ইউএনপিআরপিডির সহায়তায় ইউএন উইমেন, উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডিডিএফ) ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘প্রতিবন্ধী নারীর সুরক্ষায় আইনি কাঠামো: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৩ মে ২০২৪।
রাশেদ খান মেনন
সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ
অতিরিক্ত সচিব (প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবন্ধিতা অনুবিভাগ), সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
নবনীতা সিনহা
ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ
তানিয়া হক
সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন; অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সালমা আলী
সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
আশরাফুন নাহার
নির্বাহী পরিচালক, উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি ডেভেলপমেন্ট (ডব্লিউডিডিএফ)
তাসলিমা ইয়াসমীন
সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৈয়দা নাসরীনা পারভীন
সহকারী পরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
ফারজানা রেজা
জাতীয় কর্মসূচি কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)
নাসিমা আক্তার
প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ডিজঅ্যাবেলড উইমেন
মনসুর আহমেদ চৌধুরী
ট্রাস্টি, ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
খন্দকার জহুরুল আলম
নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর সার্ভিসেস ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি
ফারজানা নাজনীন
উপপরিচালক, কমপ্লায়েন্ট অ্যান্ড ইনকোয়ারি, বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
ইফতেখার মাহমুদ
পরিচালক, বি-স্ক্যান
আয়েশা আক্তার
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও লিগ্যাল স্পেশালিস্ট (জেন্ডার জাস্টিস), ব্লাস্ট
দেওয়ান মাহফুজ ই-মাওলা
যোগাযোগ ব্যবস্থাপক, সিবিএম গ্লোবাল বাংলাদেশ
নাজমা আরা বেগম
প্রোগ্রাম সাপোর্ট অফিসার, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ
নাফিসুর রহমান
প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনকর্মী
গোলাম ফারুক হামিম
বাংলাদেশ প্রোগ্রাম টিম লিড, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
রাশেদ খান মেনন
সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন হয়েছে। এটা একটি বড় অর্জন ছিল। কিন্তু এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে ধীর গতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি ভালোভাবে জানেন কিনা, সেটা সন্দেহ। আপনারা এখানে জাতীয় সমন্বয় কমিটির কথা বলেছেন। আমি জানি যে পাঁচ বছরে এর কোনো সভা হয়নি। পরে আমি একটি সভা করি। প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা এই কমিটির মেম্বর। এ কমিটিতে অংশগ্রহণের কারও কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। একজন মাত্র সচিব এসেছিলেন। উপজেলা ও জেলা কমিটির সামান্যতম বাজেট নেই যে এরা সভা করবে। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে বলেছিলাম, বাজেট দেওয়া না হলে কমিটিগুলো কাজ করবে কীভাবে।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীবান্ধব, নারীবান্ধব সবই ঠিক আছে। কিন্তু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যদি পরিবর্তন না হয়, মানুষকে যদি সচেতন করা না যায়, এর যদি ব্যাপক প্রচার না হয়, তাহলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১৩টা বিধি ও কর্মপরিকল্পনা কোনোটাই কাজ করবে না।
আমি মন্ত্রী থাকার সময় আইনগুলো ফাইলে আনা হলো। আমি দেখলাম, সাধারণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমস্যা রয়েছে। সেখানে নারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সমস্যা আরও বেশি হবে। শ্রুতলিখনের ক্ষেত্রে পিএসসির নীতির সঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য রয়েছে। ফলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শ্রুতিলিখনের ক্ষেত্রে এখনো সমস্যা রয়েছে। সব মন্ত্রণালয় ও সংসদ সদস্যদের এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে দুজন প্রতিবন্ধী নারীকে সংসদ সদস্য করার প্রস্তাব এসেছে। এটাকে আমি গুরুত্বের সঙ্গে সমর্থন করি। এখানে কোনো আইনের বিষয় নয়, শুধু প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলেই এটা হতে পারে।
