কর্মক্ষেত্রের দেশে শক্ত তদারকি দরকার

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বিদেশে মামলা পরিচালনার জন্য দূতাবাসে তহবিল বরাদ্দ করার দাবি জানালেন। 

উপরের বাঁদিক থেকে শামীম হায়দার পাটোয়ারী ,সালমা আলী ,তানিয়া হক ,জোহরা মনসুর

বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বিদেশে গিয়ে অল্প সময় পর অসুস্থ হয়ে যান প্রবাসী কর্মী। ১৪ বছর ধরে গড়ে প্রতিদিন ৯টি মরদেহ আসছে প্রবাসীর, যার মধ্যে ৫টি আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মৃত্যু নিয়ে অভিযোগও আছে। অথচ মৃত্যুর দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হয় না দেশে। প্রবাসীদের সুরক্ষায় শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের দেশটিতে শক্ত তদারকি দরকার। 

 ‘অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের সুযোগ: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনার মূল নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, হেলভেটাস ও প্রথম আলো যৌথভাবে এটি আয়োজন করেছে। এতে সহযোগিতা করেছে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন।

অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় ককাসের চেয়ারপারসন শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, কোটি প্রবাসী ও তাঁদের পরিবার মিলে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষের ন্যায়বিচারের প্রশ্ন এখানে। অথচ এখানে সরকারের নজর কম। ইট-পাথরের বাইরে উন্নয়ন চিন্তাই করতে পারে না সরকার। অথচ চাইলেই প্রবাসী আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেওয়া সম্ভব। সন্দেহজনক মৃত্যু, নির্যাতন যাচাই করতে বিমানবন্দরে সুরতহালের ব্যবস্থা রাখার দাবি জানান তিনি। 

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য তানিয়া হক বলেন, নীতিমালা তৈরির পাশাপাশি নৈতিকতাও প্রয়োজন। সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে; যাঁরা যাচ্ছে, তাঁদেরও। প্রত্যেক শ্রমিককে যোগ্য হতে হবে; যাতে মজুরি ও মর্যাদার সঙ্গে আপস করতে না হয়। সুশাসনের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য গবেষণাও দরকার, তাই গবেষণায় মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দরকার।

শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী। এরপর আলোচনা শেষে সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, বলা হয়, শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের দেশে কিছু করার নেই। কিন্তু অন্য দেশ তো করতে পারছে তাদের শ্রমিকদের জন্য। দেশের অভিবাসীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাই দর-কষাকষি করে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করায় জোর দিতে হবে। মামলা পরিচালনার জন্য দূতাবাসে তহবিল বরাদ্দ দিতে হবে; যাতে ভুক্তভোগী প্রবাসী কর্মীর পক্ষ হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে মামলা পরিচালনা করা যায়। এত প্রবাসী আয় করে সরকার কেন খরচ করবে না। আর প্রবাসী, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করে এ খাতে কাজ করার দাবি জানান তিনি।

জেনে বুঝে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) উপপরিচালক জোহরা মনসুর। তিনি বলেন, প্রচুর কর্মী যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সচেতনতা জরুরি। অনেকে দালালের প্রলোভনে বিদেশে যান, কারও সতর্কতাও শুনতে চান না। দেশে ফিরে অভিযোগ করলেও কোনো তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেন না। কর্মীদের সচেতন করতে বিএমইটির তিন দিনের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণে নতুন নতুন বিষয় নিয়মিত যুক্ত করা হচ্ছে। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে বিএমইটি একটি অংশ দেখে। সুরক্ষা দরকার সবখানে। তাই আইন ও নীতিমালার প্রায়োগিক দিকটায় জোর দিতে হবে। 

গোলটেবিলে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পরিচালক (প্রোগ্রাম) নাফিজ ইমতিয়াজ হাসান। এতে বলা হয়, নরসিংদী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ করছে মহিলা আইনজীবী সমিতি। এ তিন জেলায় তারা ১ হাজার ৩৫৯টি অভিযোগ পেয়েছে প্রবাসীদের কাছ থেকে। এর মধ্যে ৯৪ শতাংশ পুরুষ ও ৬ শতাংশ নারী। এঁদের মধ্যে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ২৮ শতাংশ, শ্রম আইন ও চুক্তির অধিকার বঞ্চিত হয়েছেন ৩৫ শতাংশ এবং নির্যাতন ও মৃত্যু সম্পর্কিত অভিযোগ করেছেন ২২ শতাংশ। এ ছাড়া জরুরি সহায়তা চেয়েছেন ৬ শতাংশ এবং মানব পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অন্যান্য অভিযোগ করেছেন ৯ শতাংশ। 

নিবন্ধে বলা হয়, প্রবাসীদের অভিযোগ নিয়ে বিএমইটির সালিসি আদালতে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। তবে অভিযোগের পক্ষে দলিল-দস্তাবেজ না থাকায় সালিস প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়ে যায়। আবার আদালতেও মামলাজট আছে। তাই প্রবাসীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কাগজপত্রের অভাবে প্রতারণা প্রমাণ করা যায় না। মামলা পরিচালনায় জাতীয় আইনগত সহায়তা কেন্দ্র সহায়তা করতে পারে। 

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপপরিচালক (কল্যাণ) শরিফুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের দেশগুলোতে কিছু সমস্যা রয়েছে, এটাই বাস্তবতা। এ অবস্থার পরিবর্তনে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পাসপোর্ট তৈরি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যদি স্বচ্ছতা থাকে, তাহলে অনেক বিষয় সহজ হয়ে যাবে।

হেলভেটাসের প্রকল্প পরিচালক আবুল বাশার বলেন, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়ায় কেউ না কেউ মুনাফা করছে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। 

সিমস প্রজেক্ট অ্যাডভাইজরি কমিটির চেয়ারপারসন কাজী আবুল কালাম বলেন, বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় দালালের মাধ্যমে। টাকার লেনদেনও তখন থেকে শুরু। প্রথম ধাপ থেকেই শুরু হয় প্রতারণা। অন্তত সৌদি দূতাবাসে সরকার আইনি সহায়তার তহবিল বরাদ্দ করতে পারে। ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক ও মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভের প্রোগ্রাম হেড শরিফুল হাসান বলেন, সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার দীর্ঘ যাত্রা। কিন্তু প্রবাসীরা মর্যাদা তো পেতে পারেন। রাষ্ট্র নিজে মর্যাদা দেয় না বলে অন্য দেশও তাঁদের মর্যাদা দেয় না। 

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রোগ্রাম অফিসার শেহরীন মুনির বলেন, বিদেশে কর্মী পাঠানো শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অভিবাসন খাতে বহুমাত্রিক ব্যবস্থাপনা দরকার। কর্মী-সংশ্লিষ্ট দুই দেশেই নজরদারি করতে হবে। 

গোলটেবিল আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রজেক্ট ম্যানেজার ইনজামুল হক, অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার আব্দুল্লাহ আল মামুন ও অভিবাসন-বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর।

স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ূম। আর সঞ্চালন করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।