বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘হেপাটাইটিস বি পজিটিভ চাকরি, বিদেশ গমন বা চিকিৎসা গ্রহণে অযোগ্যতা নয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৪ জুলাই, ২০২৩। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশ হলো।
অংশগ্রহণকারী
অধ্যাপক ডা. মবিন খান
সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, হেপাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)।
অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম
সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)।
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম
সাধারণ সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ। অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ।
ডা. মো. গোলাম আযম
বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ। সহযোগী অধ্যাপক, লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী
প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম
সাবেক প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)
অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক
সাবেক উপদেষ্টা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
(দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া)
অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা
উপদেষ্টা, শিশু বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ
অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম মোস্তফা
ট্রেজারার, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ। অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বিএসএমএমইউ
ডা. মো. সাইফুল ইসলাম এলিন
লিভার বিশেষজ্ঞ, লিভার বিভাগ, বিএসএমএমইউ। আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
ডা. মো. মোতাহার হোসেন
ভারপ্রাপ্ত সহসভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
ডা. তানভীর আহমাদ
সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন), কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ঢাকা।
ডা. এস কে এম নাজমুল হাসান
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, লিভার বিভাগ, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ।
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
প্রতিবছর আমরা বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করি। হেপাটাইটিস তথা লিভারের রোগ সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা আছেন। তাঁরা এ বিষয় আলোচনা করবেন। পরামর্শ দেবেন।
ভাইরাল হেপাটাইটিস একটি মারাত্মক ব্যাধি, গোটা বিশ্বেই এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। প্রতিবছর ২৮ জুলাই ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস’ পালিত হয়৷ দিবসটির উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা।
একজন ব্রিটিশ নাগরিক মি. চার্লস গোর, যিনি ১৯৯৫ সালে হেপাটাইটিস সি–তে আক্রান্ত হন এবং পরে মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাঁর লিভার সিরোসিস রোগ শুরু হয়। ওই সময়ে হেপাটাইটিস সির চিকিৎসা নিয়ে কোনো সর্বসম্মত গাইডলাইন ছিল না। যা ছিল, তা–ও অনেক ব্যয়বহুল। কোনো গাইডলাইন না থাকায় এই রোগের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যবিমা ছিল না।
চার্লস গোর ২০০০ সালে এ রকম তিনজন রোগী নিয়ে হেপাটাইটিস সি ট্রাস্ট গঠন করেন। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের রোগীদের নিয়ে ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক হেপাটাইটিস সি সচেতনতা দিবস পালন শুরু করেন। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রোগী গ্রুপগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হেপাটাইটিস দিবস পালন করে আসছিল। ২০০৮ সালে সব কটি রোগী গ্রুপ মিলে ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স গঠন করে এবং ১৯ মে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস হিসেবে পালন শুরু করে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচারের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালের ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে হেপাটাইটিস বির আবিষ্কারক নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ঘোষণা করা হয়।
