‘স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) আনোয়ারুল হক, তোফাজ্জল হোসেন, কাজী মারুফুল ইসলাম, এ কে এম তারিকুল আলম, তোফায়েল আহমেদ, শাহীন আনাম ও মাহফুজ কবির। গতকাল ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে
‘স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) আনোয়ারুল হক, তোফাজ্জল হোসেন, কাজী মারুফুল ইসলাম, এ কে এম তারিকুল আলম, তোফায়েল আহমেদ, শাহীন আনাম ও মাহফুজ কবির। গতকাল ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে

স্বশাসিত, সক্ষম, বিকেন্দ্রীকৃত স্থানীয় সরকার প্রয়োজন

ইউএনডিপি বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাগুলো উঠে আসে।

কেন্দ্রীয় সরকার ও সংসদ সদস্যদের প্রভাবে স্থানীয় সরকারের সুযোগ–সুবিধা থেকে জনপ্রতিনিধিরা বঞ্চিত ও অবহেলিত। দলীয়করণের কারণে এখানে স্বায়ত্তশাসনও নেই এবং মানুষও সেবা নিয়ে অস্বস্তিতে থাকে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চাইলে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত, কাউন্সিলর ও মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। সারা বছর ধরে নির্বাচন না হয়ে একসঙ্গে স্থানীয় নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।

২৪ নভেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাগুলো উঠে আসে। সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের সহায়তায়, ইউএনডিপি বাংলাদেশের স্ট্রেংদেনিং ইন্সটিটিউশনস পলিসিজ অ্যান্ড সার্ভিসেস প্রকল্প ও প্রথম আলো এ বৈঠকের আয়োজন করে। এতে গবেষণায় সহযোগিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর বাজেট অ্যান্ড পলিসি।

গোলটেবিল বৈঠকে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় সরকার অবহেলিত। এখানে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে; কিন্তু সিস্টেম তৈরি হয়নি। বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। একক স্থানীয় সরকার আইন হতে হবে। এখানে কালেক্টিভ লিডারশিপ বা যৌথ নেতৃত্ব পদ্ধতি করতে হবে। অর্থায়ন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। কী পরিমাণে তারা কর আদায় করবে, তা নির্ধারিত নেই। প্রয়োজনে রাজস্ব ভাগাভাগিতে যেতে হবে।’

গ্রাম আদালত প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাহী বিভাগের অধীন, তাদের কাছে বিচারের কাজ দেওয়া যায় না। সালিস থাকতে পারবে। তবে তার জবাবদিহি থাকতে হবে। নির্বাচনে জিতে আসা রাজনৈতিক কোনো নেতার হাতে বিচারের ক্ষমতা দেওয়া উচিত নয়।

৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী দিনগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, নতুন ছবি আঁকার সময় হয়েছে। আইনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সংস্কার করে তার অধীন এক বছরের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া যায়।

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য মাহফুজ কবির বলেন, স্থানীয় সরকারে সেবার জায়গা অনেক কিন্তু তাদের সেবা নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে অনেক জনপ্রতিনিধি হোল্ডিং ট্যাক্স নিতে চান না। এখানে পরিবর্তন আনতে হবে।

দলীয় প্রতীকের বাইরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রয়োজন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সরকারে কেন্দ্রের অনেক নিয়ন্ত্রণ থাকে। স্থানীয় সরকার যে একটা স্বশাসিত সরকার, সেটা সংকুচিত হয়ে যায়। বিগত বছরগুলোতে পরামর্শকের মতো বিভিন্ন নামে–বেনামে সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এখানে পরিবর্তন প্রয়োজন। স্থানীয় সরকারকে স্বশাসিত, সক্ষম ও বিকেন্দ্রীকৃত করতে হবে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম তারিকুল আলম বলেন, বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে তা ভালোভাবেই করা প্রয়োজন। স্থানীয় প্রতিনিধিদের অপসারণে বিষয়গুলো জেলা প্রশাসনের হাতেই থাকতে পারে। এর জন্য মন্ত্রণালয়ে আসার প্রয়োজন নেই।

সিরাজগঞ্জের স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকারে সেবার ক্ষেত্রে নগদবিহীন লেনদেন চালু করা যেতে পারে। এতে জবাবদিহি থাকবে।

ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক বলেন, স্থানীয় সরকারে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা স্পষ্ট হওয়া দরকার। মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাউন্সিলরদের ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার চিন্তা করা যেতে পারে। শহরের স্থানীয় সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।

স্থানীয় সরকারে নারীদের লোকদেখানোর জন্য আনা হয় বলে জানান মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিনি বলেন, আত্মীয়, বাবা, ভাই, স্বামী, শ্বশুরের প্রভাবে নারীরা নির্বাচিত হয়ে আসেন। মূল ক্ষমতায়ন নারীদের হচ্ছে না।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হামিদা বেগমও জানান, সংরক্ষিত আসনে নারীদের কাজ করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় না এবং সুযোগও পান না।

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে এক বছরের মধ্যে স্থানীয় নির্বাচনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকারের জবাবদিহি প্রসঙ্গে মানুষকে সচেতন করা জরুরি বলে জানান তিনি।

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান বলেন, সব সময় পার্বত্য এলাকার ভোটার তালিকা নিয়ে জটিলতার কথা বলা হয়। এবারের নির্বাচন কমিশন বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে।

এই সংস্কার কমিশনের আরেকজন সদস্য ফেরদৌস আরফিনা ওসমান জানান, স্থানীয় সরকারের কাজগুলো যেন পুনরাবৃত্তিমূলক না হয়। সবার দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।

পাশাপাশি এই কমিশনের সদস্য মাশহুদা খাতুন শেফালী বলেন, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্কের জায়গা যেন রাজা–প্রজার না হয়। এ ছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে সরাসরি নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

পুরো পাঁচ বছর ধরে না হয়ে এক মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়া এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ভোটগুলো যেন একসঙ্গে হতে পারে, সে প্রস্তাব দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া।

প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর সঞ্চালনায় গোলটেবিলে আরও বক্তব্য দেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী, যুব উন্নয়ন প্রতিনিধি জাহিদ হোসাইন খান, নেত্রকোনার কলমাকান্দার খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সুবোধ হাজং, শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মাওলা রতন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কৃষ্ণ কুমার সাহা।