১২ নভেম্বর ছিল বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস। এ উপলক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ইউনিসেফ বাংলাদেশের আয়োজনে ১০ নভেম্বর এক গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে। আলোচনার নির্বাচিত অংশ এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
মোহাম্মদ সহিদুল্লা
সভাপতি, নবজাতক স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় কারিগরি ওয়ার্কিং কমিটি
আহমেদুল কবির
অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
নাজমুন নাহার
সাবেক মহাপরিচালক, বারডেম হাসপাতাল
মায়া ভ্যানডেনেন্ট
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
আজিজুল আলীম
ভারপ্রাপ্ত লাইন ডিরেক্টর, মা ও নবজাতক, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য কর্মসূচি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, জাতীয় নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
নুরুল ইসলাম খান
জাতীয় পরামর্শক, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ফরিদ উদ্দিন আহমদ
উপপরিচালক ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার (নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
মো. জহুরুল ইসলাম
উপপ্রকল্প ব্যবস্থাপক, জাতীয় নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
সালাউদ্দিন আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক, প্রজন্ম রিসার্চ ফাউন্ডেশন
সাব্বির হায়দার
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার কর্মসূচি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
শামিনা শারমিন
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
ফিরোজ চৌধুরী
প্রতিবছর ১২ নভেম্বর বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘নিউনোমিয়া প্রতিরোধ করুন: প্রতিটি শ্বাসই গুরুত্বপূর্ণ’। বাংলাদেশে নিউমোনিয়া এখনো শিশুমৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ। দেশের সবখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নিউমোনিয়া নির্মূলে করণীয় নিয়ে আজকের গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা হবে। শুরুতেই ধারণাপত্র উপস্থাপন করবেন মো. জহুরুল ইসলাম।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এসব শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাপনা পাচ্ছে না।
১৯৮৯-১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে ১৩৩ জন মৃত্যুবরণ করত। আর এর মধ্যে ২৫ জনই মারা যেত নিউমোনিয়ায়। এ হার বিভিন্ন সময়ে ওঠানামা করেছে। ২০১৪-১৭ সালের মধ্যেও নিউমোনিয়া ছিল শিশুমৃত্যুর মূল কারণ।
চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচিতে (৪র্থ এইচপিএনএসপি) ২০২২ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ৩৪-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে (এসডিজি) বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ২৫ বা তার নিচে রাখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুহার ৩ বা তার নিচে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে নিউমোনিয়ায় মারা যায় ৮ দশমিক ৫ জন।
পাঁচ বছরের কম বয়সী একজন শিশু যেসব কারণে মারা যায়, তার সবচেয়ে বড় কারণ কিন্তু নিউমোনিয়া। প্রতি হাজারে মারা যাওয়া এ নবজাতকদের ১৮ শতাংশেরই মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। আমাদের দেশে নিউমোনিয়াজনিত জটিলতায় প্রতিবছর ২৪ হাজার ৩০০ শিশু মৃত্যুবরণ করছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে শিশুমৃত্যুর অন্য কারণগুলোর মধ্যে বলা হয়েছে তীব্র প্রদাহ, অপরিণত জন্ম, স্বল্প জন্ম ওজন, জন্ডিস, জন্ম আঘাত, শ্বাসকষ্ট, পানিতে ডুবে যাওয়া ইত্যাদি। নিউমোনিয়ায় মৃত্যু কমাতে আমাদের কিছু সামগ্রিক প্রয়াস প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে আমাদের সমতাভিত্তিক একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকতে হবে, যেখানে প্রতিটি শিশু নিউমোনিয়া থেকে নিরাপদ থাকবে। এ ক্ষেত্রে তিনটি জায়গাকে নির্দেশিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রতিরোধ, নিরাপদ করা ও চিকিৎসা দেওয়া। অর্থাৎ যেসব কারণে নিউমোনিয়া হয় শিশুদের, তা থেকে দূরে রাখতে হবে। আর যদি নিউমোনিয়া হয়েই যায়, তাহলে তাদের পর্যাপ্ত ও সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনা দিতে হবে।
