ডা. আনোয়ারুল কবীর
পরিচালক (স্বাস্থ্য), রাজশাহী বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
অধ্যাপক ডা. মো. জহিরুল হক
ভাইস প্রিন্সিপাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
ডা. মো. সাইফুল ইসলাম
বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি
অধ্যাপক ডা. সমীর মজুমদার
রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ, বারিন্দ মেডিকেল কলেজ
ড. কাজী শুসমিন আফসানা
সহযোগী অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুস সালাম
রেজিস্ট্রার, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. খাদিজাতুল কোবরা সম্পা
মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুশন অফিসার, তিলোত্তমা টিবি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম
মো. সাইফুল ইসলাম
বিভাগীয় ব্যবস্থাপক, ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচি
মাসুদ রানা
অফিসার, কর্পোরেট উইং, ইবনে সিনা ট্রাস্ট রাজশাহী
ডা. মো. মাসুদুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
জি এ রায়হান
সিনিয়র অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার,
ইবনে সিনা ডিজিটাল ল্যাব.
ডা . অং ক্য জাই মগ
চিফ অব পার্টি, ইউএসএআইডি'স এসিটিবি, আইসিডিডিআরবি
ডা. আদিল সিকদার
সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, আইসিডিডিআরবি
সঞ্চালক
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
ডা. আনোয়ারুল কবীর
পরিচালক (স্বাস্থ্য), রাজশাহী বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
যক্ষ্মা নিরসনে ডটস ও টিবি প্রিভেনটিভ থেরাপি রয়েছে। যক্ষ্মাবিষয়ক অনেক ডিভাইস, টুলস ও পদ্ধতির উন্নয়ন হয়েছে। এরপরও যক্ষ্মা নিয়ে আতঙ্কের একটা জায়গা রয়ে গেছে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত না হলে এ ব্যথা বোঝা যায় না। যক্ষ্মা হলে সবাই তা প্রকাশ করতে চায় না। ফলে সে যক্ষ্মা ছড়াতে থাকে। এ জন্য সচেতনতা তৈরি খুবই জরুরি।
যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এর অনেক ভালো দিক আছে। কিন্তু একেবারে অবারিত করে দেওয়া কি ঠিক হবে? এমনভাবে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে হবে, যাতে চিকিৎসার গুণগত মান ঠিক থাকে। সরকারিভাবে শিশুদের যক্ষ্মার টিকা বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি পর্যায়ে টিকাদানের ক্ষেত্রে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বেসরকারি খাতেও এই মান বজায় রাখতে হবে। লাভের বাইরে গুণমান ও সেবা নিশ্চিত করা এবং উদ্যোগী হয়ে কাজ করা, এসব মাথায় রেখে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে হবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে বেসরকারি পর্যায়ে যক্ষ্মা চিকিৎসায় হযবরল অবস্থা না হয়।
রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। আবার অনেক জায়গায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দেওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল এক্স–রে মেশিন প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। এগুলো ভালো দিক। বিশেষজ্ঞদের কাছে যক্ষ্মা ঠেকানোর জন্য নতুন কোনো পথ বের করার অনুরোধ রইল। ডটস ও যক্ষ্মা প্রতিরোধী থেরাপি নিয়ে আরও ভাবার সুযোগ আছে।
সরকারি কার্যক্রমগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সুন্দর একটা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। তাদের জবাবদিহির জায়গা আছে। বেসরকারি খাতে সব ক্ষেত্রে এ জবাবদিহি নেই। জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়, এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ভাবতে হবে।
ভাইস প্রিন্সিপাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
রাজশাহী স্থানীয়, জেলা, উপজেলা ও বিভিন্ন পর্যায়ে যক্ষ্মারোগীরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই রোগ নির্ণয় করেন। তাই যক্ষ্মা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ভূমিকাই বেশি। রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ভূমিকা আরও বাড়ানো
যেতে পারে।
