যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ২০ অক্টোম্বর ২০২৪, রংপুর
যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ২০ অক্টোম্বর ২০২৪, রংপুর

রংপুর ও উত্তরাঞ্চলে যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাত

স্টপ টিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় আরডিআরএস বাংলাদেশ সেমিনার কক্ষে। ২০ অক্টোবর ২০২৪ অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনার সারমর্ম এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

ডা. মাহফুজার রহমান সরকার

লাইন ডিরেক্টর (টিবি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডা. এস এম রওশন আলম

বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি মেডিসিন ও পাবলিক হেলথ, রংপুর মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল

ডা. রানা চৌধুরী

বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, এনটিপি

ডা. মো. রুহুল আমিন

ডেপুটি সিভিল সার্জন, রংপুর

ডা. মাবুদ উজ জামান সজল

ডিস্ট্রিক্ট সার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার (ডিএসএমও), এনটিপি

মো. আল আমিন

উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল অ্যান্ড হাসপাতাল

এম এ জলিল খান

প্রধান নির্বাহী, বিপণন বিভাগ, রংপুর প্রাইম মেডিকেল অ্যান্ড হাসপাতাল

ডা. মো. নুরুল হাসান

প্রধান ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা, আপডেট ডায়াগনস্টিক

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মামুনুর রহমান

নির্বাহী পরিচালক, গুড হেলথ হাসপাতাল

ডা. খায়রুল ইসলাম

নির্বাহী পরিচালক, দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশন

জাফরুল আলম প্রধান

বিভাগীয় ব্যবস্থাপক, ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচি, রংপুর

মো. বজলুর রশিদ

প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, আরডিআরএস বাংলাদেশ

অধ্যাপক ডা. মো. শামসুজ্জামান

অধ্যক্ষ, রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল অ্যান্ড হাসপাতাল

আবু তালেব

পিপিএম পরামর্শক, আইসিডিডিআরবি

ডা. আজহারুল ইসলাম খান

পরামর্শক, আইসিডিডিআরবি

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

ডা. মাহফুজার রহমান সরকার

লাইন ডিরেক্টর (টিবি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনটিপি) বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম বড় একটি উদ্যোগ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও টিবি লক্ষ্যমাত্রাগুলো সামনে রেখে আমরা কাজ করে থাকি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এনটিপির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭৯ হাজার রোগী ডায়াগনসিস করা। আমরা ৩ লাখ ১ হাজারের চেয়ে একটু বেশি ডায়াগনসিস করেছি। ২০-২১ শতাংশ ডায়াগনসিস করতে পারছি না, মিসিং হয়ে যাচ্ছে। ডায়াগনসিস হলে তাঁদের চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু যাঁদের করতে পারছি না, তাঁদের জন্যই মৃত্যুর হারটা বাড়ছে।

২০২২ সালের একটি পরিসংখ্যান যা ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে ৪২ হাজার মানুষ এক বছরে মারা যান। ডায়াগনসিস হয়ে যাওয়া রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার মাত্র ২ শতাংশ। সরকারের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে আইসিডিডিআরবি, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিও, প্রাইভেট পার্টনার সবাইকে সম্মিলিতভাবে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা না থাকলে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন এবং সফল হওয়া সম্ভব না।

অনেকেই মনে করেন, আমরা লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারছি না। দুটি সূচকে আমরা পিছিয়ে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছি। ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা আমরা ইতিমধ্যে অর্জন করে ফেলেছি। যক্ষ্মা ডায়াগনসিসে এখন অনেক আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। আগে শুধু অ্যানালগ এক্স-রে করেই যক্ষ্মা শনাক্ত করা হতো।

এখন ৬৪ জেলায় অত্যাধুনিক জিন-এক্সপার্ট মেশিন রয়েছে। জিন-এক্সপার্ট মেশিনের জন্যই সম্পূর্ণ আলাদা রুম লাগে এবং এসি লাগে। যা বেশ ব্যয়বহুল।