অপুষ্টি, বায়ুদূষণ ও কম জন্ম ওজন নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, তাদের ৪৬ শতাংশের পরবর্তী সময়ে নিউমোনিয়া হয়। আবার নিউমোনিয়া হলেও অপুষ্টি দেখা দেয়। নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়া শিশুদের ৩০ শতাংশ বায়ুদূষণের কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় ও মৃত্যুবরণ করে। আবার নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়া ১০০ শিশুর মধ্যে ২৬ জনের অপরিণত জন্মের ইতিহাস রয়েছে। দেশে ৫ বছরের কম বয়সী ২৮ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। ৫০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে আছে।
শিশুদের পুষ্টির বিষয়ে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং জরুরি। এখনো এটি শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। বৃদ্ধি থেমে গিয়ে খর্বাকৃতির প্রবণতা আরও কমাতে হবে। কারণ, খর্বাকৃতির শিশুদের নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
সারা বাংলাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা শতভাগ বাস্তবায়ন করা যায়নি। এর কারণ এখনো অনেকেই অপচিকিৎসায় বিশ্বাস করেন। নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর তথ্য আমরা পেয়েছি সরকারি হাসপাতাল থেকে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো চিকিৎসকেরা পরিচালনা করেন না। নিয়ম থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিউমোনিয়ার তথ্য পাওয়া যায় না।
প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। সবাইকে নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে হবে। নিয়মমাফিক হাত ধুতে হবে। পৃথিবীর ৮০ শতাংশ মানুষ বায়ুদূষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বায়ুতে যে পরিমাণ দূষক থাকার কথা, আমাদের দেশের বায়ুতে তা কয়েক গুণ বেশি। শিশুদের নিউমোনিয়ায় বায়ুদূষণ বড় একটি কারণ।
আমাদের দেশে টিকাদান কার্যক্রম বেশ ভালো। চিকিৎসার জন্য আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমাদের প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৫ জন চিকিৎসক ও ৩ জন নার্স রয়েছেন। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদর্শ হচ্ছে, মোট ৪৫ জন চিকিৎসক-নার্স।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় মেডিকেল অক্সিজেনের পর্যাপ্ত জোগান রাখতে হবে৷ নিউমোনিয়ার ওষুধ তৈরি ও বিপণনে একচেটিয়া ব্যবসা চলছে। এর অবসান হওয়া দরকার। প্রতিটি দেশের মোট জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে রাখলে নিউমোনিয়া মোকাবিলা সম্ভব। পাশাপাশি গবেষণায়ও জোর দিতে হবে। নিউমোনিয়াকে প্রতিরোধ করতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
নিউমোনিয়া নিয়ে গবেষণার গুরুত্ব অনেক। আমি তিনটি বিষয়ে কথা বলতে চাই। প্রথমত, আমাদের এমআইএস পদ্ধতি খুবই ভালো একটি পদ্ধতি। এটি অনেক বেশি কার্যকরী। এটি সব সময় আমাদের সঠিক তথ্য দিচ্ছে কি না, তার ওপর জোর দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এমন একটি পদ্ধতি সরকারের থাকতে হবে, যার মাধ্যমে প্রতিবছর সারা দেশের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। সংগ্রহকৃত এসব উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে পরিস্থিতির কতটা উন্নয়ন হয়েছে। কারণ, উপাত্ত থেকে সুপারিশ না পেলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। নিউমোনিয়ায় মৃত্যু সব জায়গায় এক রকম নয়। স্থানভেদে এর প্রাদুর্ভাব একেক রকম হয়। এ জন্য বিভিন্ন উপজেলা থেকে আমাদের তথ্য প্রয়োজন। এখানে বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করতে হবে। তাদের তথ্য আমাদের ডেটাবেজে যুক্ত হচ্ছে কি না, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে গবেষণা। নিউমোনিয়া ব্যবস্থাপনার জন্য নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলোর জন্য অসুস্থ শিশুর সমন্বিত চিকিৎসা (আইএমসিআই) সর্বোত্তম গাইডলাইন। ৯০ দশকের মাঝামাঝি ইউনিসেফ এবং স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে এটি প্রণয়ন করেছিল। এরপর ২০১৪ সালে এই গাইডলাইনটি