরে আনতে কাজ শুরু করা উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৪ সালের নতুন গাইডলাইনে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য শিশু ও কিশোরীদের জন্য নতুনভাবে টিকা ও চিকিৎসার নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে, যা অনেকটা সহজ ও চিকিৎসাবান্ধব। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে যে টিকা কার্যক্রম চলে আসছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে।
ডা. মো.গোলাম আযম
বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সহযোগী অধ্যাপক, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও লিভার বিভাগ, বারডেম
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, সারা বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ বর্তমানে হেপাটাইটিস-বি এবং সি ভাইরাসজনিত দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগে আক্রান্ত। সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১১ লাখ মানুষ এই দুটি ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার এবং লিভারের কার্যক্ষমতা হারানোর মাধ্যমে মারা যায়, যা মরণঘাতী এইডস রোগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বা লিভারের প্রদাহ মূলত দূষিত খাদ্য ও পানিবাহিত হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস ই দ্বারা সংঘটিত হয়। তবে রক্ত, রক্তের উপাদানবাহিত হেপাটাইটিস বি এবং সি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মধ্যম ক্যাটাগরিতে (Intermediate Prevalence) পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্যাটি লিভারের কারণে সৃষ্ট ন্যাশ (NASH) নামক একধরনের হেপাটাইটিস অতি উচ্চ হারে নির্ণয় হচ্ছে যা লিভারের সুস্থতার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে দেখা যাচ্ছে। মদ্যপানজনিত, ড্রাগ উদ্ভূত বা অটোইমিউনের কারণেও হেপাটাইটিস হতে পারে।
হেপাটাইটিস–বি এবং সি ভাইরাসের সংক্রমণের মাধ্যমগুলো, যেগুলো জনসচেতনতা বাড়ানো ও টিকা দেওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, সেগুলোকে উদ্দেশ করে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয়ে আসছে।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস কীভাবে এলো? চার্লস গোর নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি ১৯৯৫ সালে হেপাটাইটিস সি–তে আক্রান্ত হন, পরে মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাঁর লিভার সিরোসিস রোগ শুরু হয়। ওই সময়ে হেপাটাইটিস সির সঠিক চিকিৎসা নিয়ে কোনো সর্বসম্মত গাইডলাইন ছিল না। যা ছিল তা–ও অনেক ব্যয়বহুল। কোনো গাইডলাইন না থাকায় স্বাস্থ্যবিমা তখনো এই রোগের কভারেজ দিত না। ২০০০ সালে আরও তিনজন এ রকম রোগীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ‘হেপাটাইটিস সি ট্রাস্ট’ গঠন করেন। তারপর ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের রোগীদের নিয়ে ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক হেপাটাইটিস সি সচেতনতা দিবস পালন শুরু করেন। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রোগী গ্রুপগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হেপাটাইটিস দিবস পালন করে আসছিল। এ জন্য ২০০৮ সালে রোগীদের সব কটি গ্রুপ মিলে ‘ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স’ গঠন করে এবং ১৯ মে–কে প্রথম বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস হিসেবে পালন শুরু করে।
বিশ্বব্যাপী রোগী কল্যাণ সমিতি ও জনমতের ব্যাপক প্রচার প্রচারণার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১০ সালের ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে একটি নীতি গ্রহণ করা হয়, যেখানে হেপাটাইটিস সির সঙ্গে হেপাটাইটিস বি যুক্ত করা হয়। হেপাটাইটিস বির আবিষ্কারক অধ্যাপক বারুচ স্যামুয়েল ব্লমবার্গের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৮ জুলাইকে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ঘোষণা করে। অধ্যাপক ব্লুমবার্গ শুধু হেপাটাইটিস বি আবিষ্কারকই নন, তিনি এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বা টিকাও আবিষ্কার করেন, যে কারণে তিনি ১৯৭৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিভিন্ন বছর বিভিন্ন স্লোগান নিয়ে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে।
