আবদুল মোক্তাদির
সভাপতি, বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতি; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস
ডা. এ এম শামীম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড হাসপাতাল ও ল্যাবএইড ফার্মা
ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ
মহাসচিব, বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন
ডা. আবদুস শাকুর খান
কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন
ডা. আরিফ মাহমুদ
পরিচালক (স্বাস্থ্যসেবা), এভারকেয়ার হসপিটাল
ডা. সরদার এ নাঈম
চেয়ারম্যান, জাপান–বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল ও নাভানা ফার্মা
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ
অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. জাহাঙ্গীর কবির
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি
ডা. আজহারুল ইসলাম খান
পরামর্শক, ইউএসএআইডি’স এসিটিবি কর্মসূচি, আইসিডিডিআরবি
ডা. শাহরিয়ার আহমেদ
ডেপুটি চিফ অব পার্টি, ইউএসএআইডি’স এসিটিবি কর্মসূচি, আইসিডিডিআরবি
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আবদুল মোক্তাদির
সভাপতি, বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতি; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস
বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের উৎপাদনসক্ষমতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বসেই আমরা সর্বোচ্চ মানের পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ তৈরি করতে সক্ষম।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত কাঁচামাল আমদানির সীমাবদ্ধতা আমাদের ছিল। তা এখন আমরা অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।
যক্ষ্মা চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধ, বিশেষত কিছু অ্যান্টিবায়োটিক লার্জ স্কেল ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে তৈরি হয়, যার বিল্ডিং ব্লকগুলো অল্প কিছু দেশেই পাওয়া যায়।
চীন সারা পৃথিবীর চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ বিল্ডিং ব্লক তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে। ফলে তাদের কাছ থেকে আমদানি করে দেশীয় চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব কিছু না।
অ্যান্টিবায়োটিক বাদে অন্য যেসব কেমিক্যাল ও সিনথেটিক মলিকিউল যক্ষ্মা চিকিৎসার কাজে লাগে, তার কাঁচামালসহ সবই আমাদের দেশে তৈরি করা যায়। আগে সরকার বাইরে থেকে এসব চিকিৎসাসামগ্রী বিনা মূল্যে পেত। এখন যখন এই বিনা মূল্যের ওষুধের পরিমাণ ক্রমেই কমে আসছে, তখন দেশীয় ওষুধশিল্পকে এ খাতে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
দেশের ভালোর কথা বিবেচনা করে আমরা ওষুধ উৎপাদকেরা লাভের মাত্রা কম রেখে মানুষের ভালোর জন্য ওষুধ সরবরাহ করতে আগ্রহী।
দেশে পর্যাপ্ত চাহিদা তৈরি হলে ধীরে ধীরে তা মিটিয়ে বাইরে রপ্তানির সুযোগও আমাদের সামনে উন্মুক্ত হবে। এভাবে একদিন আমরা যক্ষ্মার ওষুধ উৎপাদনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারব।
এ ধরনের উৎপাদনে সরকারের দিক থেকে যদি কোনো নীতিগত বাধা থেকে থাকে, সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আপনাদের সহযোগিতা পেলে কম দামে ভালো মানের ওষুধ সহজলভ্য করে যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ তৈরিতে আমরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারব।
ডা. এ এম শামীম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড হাসপাতাল ও ল্যাবএইড ফার্মা
যক্ষ্মা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি কোভিডের মতোই। এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। কোভিডে সরকারি বেসরকারি অংশিদারত্বের যে মডেল আমরা অনুসরণ করেছি, যক্ষ্মার বিরুদ্ধেও তেমন সমন্বিত কৌশল প্রয়োগ করা জরুরি।
কোভিডে স্বল্প সময়ে আমরা শতাধিক পিসিআর ল্যাব তৈরি করেছি, ওষুধ তৈরি করেছি। তখন স্বাস্থ্য খাতের সরকারি কর্মকর্তারা নিয়মিত আমাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। এতে তাঁদের চাহিদা বা বক্তব্যগুলো যেমন আমরা জানতাম, তেমনি আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলোও সরকার জানত।