দুর্গম এলাকা, পাহাড়ি ও চর অঞ্চলে কীভাবে ডায়াগনসিস করব? এই অঞ্চলগুলোয় আমরা জিন-এক্সাপার্ট মেশিনের পরিবর্তে ট্রুনাট মেশিন ব্যবহার করব। এটা এসি ছাড়া রুমে ব্যাটারি দিয়েও চালানো যায়। এটি দ্বারা খুব সহজেই ডায়াগনসিস সম্ভব।

রিপোর্টিং এবং লজিস্টিক ইনফরমেশন সিস্টেম ও অনলাইন করা আছে। এর মাধ্যমে এখানে কোন মেডিসিন আছে, ডেট কোন দিন পর্যন্ত রয়েছে সবকিছু ঢাকা থেকেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এগুলো কিন্তু সাফল্যের অংশ।

মোট ডায়াগনসিসের ১০ শতাংশ শিশু রোগী হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশ শিশুদের ডায়াগনসিসে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। কারণ, অভিভাবকেরা মেনে নিতে পারেন না, তাঁর সন্তানের টিবি হতে পারে। এমনকি চিকিৎসকেরাও এভাবে চিন্তা করেন না, শিশুর টিবি হতে পারে। তাই শিশু ডায়াগনসিস একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

আইসিডিডিআরবির রিসার্চের সুফল নিয়ে জিন-এক্সপার্ট মেশিন ব্যবহার করে শিশুর মল পরীক্ষা করে যক্ষ্মা ডায়াগনসিস করতে পারছি। এতে আমাদের সক্ষমতা কিন্তু বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুদিন আগেও তিন সপ্তাহের বেশি কাশি হলে পরীক্ষা করা হতো। এখন কিন্তু দুই সপ্তাহের বেশি কাশি হলে ওই ব্যক্তির টিবি পরীক্ষা করা হয় এবং যতটা দ্রুত সম্ভব যেন ডায়াগনসিস করা হয়। ফলে টিবি নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।

আরেকটা বিষয়, সুপ্ত যক্ষ্মা সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। ৪ ভাগের ১ ভাগ মানুষ এটাতে ভোগেন। ধরুন, বাংলাদেশ ১৮ কোটি মানুষ এর মধ্যে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ এমন টিবিতে সংক্রমিত। এমন সংক্রমণ থেকে যেন রোগ বাড়তে না পারে, তার জন্য প্রয়োজন টিবি প্রিভেন্টিভ থেরাপি। এই থেরাপি দিতে পারলে টিবি নিয়ন্ত্রণ করা

সহজতর হবে। প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতাল, করপোরেট হাসপাতালগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ এখানে আশা করি।

ডা. রানা চৌধুরী

বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, এনটিপি

ব্যর্থতার চেয়ে সফলতার গল্প কিন্তু অনেক বেশি। ৭০টা সাইটের মধ্যে ৭৩টা জিন-এক্সপার্ট মেশিন। পুরো রংপুর বিভাগে কোনো উপজেলা বাদ নেই।

যক্ষ্মা কর্মসূচিকে সফল করার জন্য যত আলোচনা সভা হয়, এত আলোচনা আর কোনো কর্মসূচির জন্য হয় না। সরকারি–বেসরকারি সবার মধ্যে সমন্বয়ের জন্য এই সভাগুলো করা হয়।

যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সক্ষমতা অর্জন করেছে, তাদের জিন-এক্সপার্ট মেশিন দেওয়া হয়েছে। এর জন্য আলাদা একটি প্যানেল আছে। যদি নীতিমালার সঙ্গে মিলে যায় এবং সক্ষমতা অর্জন করে থাকে, তাহলে আলোচনা করে সেখানেও যন্ত্রটি সরবরাহ করা হবে।

তবে মূলকথা হলো, টিবি যেখানেই ডায়াগনসিস হোক না কেন, এ তথ্যটা সরকারকে জানাতে হবে। এটাই সরকারি নিয়ম। অনেকেই এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানেন না। এ জন্য আমাদের বিভিন্ন মাধ্যমে টিবি সম্পর্কে জানাতে হবে।