বেশির ভাগ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আইসিডিডিআরবি রাত আটটা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করেন। অন্য অংশীদারেরাও এ রকম সময় নির্ধারণ করতে পারেন। এর একটি ইতিবাচক ফল আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ সময়কাঠামো পরিবর্তন করা একটু কঠিন। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তা অত জটিল নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিকেল থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু করলে বেশ ভালো ফল আসবে বলে আশা করা যায়। এ সময়কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে।
ডটসের ওষুধ প্রদানও বিকেলে করা যেতে পারে। তাহলে রোগীর একটি ‘ওয়ার্কিং ডে’ নষ্ট হবে না। সন্ধ্যায় এ চিকিৎসাবিষয়ক কার্যক্রম করা গেলে রোগী তাঁর দিনের অন্যান্য কাজ করতে পারবেন।
অশ্বাসতন্ত্রীয় যক্ষ্মা (এক্সট্রা পালমোনারি টিবি) নির্ণয়ে খুবই সমস্যায় পড়ি। শ্বাসতন্ত্রের যক্ষ্মা শনাক্তকরণ অনেক সহজ। কিন্তু অশ্বাসতন্ত্রীয় যক্ষ্মা শনাক্তকরণ বেশ কঠিন ও ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত সহায়তা করলে শনাক্তের বাইরে থাকা অনেক রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অশ্বাসতন্ত্রীয় যক্ষ্মা শনাক্তের সামর্থ্য থাকে না। তখন আমরা সরাসরি যক্ষ্মার ওষুধ দিয়ে দেখি তা কাজ করে কি না। এতে রোগীর শরীরে ওষুধ প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে এনজিওগুলো এসব রোগীর খরচ বহনে সহায়তা করার চেষ্টা করতে পারে।
বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি
বাংলাদেশ সরকার জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মাধ্যমে এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে ডটস সেন্টারের মাধ্যমে যক্ষ্মা শনাক্ত ও চিকিৎসা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাত সরকারি খাত থেকে খুব বেশি আলাদা করা যায় না।
যক্ষ্মা শনাক্তে এখন আমাদের অনেক উন্নত যন্ত্রপাতি রয়েছে। মাইক্রোস্কোপিক এক্স-রে, মলিকুলার টুলস রয়েছে। আমাদের ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোগ রয়েছে। এই মেশিনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের বুকের এক্স-রে করা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে রোগীর যক্ষ্মা আছে কি না, সে বিষয়ে একটি পরামর্শ পাওয়া যায়। এ ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আমাদের কাছে রয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও চিকিৎসা খাতে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। রাজশাহীতেও এ সংখ্যা অনেক। আমার জানামতে রাজশাহীতে জিন এক্সপার্ট বা মলিকুলার প্রযুক্তি নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিও হয়তো নেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বেসরকারি খাতে যক্ষ্মা শনাক্ত হলে বাধ্যতামূলকভাবে কাছাকাছি সরকারের ডটস সেন্টারে রেফার করতে হবে। এক্স–রে এখন স্বল্পমূল্যে করা যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে রোগীর আর্থিক সহায়তার জন্য বেসরকারি খাতগুলো এগিয়ে আসতে পারে। আমরা জেলা পর্যায়ে অ-শ্বাসতন্ত্রীয় যক্ষ্মার নমুনা সংগ্রহ করে জিন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে যক্ষ্মা শনাক্ত করছি। এটি একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। ভবিষ্যতে উপজেলা পর্যায়েও হয়তো জিন এক্সপার্টের মাধ্যমে অ-শ্বাসতন্ত্রীয় যক্ষ্মা শনাক্ত করতে পারব।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে সামাজিক সহায়তা কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। বেসরকারি ডাক্তাররা আন্তরিক হয়ে রোগীদের আমাদের নেটওয়ার্কের মধ্যে এনে দিলে এই খরচটা ভাগাভাগি করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে এই কার্যক্রম আরেকটু বাড়ানো গেলে ভালো হতো। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত জানালে ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে।
রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ, বারিন্দ মেডিকেল কলেজ