অধ্যাপক ব্লুমবার্গ হেপাটাইটিস বি আবিষ্কাকারের পাশাপাশি এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বা টিকাও আবিষ্কারক করেন, যে কারণে তিনি ১৯৭৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের অতিকার্যকরী টিকা এবং হেপাটাইটিস বি ও সির নিরাময়যোগ্য ওষুধ নাগালযোগ্য হওয়ায় ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি একটি উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব গ্রহণ করে। যেখানে ২০২০ সালের মধ্যে সদস্যদেশগুলোকে নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলা হয়, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিসকে বিশ্ব থেকে নির্মূল করা যায়। টেকসই উন্নয়ন অভীস্ট (এসডিজি) অর্জনে এটি বিবেচনা করা হয়েছে।
এ বছরের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘We are not waiting’ অর্থাৎ ‘হেপাটাইটিস নির্মূলের জন্য আমরা আর দেরি করছি না’।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এখানে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্নবিত্ত। অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের ৩৫ শতাংশ, ক্রনিক হেপাটাইটিসের ৭৫ শতাংশ, লিভার সিরোসিসের ৬০ শতাংশ এবং লিভার ক্যানসারের ৬৫ শতাংশের জন্য এখনো হেপাটাইটিস বি ভাইরাস দায়ী।
বাংলাদেশে ২০০৩ সাল থেকে প্রথম ইপিআই শিডিউলে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনকে যুক্ত করা হয়। এর পর থেকে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমতে দেখা যায়। আমরা যদি একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্তের হার ছিল প্রায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। সেখানে বর্তমানে এই হার এসে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
২০১৮ সালে দেশব্যাপী অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলমের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত জনসংখ্যা প্রায় ৫ দশমিক ১ শতাংশ। নারীদের চেয়ে পুরুষের আক্রান্তের হার বেশি। আবার গ্রাম থেকে শহরের মানুষই বেশি আক্রান্ত। দেশের ৮৫ লাখ মানুষ বি ভাইরাসে আক্রান্ত। আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ৫৭ লাখ, নারীর সংখ্যা ২৮ লাখ। আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ চাকরিপ্রার্থী, কর্মক্ষম পুরুষ ও নারী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ হলেই চাকরিতে অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে, যেটা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়।
এবারের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের থিম হলো ‘উই আর নট ওয়েটিং’ অর্থাৎ আমরা অপেক্ষা করছি না। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে ২০২৩ সাল নাগাদ হেপাটাইটিস নির্মূলের যে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি, তা যেন পিছিয়ে না যায়। হেপাটাইটিস বি এবং সি সারা বিশ্বে লিভার প্রদাহসংক্রান্ত ৯৬ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী।
এই সংক্রমণগুলো এইচআইভি, ম্যালেরিয়া এবং যক্ষ্মার মতো শীর্ষ চারটি বিশ্বজনীন সংক্রামক রোগের সঙ্গে সমতুল্য। হেপাটাইটিস শুধু বিশ্বের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও একটি বড় বোঝা। সুতরাং হেপাটাইটিস নির্মূলে আমাদের বহুমুখী কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রথমেই দরকার হেপাটাইটিস রোগীদের শনাক্ত ও রোগ নির্ণয় করা। রোগীদের চিকিত্সার অধীনে নিয়ে আসা। হেপাটাইটিস যেন না হতে পারে, সে জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমরা জানি, পৃথিবীতে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে আক্রান্ত অথচ ২৯ কোটি মানুষই জানে না যে তারা তাদের রক্তে হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস আছে। এ জন্য আক্রান্ত রোগীদের খুঁজে বের করার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হেপাটাইটিস বি এবং সি স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া সহজলোভ্য করতে হবে। জনসচেতনতার মাধ্যমে মানুষকে উক্ত ভাইরাস নির্ণয়ের জন্য উত্সাহিত করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় ধাপে, নির্ণীত রোগীদের চিকিত্সার অধীনে নিয়ে আসতে হবে। হেপাটাইটিস বি চিকিত্সায় বেসিফোভির নামে একটি নতুন ওষুধ সংযোজিত হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোগীর সেবনের জন্য ওষুধ সুলভ মূল্যে আমাদের দেশে পাওয়া যাচ্ছে।