আবার সংশোধন করা হয়। সেখানেও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এই গাইডলাইনটি করা হয়েছিল প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য। স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমরা একটি গবেষণা করেছি দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের সংক্রমণ নিয়ে। সেখানে আমরা দেখেছি শ্বাসযন্ত্রের সিনসিশিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) প্রধান ভূমিকা রাখে, ব্যাকটেরিয়া নয়। এর মানে হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক খুব বেশি দরকার নেই। সরকারের ইপিআই কার্যক্রমের কারণে ভ্যাকসিনের কাভারেজ অনেক বেশি। দেশে নিউমোনিয়া চিকিৎসায় যে নির্দেশিকা বা গাইডলাইন ব্যবহার করা হয়, তাতে দুর্বলতা আছে।
এটি সমৃদ্ধ করতে হবে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমাতে হবে।
দেশে বর্তমানে ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। প্রতিটি ক্লিনিকে একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আছেন, যঁার মূল কাজ হচ্ছে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা, রোগীকে নিরাপদ রাখা ও চিকিৎসা দেওয়া। কমিউনিটি ক্লিনিকে তিনটি কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপ ১৩ থেকে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট। প্রতি মাসে তারা সভা করে এবং এর মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে।
বর্তমানে উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিকে পালস অক্সিমিটার রয়েছে। এ বছরের মধ্যেই আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে নেবুলাইজার মেশিন স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিরোধ করা, নিরাপদ করা, শনাক্ত করা ও চিকিৎসা দেওয়া—এই আঙ্গিকে আমরা কাজ করছি। এর ফলে নতুন প্রশিক্ষণ গাইডলাইন বাস্তবায়নে সুবিধা হবে৷
কমিউনিটি ক্লিনিক একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করে। আমরা প্রান্তিক মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছি। আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এভাবে কাজ করলে আমরা নিউমোনিয়াকে রুখে দিয়ে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব বলে আশা রাখি।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে একপর্যায়ে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এই পরিস্থিতিকে বলে হাইপোক্সিয়া, তখন রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়। এ অবস্থায় কার্যকর ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই দেখতে হবে তার শ্বাসকষ্টের মাত্রা ও অক্সিজেনের পরিমাণ কেমন। এ জন্য উপজেলা বা জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রই শুধু নয়, কমিউনিটি ক্লিনিকেও অক্সিজেন পরিমাপের জন্য পালস অক্সিমিটার প্রয়োজন।
রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা জানা খুবই জরুরি। কারণ, কারও যদি অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে থাকে, তাহলে তাকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে। অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে সময়মতো চিকিৎসার জন্য পাঠানো না হলে রোগী হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মারা যেতে পারে। দেরি করে হাসপাতালে নিলেও তার চিকিৎসাপদ্ধতি জটিল হয়ে পড়ে।
এ জন্য হাইপোক্সিয়া ব্যবস্থাপনায় প্রথমত অক্সিজেনের মাত্রা জানা জরুরি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে পালস অক্সিমিটার সরবরাহ করা হয়েছে। আইএমসিআই কর্মসূচির আওতায় আমরা সব জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পালস অক্সিমিটার দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এটি হাইপোক্সিয়া ব্যবস্থাপনায় জরুরি একটি উপকরণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া প্রতিরোধে বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা, নিরাপদ করা ও চিকিৎসা করা। প্রতিরোধের মধ্যে বলা হচ্ছে, শিশুরা যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ ও পুষ্টি পায়, তাহলে তারা নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া থেকে মুক্ত থাকবে। আর প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনেশন জরুরি। পাশাপাশি হাত ধোয়াও আবশ্যক। বায়ুদূষণের বিষয়টিও নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। এসব জায়গায় কাজ করলে আমরা ছোট–বড় সবার নিউমোনিয়া হওয়া প্রতিরোধ করতে পারি।