সরকারি ও বেসরকারি সব খাতেই যক্ষ্মা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা চলছে। তবে বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোতে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি জোরালোভাবে চালু নেই। আমাদের সমস্যাগুলো সার্বিকভাবে বুঝতে না পারলে যথাযথ পরিকল্পনা করা কঠিন।
যক্ষ্মার চিকিৎসায় সব কটি খাতকে শুধু অন্তর্ভুক্ত করলেই হবে না। যক্ষ্মার চিকিৎসাবিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালাও তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা দরকার। যক্ষ্মার সর্বাধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে সিনিয়র চিকিৎসকেরা জানলেও জুনিয়র চিকিৎসকেরা ঠিকমতো জানেন না।
বেসরকারি চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদানকারীদের অন্তর্ভুক্ত ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। তাঁদের কাছে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির নির্দেশিকা পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন।
বেসরকারি খাতে ডটস কর্নার করা গেলে রোগীদের ভোগান্তি কম হবে। সেখানেই যক্ষ্মা শনাক্ত করা যাবে। যত দ্রুত যক্ষ্মা শনাক্ত করা যাবে, তত দ্রুত যক্ষ্মা সংক্রমণ কমানো যাবে। ডায়াবেটিস, বয়স বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে যক্ষ্মা হতে পারে।
যক্ষ্মায় ভারাক্রান্ত ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। এটি উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ করলে উন্নয়ন সহযোগীদের সাহায্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে জন্য এখনই আমাদের শক্ত হয়ে দাঁড়ানো দরকার। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো বেসরকারি খাতসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত করা।
সহযোগী অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জনসচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে নাট্যকলা বা নাটক খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটা বিষয় খেয়াল করুন, ৩০ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী শনাক্তের বাইরে রয়েছে, যেটা এই আলোচনায় উঠে এসেছে। এই ৩০ শতাংশ মানুষ কমিউনিটির অন্যদের মধ্যে অসচেতনভাবে যক্ষ্মা সংগ্রমণ করছেন। এটা ভীষণ উদ্বেগের বিষয়। তাঁদের সচেতনতা তৈরির জন্য নাট্যকলা কাজ করতে পারে। উন্নয়ন নাটক বলে নাটকের একটা ফর্ম আছে।
উন্নয়ন মানে মানবিক এবং কাঠামোগত উন্নয়ন। আর উন্নয়ন নাটক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানবিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এই নাটকে অভিনেতারা সরাসরি দর্শকের সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করেন। দর্শকরাই সমস্যার সমাধান বিষয়ে ধারণা দিয়ে থাকে।
জানামতে ঘনবসতি অঞ্চলে এ রোগের প্রবণতা বেশি। এসব জায়গায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো ছোট ছোট দল করে উন্নয়ন নাটক মঞ্চায়ন করতে পারে। সচেতনতা তৈরিতে থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্ট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমাদের মধ্যে ডাক্তারের কাছে না যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। ডাক্তারের কাছে যেতে না চাওয়া জনগোষ্ঠীকে সচেতন করার মাধ্যমে আগেই এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। উন্নয়ন নাট্যের পাশাপাশি ভিজ্যুয়াল মিডিয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ‘যক্ষ্মা ভালো হয়’ এ রকম একটি প্রচারণা
আগে টিভিতে খুব প্রচারিত হতো। কিন্তু যক্ষ্মা যেন না হয়, সে–বিষয়ক প্রচারণাও বেশ জরুরি।
অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে রোগীদের বারবার জানানো প্রয়োজন। মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমরা ফেসবুককে ব্যবহার করতে পারি। সেখানে রিলস ভিডিওর মাধ্যমে যক্ষ্মাবিষয়ক সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে।
রেজিস্ট্রার, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