যেখানে রোগী আছে এবং সরকারি সহায়তা লাগবে আমরা দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারি বেসরকারি বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে চিকিৎসাসেবাটাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। যক্ষ্মা প্রতিরোধ ও নির্মূল করতে হলে সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল ও এনজিওগুলোকে এ ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে।

ডা. মো. রুহুল আমিন

ডেপুটি সিভিল সার্জন, রংপুর

সরকার কী করছে, এটাও জানা দরকার। একটা টিবি ট্রিটমেন্ট করতে হলে সরকারকে ১২-১৫ হাজার টাকার ওষুধ বিনা মূল্যে দিতে হয় এবং এটা কিন্তু সরকার থেকে বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এ রোগটার ভয়াবহতা বিবেচনা করেই কিন্তু কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

একজন ড্রাগ রেসিস্ট্যান্স টিবি রোগীর চিকিৎসা করতে সরকারের ১০ লাখ টাকার ওপর খরচ হয়। জিন-এক্সপার্ট মেশিন একটা টেস্ট করতে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। সরকার কিন্তু এই ব্যাপক খরচ করছে শুধু ভালো চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য।

এনটিপির সহযোগিতায় রংপুর জেলায় ১৭০ জন গ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট চিকিৎসককে ট্রেনিং করিয়েছি। আমাদের সচেতনতা কার্যক্রম সব সময় চলমান। কর্মীদের টার্গেট দেওয়া আছে, অন্তত সন্দেহজনক রোগীকেও যেন কফ টেস্টে পাঠায়। আবার গ্রামের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোও রোগী পাঠায়।

তবে রংপুর জেলায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাই না। দুঃখ প্রকাশ করছি, হয়তো আপনাদের আরও বেশি নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। আমরা পারিনি। তবে আপনাদের অবস্থান থেকেও সহযোগিতার প্রচেষ্টায় ঘাটতি ছিল।

টিবি যতটা ভয়াবহ, তার চেয়ে ভয়াবহভাবে ফিরে আসছে ড্রাগ রেসিস্ট্যান্স টিবি হিসেবে। এটা আমাদের জন্য হুমকি। গণজোয়ার আসলেই প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে শুধু সরকার নয়, শুধু প্রাইভেট সেক্টর নয়, এখানে গণমাধ্যমকর্মীদেরও অংশগ্রহণ বিশেষভাবে প্রয়োজন।

ডা. এস এম রওশন আলম

বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি মেডিসিন ও পাবলিক হেলথ, রংপুর মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল

ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য সহায়ক বিষয়গুলো আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল। যক্ষ্মা প্রতিরোধ করার জন্য, যক্ষ্মা হলে করণীয় কী, এই প্রাথমিক ধারণা জনসাধারণের মধ্যে নেই। এ জন্য একটা গণ–আন্দোলন হওয়া উচিত। যক্ষ্মা হলে করণীয় কী, তা মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় কি না।

৩০ ভাগ কেস আমরা শনাক্ত করতে পারছি না। এর কারণ প্রাইভেট সেক্টর, যাদের তাদের সব কর্মকাণ্ড অফিস টাইমের বাইরে। সেই সময় যদি কোনো সাসপেক্ট রোগী পাওয়া যায়, তাহলে তাকে এক্স-রে বা জিন-এক্সপার্ট কোথায় করাব? এ জন্য ছোট্ট সুপারিশ, এখানে যদি জিন-এক্সপার্ট মেশিন ও এক্স-রে করানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে রোগীদের আমরা সাজেস্ট করব। টেস্টের পর পজিটিভ না নেগেটিভ জেনে আমরা একটা চিকিৎসা দিতে পারব।

রোগীর তথ্যাদি এনটিপির রেজিস্ট্রারে আছে কি না, সেটাও জানা যাবে। আর এভাবে কাজ করা গেলে আমাদের কার্যক্রম আরও সুন্দরভাবে এগিয়ে যাবে।

ডা. মাবুদ উজ জামান সজল

ডিস্ট্রিক্ট সার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার (ডিএসএমও), এনটিপি