এ সমন্বয়ের ফলেই স্বল্প সময়ে আমরা কোভিড রোগীদের জন্য ১৪ হাজার কোভিড চিকিৎসা শয্যা তৈরি করতে পেরেছিলাম, যেখানে সরকারের ছিল মাত্র ১ হাজার ৭০০ শয্যা।
ল্যাবএইড বাংলাদেশের একটি বড় প্রতিষ্ঠান। আমাদের প্রায় ৬০০ চিকিৎসা শয্যা আছে। ৮০০–এর বেশি চিকিৎসক আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। প্রতিদিন আমরা ১০ হাজারের বেশি মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকি।
৩৫ বছর ধরে কাজ করছি আমরা। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের সরকারি কর্মসূচিতে আমাদের যুক্ত করার সুযোগ আছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষায়িত সেল হতে পারে।
আমাদের বক্ষব্যাধির চিকিৎসকেরা প্রচুর রোগী দেখেন৷ এর মধ্যে কতজন যক্ষ্মায় আক্রান্ত, সেই তালিকা যথাযথভাবে রাখা হয় না। রোগীদের সব তথ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। ‘জানাও’ অ্যাপের বিষয়েও আমি আগে অবগত ছিলাম না। এ বিষয়ে মানুষদের জানাতে হবে।
কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা গেলে যক্ষ্মা নির্ণয়ের সময় ও চিকিৎসার ব্যয় কমে আসবে। সেই সঙ্গে বিদেশি সাহায্য নির্ভরতাও কমবে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সব সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। যার প্রয়োজন, তার পেছনেই যেন টাকাটা খরচ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সব ব্যয়ের নিরীক্ষা করতে হবে। আর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষাপদ্ধতি সরকারি-বেসরকারি খাতে প্রচলিত আছে। এ পরীক্ষাপদ্ধতিগুলোকে একটা মানে নিয়ে এসে একীভূত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ
মহাসচিব, বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন
প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করছি আমরা। আমরা বাংলাদেশে ডায়াগনস্টিক চেইনের মাধ্যমে অনেক মানুষকে আমরা স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি।
বর্তমানে আমাদের বেসরকারি খাত বিকশিত হচ্ছে। কারণ, মানুষ এক জায়গায় সব সেবা (ওয়ান–স্টপ সার্ভিস) চায়। এক জায়গায় গিয়ে যদি সব পরীক্ষা–নিরীক্ষা সম্পন্ন করে চিকিৎসার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, তাহলে পদ্ধতিগত ক্ষতি (সিস্টেম লস) কমে আসবে।
আমাদের বিশেষজ্ঞরা খুবই দক্ষ। যক্ষ্মা মোকাবিলায় আমরা উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারি। ওরা যক্ষ্মাকে ভয় পায়, আমরা সাহস করে চিকিৎসা করি।
আপনাদের মতো আগ্রহী সহযোদ্ধাদের পাশে পেলে আমরা বেসরকারি খাতকেও যক্ষ্মা চিকিৎসায় নিয়ে আসতে পারব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচিতে রোগীকেন্দ্রিক সেবার কথা বলেছে। পুরো বিশ্ব যেখানে সহানুভূতি ও সেবার কথা বলছে, সেখানে আমরা এখনো আদ্যিকালের ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে চাইছি।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমরা প্রচুর রোগী শনাক্ত করে থাকি এবং চিকিৎসার জন্য পাঠাই। কিন্তু সরকারি হাসপাতালগুলোর যে জটিলতা, তাতে অনেক রোগীই সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
শুধু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকায় আমাদের প্রচুর শনাক্ত রোগী নথিভুক্ত না হয়েই থেকে যাচ্ছে। এবিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি।
আপনারা সুযোগ দিলে আমরা এই চিকিৎসাসেবার দায়িত্বও নিতে চাই। আমাদের দেশে সংক্রমণ প্রতিরোধ খুব কঠিন কোনো বিষয় নয়।
অপুষ্টি ও তামাক যক্ষ্মা নির্মূলে বাধার সৃষ্টি করছে। অপুষ্টিতে ভোগা মানুষদের থেকে এই রোগ সমাজের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ছে। তবে সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করে এর মোকাবিলা করা সম্ভব।
ডা. আবদুস শাকুর খান
কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন অনুসারে দেশের অনেক চিকিৎসক বেসরকারি খাতে তাঁরা কাজ করছেন।