যক্ষ্মাবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি অংশীজনেরা পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, যক্ষ্মা চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। যক্ষ্মার চিকিৎসা সর্বাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জানাতে হবে।
আমাদের সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় শুরু হয়েছে। এটাকেও শক্তিশালী করার সুযোগ রয়েছে। চিকিৎসাসেবার সুবিধাগুলো শুধু আইসিডিডিআরবির ঢাকা অফিসে থাকলেই চলবে না। এটাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই এ বিষয়ক কার্যক্রমগুলোর গতি বাড়বে। আইসিডিডিআরবি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সৃষ্টিলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিকভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। যক্ষ্মা আইসিডিডিআরবির একটি অগ্রাধিকার খাত। যক্ষ্মাবিষয়ক গবেষণায় আইসিডিডিআরবিকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রতিকারের পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গবেষণায় আরেকটু গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।
পুষ্টির সঙ্গে যক্ষ্মা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এটিকে জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে ভালো হয়। যেন চিকিৎসার আওতায় থাকা প্রান্তিক রোগীদের পুষ্টি সহায়তা দেওয়া যায়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় অপুষ্টিকে আরও জোরালোভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। জানাও অ্যাপটি বেশ কার্যকর বলে মনে হলো। এটার বিস্তৃতি ঘটানো দরকার। যেন চিকিৎসকেরাও এই অ্যাপের যথাযথ সুবিধা নিতে পারেন।
যক্ষ্মা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ চিকিৎসা খাতে বৈশ্বিক সহায়তাও আছে। কিন্তু যক্ষ্মা শনাক্তকরণ থেকে চিকিৎসা—সব বিনা মূল্যে করার ব্যবস্থার বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। তাহলে মানুষ চিকিৎসায় উৎসাহী হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া ২০৩৫ সালের অভীষ্ট অর্জন দুরূহ ব্যাপার।
অফিসার, কর্পোরেট উইং, ইবনে সিনা ট্রাস্ট রাজশাহী
আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে এ–সংক্রান্ত পরীক্ষাগুলো কম খরচে করার সুযোগ দিয়ে ভূমিকা রাখি। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের কিছু সামাজিক দায়িত্বও রয়েছে।
আমরা যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে আইসিডিডিআরবির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। বেসরকারি খাত হিসেবে তথ্য-উপাত্ত ও সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে আমরা সচেষ্ট আছি। আমরা এ বছরের মধ্যে রাজশাহীতে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করার পরিকল্পনা করেছি।
আমরা জিন এক্সপার্ট মেশিনসহ অত্যাধুনিক অন্যান্য মেশিন ব্যবহার করছি। এক্স–রে মেশিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যোগ করার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। খুব দ্রুতই আমাদের রাজশাহী কেন্দ্রগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সুবিধা দেওয়া যাবে।
বিভিন্ন রেফারেন্সে আমাদের কাছে অনেক রোগী আসেন। পরীক্ষা করে অনেকেই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হন। রোগীদের টেস্ট রিপোর্ট দেওয়ার পরে তাঁরা চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন কি না, সে বিষয়ক তথ্য আমাদের কাছে থাকছে না। তাই যক্ষ্মা শনাক্ত রোগীদের জন্য আলাদা তথ্যভান্ডার করা উচিত।
করোনাকালে আমরা প্রতিদিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা একটি প্রতিবেদনে সিভিল সার্জনের কাছে জমা দিতাম। তেমনি যক্ষ্মা শনাক্তের ক্ষেত্রেও এ রকম কোনো উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন না হলেও অন্তত সপ্তাহে একবার যক্ষ্মা শনাক্ত রোগীদের প্রতিবেদন তৈরি করে আইসিডিডিআরবি বা এ ধরনের অন্য প্রতিষ্ঠানে জমা দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে ভেবে দেখা দরকার।
মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুশন অফিসার, তিলোত্তমা টিবি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম
আমরা সিটি করপোরেশনের মোট ১০টি ওয়ার্ডে কাজ করি। আমাদের কাজ ১০টি ওয়ার্ডে সীমাবদ্ধ। আমরা সরকারি-বেসরকারি ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করি। আমাদের এখানে কমিউনিটি পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। তাঁরা স্থানীয়পর্যায়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের যক্ষ্মা শনাক্তকরণে সহায়তা করেন। যক্ষ্মা শনাক্ত হলে আমরা রোগীদের বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদান করে থাকি।
আমাদের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের রোগীকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আনার ভাড়াও দিয়ে দেওয়া হয়। যক্ষ্মা রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। ব্র্যাক, আইসিডিডিআরবি ও ডটস সেন্টারের সমন্বিত উদ্যোগে এ কাজগুলো করা হয়। যক্ষ্মা শনাক্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য আমরা কাউন্সেলিং করি। রোগীকে যক্ষ্মা চিকিৎসাসেবার গুরুত্ব বুঝিয়ে চিকিৎসাসেবার আওতায় নিয়ে আসি। যক্ষ্মা শনাক্ত রোগী হিসেবে নিবন্ধন করেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। রোগীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়। তবু আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিদর্শন করেন। সে ক্ষেত্রে অনেক বাসা বা পরিবার তাঁদের প্রবেশের অনুমতি দেয় না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে সহজে পৌঁছানো যায়, কিন্তু বিত্তশালী পরিবারে অত সহজে পৌঁছানো যায় না। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের চিকিৎসকদের ভূমিকা রয়েছে। কারণ, নিয়মিত বিরতিতে এসব মানুষেরা তাঁদের থেকে চিকিৎসা নেন। তাই সন্দেহভাজন রোগীদের রেফার করার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা রয়েছে। আমরা বেসরকারি খাতের চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। এখানে সমন্বয় আরেকটু বাড়াতে পারলে ‘মিসিং কেসগুলো’ চিকিৎসার আওতায় আসবে। আমরা ইতিমধ্যে সুপ্ত যক্ষ্মা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। চিকিৎসকেরা সুপ্ত যক্ষ্মা রোগীদের আমাদের কাছে যথাযথভাবে রেফার করলে যক্ষ্মা নিরসনের ফাঁক কমে আসবে।
বিভাগীয় ব্যবস্থাপক, ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচি
ব্র্যাক বাংলাদেশ সরকার ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ৬৪টি জেলায় কাজ করছে। বাংলাদেশের ৫১টি জেলায় ব্র্যাক সরাসরি কাজ করে। বাকি ১৩টি জেলায় সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করে।
৭০ শতাংশ যক্ষ্মারোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে। বাকি ৩০ শতাংশ রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এসব রোগী কমিউনিটিতে বসবাস
করছেন। তাঁরা এ রোগটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে নতুন করে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ৩০ শতাংশ রোগীকে শনাক্ত করতে না পারলে যক্ষ্মা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এখানে বেসরকারি খাত আগের চেয়ে অনেক বেশি যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এ জায়গায় আরও কাজ করার
সুযোগ রয়েছে।
ডটস কর্নার চালু করার বিষয়টি এসেছে। আমরা বেশ কিছু ডটস কর্নার চালু করেছি। এখানে আমাদের আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস লাগবে। প্রয়োজনীয় জনবল ব্র্যাক বা অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রদান করবে। যক্ষ্মারোগীর পরিবারের অন্য সদস্যদের যক্ষ্মা প্রতিরোধে থেরাপি দেওয়া হচ্ছে—টিভিতে এ ধরনের প্রচারণা চালানো দরকার। সরকার সামাজিক সহায়তা, পুষ্টি ও যক্ষ্মা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে নানা
রকম সাহায্য দিচ্ছে; কিন্তু এ বিষয়গুলো অনেকেই জানেন না।
এখানে চিকিৎসকের পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদেরও বিশেষ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।