বর্তমানে রংপুর জেলায় ৩ হাজার ৮৫ জন রোগী নিয়মিত চিকিৎসা পাচ্ছেন। এখানে বেসরকারি খাতের একটা বড় ভূমিকা আছে। ভূমিকাটা হলো জিন এক্সপার্ট টেস্ট , এক্স-রে ছাড়াও বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার পড়ে।

যক্ষ্মার কিছু সাইড ইফেক্ট আছে; সেটার জন্যও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। যক্ষ্মার মূল প্রভাব পড়ে লিভারে। সে ক্ষেত্রে এখানেও কিছু টেস্ট করতে হতে পারে। এই যে ভুক্তভোগী রোগী, তাঁদের কিন্তু কোনো না কোনোভাবে বেসরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সুতরাং পরোক্ষভাবে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকগুলো আমাদের সহযোগিতা করছে প্রতিনিয়ত।

জাতীয় যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সহায়তায় তিন শ জনের বেশি চিকিৎসককে ওরিয়েন্টেশন করানো হয়েছে রংপুর শহরেই। রংপুর শহরে পাঁচটি জিন-এক্সপার্ট মেশিন আছে। এগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা হয়।

বেসরকারি খাতে জিন-এক্সপার্ট মেশিন দেওয়ার কথা বলেন অনেকেই। একটু যদি লক্ষ করি, স্থানীয় একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মেশিন দেওয়ার পর ছয় মাসে মাত্র ১৫২টা টেস্ট হয়েছে। যেখানে রংপুর মেডিকেল কলেজে মাসে গড়ে সাড়ে তিন শ টেস্ট করানো হয়। অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে আশানুরূপ সংখ্যায় কেস আসে না। সে জন্য সব বেসরকারি হাসপাতালে জিন-এক্সপার্ট মেশিন দেওয়া হয়তোবা একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নয়।

বেসরকারি খাত অনেক ভূমিকা রাখতে পারে; ডায়াগনসিসের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যানার করতে পারে, লিফলেট দিতে পারে। রোগীদের কফ পরীক্ষার জন্য সরকারি হাসপাতালের কথা জানাতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত লোক দিয়ে আপনাদের প্রতিষ্ঠান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এভাবে কাজটি এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

এম এ জলিল খান

প্রধান নির্বাহী, বিপণন বিভাগ, রংপুর প্রাইম মেডিকেল অ্যান্ড হাসপাতাল

বাংলাদেশে ডেঙ্গু ও পরবর্তীতে করোনা সংক্রমণের সময় প্রতিদিনের তথ্য সংগ্রহ ও পরিবেশন কার্যক্রম বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। তেমনি যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণেও যদি সার্বক্ষণিক তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকে, তবে তা আরও কার্যকর হতে পারে।

এখন ‘জানাও’ অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিদিনের যক্ষ্মার তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে প্রচারণা বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া সারা দেশের মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে অবহিত করা যেতে পারে। এনজিওদের মাধ্যমে, গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে যাঁরা চিকিৎসা সেবায় আছেন, তাঁদেরকেও সংযুক্ত করা উচিত। এতে করে প্রতিটি স্তরে যক্ষ্মা বিষয়ে জানানো ও সচেতনতা তৈরি সহজ হবে।

এনজিও, মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এই প্রচারণায় যুক্ত হলে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে যথেষ্ট অগ্রগতি সম্ভব।

মো. আল আমিন

উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল অ্যান্ড হাসপাতাল

বিভিন্ন রোগের জন্য বেসরকারি হাসপাতালে নির্দেশনা ও পরামর্শ দেয়া থাকে; কিন্তু যক্ষ্মার জন্য এমন কিছু করা হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, কোনো হাসপাতালে দেখিনি দুই সপ্তাহ কাশি হলে যক্ষ্মা পরীক্ষা করতে হবে এমন নির্দেশনা আছে! তাই বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলেতে এই ধরনের সচেতনতা বাড়াতে হবে।

‘জানাও’ অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে, সে তথ্য সব ডাক্তারের কাছে পৌঁছে দেওয়া খুব জরুরি। সে ক্ষেত্রে তাঁরা রোগী শনাক্ত করে জানাতে পারবেন এবং তথ্যটা সঠিকভাবে নির্ধারিত জায়গায় থাকবে।