প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটার বিষয়টি অনেক চেষ্টা করেও কার্যকর করতে পারিনি। একসময় সংসদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ককাস ছিল। সেটা আবার চালু করা যায় কি না, তার উদ্যোগ নিতে হবে। নারী শিশু ও প্রতিবন্ধীদের বাজেট কীভাবে কার্যকর হয়, সেটা তদারক করা প্রয়োজন। যারা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা বেশি করে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন বলে আশা করি। সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরও উন্নয়ন সম্ভব হবে।
নবনীতা সিনহা
ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ
জেন্ডার সমতা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। তবে তাতে সন্তুষ্ট হয়ে থেমে থাকলে চলবে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি দেখা যায়। সম্পদ, সক্ষমতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে করা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার জন্য অবশ্যই সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
সিআরপিডি এবং সিডও উভয় সনদে উল্লিখিত বৈষম্যহীনতার সংজ্ঞায় কাঠামোগত বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে। তাই বৈষম্যের বিভিন্ন দিক ও ব্যক্তির ওপর বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট প্রভাব বোঝার জন্য ইন্টারসেকশনাল অ্যাপ্রোচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যখন এসডিজি নিয়ে কথা বলি, তখন কাউকে পিছিয়ে না রাখার কথা বলি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শুধু চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়। এসডিজির বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন এই জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পিছিয়ে রাখার প্রক্রিয়াটিকে চিহ্নিত করতে পারব এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হব।
আজ আমরা বাজেটের বিষয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ পেয়েছি। বাংলাদেশে জেন্ডার বাজেট, জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা ও শিশুদের জন্য বাজেট নিয়ে কাজ হয়েছে। বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ইস্যুতে কাজ করা যায়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সত্যিই অনেক এগিয়ে রয়েছে। কীভাবে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীদের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, তার জন্য আমাদের এগিয়ে আসতে হবে এবং এই আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
ইউএন উইমেনের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিবন্ধী নারীদের সুরক্ষায় আইনি ব্যবস্থার যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার থেকে উদ্ভূত সুপারিশগুলো নিয়ে আগামী দিনগুলোতে কাজ করব। ইউএনপিআরপিডি অংশীদারির প্রতি গুরুত্ব দেয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিশেষত নারীদের অন্তর্ভুক্তিকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইউএন উইমেন বাংলাদেশ সরকার, সুশীল সমাজ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিদ্ধ।
বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ
অতিরিক্ত সচিব (প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবন্ধিতা অনুবিভাগ), সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রায় ১৩টি বিধিমালা হয়েছে। আইন আছে। সবখানে সুন্দর কথা আছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে আসত। আমাদের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে দুটি আইন আছে। কারণ, দুই ধরনের প্রতিবন্ধী আছে—একটা নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী (এনডিডি), আরেকটি নন–এনডিডি প্রতিবন্ধী। এ দুটি আইন নিয়ে আমরা কাজ করছি। আপনাদের অনেক প্রচেষ্টার ফলে ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন হয়েছে।
আমাদের প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও প্রতিবন্ধী নিউরো ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্টের অফিস এখন মিরপুরে। সারা দেশে ১০৩টি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র আছে। আমরা প্রতি উপজেলায় সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র করতে চেয়েছি; কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হলো, প্রতিবছর ২০টি করে সেবাকেন্দ্র করতে হবে। তাহলে সব উপজেলায় তা করতে অনেক সময় লেগে যাবে। আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রতি উপজেলায় ফাউন্ডেশনের অফিস থাকত। তাহলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরও বেশি সেবা সাহায্য দিতে পারতাম।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব। তিনি সব সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আন্তরিক। আমাদেরও সেভাবে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এখানে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় কাজ করে। আমাদের মন্ত্রণালয়ে প্রতিবন্ধিতা ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে উইং আছে।