সরকারিভাবে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অত্যাধুনিক জিন এক্সপার্ট মেশিন রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় সরকার এক্স–রে মেশিন দিয়েছে। এর সঙ্গে নতুনভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যোগ হয়েছে। এসব বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
সহকারী অধ্যাপক, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
রোগীর নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে এখনো কিছু সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসাকেন্দ্রে যক্ষ্মার নমুনা সংগ্রহের নির্দেশিকা সংবলিত লিফলেটগুলো দেওয়া যেতে পারে। অনেক রোগী দু–এক মাস ওষুধ সেবনের পরে সুস্থবোধ করলে আর ওষুধ সেবন করতে চান না। তাঁরা তখন আমাদের সঙ্গে
আর যোগাযোগ করেন না। এসব রোগীকে কীভাবে চিকিৎসাসেবার আওতায় নিয়ে আসতে পারি,
তা নিয়ে ভাবা জরুরি। সুপ্ত যক্ষ্মার জন্য
আমাদের চিকিৎসা চালু রয়েছে; কিন্তু সুপ্ত যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে চান না। এ বিষয়গুলো নিয়ে তাঁদের সচেতন করা গেলে
ভালো হবে।
এখন আমাদের কাছে অত্যাধুনিক জিন এক্সপার্ট আলট্রা মেশিন রয়েছে। আইসিডিডিআরবিতে আমরা সুবিধাটা পাচ্ছি। অফিস চলাকালের বাইরেও আমরা এ সুবিধা নিতে পারছি। এই সেবা চালু রেখে ছড়িয়ে দিলে আরও ভালো হবে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগনির্ণয়ের এই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দেওয়া গেলে ভালো হবে। ডটস খুবই অদ্বিতীয় একটি পদ্ধতি। এর মাধ্যমে রোগনির্ণয়–পরবর্তী চিকিৎসাসেবা খুব ভালোভাবে দেওয়া যাচ্ছে। এটা আরও শক্তিশালী করতে হবে।
যক্ষ্মা চিকিৎসার ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা তৈরিতে আমরা অনেক কার্যক্রম করতে পারি। মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় নেতাদের এসব বিষয়ে জানানো যেতে পারে। যক্ষ্মা কীভাবে ছড়ায়, কোথায় চিকিৎসা করতে হয়, কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে এ বিষয়ে কী কী সেবা রয়েছে, সেসব বিষয়ে জোর দিয়ে জানাতে হবে। এ ছাড়া যক্ষ্মার ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকেও সামনে নিয়ে আসতে হবে। তৈরি পোশাক খাত কর্মী, জেলখানা, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ চরাঞ্চলে বসবাস করা ব্যক্তিরা যেন বাদ না পড়েন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
চিফ অব পার্টি, ইউএসএআইডি'স এসিটিবি, আইসিডিডিআরবি
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সরকারি প্রচেষ্টার মাধ্যমে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে যক্ষ্মারোগের সঠিক এবং দ্রুত নির্ণয়, চিকিৎসা প্রদান ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার সুযোগ আছে।
আমরা জানি, বাংলাদেশে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যার তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। বেসরকারি খাত বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মেসি ও এনজিওগুলোর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যক্ষ্মারোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ আছে।
সরকারি খাতের একক তহবিল দিয়ে বৃহৎ পরিসরে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করতে পারে। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিজ উদ্যোগে চিকিৎসা কার্যক্রম গ্রহণ করলে আমরা কারিগরি সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারি।
বেসরকারি খাতের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা অধিক কার্যকরভাবে প্রদান করা যায়। আমরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করছি। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও আইসিডিডিআরবি বিশ্বাস করে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ অংশগ্রহণে বা পাবলিক-প্রাইভেট মিক্সের (পিপিএম) মাধ্যমে যক্ষ্মারোগের বিস্তার রোধে টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।