হেপাটাইটিস বির অতি কার্যকর টিকা এবং হেপাটাইটিস বি ও সির নিরাময়যোগ্য ওষুধ নাগালযোগ্য হওয়ায় ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে একটি উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব গ্রহণ করে। যেখানে ২০২০ সালের মধ্যে সদস্যদেশগুলোকে নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলা হয়, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিসকে বিশ্ব থেকে নির্মূল করা যায়। এসডিজি অর্জনে এই প্রস্তাবকে অন্যতম উপজীব্য হিসেবে ধরা হয়েছে। এই বছরের স্লোগান ‘Its time for action’ অর্থ ‘এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।’
অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান
প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি)
দেশে কতজন গর্ভবতী মা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। হেপাটাইটিস ভাইরাস গর্ভবতী মা থেকে শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। গর্ভবতী মাকে অনেক সময় রক্ত দিতে হয়, যেখান থেকেও তিনি আক্রান্ত হাতে পারেন। গর্ভবতী মায়েরা যদি হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে একই সঙ্গে মা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি মায়ের গর্ভের সন্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রচণ্ড জন্ডিসসহ আরও অনেক সমস্যা হতে পারে। একপর্যায়ে মা লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। গর্ভবতী মা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে অপরিণত শিশু প্রসব ও শিশুর সংক্রমণ হতে পারে। মায়ের মারাত্মক জন্ডিস হলে গর্ভস্থ শিশু মারাও যেতে পারে।
প্রত্যেক গর্ভবতী মায়ের হেপাটাইটিস পরীক্ষার কথা বলা থাকলেও সবার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে জন্য এই টেস্ট ফ্রি করে দিতে হবে। একজন নারীর গর্ভকালের চেয়ে আগেই হোপাটাইটিসের টিকা দেওয়া ভালো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হলো: হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের শিশুকে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দিতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিন দিতে হবে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। এসব ক্ষেত্রে আমরা হেপাটোলজি বিশেষজ্ঞ ও অন্য সব বিভাগের বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাজ করি।
এই ভ্যাকসিন ৩ পর্যায়ে গর্ভবতী নারীদের দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিশোরী বয়সে যখন টিটেনাস টিকার ৫ ডোজ দেওয়া হয়, তখন হেপাটাইটিসের দুই ডোজ টিকা দেওয়া যেতে পারে। সেটা না দেওয়া থাকলে যখন দম্পতিরা প্রেগনেন্সি কাউন্সেলিংয়ের জন্য আসেন, তখন দুইডোজ টিকা দেওয়া যেতে পারে। তা না হলে যখন একজন গর্ভবতী মা অ্যান্টিন্যাটাল চেকআপে আসবেন, তখন ১২ সপ্তাহ পর থেকে হেপাটাইটিস বি-এর টিকা দুই ডোজ দেওয়া যাবে।
আমাদের দেশে একটি ধারণা প্রচলিত আছে, গর্ভবতী নারীরা কোনো টিকাই গ্রহণ করতে পারবেন না। এটা ভুল ধারণা। মানুষকে এটা বোঝাতে হবে, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা মা কিংবা শিশু, কারও ক্ষতি করে না। আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল করতে হবে, তা সফল করতে হলে গর্ভবতী সব মাকে হেপাটাইটিসমুক্ত রাখা জরুরি।
অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক
সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সব সময় প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধে গুরুত্ব দেয়। মা থেকে শিশুর হেপাটাইটিসবি প্রতিরোধ করতে হলে কিছু বিষয় জানা দরকার। সবাই সচেতনতার কথা বলি। কিন্তু একই সঙ্গে আরও একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো জনসম্পৃক্ততা। কিন্তু জনসম্পৃক্ততা বিষয়টি তেমন আলোচনায় আসে না। সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকার জন্য এসব হয়।
কিশোরী ও আগামী দিনের মায়েদের সচেতন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যায়ক্রমে দেশের সব স্কুলে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হেপাটাইটিস ও রিপ্রোডাকটিভ হেলথ নিয়ে এক ঘণ্টার এক সেশন নেওয়া যেতে পারে। স্কুলের এসব মেয়ে যখন মা হবে, তখন তারা ভাইরাল হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতন থাকবে। এরা সচেতন হলে নিজেরা নিয়ম মেনে চলবে এবং অন্যদেরও সচেতন করবে। স্কুল হেলথের বিষয় আপনাদের একটা উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। হেপাটাইটিস প্রতিরোধে অন্যান্য কাজের মধ্যে এটা খুবই কার্যকর উদ্যোগ হবে বলে মনে করি।
শরীরে ট্যাটু করা, নাক-কান ফোঁড়ানো থেকেও হেপাটাইটিসের সংক্রমণ হতে পারে। নিরাপদ যৌন আচরণ না করলে হেপাটাইটিস হতে পারে।
গ্লোবাল হেলথ সেক্টর স্ট্র্যাটেজির তথ্যমতে, ভাইরাল হেপাটাইটিস, সেক্সচুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ ও এইচআইভি—এই তিনটি রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
২০৩০ সালের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূল করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মূল করতে হলে কোন বছর কী করতে হবে, সেটা ঠিক করে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রিভেনশন স্ট্র্যাটেজি, টেস্টিং স্ট্র্যাটেজি, জেলা উপজেলায় স্ক্রিনিংয়ের স্ট্র্যাটেজি নিতে হবে। বিভিন্ন সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে স্কেল আপ করতে হবে। এভাবে নানা উদ্যোগের মাধ্যমে ২০৩০ সালের লক্ষ্য অর্জন করার পথে এগিয়ে যেতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী
মহাসচিব, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ
শিশু জন্মের ৬ মাসের মধ্যে হেপাটাইটিস বি-এর সংক্রমণ হলে তাদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস হতে পারে। প্রাপ্ত বয়সে যাদের হেপাটাইটিস বি-এর সংক্রমণ হয়, তাদের ২৬ শতাংশ লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার হতে পারে। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত মায়ের গর্ভবতী সন্তানও হেপাটাইটিসে সংক্রমিত হতে পারে। যেসব দেশে হেপাটাইটিস বি ২ শতাংশের বেশি, সেসব দেশে মা থেকে সন্তানের এই ভাইরাস প্রতিরোধ জরুরি। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের হার প্রায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
সংক্রমণ প্রতিরোধে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দিতে হবে। বার্থ ডোজ দিতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের মধ্যে ৮টি দেশ বার্থ ডোজ দিচ্ছে। বাংলাদেশেও বার্থ ডোজ দেওয়া জরুরি। বিশ্বের যত দেশ হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ প্রতিরোধে সফলতা অর্জন করেছে, এরা সবাই বার্থ ডোজ দিয়েছে।
বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মা থেকে সন্তানের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে প্রত্যেক গর্ভবতী মায়ের হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা করতে হবে। আক্রান্ত মায়েদের সঠিক চিকিৎসা দিতে হবে। নবজাতক জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। নারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থলে হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারী সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞরা হেপাটাইটিস বি সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। মিডওয়াইফদের হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের বিষয়ে সচেতন করা জরুরি, যেন তাঁরা নবজাতককে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দিতে পারেন।
বাংলাদেশে প্রায় অর্ধেক মানুষ গ্রামে বাস করে। গর্ভকালীন হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। কুসংস্কার ও ভ্যাকসিন-ভীতি দূর করতে হবে। হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন সহজলভ্য করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক পরিসংখ্যান করতে হবে।
ডা. মো.সাইফুল ইসলাম এলিন
আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা, বাংলাদেশ। লিভার বিশেষজ্ঞ, বিএসএমএমইউ
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস যেকোনো বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। একিউট হেপাটাইটিসের ৩৫%, ক্রনিক হেপাটাইটিসের ৭৫%, লিভার সিরোসিসের ৬০% এবং লিভার ক্যানসারের ৬৫%-এর জন্য এখনো হেপাটাইটিস বি ভাইরাস দায়ী।
বাংলাদেশে ২০০৩ সাল থেকে প্রথম ইপিআই কর্মসূচিতে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনকে যুক্ত করা হয়। এর পর থেকে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমতে দেখা যায়। আমরা যদি একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্তের হার ছিল ৯.৭%, সেখানে বর্তমানে এই হার এসে দাঁড়িয়েছে ৫.১%।
২০১৮ সালে দেশব্যাপী অধ্যাপক শাহিনুল আলমের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, হেপাটাইটিস বিতে আক্রান্ত জনসংখ্যা প্রায় ৫.১%, আক্রান্তের দিক থেকে পুরুষের সংখ্যা নারীদের চেয়ে বেশি এবং গ্রামের মানুষের চেয়ে শহরের মানুষই অধিক আক্রান্ত। দেশের মোট জনসংখ্যা যদি আমরা ১৭ কোটি ধরি, তবে বি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮৫ লাখ। আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ৫৭ লাখ, নারীর সংখ্যা ২৮ লাখ, আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ এবং আক্রান্ত পরিবারের সংখ্যা ১৫ লাখ। বর্তমানে চাকরিপ্রার্থী, কর্মক্ষম ১৫-৩০ বছর বয়সী পুরুষ ও নারীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ হলেই চাকরিতে অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে, যেটা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। ১৮-৪৫ বছর বয়সী প্রজননসক্ষম নারীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ।
অপরদিকে লিভারের জন্য আরেকটি ক্ষতিকর ভাইরাস হচ্ছে হেপাটাইটিস সি। লিভার সিরোসিসের ৩০% এবং লিভার ক্যানসারের ১৭%-এর জন্য দায়ী হেপাটাইটিস সি। তাই হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি উভয় ভাইরাস বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।
অধ্যাপক ডা. মো.আকমত আলী
কার্যকরী সদস্য, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, আদ-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস বি এক নীরব ঘাতকের নাম। ক্রনিক হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস, লিভার ফেইলিউর ও লিভার ক্যানসারের মতো মারাত্মক জটিলতার জন্য এই হেপাটাইটিস বি অন্যতম প্রধান কারণ বলে ধরা হয়। হেপাটাইটিস বি সংক্রমিত মানুষের রক্তের মাধ্যমে এই ভাইরাস যেমন ছড়ায়, তেমনি গর্ভবতী মায়ের থেকেও সন্তানের দেহে প্রবেশ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে শুধু শিশুর জন্মের সময় মায়ের থেকে ছড়ায় তা নয়, মায়ের গর্ভে থাকাকালীন এই ভাইরাস শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই ভাইরাস নবজাতক শিশুর শরীরে প্রবেশ করলে প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি হতে পারে। অসংক্রমিত মায়ের হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়ার মাধ্যমে মায়ের প্রতিরোধ সম্ভব। আবার হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মায়ের গর্ভকালীন অবস্থায় ওষুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে এবং জন্মগ্রহণের পরপরই শিশুকে হেপাটাইটিস বি ইমুনোগ্লোবুইলিন ইনজেকশনের মাধ্যমে দিলে শিশুর দেহে হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ
প্রতিরোধ সম্ভব।
এখন কথা হলো, এসব তথ্য মানুষ অল্প সময়ে জানবে কীভাবে? এ অবস্থায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইপিআই, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবহার, ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ওরস্যালাইনের ব্যবহার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণমাধ্যম অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। এখন গণমাধ্যম আগের চেয়ে অনেক বিস্তৃত ও শক্তিশালী। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে আজ আমাদের প্রত্যাশা রইল, গর্ভবতী মায়ের মাধ্যমে শিশুর শরীরে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গণমাধ্যম আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। যথাযথ প্রচারের ফলে জাতি হেপাটাইটিস বি–মুক্ত নবজাতককে স্বাগত জানাবে, ভবিষ্যতে সুস্থ সমাজের অংশ হয়ে দেশ পরিচালনা করবে, বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে এই প্রত্যাশা রইল।