যখন ঘোষণা দেওয়া হলো—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য স্কুল করা হবে। তখন অল্প সময়ের মধ্যে তিন থেকে চার হাজার আবেদন জমা পড়ে। এগুলোর স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রবল চাপ রয়েছে। একে ক, খ ও গ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। ক ক্যাটাগরির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। অবকাঠামোসহ কোনো কিছুই নেই, শুধু সাইনবোর্ড দিয়ে অনেকে আবেদন করেছে। এ জন্য অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানও সমস্যায় পড়েছে। আমরা গাজীপুরে প্রতিবন্ধী স্কুলের কারিকুলাম নিয়ে কর্মশালা করেছি। এটা নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বসব। বিভিন্ন কমিটির সভা করার কথা রয়েছে, অফিসে ফিরে এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেব।
এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ করতে যাচ্ছি। প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আজকের গোলটেবিলে সুন্দর আলোচনা হয়েছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে যা যা করণীয়, সেটি আমরা করার চেষ্টা করব।
আশরাফুন নাহার
নির্বাহী পরিচালক, উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি ডেভেলপমেন্ট (ডব্লিউডিডিএফ)
কোনো পরিবারে একজন শিশু এলে আমরা আনন্দ করি। কিন্তু যদি একজন প্রতিবন্ধী মেয়েশিশু জন্ম নেয়, তাহলে সে পরিবার তাকে কীভাবে গ্রহণ করে? একটি ধনী পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিলে তাদের সামাজিক মর্যাদা কমে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে অপবাদ দেওয়া হয়। কোনো ক্ষেত্রে তাঁকে ঘর ছাড়াও হতে হয়।
কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা রয়েছে। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা যাঁরা দেবেন, তারা কি প্রতিবন্ধীবান্ধব কারিকুলাম তৈরি করেছেন। তাঁরা কি জানেন কীভাবে শিক্ষা প্রদান করতে হবে। এখানে অসংগতি রয়েছে। শুধু নীতি থাকলে হবে না, সেটা বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। আমরা যারা অনেক চড়াই–উতরাই পার করে শিক্ষা গ্রহণ করেছি, তারা কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদি সুযোগ পায় তাহলে তারা একটি জায়গায় যেতে পারে। কর্মসংস্থানের কোটা বন্ধ হওয়ায় প্রতিবন্ধী নারীদের চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে। আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বৈষম্যের শিক্ষার হচ্ছেন। কিন্তু আইন সংশোধন করা না হলে একটা প্রজ্ঞাপন দিয়ে কোটা বাতিল করা যাবে না। প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে বলা হয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থানের কোটা থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে প্রতিবন্ধী নারী ব্যক্তিদের জন্য একটি বিশেষ কর্মসংস্থান নীতিমালা হবে। গত কয়েক বছরে এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। তাহলে এ কাজগুলো কারা করবে। প্রতিবন্ধী নারীদের পারিবারিক, উত্তরাধিকার সম্পত্তি প্রাপ্তি, শারীরিক, মানসিক, সাইবার ক্রাইম ও যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হতে হয়। বিচারের ক্ষেত্রে তাঁরা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে অবশ্যই দুজন প্রতিবন্ধী নারীকে মনোনয়ন দিতে হবে। প্রতিবন্ধীবিষয়ক সংসদীয় ককাস পুনর্বহাল করতে হবে। আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত মাননীয় সংসদ সদস্য ও অতিরিক্ত সচিব মহোদয়কে বলব, তাঁরা যেন আমাদের সুযোগ-সুবিধার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তাসলিমা ইয়াসমীন
সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সিআরপিডি (জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংক্রান্ত সনদ) প্রতিবন্ধিতার বৈষম্যকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবন্ধিতার নীতিগুলো মানবাধিকার নীতিকে অনুসরণ করবে। এ জন্য একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অন্য সবার মতো সমান অধিকার ভোগ করবেন। বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে, অন্যদের তুলনায় সেবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কোনোভাবে বৈষম্য করা যাবে না।