সরকারি চিকিৎসকেরাও দিন শেষে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেন। প্রয়োজন ও প্রাপ্তির নিরিখে বলতে গেলে ৭০ শতাংশের বেশি চিকিৎসাসেবাই আসছে বেসরকারি খাত থেকে।
বাংলাদেশের মতো যক্ষ্মাপ্রবণ দেশে সব রোগীর পক্ষে সরকারি হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে বেসরকারি খাতেরও এখানে ভূমিকা রয়েছে।
কমিউনিটিকে সচেতন করতে না পারলে সংক্রামক ব্যাধি নির্মূল করা সম্ভব হয় না। এই লক্ষ্যে গণমাধ্যম, চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন, এনজিওর উদ্যোগগুলো প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসে জোর দিতে হবে। বিভিন্ন ধরনের যক্ষ্মা শনাক্তে রেডিওলজি কাজে লাগানোর উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। যক্ষ্মার সুপ্তাবস্থা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের নিয়ে কাজ করতে হবে।
একটু জোরালো ও সমন্বিত নীতিমালা তৈরি করে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের জন্য আইসিডিডিআরবি পরিচালিত টিবিএসটিসির সময়সীমা রাত আটটা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।এই সময়সীমা আরও বাড়াতে হবে। বেশির ভাগ ডটস সেন্টারও বেসরকারি এনজিও পর্যায়েই পরিচালিত হয়। সুতরাং শনাক্তকরণ, সচেতনতা ও সেবা প্রদান—সব ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন।
বর্তমানে দেশে চাহিদার ৯৮ ভাগের বেশি ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। যক্ষ্মার ওষুধ তৈরিতে কোনো আন্তর্জাতিক বাধা থাকলে তা দূর করে দেশেই ওষুধ তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে।
ডা. আরিফ মাহমুদ
পরিচালক (স্বাস্থ্যসেবা), এভারকেয়ার হসপিটাল
বহু প্রাচীন একটি রোগ হলেও বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যক্ষ্মা এখনো ভয়ানক এক বাস্তবতা। ছাত্র অবস্থায় দেখেছি, বিদেশ থেকেও যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্য রোগীরা এখানে আসতেন।
সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেরই স্বাস্থ্যসেবায় অনেক অবদান আছে। তারপরও প্রতিবছর ৫-৬ বিলিয়ন ডলার চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
আমাদের সক্ষমতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যক্ষ্মা মোকাবিলায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে একধরনের অনীহা রয়েছে, যা আমরা কোভিড মহামারির শুরুতেও দেখেছি।
কোভিড ও ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আমরা সরকারের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও অ্যাপটির কথা আমি আজই জানতে পারলাম। এ বিষয়ে আগে জানা থাকলে আমরা হয়তো যক্ষ্মা নির্মূলে আরেকটু এগিয়ে থাকতাম।
আমাদের হাসপাতালে আমরা প্রতিবছর ৫-১০ হাজার রোগী শনাক্ত করি। কিন্তু ওষুধ দিতে না পারার কারণে তাদের সরকারি হাসপাতালে পাঠাতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উদ্যোগ নিলে এ কাজে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ আরও বাড়ানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও বিভিন্ন এনজিওর উদ্যোগে আগের থেকে বেসরকারি অংশগ্রহণের মাত্রা অনেক বেড়েছে।
তবু অনেকে চিকিৎসাসেবার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
কোভিডের সময় জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য আমরা প্রচুর কথা বলেছি। এই জনসচেতনতা তৈরির কাজটিকে আমাদের গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে।
ডা. সরদার এ নাঈম
চেয়ারম্যান, জাপান–বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল ও নাভানা ফার্মা
দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারি খাত দিয়ে থাকে। তাই বেসরকারি খাতকে বাদ দিয়ে দেশের চিকিৎসাসেবার সার্বিক আলোচনা সম্ভব নয়।
কোভিড সংকটেও আমরা এ ঘটনাই দেখেছি। প্রথমে বলা হয়েছিল, কোভিডের জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতাল ছাড়া কেউ চিকিৎসা দিতে পারবেন না। অথচ বেসরকারি হাসপাতালেও অনেক সরকারি চিকিৎসকেরা কাজ করেন। তাহলে কেন সরকারি-বেসরকারি বলে চিকিৎসকদের আলাদা করা হবে?
বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় নিয়ে অহেতুক ভয় তৈরি করে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করা হয়। সরকারি হাসপাতালে ফ্রি বলে যে প্রচারণা চালানো হয়, সেই টাকাটাও তো কাউকে না কাউকে দিতে হয়।
সরকারি মানেই ফ্রি আর বেসরকারি হলেই ব্যয়বহুল, এই ভুল ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
দেশে যেহেতু স্বাস্থ্যবিমার কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই বেসরকারি খাতকে বাদ দিয়ে কোনো চিকিৎসাই সম্ভব নয়।
একজন সার্জন হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দেশের সেরা সার্জারির চিকিৎসাকেও বিভিন্ন ধরনের যক্ষ্মার সংক্রমণ প্রভাবিত করে।
যক্ষ্মাকে যদিও আমরা ফুসফুসের রোগ বলেই জানি। তবে অস্ত্রোপচারের ক্ষত সারাতেও এ জীবাণু বাধার সৃষ্টি করে। তাই আমাদের প্রয়োজন দ্রুত শনাক্তকরণ।
সরকারের ১৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে চলতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস নয়, সত্যিকারের সহযোগিতা গড়ে তোলা গেলেই ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। এ জন্য উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। সব রকম সহযোগিতার জন্য আমরাও প্রস্তুত থাকব।
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ
অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যক্ষ্মা চিকিৎসার বেসরকারি খাতের ভূমিকার ওপর একটু জোর দিতে চাই। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে যে শতকরা ৬০ ভাগের বেশি রোগী প্রথম শনাক্তের জন্য অপ্রথাগত চিকিৎসা নিতে যান। এর মধ্যে ফার্মেসি থেকে শুরু করে হাতুড়ে চিকিৎসকসহ সবই রয়েছে।
আমাদের দেশে যক্ষ্মা শনাক্ত হতে বিলম্বের কারণে রোগীদের ক্ষতির মাত্রাও বেশি হয়। স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে শনাক্তকরণের কাজে সম্পৃক্ত করা যায়। বেসরকারি পর্যায়ে শনাক্ত রোগীর ক্ষেত্রে ‘জানাও’ অ্যাপের কথা আমরা শুনেছি। তবে জানাও অ্যাপের মতো উদ্যোগগুলো আরও প্রচলিত ও সহজলভ্য হতে হবে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমাদের প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি, ক্রাউড ফান্ডিং, স্থানীয় ও প্রবাসীদের দান কাজ করতে পারে। এ ছাড়া চিনি, তামাক, অ্যালকোহলের মতো ক্ষতিকর জিনিসে স্বাস্থ্য করের মতো অতিরিক্ত কর আরোপ করা যেতে পারে। এই সব খাতের অর্থ মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারত্বে একটি জাতীয় যক্ষ্মা তহবিল গড়ে তোলা সম্ভব।
যক্ষ্মা চিকিৎসায় বিশাল খরচের বড় অংশটিই হয় যথাসময়ে রোগ শনাক্ত না হওয়ার কারণে। শনাক্তকরণের সময় কমিয়ে আনলে এই অহেতুক ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসার জন্য যাতায়াত খরচ হয়। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্র থেকে ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা এখনো দেখা যায়। ফলে রোগীর আর্থিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। আক্রান্ত ব্যক্তির খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতেও অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়৷ এই সব ব্যয় নির্বাহের জায়গায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
সরকারি উদ্যোগ অনেক সময়ই তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকর থাকে না। এই আলোচনাকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিস্তৃত করতে হবে। অপুষ্টি ও যক্ষ্মা প্রতিরোধে সব অংশীদারকে নিয়ে জনসচেতনতার অভিযান গড়ে তুলতে হবে। ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদেরও এ কাজে অংশ নিতে হবে।
ডা. জাহাঙ্গীর কবির
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি
বিশ্বের ৩০টি যক্ষ্মাপ্রবণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তবে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাফল্যও কম নয়। ২০১৫ সালে প্রতি লাখে ৪৫ জন রোগী মৃত্যুর সংখ্যাটিকে ২০২২ সালে আমরা প্রতি লাখে ২৫ জনে নামিয়ে এনেছি।
সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় যক্ষ্মা শনাক্তকরণ কার্যক্রমের আধুনিকায়ন ও বিস্তৃতি হয়েছে। বর্তমানে যক্ষ্মা শনাক্তে জেলা-উপজেলা হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে প্রাথমিক শনাক্তকরণের হার সারা দেশেই বেড়েছে।
তবে শিশুদের ক্ষেত্রে যক্ষ্মা শনাক্তকরণে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এই মুহূর্তে আমাদের মোট শনাক্ত রোগীর ৫-৬% শিশু, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছি।
ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা চিকিৎসায় আমাদের উদ্ভাবিত অ্যান্টিবায়োটিক মিশ্রণ প্রয়োগ করে সফল হয়েছি। বাড়িতে রেখে ছয় মাসের ওরাল ডোজ প্রয়োগ করে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা চিকিৎসা করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী মোট শনাক্তকরণের ৫৩% করেছেন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী ও এনজিওর মাঠকর্মীসহ কমিউনিটি হেলথ স্বাস্থ্যকর্মীরা। ২২% রোগী শনাক্ত হয়েছে বেসরকারি খাতে।অনেক বেসরকারি মেডিকেলে ডটস সেন্টার করা হয়েছে, জিন এক্সপার্ট মেশিন দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও পুলিশ হাসপাতাল, মিলিটারি হাসপাতাল,
২১টি কারাগার যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় এসেছে। পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারদের জন্য জানাও অ্যাপস চালু করা হয়েছে। কিছু জায়গায় এই অ্যাপস ব্যবহারের জন্য আমরা তাদের প্রশিক্ষণও দিয়েছি।
বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামচিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের প্রশিক্ষণের কাজ চলছে। দরিদ্র রোগীদের প্রয়োজনে তার যাতায়াত খরচটুকুও আমরা বহন করছি।
অপুষ্টিজনিত যক্ষ্মা প্রতিরোধে ০-৫ বছর বয়সী অপুষ্ট শিশুদের যক্ষ্মা পরীক্ষা আবশ্যিক করা হয়েছে। শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তে আমাদের তৈরি গাইডলাইনটি ইউটিউবে চিকিৎসকদের সুবিধার জন্য শিগগিরই উন্মুক্ত করা হবে।
এভাবে আধুনিকায়নের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমি আশাবাদী।
ডা. শাহরিয়ার আহমেদ
ডেপুটি চিফ অব পার্টি, ইউএসএআইডি’স এসিটিবি কর্মসূচি, আইসিডিডিআরবি
যক্ষ্মা একটি বায়ুবাহিত রোগ। যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতায় ঘাটতি আছে, তারা এ রোগের ঝুঁকিতে বেশি আছে। বৈশ্বিকভাবেও যক্ষ্মা একটি বড় জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা।
নীরব ঘাতক যক্ষ্মা ২০২৩ সালে ৩ লাখ ৭৯ হাজার রোগীর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশে এক হাজারের বেশি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকা মেট্রো এলাকায় প্রতি ২৬ মিনিটে একজন মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে।
অনেক রোগী বেসরকারি খাতে চিকিৎসা নেয় ,যাদের তথ্য জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে জাতীয় পর্যায়ের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং সেই অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণে এ ধরনের তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম দিককার দেশ হিসেবে আমরা সুপ্ত যক্ষ্মার চিকিৎসায় টিবি প্রিভেন্টিভ থেরাপি চালু করেছি। আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে অনেক কাজ করছি আমরা। সরকারি–বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ মডেলে ১০টি যক্ষ্মা নির্ণয় ও চিকিৎসাকেন্দ্র পরিচালনা করছি।