ডায়াগনস্টিক সুবিধার ব্যাপারটিও প্রচার করা উচিত। সরকার একটি মেশিন এই হাসপাতালে দিয়েছে, এই তথ্যটা প্রচার করা, যাতে সবাই ব্যবহার করতে পারেন।

ডা. মো. নুরুল হাসান

প্রধান ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা, আপডেট ডায়াগনস্টিক

যক্ষ্মায় সারা বিশ্বের চিত্রে বাংলাদের অবস্থান সপ্তম। সেখানে দেখা যাচ্ছে আমরা ৩০ শতাংশ রোগী শনাক্তকরণে সফল হতে পারছি না। কেন পারছি না? বেসরকারি পর্যায়ে যথেষ্ট পরিমাণ রোগী আসেন এবং সেবা নেন। সেখান থেকে নিঃসন্দেহে বড় একটা অংশ যক্ষ্মার উপসর্গ  শনাক্ত হয়।

আমাদের ডায়াগনস্টিকে রিসার্চ করে দেখলাম, এখানে আসা রোগীদের গড়ে বিশাল একটা অংশের টিবি সংক্রমণের লক্ষণ রয়েছে। তাই যক্ষ্মা শনাক্তকরণে এবং প্রতিরোধে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশাল একটি ভূমিকা আছে। এখানে যথাযথ উদ্যোগ নেই বলেই তা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।

যাঁরা আসলেই ভালো কাজ করছেন, সেবার মানসিকতা নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের সুযোগ করে দিতে হবে। বেসরকারি–সরকারি মিলে উদারহস্তে কাজ করলে যক্ষ্মা প্রতিরোধ সম্ভব এবং এই বাকি ৩০ শতাংশ শনাক্তে তখন সফলতা আসবে।

জাফরুল আলম প্রধান

বিভাগীয় ব্যবস্থাপক, ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচি, রংপুর

সরকারের অন্যতম সফল প্রোগ্রাম হলো যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। প্রতি ৮ জনে ৭ জন আমরা শনাক্ত করতে পারছি, তাই আমরা সফল। বিশ্বের অনেক দেশকে আমরা ছাড়িয়ে গেছি। এ জন্য সরকারের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশাল অবদান আছে।

যক্ষ্মা রোগী খুঁজে আনা থেকে লজিস্টিক সাপোর্টসহ যা লাগে, পুরো কার্যক্রমের সঙ্গে ব্র্যাক আছে। ৩৫০টি উপজেলা, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন, জেলা হাসপাতাল এমনকি জেলখানায় নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্র্যাক কাজ করছে।

আশা করি, সম্মিলিত উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা নিলে আমরা যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারব।

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মামুনুর রহমান

নির্বাহী পরিচালক, গুড হেলথ হাসপাতাল

যক্ষ্মারোগী ২১ থেকে ৩০ শতাংশ শনাক্ত হচ্ছে না। বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ রোগী বেসরকারি খাতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ জায়গায় প্রাইভেট হাসপাতাল আছে, সেখানে টিবি রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য একটা ব্যবস্থাপনা দরকার, কিন্তু তা নেই। এখানে অর্থ নেই, প্রশিক্ষণ নেই।

এ বিষয়ে সরকারি–বেসরকারি খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কোনো তথ্যও দেন না। আর এই টিবি রোগীদের সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে কি না, তাঁদের মধ্যে নতুন কোনো জটিলতা ডেভেলপ করছে কি না, সে বিষয়েও কোনো তথ্য আছে বলে মনে হয় না। আর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যাঁরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন, নবীন চিকিৎসক তাঁদের কাছে এই বেসরকারি খাতে কারা কাজ করছেন, কীভাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা হবে, তা জানেন না। সরকারি পর্যায়ের সেবা ও সুবিধাগুলো বেসরকারি পর্যায়েও যেন পান, তা নিশ্চিত করতে হবে।