সম্প্রতি ইউএন উইমেন ‘প্রতিবন্ধী নারীদের সুরক্ষার জন্য আইনি কাঠামো’ শীর্ষক একটি আইনি পর্যাোলাচনা করেছে। এতে দেখা গেছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে রাইট বেজড অ্যাপ্রোচের অভাব রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনে কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। প্রতিবন্ধী নীতিতে মনে করা হয়, সব প্রতিবন্ধীদের একই রকম সমস্যা। কিন্তু সিআরপিডিতে নারী-পুরুষের সমতা একটি মৌলিক নীতি। সিআরপিডির ৬ নম্বর ধারায় নারী প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের স্বীকৃতি থাকার পরও আমাদের আইনের কাঠামোয় কোথায় দেখা যায়নি যে একজন নারী প্রতিবন্ধী যে বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে পারেন, সে বিষয় কিছু বলা আছে।
সিআরপিডি অনুসারে প্রত্যেকের সমান আইনি স্বীকৃতি থাকতে হবে। ধারা যাক, একজন ব্যক্তি বিশেষ এক ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। সে জন্য তাঁকে নন–লিগ্যাল পারসন মনে করা যাবে না। আমাদের আইনেও সবার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আমাদের পুরো আইনি কাঠামোয় ‘মানসিক ভারসাম্যহীন বা অপ্রকৃতিস্থ’ এই আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের অনেক আইনেই একজন ব্যক্তিকে আইনি সক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। আইনের এ ধরনের ধারা মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চরম বৈষম্যমূলক।
আইনি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ কোনো সুবিধা নেই। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীদের আরও বেশি অসুবিধায় পড়তে হয়। অনেক সময় বাসায় চেইন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না, বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় যা পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একজন প্রতিবন্ধী মেয়ের যখন বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়, তখন তার পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের মূল আইন কাঠামোয় একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিবন্ধী হিসেবে আলাদা কোনো সুযোগ নেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে নারী প্রতিবন্ধীরা আইনের আশ্রয় নেবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হন। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
তানিয়া হক
সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন; অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারী জনগোষ্ঠী সবচেয়ে অবহেলিত। তাঁরা দুই ধরনের বৈষম্যের শিকার। একদিকে তাঁরা নারী, অন্যদিকে প্রতিবন্ধী। প্রতিনিয়ত যেখানে সাধারণ নারীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, সেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের চ্যালেঞ্জ সীমাহীন। এটি একটি জাতীয় ইস্যু।
আজকের আলোচনার মূল বিষয় হলো, প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন কতটা জেন্ডারবান্ধব। প্রতিবন্ধী নারীর সুরক্ষার ক্ষেত্রে জেন্ডার, সম্প্রদায়, ভাষাসহ প্রতিবন্ধী নারী দেশের কোন অঞ্চলে আছেন, সেটাও প্রভাব ফেলে বলে মনে করি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকে দেখা যায় যে ময়মনসিংহে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বেশি, কিন্তু সিলেটে কম। এর অর্থ ভৌগোলিক অবস্থানের একটা প্রভাব রয়েছে। এই বাড়া-কমার কারণ যদি আমরা খুঁজে বের করতে পারি, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব।
প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষেত্রে অবকাঠামোর জন্য বাজেট বরাদ্দ ভীষণভাবে প্রয়োজন। ঘর থেকে শুরু করে সব জায়গায় প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামো দরকার। আমাদের গবেষণাভিত্তিক নীতিমালা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নীতিনির্ধারকদের আরও দায়িত্বশীল
আচরণ, নিয়মিত বৈঠক, কাজের তদারকসহ এসব বিষয় গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
সালমা আলী
সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ সিডও, শিশু অধিকার সনদসহ জাতিসংঘের নানা সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। অনুস্বাক্ষরকারী দেশের এক ধরনের দায়বদ্ধতা থাকে। আইন ধারা সবই হচ্ছে; কিন্তু প্রয়োগ হচ্ছে না। ঠিকভাবে বাজেট বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তদারক হচ্ছে না।