আমাদের ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট ইউএসএআইডির এসিটিবির মাধ্যমে যক্ষ্মা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমাদের তরুণদের নেটওয়ার্ক আছে, টিভিতে টক শো করছি, গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করছি। কমিউনিটিকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে কিছু উঠোন বৈঠক করেছি। স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড আয়োজন করছি দৈনিক প্রথম আলোর সহযোগিতায়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কৌশল পরিকল্পনা অনুসারে সব কাজ করার জন্য অনেক অর্থায়ন দরকার।
যক্ষ্মার সব চিকিৎসা বিনা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশীয় অর্থায়ন বেড়েছে, দাতা অর্থায়ন কমে আসছে। আমাদের নিজেদেরই নিজেদের দায়িত্ব নিতে হবে।
বেসরকারি খাত সবসময় খরচ সাশ্রয়ী সমাধান তৈরি করে। সেজন্য যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে বেসরকারি খাতের যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করা প্রয়োজন।
ডা. আজহারুল ইসলাম খান
পরামর্শক, ইউএসএআইডি’স এসিটিবি কর্মসূচি, আইসিডিডিআরবি
কোভিড মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের চমৎকার উদাহরণ। এটাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে দেশের স্বাস্থ্যসেবার অধিকাংশই দিয়ে থাকে বেসরকারি খাত। তাই বেসরকারি খাতকে বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা চলার কোনো সুযোগ নেই এবং চলছেও না।
স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বহু অর্জন রয়েছে; কিন্তু আমাদের পাওয়ার আছে আরও অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে সমন্বয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি ও বেসরকারি খাতকে সমন্বয় করেই চলতে হবে।
সমন্বয়ের একটি জরুরি জায়গা হলো ব্যয়। এখানে যেমন সরকারের বা জনগণের টাকা আছে, তেমনি দাতা সংস্থাগুলোর টাকাও আছে। আমাদের দাতাদের টাকার পরিমাণ কমছে। এই টাকার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এখানে দেশে ওষুধ তৈরির কথা উঠে এসেছে, কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে। দেশে ওষুধ তৈরি হলে দামে সাশ্রয় হবে, সরবরাহ আরও সহজ হবে। আমরা যত দূর সম্ভব কারিগরি ও নীতিগত সহায়তা দিচ্ছি। তবে ওষুধ, সচেতনতা সৃষ্টি, চিকিৎসাসেবা, বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আমরা বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে চাই।
‘জানাও’ অ্যাপের জনপ্রিয়তা বাড়াতে আমরা কাজ করব। আর কমিউনিটি ক্লিনিকের মডেলে কমিউনিটি সম্পৃক্ততা বাড়াতে আমাদের চেষ্টা থাকবে। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে যক্ষ্মা রোগীদের জন্য বিশেষ বেড ব্যবস্থাপনার অনুরোধ থাকবে।
আপনারাই বলেছেন যে বেসরকারি খাতকে বাদ দিয়ে যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচি সাফল্য পাবে না। যক্ষ্মা নির্মূলে আপনাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।
একদিকে ড্রাগস ও ডায়াগনসিস, অন্যদিকে রোগীর রেকর্ড তৈরি ও সংরক্ষণে আপনাদের সহযোগিতা আমাদের কাম্য।
এ বিষয়ে কাজের ক্ষেত্রে আলোচকেরা উৎসাহ দিয়েছেন। আশা করছি, শিগগিরই আমরা আবার একত্রে বসে একটি যৌথ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করব । বাংলাদেশকে ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এ পরিকল্পনা সহায়ক হবে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে কার্যকরী সমন্বয় জরুরি
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা করা জরুরি
সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারত্বে একটি জাতীয় যক্ষ্মা তহবিল গড়ে তোলা যেতে পারে
চিকিৎসার ব্যয় কমাতে দেশীয় পর্যায়ে যক্ষ্মা চিকিৎসার ওষুধ উৎপাদন বাড়াতে হবে
প্রাথমিক পর্যায়ে যক্ষ্মা শনাক্তকরণ বাড়াতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন
স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সারাদেশে যক্ষ্মা সচেতনতা বিষয়ক প্রচারণা চালাতে হবে
বেসরকারিখাতে শনাক্ত সব রোগীর তথ্য জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে জানাও অ্যাপের মাধ্যমে নোটিফাই করতে হবে