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় বলা হয়েছে, সব প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা–সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। উপসর্গ দেখা দিলেই যেন মানুষ এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে পারে। আলোচনায় উঠে এসেছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় নিউমোনিয়ায় মৃত্যুহার ৪৬ শতাংশ। এ জন্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যেন নিউমোনিয়ার গুরুতর রোগী পৌঁছানোমাত্রই চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয়।
চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচিতে আমরা প্রথমবারের মতো নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্যকে সংযুক্ত করেছি। পরবর্তীকালে জাতীয় নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির (এনএনএইচপি) আওতায় আমাদের সব সেবাকর্মী ও সহযোগীদের কমপ্রিহেনসিভ নিউবর্ন কেয়ার প্যাকেজ (সিএনসিপি) প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সারা দেশে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
ডায়রিয়ার সঙ্গে নিউমোনিয়ার আন্তসম্পর্ক রয়েছে। এ জন্য আমরা ওষুধ ও সেবার তালিকায় খাবার স্যালাইন যুক্ত করেছি। আর লজিস্টিকস সরবরাহের মধ্যে পালস অক্সিমিটার আমাদের সব সেবাকেন্দ্রে আছে। তবে আমাদের পেডিয়াট্রিক পালস অক্সিমিটার নেই। এটি এ বছর থেকে আমরা আমাদের সেবাকেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করতে পারব বলে আশা করছি।
কোবো কালেক্ট নামে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেবাকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও পর্যবেক্ষণকারীদের কাছ থেকে সরাসরি উপাত্ত সংগ্রহ করছি। এর মাধ্যমে আমরা সেবা প্রদান কেন্দ্রের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারছি। আমাদের কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জনবল। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এক–তৃতীয়াংশ জনবলের পদ ফাঁকা আছে। নিয়োগ কার্যক্রম পুরোপুরি সম্পন্ন হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।
আমাদের মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন। এর সব কটিই ঢাকা সিটির অন্তর্ভুক্ত। অধিদপ্তরের অন্তর্গত ২৭৮টি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র (এমসিডব্লিউসি) রয়েছে। এসব কেন্দ্রে শিশুরোগসংক্রান্ত কোনো মেডিকেল কর্মকর্তা নেই। এই পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ জানতে ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে একটি গবেষণা করা হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে মায়েরা হাসপাতালে বিলম্বে আসেন। প্রধানত এ কারণেই মৃত্যুহার এত উচ্চ। দুঃখজনক হচ্ছে, এখনো মায়েরা হাসপাতালে বিলম্বে আসছেন। এর সুনির্দিষ্ট কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। এটি প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এ বিষয়টিতে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।
নিউমোনিয়ায় প্রতিবছর কত শিশু মারা যাচ্ছে, তার একটি হিসাব জানা গেলেও কত শিশু আক্রান্ত হচ্ছে, তার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। এ উপাত্ত আমাদের কাছে নেই। এর কারণ হচ্ছে আমরা সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে উপাত্ত পেলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য পাওয়া যায় না।
নিউমোনিয়া কমাতে হলে আমাদের প্রথম কাজই হবে মানুষকে সচেতন করা। শুরুতে মায়েদের সচেতন করতে হবে। কেবল মায়েদের নয়, পুরো পরিবারের সবাইকে সচেতন করা জরুরি। কারণ, মায়েরা সব সময় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। নিউমোনিয়া কমাতে কেবল স্বাস্থ্য খাত নয়, সব খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।