আমাদের দীর্ঘ সময়ের অ্যাডভোকেসির ফলে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে এখনো বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি কাজ করছে। আমরা অনেক কিছু করছি। কিন্তু দিন শেষে সমন্বয়ের অভাবে কাজ হচ্ছে না। এ বিষয় নিয়ে সংসদের ভেতরে বাইরে কথা বলতে হবে।
কিছু কাজ শুরু হয়। কিন্তু পরে গিয়ে আর থাকে না। সরকারি আইনজীবী, বিচারক ও সারভাইভারদের মধ্যে সমন্বয়টা খুব জরুরি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যে শেল্টারগুলো আছে, সেখানে সেবার মান ঠিক আছে কি না, সেটা দেখতে হবে। ভসারভাইভারদের সেবা দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক, সমাজকল্যাণ ও আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার।
আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হয়। পারিবারিক সহিংসতার খসড়া মহিলা আইনজীবী সমিতি থেকে করেছি। সুরক্ষা আদেশসহ কিছু কাজ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় করতে পারে। আজকের আলোচনায় যে সুপারিশ আসবে, সেগুলো নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে হবে। প্রতি দুই মাস পরপর এ বিষয় নিয়ে বসতে হবে।
সৈয়দা নাসরীনা পারভীন
সহকারী পরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
উপজেলায় আমাদের কর্মপরিধি ব্যাপক, কিন্তু আমাদের জনবল খুব কম। অনেক সময় নিজেদেরই অফিসের তালা খুলতে হয়। আমাদের পরিবহনসুবিধাও তেমন নেই। আমাদের আছে মানসিক শক্তি।
আমরা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে কাজ করি। আমাদের এক উদ্যোক্তার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ে ছিল, মেয়েটি আমাকে বলত, আপনার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, আপনার মতো চাকরি করব। সে এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমি তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। তার যে মেধা, সে অনেক কিছু করতে পারবে।
উপজেলা পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের, বিধবা, বয়স্ক ভাতাসহ বিভিন্ন কমিটিতে আমরা থাকি। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরকে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সেলে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করবে। প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য আমাদের যদি কোনো কাজ দেওয়া হতো, আমরা অনেক সুন্দরভাবে তা করতে পারতাম। আমরা সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করতে চাই।
ফারজানা রেজা
জাতীয় কর্মসূচি কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)
আমরা আইএলও থেকে সরকারের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করছি। সম্প্রতি জাতীয় কর্মসংস্থান নীতিমালা হয়েছে। প্রতিবন্ধী মানুষদের কীভাবে মূলধারায় আনা যায়, তাদের দক্ষতা বাড়ানো যায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জাতীয় কর্মসংস্থান নীতিতে সরকারের কিছু কমিটমেন্ট আছে।
ইউএনসিআরপিডির উদ্দেশ্য হলো, প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠন, সরকার ও যারা এই এজেন্ডা নিয়ে কাজ করেন তারা যেন সবাই সিআরপিডি বাস্তবায়নে ভূমিকা নেন। প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন হওয়ার ১০ বছর পেরিয়েছে। এখন প্রয়োজনের আলোকে এটা সংশোধন করা যেতে পারে।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নারীরা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। তাঁদের শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্যাপ থাকলে চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। নিয়োগকর্তারা অনেক সময় বলেন, তাঁরা যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিবন্ধী কর্মী পাচ্ছেন না। আমরা আইএলও থেকে মনে করি যে সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিবন্ধী নারীরা ভালো মানের কাজ করতে পারবেন। কর্মসংস্থান নীতি নিয়ে আগামী পাঁচ বছর কাজ করব। আমরা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করি। আমাদের দিক থেকে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য আরও কী করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেব।
নাসিমা আক্তার
প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ডিজঅ্যাবেলড উইমেন
