আটজনের মধ্যে একজন শিশু মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তির শিশুরা বেশি পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকে না। এই বয়সী শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা গেলে তারা পড়াশোনায় ভালো করে। খর্বাকৃতি ও ওজনস্বল্পতার মতো শারীরিক জটিলতাও কমে আসে। তাই সরকারকে শিশুদের উন্নয়নের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বরাদ্দ রাখতে হবে।
‘অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের উন্নয়নে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারে বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় রাইট টু গ্রো কান্ট্রি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ ও প্রথম আলো এই বৈঠকের আয়োজন করে।
আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় সব শিশুর জন্য পরিকল্পনা করতে হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, একটা অসুস্থ শিশুর জন্ম হলে তাকে সবার পক্ষ থেকে সহযোগিতা করতে হবে। দামি হলেও খাবার পুষ্টিকর না–ও হতে পারে। এই জায়গায় সচেতনতা তৈরি করতে হবে, যাতে শিশুরা পুষ্টিকর খাবার পায়। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ স্বাস্থ্যেই ব্যয় করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ অবশ্যই রাখতে হবে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) এ কে এম তারিকুল আলম। তিনি বলেন, শিশুদের জন্য বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়কে তথ্য–উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন এনজিওর কর্মীরা।
সুস্থ শিশুর জন্য মায়ের পাশাপাশি বাবারও পুষ্টির দরকার আছে বলে মনে করেন এ কে এম তারিকুল আলম। পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের নিয়ে সঠিক তথ্য–উপাত্ত নেই উল্লেখ করে তারিকুল আলম বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে ডেটা কালেক্টর (তথ্য সংগ্রহকারী) নিয়োগ দিতে পারলে সঠিক তথ্য–উপাত্ত পাওয়া সম্ভব।
শিশুদের জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক তানিয়া খান। তিনি বলেন, ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন শিশুদের জন্য আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের আওতায় নারীদের একটি অধিদপ্তর আছে, শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর থাকলে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা যেত।’
পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে পুষ্টির পেছনে বিনিয়োগ বেশি উল্লেখ করে তানিয়া খান বলেন, বাস্তবায়ন হয়তো যথাযথ হচ্ছে না। না হলে শিশুদের তো অপুষ্টিতে ভোগার কথা নয়।
পানি সরবরাহের সঙ্গে পুষ্টির একটা সম্পর্ক আছে, বিষয়টি কয়েক বছর আগেও মনে করা হতো না বলে জানান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক (সিআর ওয়াশ প্রকল্প) সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, পানি পুষ্টি দেয়। অল্পবয়সী শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পানির গুণগতমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানিতে লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকায় শিশুরা খর্বাকৃতির হচ্ছে।
পানির সঙ্গে সরকারের অনেকগুলো দপ্তর জড়িত উল্লেখ করে সাইফুর রহমান বলেন, দায়িত্ব ১০টি মন্ত্রণালয়ের হলে সবাইকে দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের পরামর্শক এ এফ এম ইকবাল কবির। তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৫–১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রথম শিশুদের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়। আবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ থাকলেও সেখানে পুষ্টি নিয়ে বরাদ্দের আলাদা খাত নেই।
শিশুর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা বিশ্বের শীর্ষ ২০টি দেশের একটি বাংলাদেশ উল্লেখ করে ইকবাল কবির বলেন, আটজনের মধ্যে একজন শিশু মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। গ্রামের চেয়েও শহরের বস্তির শিশুরা বেশি পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য বেসরকারি খাতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ নীতি উপদেষ্টা (কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা) ওসমান হারুনি। খাদ্য নিয়ে কাজ করা বেসরকারি খাতের মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন সবার কাছে প্রক্রিয়াজাত খাবার চলে যাচ্ছে। তাই বেসরকারি খাতকে খাদ্য উৎপাদনের সময় পুষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
সরকারের কাছে শিশুদের পুষ্টির নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দাবি জানান ম্যাক্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি পুনর্বিবেচনার সুযোগ এসেছে। সরকার সেখানে শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে এনজিওসহ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে, সেগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে রাইট টু গ্রোর কার্যক্রম তুলে ধরেন রাইট টু গ্রো কান্ট্রি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশের টিম লিড ইকবাল আজাদ। তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় ৫ বছরের কম বয়সী ৩০ হাজার ৫০০ শিশুর ওপর বিনিয়োগ করে দেখেছেন, শিশুদের খর্বাকৃতি ও ওজনস্বল্পতা কমে আসে। এই শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিতে বিনিয়োগ করলে সেটির ফল অনেক বেশি আসে। তাই সরকারের উচিত শিশুদের জন্য আলাদাভাবে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দ রাখা।
যেখানে শিশুরা বেশি পুষ্টিহীনতায় ভুগছে, সেখানে বেশি বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর রিফাত বিন সাত্তার।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর সায়কা সিরাজ, অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মোহাম্মদ আকমল শরীফ, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের সিনিয়র ডিরেক্টর চন্দন গোমেজ, ইউনিসেফের পুষ্টিবিশেষজ্ঞ গোলাম মহিউদ্দিন খান সাদী, আইএফপিআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ নীতি উপদেষ্টা রুহুল আমিন তালুকদার, সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক তানিয়া শারমিন, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গোলখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নাসির উদ্দিন এবং খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাঘুরাঘুনা ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা উৎপল বসাক।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।