বেসরকারি খাতের কথা আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিককে নিউমোনিয়া–সংক্রান্ত কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে হবে। এ জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের মানুষকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে।
বাংলাদেশ শিশুমৃত্যু কমিয়েছে, নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুও কমিয়েছে। এখনো যে মৃত্যু হচ্ছে, তা প্রতিরোধযোগ্য। তবে এই কাজ স্বাস্থ্য বিভাগের একার নয়। ওয়াশ, এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং, পরিবেশদূষণজনিত সমস্যা—সবকিছুই বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে নিরাপদ পানির জোগান রয়েছে। তবে স্যানিটেশনের দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
বাইরের বায়ুদূষণ ও ঘরের ভেতরের দূষণ এখনো চিন্তার বিষয়। এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। পাশাপাশি জ্বালানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের বিকল্প চিন্তাও করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হচ্ছে। তবে আমাদের বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করতে হবে। এটি কেবল নিউমোনিয়া নয়, অনেক সমস্যার জন্য দায়ী। তা না হলে আমাদের অনেকে অর্থনৈতিক অর্জন হারাতে হবে। এ জন্য সব খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ও কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষিত ও মানসম্মত স্বাস্থ্য জনবল গড়ে তুলতে হবে। হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা জোরদার করতে এবং হাইপোক্সিয়ার চিকিৎসায় ইউনিসেফ সরকারকে সহযোগিতা করেছে। আমরা দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছি৷ প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ও কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষিত ও মানসম্মত স্বাস্থ্য জনবল গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীরাই প্রথম সারির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনবল। তঁারা সবচেয়ে ভালো সেবা দিতে পারেন। ৩০ শতাংশ জনবল না থাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনবল ব্যতীত কার্যক্রমকে গতিশীল করা সম্ভব নয়৷ এ বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
এমোক্সিসিলিন ডিসপারসিবল ট্যাবলেটের প্রাপ্রতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন করা উচিত। তাহলে কোনো সরবরাহকারী উৎপাদন না করতে পারলে অন্য জায়গা থেকে সংগ্রহ করা যাবে। এটি স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা।
বৈশ্বিকভাবে আমরা নিউমোনিয়া নিয়ে খুবই সচেতন। আমি খুশি যে বাংলাদেশে নিউমোনিয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ নিউমোনিয়া প্রতিরোধের ২০২০ সালে বাংলাদেশ অঙ্গীকার করেছে৷ আমরা আশা করছি, আগামী ২০২৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ আরও শক্তিশালী অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করবে।
আমি নিউমোনিয়া–সংক্রান্ত চিকিৎসায় কিছু সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমটি হচ্ছে সেবা বিতরণের ক্ষেত্রে অক্সিজেন সরবরাহে সীমাবদ্ধতা ও পালস অক্সিমিটারের অপ্রতুলতা। এ দুটি উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিত করে সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে।
আলোচনায় শনাক্তকরণে নিউমোনিয়া ও নিউমোনিয়া নয়—এমন একটি জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে যার নিউমোনিয়া নয়, তাকে হয়তো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত দেখানো হচ্ছে। আবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ দেখানো হয়। যার চিকিৎসা পাওয়ার কথা, তিনি হয়তো পাচ্ছেন না। অন্যদিকে যার নিউমোনিয়ার চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের সম্পদের ন্যায্য বণ্টন করতে হবে। কারণ, সবখানে নিউমোনিয়ার প্রকোপ এক রকম নয়। তাই সবখানে বরাদ্দও সমান হবে না। এ জন্য আমাদের উপাত্ত প্রয়োজন। গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সব উপাত্ত সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করতে হবে।
অপরিণত জন্মের সঙ্গে নিউমোনিয়া সম্পর্কিত। ফলে একজন মায়ের গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই খেয়াল রাখতে ও সচেতন করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, নিরাপদ প্রসব কতটা জরুরি৷