ডা. খায়রুল ইসলাম

নির্বাহী পরিচালক, দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশন

টিবি নিয়ে এত কথা হয়, কিন্তু চোখের টিবি ব্যাপারটাও যে গুরুত্বপূর্ণ, এটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। বুঝতেও চায় না।

চোখে যক্ষ্মার সংক্রমণ থেকে অন্ধত্বও হতে পারে, কিন্তু এ ব্যাপারটা অবহেলায় থেকে। প্রচুর রোগীর মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা যায়, কিন্তু রোগীকে যক্ষ্মার উপসর্গের কথা বলে পরীক্ষা করতে বললে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করেন। এটার চিকিৎসা করা খুব জটিল। এ জন্য সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো দরকার।

চোখেও যে যক্ষ্মা হতে পারে, তার উপসর্গগুলোর কথা ছড়িয়ে দিতে হবে। আর জাতীয় পর্যায়ে এটা আনা উচিত, চোখের চিকিৎসায় কিছু লক্ষণ আছে, সেগুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা উচিত।

মো. বজলুর রশিদ

প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, আরডিআরএস বাংলাদেশ

জাতীয় যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে উপজেলা পর্যায়ে কাজ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হলেও তার অগ্রগতি দৃশ্যমান। 

আমরা ট্রু-নাট মেশিনের মাধ্যমে কফ পরীক্ষা শুরু করেছি, যা যক্ষ্মা শনাক্তে একটি কার্যকর পদক্ষেপ। এ ছাড়া এনজিও এবং সরকারি হাসপাতালের সমন্বয়ে বিভিন্ন এলাকার রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে এবং তাঁদের তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

সম্প্রতি পিপিএম মবিলাইজার নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হলেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর তথ্য সংগ্রহে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। চরাঞ্চলে কাজ করা কষ্টসাধ্য হলেও সেখানে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নানা বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণের প্রবণতা পরিবর্তিত হচ্ছে—যেমন কুড়িগ্রামে এ বছর বেশি আর লালমনিরহাটে এ বছর সংক্রমণের প্রবণতা কম।

ডা. আজহারুল ইসলাম খান

পরামর্শক, আইসিডিডিআরবি

প্রাইভেট সেক্টর ছাড়া কোনো প্রোগ্রাম সফল হতে পারে না। কোভিড বা ডেঙ্গু, ইপিআই কি শুধু সরকারি হাসপাতালের কারণে সফল হয়েছে? এখানে বেসরকারি হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

এনটিপি খুব সফল একটা কর্মসূচি। প্রতিটি জেলায় চলে গেছে জিন-এক্সপার্ট, দুই ঘণ্টার মধ্যে রেজাল্ট চলে আসে। ডায়াগনসিস, টেস্ট, ট্রিটমেন্ট—সবকিছু বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। তারপর কেন কমছে না? একজন বলেছেন, ৯৫ শতাংশ চিকিৎসা তাঁর সফল কিন্তু তিনি জানাতে পারছেন না। এটা আপনাদের জানাতে হবে জাতীয় স্বার্থে।

ট্রেনিং শুরু হয়েছে, ঢাকাসহ বিভাগীয় জেলাগুলোতে হচ্ছে। শুধু সরকারি নয়, প্রতিটি হাসপাতালেই যাওয়া হবে। এক্স-রের ওপরও বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। সবকিছু করা হচ্ছে। আমরা প্রাইভেট সেক্টরকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি, যেন তারা রোগীদের যথাযথ সেবা দেয়।

সুপারিশ

  • যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করে বিশেষ কর্মশালার আয়োজন।

  • স্থানীয় এনজিও ও স্বাস্থ্যসেবা সংস্থাগুলোকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আওতায় এনে কাজ করা।

  • জানাও অ্যাপের ব্যবহার বাড়ানো ও চিকিৎসকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

  • ড্রাগ রেসিস্ট্যান্স টিবি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

  • সচেতনতার জন্য গণমাধ্যমের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

  • দুই সপ্তাহের বেশি কাশি যক্ষ্মা পরীক্ষা করতে হবে।

  • সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে যক্ষ্মা শনাক্ত ও চিকিৎসার নিয়ম সম্বলিত পোস্টার থাকা জরুরি।