হেপাটাইটিস বি এবং সি সংক্রমণ হ্রাস করার জন্য প্রতিরোধ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। হেপাটাইটিস বির টিকাদান হলো হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যতম সফল অস্ত্র। শিশুদের টিকাদানে বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশেও টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে হেপাটাইটিস বির প্রাদুর্ভাব অনেকটাই কমে এসেছে। হেপাটাইটিস মুক্ত করার জন্য বিনিয়োগ দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল আনবে। হেপাটাইটিস প্রতিরোধের পরিকল্পনা সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন সেক্টরের সমর্থন প্রয়োজন। পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে জনসাধারণের সচেতনতাই মূল। তাই চলুন, এই লক্ষ্যটি বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করি। চলুন, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি হেপাটাইটিস-মুক্ত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করি।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের যোগ্যতা নির্ভর করে রোগের তীব্রতা ও কাজের প্রকৃতির ওপর, অর্থাৎ কোন ধরনের কাজ করতে যাচ্ছেন, তার ওপর। ঢালাওভাবে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের যেকোনো কাজের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত করা যাবে না, যতক্ষণ না তাঁরা এই ভাইরাসের উপস্থিতির কারণে নিজেরা বা তাঁর সহকর্মীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়েন।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস মানবদেহে দুটি রোগের সৃষ্টি করতে পারে। তা হলো লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার। গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১৫-২৫ শতাংশ জীবনের যেকোনো পর্যায়ে লিভারের এই দুটি রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বাকিদের শরীরে এই ভাইরাস সারা জীবন সুপ্ত অবস্থায় কাটিয়ে দিতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসার মাধ্যমে এই ভাইরাসকে বেশির ভাগ সময়েই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমানে আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বির সব ধরনের ওষুধ বিদ্যমান। কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পূর্বে অবশ্যই একজন লিভার বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া উচিত।
যাঁরা সরাসরি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত, যেমন চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, বিশেষভাবে যাঁরা সরাসরি সার্জারি, রক্ত সঞ্চালন কিংবা প্যাথলজিক্যাল কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত থাকতে পারেন। আর যাঁরা অন্যান্য কাজে যোগদান করবেন বা করেছেন, তাঁদের শুধু দেহে বি ভাইরাসের উপস্থিতির কারণে কর্মক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচনা করা ঠিক নয়।
১৮৮৩ সালে জার্মানির ব্রিমান শিপইয়ার্ডের কর্মীদের মধ্যে জন্ডিসের প্রাদুর্ভাবের ঘটনা প্রথম সিরাম হেপাটাইটিস প্রতিবেদন হিসেবে ধরা হয়। সেখানে কর্মীদের গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু টিকা দেওয়ার এক থেকে সাত মাস পর কিছু কর্মী জন্ডিসে আক্রান্ত হন। তবে ছোঁয়াচে জন্ডিসের বিবরণ দিয়েছেন গ্রিক মহাপুরুষ হিপোক্রেটিস।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যৌনরোগ ক্লিনিকে একই সিরিঞ্জ ও সুচ দিয়ে অনেক রোগীকে ইনজেকশন দেওয়া হতো। দেখা যেত, এসব রোগীর মধ্যে কেউ কেউ এক থেকে তিন মাসের মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ধারণা করা হতো, একই সিরিঞ্জ ও সুচ ব্যবহারের কারণে এটা হয়েছে।
১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো ভাইরাসকে জন্ডিসের কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়। তবে ১৯৩৭ সালে প্রমাণিত হওয়ার আগপর্যন্ত এ ধারণাকে তেমন পাত্তা দেওয়া হয়নি। এ সময় ২ হাজার ২০০ জনকে ইয়েলো ফিভারের টিকা দেওয়া হলে দুই থেকে পাঁচ মাসের মধ্যেই ৫২ জন জন্ডিসে আক্রান্ত হন। বিভিন্ন রকম পর্যালোচনা করার পর প্রমাণিত হয় যে ইয়েলো ফিভার ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার সময় যে হিউম্যান সিরাম ব্যবহার করা হয়েছিল, তা হেপাটাইটিস ভাইরাসে সংক্রমিত ছিল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার ম্যাককালাম প্রস্তাব দিলেন, পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে যে হেপাটাইটিস ছড়ায়, তাকে বলা হবে হেপাটাইটিস এ ভাইরাস। আর সুচ-সিরিঞ্জ কিংবা রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে যে হেপাটাইটিস ছড়ায়, তাকে বলা হবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। বর্তমানে হেপাটাইটিস এ, বি, সি এবং ডি রয়েছে। আরও হেপাটাইটিস ভাইরাস রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