দেশে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা আছে। এ নীতিমালার ৩৯ নম্বর ধারায় প্রতিবন্ধী নারীর কথা বলা আছে। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। সেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করতে দেখিনি। নারী উন্নয়ন নীতিমালায় প্রতিবন্ধী নারীদের কথা বলা থাকলেও তাঁদের জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। প্রতিবন্ধী নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও প্রভাবশালীদের চাপে সুষ্ঠু সমাধান পাওয়া যায় না। আবার মামলা হলে অধিকাংশ প্রতিবন্ধী পরিবারের পক্ষে দীর্ঘদিন মামলা চালানো সম্ভব হয় না। বাক্ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হন। অনেক ক্ষেত্রে আইনজীবীরা হয়তো তাঁদের বিষয়ে অবগত নন। এ জন্য অনেক সময় সঠিক বিচার পান না। প্রতিবছর যে পরিমাণ প্রতিবন্ধী নারী সহিংসতার শিকার হন, সে তুলনায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার নেই। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
আবার বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী নারী তৃণমূলে বাস করেন। তাঁদের গণপরিবহনের সুযোগ তেমন নেই। আবার চাকরির সুযোগও প্রায় নেই বললেই চলে। অধিকাংশ চাকরি শহরকেন্দ্রিক। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক সমস্যার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা জরুরি।
মনসুর আহমেদ চৌধুরী
ট্রাস্টি, ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
ইউএনসিআরপিডি তৈরির সময় বাংলাদেশ অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পরিবীক্ষণ ফাইল আছে। অনুমোদনের পরে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ ফাইল কার্যকর ছিল। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণে অনেক ধরনের কমিটি করা হলো; কিন্তু কোনো কমিটি কাজ করে না। বর্তমান সমাজকল্যাণমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে কমিটিগুলোকে আবার চালু করা যায়।
বিভিন্ন পর্যায় থেকে আমরা সরকারকে ইউএনসিআরপিডির প্রতিবেদন দেব। আজকের অনুষ্ঠানের অতিথি মাননীয় সংসদ সদস্যকে অনুরোধ করব, আপনি আমাদের সমস্যার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন। বাজেট অধিবেশনে আমাদের জন্য বেশি করে বাজেট বরাদ্দের জন্য বলবেন। জাতীয় সংসদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আপনি একটি ককাস তৈরি করবেন বলে জোর দাবি জানাচ্ছি। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন কোনো দিন হবে না। সবাইকে অনুরোধ করব, প্রতিবন্ধী মানুষদের অবহেলা করবেন না।
খন্দকার জহুরুল আলম
নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর সার্ভিসেস ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি
ইউএনসিআরপিডির খসড়া যখন হয়, তখন বাংলাদেশ থেকে আমরা বেশ কয়েকজন জড়িত ছিলাম। ইউএনসিআরপিডিতে প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি এসেছে। বাংলাদেশে আইন করার সময় আমি ছিলাম। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম ছিলেন। বাংলাদেশের আইনে আমরা নারীদের বিষয়টি যুক্ত করতে পারিনি। তখন যুক্তি দেওয়া হলো যে নারী-পুরুষ সবাইকে সমানভাবে দেখা হবে। জাতীয় সমন্বয় কমিটি কিন্তু নারীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারে।
আইন হলো, জাতিসংঘে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ হলো, কিন্তু এর বাস্তবায়ন হবে কীভাবে। আইসিটি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় কিছু কাজ করেছে। অন্য মন্ত্রণালয় তেমন কিছুই করেনি। এটা দেখার দায়িত্ব ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের, তারা সেটা যথাযথভাবে করতে পারেনি। প্রতিবন্ধী নারীরা তথ্যপ্রযুক্তিতে ভালো করেন। এদিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
ফারজানা নাজনীন
উপপরিচালক, কমপ্লায়েন্ট অ্যান্ড ইনকোয়ারি, বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
সিআরপিডির ৩০ ধারায় পরিবীক্ষণ কমিটির কথা বলা হয়েছে। ২০০৮ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি পরিবীক্ষণ কমিটি গঠন করে। কিন্তু বেশ কবছর ধরে এ কমিটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানবাধিকার কমিশন এ কমিটিকে কার্যকর করার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে। কিন্তু যতটুকু জানি এখনো তা কার্যকর হয়নি। এ কমিটি কার্যকর হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবেন বলে আশা করি।