ডা. এস কে এম নাজমুল হাসান
কার্যকরী সদস্য,হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ
বাংলাদেশে চিকিৎসা বাবদ রোগীদের আউট-অফ-পকেট ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের (বিএনএইচএ) রিপোর্ট অনুসারে, মোট আউট-অফ-পকেট ব্যয়ের প্রায় ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ ওষুধে, ১১ দশমিক ৭ শতাংশ রোগনির্ণয়ে খরচ করা হয়। তাই দরিদ্র মানুষের জন্য বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ওষুধ প্রদান করা রোগীদের ওপর অতিরিক্ত খরচের বোঝা কমানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত আন্তর্জাতিক সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং এনজিওগুলোর কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবার জন্য সহায়তা পেয়ে থাকে। এই পার্টনারশিপের একটি অংশ হিসেবে বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে ওষুধ প্রদানের উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৯৩ সাল থেকে যক্ষ্মা রোগীকে বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদান করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে অদ্যাবধি এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৭টি সরকারি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক মেডিকেল কলেজে লিভার বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই মেডিকেল কলেজগুলোতে অতি সত্বর লিভার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে এবং যেসব জেলায় মেডিকেল কলেজ নেই, সেখানে কনসালট্যান্ট পদ সৃষ্টি করে লিভারবিশেষজ্ঞকে পদায়িত করতে হবে, যাতে তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ হেপাটাইটিস রোগী শনাক্ত করতে পারেন।
সরকার নিজ উদ্যোগে এবং এনজিওর মাধ্যমে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের বিনা মূল্যে ওষুধ ওসেবা প্রদান করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সমন্বিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আমরাও সেই লক্ষ্যের দিকে পৌঁছাতে পারব।
ডা. মোহাম্মদ কামরুল আনাম
কার্যকরী সদস্য, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
লিভার বিশেষজ্ঞ, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
আমরা জানি, নারী ও শিশুর এইচআইভি সংক্রমণের বেশির ভাগই হয়ে থাকে মূলত ভার্টিক্যাল ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে অর্থাৎ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় অথবা এর সামান্য অব্যবহিত পরে আক্রান্ত মায়ের থেকে। এতে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি–তে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি, যা সদ্য ভূমিষ্ঠ সংক্রমিতদের ক্ষেত্রে ৯০%, ১-৪ বছর বয়সের সংক্রমিতদের ক্ষেত্রে ৩০%। অথচ সংক্রমিত বড়দের ক্ষেত্রে যা ৫% –এর নিচে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গ্লোবাল হেলথ সেক্টর স্ট্যাটেজিতে হেপাটাইটিস বি নির্মূলের জন্য হেপাটাইটিস বি আক্রান্তের ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ০.১% কমিয়ে আনার কথা বলেছে।
মূলত দুভাবে মা থেকে শিশুতে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। সব গর্ভবতী মায়ের গর্ভাবস্থার একদম শুরুতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এইচআইভি, সিফিলিস ও এইচবিএসএজি (HBsAg) পরীক্ষা করতে হবে। এইচবিএসএজি পজিটিভ মায়েদের মধ্যে যাঁদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন হবে, তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। যে সব নারী পরবর্তী সময়ে আরও সন্তান নিতে চান, তাঁদের ক্ষেত্রে TDF Prophylaxis বিরতি ছাড়া পরবর্তী গর্ভাবস্থাসমূহতেও কিংবা সন্তান জন্মদানে সক্ষম বয়স পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হচ্ছে: নবযাতক শিশুদের হেপাটাইটিস-বির প্রথম ডোজ টিকা জন্মের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে আরও দুটি টিকা দিতে হবে চার সপ্তাহ বিরতিতে। এভাবে টিকাপ্রাপ্ত অন্তত ৯৫% শিশু হেপাটাটিস বি সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।