মানবদেহে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ ও লিভারে তার আগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার যত পথ আছে, সেগুলোর মধ্যে জন্মের সময় মা থেকে শিশুর শরীরে প্রবেশের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া আরও বিভিন্নভাবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমিত হয়। এটা প্রতিরোধের জন্য ২০০৩ সালের ১২ এপ্রিল হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিশুর দেড় মাস, আড়াই মাস ও সাড়ে তিন মাস বয়সে টিকা দেওয়া হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের টিকা দেওয়ার ফলে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। বাংলাদেশে ২০০২ সালে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা কার্যক্রম শুরু করার আগে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমণের হার ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু টিকা কার্যক্রম শুরু করার পর ২০০৬ সালে এটা কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে এটা কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। ইপিআই কার্যক্রমের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের যে কার্যক্রম চলছিল, যেকোনো মূল্যে সেটা চালিয়ে যেতে হবে।
গর্ভবতী মায়েরা যদি হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে একই সঙ্গে মা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি মায়ের গর্ভের সন্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মায়ের অ্যাকিউট ইনফেকশন হলে এটা কখনো মারাত্মক পর্যায়ে চলে যেতে পারে। গর্ভের শিশু মারা যেতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা মা-ও মারা যেতে পারেন। গর্ভজটিলতা দেখা দিতে পারে। সন্তান প্রসবের সময় অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হতে পারে। লিভারের অবস্থা ভালো না থাকায় কিছু ওষুধ দিতে পারি না। সবকিছু মিলিয়ে গর্ভবতী মায়ের জন্ডিস বা হেপাটাইটিস–বি একটা রেড অ্যালার্ট। এসব ক্ষেত্রে আমরা হেপাটোলজি বিশেষজ্ঞসহ সব বিভাগের বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাজ করি।
আমাদের সবচেয়ে বড় সুযোগ হলো, এ রোগের ভ্যাকসিন আছে। এ ভ্যাকসিন খুব কার্যকর। দেশের সব শিশু-নারী-পুরুষের যদি ভ্যাকসিন নেওয়া থাকে, তাহলে আমরা সুরক্ষিত। যেসব মা সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে আসেন, যিনি অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে আসেন, তাঁর ও তাঁর স্বামীর হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আছে কি না, পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সব গর্ভবতী মাকে টিকা দেওয়া যাবে না। গর্ভবতী মায়েদের কিছু পরিস্থিতি বিবেচনা করে টিকা দেওয়া না–দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের কথা বলছি, যেখানে সব মানুষ আর্থিক কষ্ট ছাড়াই উচ্চ মানের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাবেন। বাস্তব পরিস্থিতি হলো বর্তমানে আমাদের স্বাস্থ্যের পেছনে যত খরচ হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশই মানুষ নিজের পকেট থেকে খরচ করছে। স্বাস্থ্য খাতে খরচ নির্বাহ করতে গিয়ে শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠী নয়, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও নিঃস্ব হয়ে যায়।
কলেরা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরসহ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ; সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ও সম্প্রতি কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যাপক সফলতা অর্জনসহ অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। ২০১৯ সালের বিশ্বব্যাংকের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৫১, যেখানে নেপালের ৫৩, ভারতের ৬১, ভুটানের ৬২, শ্রীলঙ্কার ৬৭ ও মালদ্বীপের ৬৯।
হেপাটাইটিসের চিকিৎসা কেবল বড় বড় হাসপাতাল বা শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রভিত্তিক হলে দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক ও সরকারি বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং জাতীয় টিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে বিনা মূল্যে টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের হেপাটাইটিস প্রতিরোধের উপায়গুলো সম্পর্কে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে খুব দ্রুত দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়গুলো পৌঁছে যেতে পারে।
বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের হার জাতীয় বাজেটের প্রায় ৫ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের চেয়ে কম। রিসোর্সের অসম বণ্টন এবং উল্লেখিত সমস্যাগুলো সঠিকভাবে সমাধান না করার ফলে চিকিৎসা বাবদ রোগীদের আউট অব পকেট ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
ন্যাশনাল হেপাটাইটিস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম চালু করা দরকার। বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের জন্য ন্যাশনাল টিউবারকিউলোসিস কন্ট্রোল প্রোগ্রামের আওতায় ১৯৯৩ সাল থেকে যক্ষ্মা রোগীকে বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদান করা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগী পার্টনার হিসেবে ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন কাজ করে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে অদ্যাবধি এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৭টি সরকারি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক মেডিকেল কলেজে লিভার বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই মেডিকেল কলেজগুলোতে অতিসত্বর লিভার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে এবং যেসব জেলায় মেডিকেল কলেজ নেই, সেখানে কনসালট্যান্ট পদ সৃষ্টি করে লিভার বিশেষজ্ঞকে পদায়িত করতে হবে, যাতে তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ হেপাটাইটিস রোগী শনাক্ত করতে পারেন। সরকার নিজ উদ্যোগে অথবা এনজিওর মাধ্যমে এই ঝুঁকিপূর্ণ রোগীকে বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদান করতে পারে।
উপরিউক্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, আমরা সেই অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে পৌঁছাতে পারব।
বিভিন্ন দেশের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে। সেটি হলো ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস ভাইরাস নির্মূল করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হেপাটোলজি সোসাইটিকে যুক্ত করে সরকার এটা করতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হলে হেপাটোলজি সোসাইটিকে এটা দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। হেপাটাইটিসের ঠিকা ব্যয়বহুল। সরকারকে এটা বিনা মূলে৵ দেওয়া শুরু করতে হবে।
উপজেলা পর্যায়ে হেপাটাইটিস পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও রোগী শনাক্ত করা জরুরি। হেপাটাইটিস রোগীকে সম্পৃক্ত করে উপজেলা পর্যায় থেকে সচেতনতার কাজ করতে হবে। আরেকটি বড় কাজ হলো, কারা আক্রান্ত এবং কারা এটা অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে, এটা চিহ্নিত করতে হবে। সরকারের পরিকল্পনায় যদি হেপাটাইটিস নির্মূল করার বিষয়টা থাকে, তাহলে অবশ্যই হেপাটাইটিস প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দ্রুত রোগী শনাক্ত ও তাদের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মূল করা সম্ভব হবে বলে আশা করি।
বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ৩০ শতাংশ চাকরির ক্ষেত্রে এবং ২০ শতাংশের বেশি চিকিৎসাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। বৈষম্যের শিকারের ভয়ে অনেকে হেপাটাইটিস টেস্ট করান না। যার জন্য হেপাটাইটিস নিরূপণ ও চিকিৎসা ব্যাহত হয়।
প্রতি ১০ জন আক্রান্তের মধ্যে ৯ জনই জানে না যে তাদের শরীরে এই ভাইরাস আছে। আশার কথা, এই দুই নীরব প্রাণঘাতী ভাইরাস প্রতিরোধযোগ্য। চিকিৎসক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার জন্য তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধে আত্মনিয়োগ করা।
আমাদের দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তাদের হেপাটাইটিস বি ও সি সম্বন্ধে ধারণা নেই বললেই চলে। তৃণমূলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে রোগপ্রতিরোধ ও চিকিৎসার আওতার বাইরে রেখে কোনো রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফল হবে না। হেপটাইটিস বি ভ্যাকসিন, বিশেষায়িত পরীক্ষাগুলো সহজলভ্য করা জরুরি। সুবিধাবঞ্চিতদের বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদানের ব্যবস্থা করা দরকার।
নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, স্বাস্থনীতি প্রয়োগকারী এবং সিভিল সোসাইটির সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বৈষম্য (স্টিগমা অ্যান্ড ডিসক্রিমিনেশন) প্রতিরোধ ও দূরীকরণ করা সম্ভব।
আসুন, আমরা হেপাটাইটিসের বৈষম্য প্রতিরোধ ও নির্মূলে কাজ করি এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াই।
সাধারণত রক্তের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস ছড়ায়। হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হলো মাদকাসক্ত ব্যক্তি, সমকামী, অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কে আসক্ত ব্যক্তি। আবার যাঁরা হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস বহনকারী মায়ের নবজাতক, যাঁরা চিকিৎসাসেবা কর্মী, যাঁরা রক্ত গ্রহণকারী, যাঁরা ডায়ালাইসিস গ্রহণকারী; তাঁদের মাধ্যমেও হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস ছড়াতে পারে। অন্যদিকে করমর্দন, কোলাকুলি, জামাকাপড়, থালাবাসন-চামচ ইত্যাদির মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস ছড়ায় না। যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাঁদের জীবদ্দশায় ১৫ থেকে ৪০ শতাংশ লিভার সিরোসিস, লিভার ফেইলিউর বা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সারা বিশ্বে প্রায় তেত্রিশ কোটি মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত এবং প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ মানুষ এর কারণে মৃত্যুবরণ করেন। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি।
বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি–সংক্রান্ত কুসংস্কার এবং বৈষম্য সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার জন্য আমরা একটি গবেষণা সম্পন্ন করি। ১০৩৯ জন গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর মধ্যে পুরুষ ৭৯.৭% মোট ৮২৮ জন এবং নারী ২০.৩% মোট ২১১ জন। চাকরি নিয়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি ২৭.৮%, সামাজিক বৈষম্যের শিকার ১৪.৬%, চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন ৮.৭%, পরিবারে বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছেন ৭.৩%, শিক্ষাক্ষেত্রে ৪.৩%। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৫.৭% চাকরিক্ষেত্রে, ৭৬.৪% শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ৭.১% পরিবারে তাদের রোগ–সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করেননি।
হেপাটাইটিস–বি নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কারের কারণে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা প্রায়ই চিকিৎসাসেবায় বাধার সম্মুখীন হন। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার নীতি কিংবা কর্মসূচির মধ্যে এসব কুসংস্কার অন্তর্ভুক্ত থাকে।
ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স সিভিল সোসাইটির ২০১৭ সালের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশের সিভিল সোসাইটির ৯৩ শতাংশ মানুষ এই তথ্য দিয়েছেন যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজ নিজ দেশে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হন।
স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত সবাইকে হেপাটাইটিস–সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান প্রদান করতে হবে এবং তাদের সবাইকে কুসংস্কার সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। চিকিৎসা পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত সেবা হিসেবেই একজন ব্যক্তির হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং এর ফলাফল শুধু রোগীর জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। পরীক্ষাটি শুধু ব্যক্তির স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত সেবার জন্যই করা উচিত, কোনো চাকরি কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে নয়।
হেপাটোলজি সোসাইটি ১৮ বছর যাবত এসব সামাজিক কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছে। আমরা হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত অন্তত ২০০ জন যুবকে চাকরিতে নিয়োগের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ সুপারিশ করেছি। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন ইনভেসিভ প্রসিডিওর যেমন করোনারি এনজিওগ্রাম, ভাসকুলার সার্জারি, কোলেসিসটেকটমি ইত্যাদি অপারেশনের জন্য আমরা সার্জনদের আশ্বস্ত করেছি।
হেপাটাইটিস বি নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার, বৈষম্য রোধ ও জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নে নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে দেশের চিকিৎসক সমাজ, সুশীল সমাজ, আইন প্রণেতা, সাংবাদিক সবাইকে একত্রে কাজ করে যেতে হবে।
ফিরোজ চৌধুরী
অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরাও আশা করি, হেপাটাইটিস বি নিয়ে সব ধরনের কুসংস্কার দূর হওয়া জরুরি। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
হেপাটাইটিস পজিটিভ হলেই চাকরি ও বিদেশযাত্রার জন্য কোনোভাবেই অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত নয়।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা সবার জন্য বিনা মূল্যে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসের পরীক্ষা অল্প ব্যয়ে করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার।
হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের মুখে খাওয়ার ওষুধের মাধ্যমে প্রায় শতভাগ রোগ নির্মূল সম্ভব। এর দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
হেপাটাইটিস বি এবং সি চিকিৎসার সব ওষুধকে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, সুই-সিরিঞ্জের ব্যবহার ও অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস ছড়ায়। এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।