আমাদের অনেক ফ্যাসিলিটি প্রস্তুত হয়েছে। অনেক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা জানি আমাদের অক্সিজেন লাগবে, পালস অক্সিমিটার লাগবে। গণমাধ্যমে সমস্যা তুলে ধরা হলে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। হাইপোক্সিয়া ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের অক্সিজেন থেরাপির যুক্তিসংগত ব্যবহার হচ্ছে।
কিন্তু আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ের কী অবস্থা? এখনো কেন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর মায়েরা দেরি করে হাসপাতালে আসছেন? এ বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে হবে। আমরা একটি গবেষণায় দেখেছি, এখনো যে ৫৪ শতাংশ মায়েরা চিকিৎসার জন্য আসছেন না, তাঁদের ১০ শতাংশের বেশি মনে করে আসার প্রয়োজন নেই। আর ৪০ শতাংশের বেশি লোকজন মনে করছেন, আরেকটু অপেক্ষা করি। কাশি হয়েছে, ভালো হয়ে যাবে। কিংবা যে ওষুধ চিকিৎসক দেন, তা পরামর্শ ছাড়াই আগে থেকেই খাওয়াতে শুরু করেন। এই ধারণা পরিবর্তন করতে হবে৷ এ জন্য কেবল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে নয়, স্বাস্থ্যকর্মীদেরও সমাজ পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে।
এখনই আমাদের সর্বোত্তম সময়। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বর্তমানে ৫ম হেলথ সেক্টর প্রোগ্রাম তৈরি করছে। এখনই সঠিক সময় নিউমোনিয়া প্রতিরোধে একটি সম্মিলিত পরিকল্পনা তৈরি করার। মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, পুষ্টি বিভাগ, টিকাদানকারী বিভাগ, কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার, পরিবেশ বিভাগ—সবাইকে একসঙ্গে একটি সম্মিলিত পরিকল্পনা করতে হবে, যেন নিউমোনিয়ার প্রতিটি ঝুঁকির কারণ প্রতিহত করা যায়।
অনেক সময় দেখা যায়, আইএমসিআই বা শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাজেটে অর্থায়নে বড় একটি ফারাক থেকে যায়। এটি বৈশ্বিক সুপারিশেও এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মোট ৫ শতাংশ বাজেট থাকতে হবে। পরিকল্পনা করার সময় এ বিষয়টি বিবোচনায় রাখা জরুরি।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধের তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়ে থাকে৷ এগুলো হচ্ছে সুরক্ষা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা। এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিরোধসংক্রান্ত বিষয় আমি বলতে চাই৷ ঘর স্যাঁতসেঁতে রাখা চলবে না। বায়ুদূষণের কারণে আমরা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখি। যে ঘরে শিশু আছে, ধুলা এলেও সে ঘরের দরজা-জানালা খুলতে হবে। কয়েক ঘণ্টা পর বন্ধ করলেই হবে। প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য আলো-বাতাস প্রবেশ করতে দিতে হবে৷
আলোচনায় রান্নার ধোঁয়ার কথা বলা হয়েছে৷ এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কীভাবে এটি কমানো যায়, তা বিবেচনা করে চুলাও আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি খুব বেশি ব্যয়বহুল নয়। এটি হয়তো ব্যক্তিগতভাবে কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের ভাবতে হবে কীভাবে ধোঁয়ামুক্ত বা কম ধোঁয়ার চুলা স্থাপন করা যায়।
এ ছাড়া বাইরের পরিবেশে বায়ুদূষণও বড় একটি বিষয়। উন্নয়ন কাজ করলে ধুলা হবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু নিয়ম করে পানি ছিটিয়ে এটি প্রতিরোধ সম্ভব। এ ছাড়া ইটের ভাটাও বড় একটি সমস্যা। এটি পরিবেশদূষণের বড় একটি উৎস। আধুনিক ইটভাটায় বায়ুদূষণ হয় না। কিন্তু এ সংখ্যা খুব কম। বাকিরা কেন এ পদ্ধতি অবলম্বন করছে না তা দেখতে হবে। কজন ব্যবসায়ীর চেয়ে ১৭ কোটি মানুষের জনস্বার্থ সবার আগে দেখতে হবে।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে পালস অক্সিমিটার একটি জরুরি উপকরণ। এর দামও খুব বেশি না। এ বিষয়ে সরকার কাজ করছে, যা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। তবে এ যন্ত্রগুলো নষ্ট হলে যাতে সেবা বন্ধ না হয়, তাই আগে থেকেই কিছু যন্ত্র সংগ্রহে রাখতে হবে। অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে৷