সিআরপিডিতে প্রতিবন্ধী নারীদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ধারা নেই। তাই প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনের সংশোধন করে তা যুক্ত করতে হবে। চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোটা নেই। যদি প্রতিবন্ধী কোটা নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে এটাই প্রমাণিত হয় যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকেও বাধাগ্রস্ত করবে।
ইফতেখার মাহমুদ
পরিচালক, বি-স্ক্যান
আমাদের বাজেটের একটা বড় অংশ সামাজিক সুরক্ষায় দেওয়া হয়। কিন্তু উন্নয়ন বাজেটে অনেক সময় বরাদ্দ থাকে না বা থাকলেও খুব কম থাকে। কিছুদিন আগে একটা শিরোনাম দেখছিলাম যে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশগম্যতা নেই। প্রতিবন্ধীপ্রবণ বাজেট করা হচ্ছে না। ২০ বছর ধরে আমরা বলে আসছি যে বাজেট যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংবেদনশীল হয়। কিন্তু কখনো এ ধরনের বাজেট হয়নি। তাহলে প্রতিবন্ধী মানুষের বাজেটের টাকা কোথায় যাচ্ছে, সেটা জানতে পারছি না। স্বাস্থ্য খাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, এর জন্য কিন্তু বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে না। হাসপাতালে গেলে আমাদের সাধারণ সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। দেশে অনেক মেগা প্রকল্প হচ্ছে। এসব প্রকল্পে যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুযোগ নিশ্চিত হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের জন্য একটা প্রতিবন্ধী অধিদপ্তর করতে হবে। সব মন্ত্রণালয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বাজেট থাকতে হবে।
আয়েশা আক্তার
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও লিগ্যাল স্পেশালিস্ট (জেন্ডার জাস্টিস), ব্লাস্ট
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন–২০১৩ প্রণীত হলেও শুধু আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং নিয়মিত মনিটরিং ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারার কারণে এ আইন প্রণয়নের ১০ বছর অতিক্রান্ত হলেও অদ্যাবধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
শিক্ষার সুযোগ, কর্মসংস্থানের সমসুযোগ, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের অধিকার, ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিশেষত প্রতিবন্ধী নারীরা বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থাকে এখনো সম্পূর্ণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় বিদ্যমান আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
দেওয়ান মাহফুজ ই-মাওলা
যোগাযোগ ব্যবস্থাপক, সিবিএম গ্লোবাল বাংলাদেশ
আমরা প্রতিবন্ধী নারীদের সুরক্ষার কথা বলছি। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দুই ধরনের সুরক্ষার প্রয়োজন হয়—এক. তার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে; দুই. পারিপার্শ্বিক অবস্থান থেকে। আইন পারিপার্শ্বিক দিককে প্রভাবিত করছে, যেন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। ব্যক্তি হিসেবে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ যখন কিছু করতে চান, তখন তাঁকে আমরা কতটুকু সাহায্য করতে পারছি।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটা শুধু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন আছে। আমরা চাই, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা যেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মূলধারায় আসে। নারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বয়ঃসন্ধিসহ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তার নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত হয়। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের তাঁদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।
নাজমা আরা বেগম
প্রোগ্রাম সাপোর্ট অফিসার, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ
প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে বড় একটা জনসংখ্যা হচ্ছে শ্রবণপ্রতিবন্ধী। তাঁরা ইশারা ভাষায় কথা বলেন। তাঁরা অনেক সময় ভুক্তভোগী হয়ে আদালতে যান। আইনে তাঁদের জন্য ইশারা ভাষায় দোভাষী থাকার নিয়ম আছে। কিন্তু দোভাষীরা কীভাবে ভুক্তভোগীদের সাহায্য করবেন, আইনে এর উল্লেখ নেই। ম্যাজিস্ট্রেট ইচ্ছে করলে দোভাষীর সাহায্য নিতে পারেন, আবার না–ও পারেন। আমরা পঞ্চগড়ে একজন শ্রবণপ্রতিবন্ধীর জন্য দোভাষী পাঠালাম। কিন্তু তিনি সরকার অনুমোদিত না বলে তাঁর সাহায্য নেওয়া হয়নি। এটা একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি।
