প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ছাড়া বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। সঠিক কাজ করার উপযুক্ত সময় এখনই।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ছাড়া বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অতীতের ব্যর্থতা বা ভুল শোধরানোর এখনই উপযুক্ত সময়।
রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল শনিবার ‘বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর্ক ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিশনের সদস্য, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, গবেষক, সাবেক আমলা ও সরকারের কর্মকর্তারা বক্তব্য দেন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস সামনে রেখে এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়। দিবসটি ১২ ডিসেম্বর।
বৈঠকে একাধিক অংশগ্রহণকারী বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা দূর করার সুযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের আছে। তাঁরা জোর দিয়ে বলেন, একদিকে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে, অন্যদিকে পাওয়া বরাদ্দ সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করার দক্ষতাও অর্জন করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে আয় শ্রেণিতে অথবা গ্রাম ও শহরে যেসব বৈষম্য আছে, তা দূর করতে হবে। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির (এসএসকে) দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকের শুরুতে আর্ক ফাউন্ডেশনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো দীপা বড়ুয়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত পরিস্থিতি একটি উপস্থাপনায় তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি ছয়টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। বিষয়গুলো হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি, অসংক্রামক রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য, অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হ্রাস, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন, ডিজিটালাইজেশন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
দীপা বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশে ৬৭ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগের মতো অসংক্রামক রোগে। অথচ অসংক্রামক রোগ বিষয়ে সরকারের বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। দেশের বহু মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ অবস্থায় থাকলেও এ বিষয়ে বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের ১ শতাংশের কম। অন্যদিকে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে এর কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। ২০১৯ সালে শুধু এ কারণেই দেশে ২৬ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ হয় স্বাস্থ্য খাতে। এই বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার সব কটি দেশের তুলনায় কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে দুই ধরনের ব্যর্থতা দেখা গেছে—নিয়ন্ত্রণজনিত ব্যর্থতা এবং ব্যবস্থাপনা–সম্পর্কিত ব্যর্থতা। অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুটি বিভাগ, মহাপরিচালকদের কাজে সমন্বয়হীনতা, জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠা, গবেষণার ফলাফল কাজে না লাগা, লাগামহীন ওষুধ কোম্পানি—এগুলো নিয়ন্ত্রণজনিত ব্যর্থতার উদাহরণ। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মাঠপর্যায়ে—কোথাও ব্যবস্থাপনা নেই।’ চিকিৎসকদের ‘ক্যারিয়ার’ তৈরির ক্ষেত্রেও অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মু. হুমায়ুন কবির বলেন, মোটাদাগে গ্রাম ও শহরে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিভাজন দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানে চাপ বেশি, কাজের দ্বৈততা আছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে যাঁরা সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। অনেক স্থানে ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো প্রায় অকেজো অবস্থায়, অনেক স্থানে পদ খালি। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুটি বিভাগ করে একজন সচিবের পদ তৈরি হওয়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বেশ কিছু এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) হতে দেখা যাচ্ছে। এমআইএস আর ডিজিটাল হেলথ এক জিনিস নয়। কিন্তু দরকার ডিজিটাল হেলথ। দ্রুত না করা হলে দেশ এর সুফল পাবে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, শহর বা গ্রামের মানুষকে বাইরে রেখে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব নয়। নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির মাধ্যমে শিশু, নারী ও পুষ্টিসেবা দেওয়া হয়। এই সেবা দেওয়া হয় দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের। শহরের মধ্যবিত্তরাও এই সেবার বাইরে। এর অর্থ নগরের বহু মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা হচ্ছে উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কৌশল দরকার। স্বাস্থ্যে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমানোর জন্য ব্যক্তি বিমা নাকি জাতীয় বিমা সঠিক, তা নিয়ে আরও আলোচনা দরকার। সেবার মান তত্ত্বাবধান অনলাইনে করা ঠিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংখ্যাগত বিষয় অনলাইনে দেখভাল করা যায়, কিন্তু সেবার মান দেখতে হবে সরেজমিন।
এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির সাবেক পরিচালক খালেদা ইসলাম বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে ২০১৬ সালে করা অত্যাবশ্যকীয় সেবার প্যাকেজকে হালনাগাদ করতে হবে।
নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, গত শতকের ষাটের দশকে থাইল্যান্ড সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার উদ্যোগ নিলে বিশ্বব্যাংক তার বিরোধিতা করেছিল। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, থাইল্যান্ডের অর্থনীতি শেষ হয়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি। বরং দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক আস্থা বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন নতুন সুযোগ তৈরি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, স্বাস্থ্য প্রশাসন পুনর্গঠন করতে হবে, বিনা মূল্যে ওষুধ দিতে হবে, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে নিয়মনীতির মধ্যে আনতে হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ের কমিটিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
আইসিডিডিআরবির মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক শামস এল আরেফিন বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়টি কম গুরুত্ব পায়। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রণের স্থান যত বেশি থাকবে, তত অনিয়ম বাড়বে।
বিশ্বে বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে চার ধরনের বিমাব্যবস্থা আছে উল্লেখ করে এফসিডিওর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা রাশিদ জামান বলেন, প্রাইভেট সেক্টরকে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে, তাদের জন্য নীতি করতে হবে, তাদেরকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ফোকাল পয়েন্ট সুব্রত পাল বলেন, স্বাস্থ্যে ব্যক্তির ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ ব্যয় করেন সমাজের সবচেয়ে উচ্চবিত্তরা। সুতরাং দৃষ্টি দিতে হবে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের দিকে। লক্ষ রাখতে হবে স্বাস্থ্য ব্যয় করতে গিয়ে কেউ যেন দরিদ্র হয়ে না পড়েন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আয়োজক সংগঠন আর্ক ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক বলেন, জেলা বা বিভাগ, আয় শ্রেণি বা গ্রাম ও শহরে যে বৈষম্য, তা দূর করতে হবে। নারী স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে নীতি কী হবে, তা ঠিক করা দরকার।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।