ডিজিটাল অস্কালটেশন নিউমোনিয়া শনাক্তে অনেক কার্যকরী। প্রান্তিক অঞ্চলের স্বাস্থ্যকর্মীরা এর সাহায্য যদি নিউমোনিয়া শনাক্ত করতে পারে, এর অনেক ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। অক্সিজেন সরবরাহে সরকারি খাতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে করোনার কারণে অক্সিজেন সরবরাহ আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। সুতরাং, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একজন শিশুও যদি অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়, এটি হবে অন্যায়।
নেবুলাইজার মেশিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এখন অনেক প্রচলিত। অনেকের ঘরেও নেবুলাইজার আছে। প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেবুলাইজার থাকা নিশ্চিত করতে হবে। আর এমোক্সিসিলিন ডিসপারসিবল ট্যাবলেট খুবই কার্যকর। কোম্পানিগুলো কেন এগিয়ে আসছে না! তারা না করলে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড উৎপাদন করতে পারে। এটি তো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তারা এটি করলে ইউনিসেফ তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এটি আফ্রিকার দেশগুলোতেও রপ্তানি করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন খাত হিসেবে না দেখে সমন্বিতভাবে দেখা উচিত। বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা করে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পুরো ব্যবস্থায় একসঙ্গে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তখনই এর সুফল মিলবে। পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া নবজাতক বা নিউমোনিয়ায় মৃত্যু কমানো সম্ভব নয়। সরকারকে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী না হলে অন্য সব ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি বড় একটি ঝুঁকি, যা আমাদের মনে রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বলা হচ্ছে, ধনীদের তুলনায় গরিবদের মৃত্যুর হার বেশি। এটি নির্দেশ করে স্বাস্থ্য খাতে প্রবেশযোগ্যতা বাড়িয়ে শতভাগ করতে হবে। যে ধরনের আর্থিক পরিস্থিতিতেই অবস্থান হোক, যখন এবং যেখানে প্রয়োজন, প্রত্যেককেই উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। এর মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো স্বাস্থ্য খাতে প্রভাব ফেলে৷ আমি স্বাস্থ্য খাতের কোনো সমস্যাকে আলাদা করে দেখতে চাই না। আমি একে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার অংশ হিসেবে দেখতে চাই। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ইউনিসেফ একা চেষ্টা করতে পারে, এতে কোনো লাভ হবে না যদি না আমরা অনুপ্রাণিত হই।
আলোচনায় জনবলসংকটের বিষয়টি এসেছে। পর্যাপ্ত উপকরণ থাকা সত্ত্বেও দক্ষ লোকবল না হলে ভালো ফল সম্ভব নয়। উপজেলা পর্যায় থেকে একদম প্রান্তীয় পর্যায়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। তাদের প্রেরণা দিতে হবে, সংযুক্তও করতে হবে।
ফিরোজ চৌধুরী
আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আজকের গোলটেবিল আলোচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উঠে এসেছে। আশা করা যায়, নীতিনির্ধারকেরা তা বিবেচনায় নেবেন এবং নিউমোনিয়া থেকে শিশুরা রক্ষা পাবে।
■ নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অক্সিজেনের পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
■ প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পেডিয়াট্রিক পালস অক্সিমিটারের ব্যবস্থা করতে হবে।
■ এমোক্সিসিলিন ডিসপারসিবল ট্যাবলেটের প্রাপ্রতা নিশ্চিত করা জরুরি।
■ ডিজিটাল অস্কালটেশন সরবরাহ খুবই প্রয়োজন।
■ স্বাস্থ্য খাতে প্রবেশযোগ্যতা শতভাগ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
■ শিশুদের পুষ্টির বিষয়ে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং জরুরি।
■ প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা দরকার।
■ নিউমোনিয়া গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।
■ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেও নিউমোনিয়ার তথ্য সংগ্রহ করা জরুরি।
■ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় নেবুলাইজার মেশিন স্থাপন জরুরি।
■ নিউমোনিয়ায় মৃত্যু কমাতে সামগ্রিক প্রয়াস প্রয়োজন।