সমন্বয় কমিটি এর সমাধান করতে পারে। কিন্তু গত ১০ বছরে এ কমিটি সভা করেছে তিনটি। করোনার সময় যারা সরকারের কার্ড পেয়েছে, তারা সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারী-পুরুষসহ অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সরকারের কার্ড না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করেছে। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
নাফিসুর রহমান
প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনকর্মী
দীর্ঘ সময় ধরে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। পলিসি অ্যাডভোকেসি নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা সচেতনতার কথা বলি। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক উদাসীনতা রয়েছে। আমরা যখন সরকারি প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলি, তাঁরা সব সময় বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীবান্ধব, তাঁরা প্রতিবন্ধীবান্ধব। সরকারের তিনটি অংশ লেজিসলেটিভ, জুডিশিয়ারি ও এক্সিকিউটিভ। লেজিসলেটিভ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তাঁরা সব সময় প্রতিবন্ধীবান্ধব। সমস্যা হলো এক্সিকিউটিভ নিয়ে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে তাদের মধ্যে উদাসীনতা রয়েছে। অধিকাংশ সময় তাঁরা আইন বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা নেন না। জাতীয় সমন্বয় ও নির্বাহী কমিটি এসব তো মন্ত্রণালয়ের হাতে। মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেই হয়। জাতীয় তদারক কমিটি ছিল। তিন মাস পরপর তারা সভা করত। ২০১৬ সালের পর থেকে তারা সভা করেনি। এসব বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
গোলাম ফারুক হামিম
বাংলাদেশ প্রোগ্রাম টিম লিড, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
বহুদিন ধরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলছি। তাঁদের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু এর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারীর তেমন অংশগ্রহণ থাকে না। এটা নিয়ে অনেক কথা বলেও কোনো কাজ হয়নি। সাধারণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারও নিশ্চিত হয়নি। প্রতিবন্ধী নারী আরও পেছনে পড়ছেন। তবে ধীরে হলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার ৩৯ ধারায় কয়েকটি উপধারা আছে।
প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য কী করতে হবে, এ উপধারায় সবকিছু বলা আছে। এই ধারাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য আইনের প্রয়োজন হতো না। এখন প্রধান কাজ হচ্ছে আইন ও ধারা বাস্তবায়ন করা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমস্যা হলে তাঁরা কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন, বুঝতে পারেন না। একটা পর্যায় গিয়ে প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলোও অসহায় হয়ে পড়ে। এসব বিষয় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রতিবন্ধী নারীদের চাহিদার ভিত্তিতে আইনি কাঠামোতে সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিবন্ধী নারীদের সুরক্ষায় বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে। ‘বৈষম্যহীনতার’ সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন।
প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়ক উপকরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ইউএনসিআরপিডি এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নে উল্লেখিত কমিটিগুলোকে কার্যকর করতে হবে।
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে দুজন প্রতিবন্ধী নারীকে মনোনয়ন দিতে হবে।
সব মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বাজেট থাকতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করতে হবে। মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দপ্তরের ফোকালদের প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে দক্ষতা তৈরির কাজ চলমান রাখতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষার বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। নীতিমালার পার্থক্যের কারণে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শ্রুতলিখনে যে সমস্যা রয়েছে, তা দূর করতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থানের কোটা রাখতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটা পৃথক অধিদপ্তর রাখা দরকার।
প্রতিবন্ধীবিষয়ক সংসদীয় ককাস পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন।