‘ক্ষুদ্র চা শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৌশল নির্ধারণ ও বিনিয়োগে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ৬ অক্টোবর ২০২৪ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে
‘ক্ষুদ্র চা শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৌশল নির্ধারণ ও বিনিয়োগে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ৬ অক্টোবর ২০২৪ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে

ক্ষুদ্র চা শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৌশল নির্ধারণ ও বিনিয়োগে করণীয়

সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া ও প্রথম আলোর যৌথ আয়োজনে ‘ক্ষুদ্র চা শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৌশল নির্ধারণ ও বিনিয়োগে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৬ অক্টোবর ২০২৪। আলোচকদের বক্তব্যের সারকথা এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

অংশগ্রহণকারী

ওসমান হারুনি

সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা ও ব্যবসা উন্নয়ন শাখা, রাজকীয় নেদারল্যান্ডস দূতাবাস, ঢাকা, বাংলাদেশ

 

মো. আমির হোসেন

উন্নয়ন কর্মকর্তা ও ইনচার্জ, বাংলাদেশ চা বোর্ড, পঞ্চগড়

সেলিম রেজা হাসান

কান্ট্রি ম্যানেজার, সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া

ড. মো. শহিদ-উজ-জামান

প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক, ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)

কামরান তানভিরুর রহমান

চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চা সংসদ

সৈয়দ আবুল মনসুর

চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বটলিফ চা কারখানা মালিক সমিতিৎ

নিয়াজ আলি চিশতি

মহাসচিব, বাংলাদেশ বটলিফ চা কারখানা মালিক সমিতি

আমিরুল হক খোকন     

সভাপতি, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র চা-বাগান মালিক ও চা ব্যবসায়ী সমিতি, পঞ্চগড় 

এম শাহ আলম

ডিরেক্টর অব অপারেশন, ডানকান ব্রাদার্স (বাংলাদেশ) লিমিটেড এবং সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চা সংসদ

ফোরাত জাহান সাথী

চা–চাষি ও চা ব্যবসায়ী, পঞ্চগড়

শাহেদ ফেরদৌস

সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর, ট্রেড ক্র্যাফট এক্সচেঞ্জ

ফয়জুল মতিন

উপদেষ্টা, সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

প্রথম আলো, প্রথম আলো

আলোচনা

ওসমান হারুনি

সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা ও ব্যবসা উন্নয়ন শাখা, রাজকীয় নেদারল্যান্ডস দূতাবাস, ঢাকা, বাংলাদেশ

 

ডাচ সরকারের উদ্যোগ ‘পাওয়ার অব ভয়েস’। বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তিদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করে সমাজে তাদের ক্ষমতায়ন করার জন্য এ প্রকল্প; যা সলিডারিডাড বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্প বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও রয়েছে।

আমাদের অন্যতম রপ্তানি পণ্য ছিল চা। বিশ্ববাজারে আমাদের উৎপাদিত চায়ের ভালো চাহিদা ছিল। দেশীয় বাজারে এ চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। সেটা এখন পুরো বিপরীত হয়ে গেছে। বিশ্ববাজারে প্রতিবেশী দেশগুলোর চা রপ্তানি আরও বাড়ছে, সেখানে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। আমাদের চা ব্যবসায়ীরা কি কেবল দেশীয় বাজার লক্ষ্য করছেন? পোশাকশিল্প বা অন্যান্য পণ্যের মতো এখানেও বৈচিত্র্য আনা দরকার। স্থানীয় বাজারে চায়ের চাহিদা প্রচুর বেড়েছে, দামও বাড়ছে। তবে চা উৎপাদনকারীদের কোনো আর্থিক পরিবর্তন নেই।

আলোচনায় অনেকগুলো বিষয় এসেছে। তার মধ্যে সামাজিক, আর্থিক, প্রাকৃতিক ও কারিগরি ব্যাপারগুলোয় একটি ফাঁক রয়েছে। এ বিষয়গুলো চা বোর্ডের কাজ করার সক্ষমতা আছে। এখানে সবাই চাষপদ্ধতির ত্রুটির কথা বলছেন; কিন্তু জেনেটিক্যাল বিষয়টিও ভেবে দেখার সুযোগ আছে।

পঞ্চগড়ের উল্টো পাশেই দার্জিলিং। সেখানে বিশ্বমানের চা উৎপাদিত হচ্ছে। আমাদের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক অবস্থা তাদের কাছাকাছি। ওই আলোকে এ অঞ্চলকে হটস্পট ধরে কাজ শুরু হয়েছে। এখানে আমাদের চাষ হওয়া চায়ের প্রজাতিগুলোর মান ও আবহাওয়া বিবেচনা করে বর্তমান প্রজাতির চেয়ে ভালো প্রজাতির ক্লোন নিয়ে কাজ করা দরকার। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের উন্নত জিন আনার সুযোগ আছে। কারিগরি দিক থেকে বাংলাদেশ চা বোর্ড ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে গবেষণা করতে পারে।

ক্ষুদ্র চা-চাষিরাও মানসম্মত চা তৈরি করতে পারেন—এটি প্রমাণ করতে এর সম্প্রসারণ করতে হবে। এটিকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়লে চায়ের দাম ও চাহিদা বাড়বে।

বিশ্ববাজারসহ বাংলাদেশেও বৈচিত্র্যময় চায়ের চাহিদা রয়েছে। চা-চাষি ও ব্যবসায়ীদের চা হাতবদল হতে গিয়ে মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী চলে আসছে। তাই কৃষকদের মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে স্লিপ চেইনের প্রথা ভাঙতে পারলে চাষি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি হবে। আর চায়ের গুণগত মান ধরে রাখা ব্যক্তি উদ্যোগে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

মো. আমির হোসেন

উন্নয়ন কর্মকর্তা ও ইনচার্জ, বাংলাদেশ চা বোর্ড, পঞ্চগড়

১৯৯৯ উত্তরাঞ্চলের চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় ৪০ হাজার একর জমিতে চা চাষ করা সম্ভব।

উত্তরাঞ্চলে চা চাষ একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ব্রিটিশ আমলে থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে সরকারি খাসজমি লিজ নিয়ে চা চাষ করা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে ধান, গমের পাশাপাশি কৃষক তাঁর চা চাষ উপযোগী জমিতে চা চাষ শুরু করেন এবং চা বোর্ডের অনুমোদিত ফ্যাক্টরিতে তা বিক্রি করছেন। বাংলাদেশ চা বোর্ড ২০০১ সালে এ অঞ্চলে কার্যালয় স্থাপন করে। এরপর তিনটি প্রকল্পের আওতায় চা বোর্ড থেকে চা–চাষিদের প্রণোদনা ও ঋণসহায়তা দিয়েছি।

চা চাষের এ কার্যক্রম শুরু হয় পাঁচজন ক্ষুদ্র চা–চাষি দিয়ে। ২০২৩ সালে চা–চাষির সংখ্যা ৮ হাজার ৩৭১–এ দাঁড়ায়। ১৫ থেকে ২০ একর জমি নিয়ে চা চাষ শুরু হয়। ২০২৩ সাল শেষে তা ১২ হাজার ১৩২ একর জমিতে সম্প্রসারিত হয়। ২০২৩ সালের চালু থাকা ২৫টি কারখানা থেকে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়, যা মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ১৮ শতাংশ।

২০২৩ সালে নিলামে চা বিক্রি হচ্ছিল না। সে সময় উত্তরাঞ্চলে প্রতি কেজি চা ৬০–৮০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। কারখানামালিকেরা চা–চাষিদের ঠিকমতো দাম দিতে পারেননি। ফলে চা–চাষিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ চা বোর্ড বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। চায়ের নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দেওয়া হয়; কিন্তু উত্তরাঞ্চলের চা সে দামে বিক্রি হচ্ছে না। এ অঞ্চলের উৎপাদিত চায়ের প্রায় ৭০ শতাংশ এখনো অবিক্রীত রয়ে গেছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত।

সেলিম রেজা হাসান

কান্ট্রি ম্যানেজার, সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া

সলিডারিডাড একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। আমরা বিশ্বের ৪০টি দেশে কাজ করছি। আমরা কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করি। নীতিমালাগত বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করি।

কৃষকের চা উৎপাদন থেকে শুরু করে চায়ের টেবিলে তা পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে সলিডারিডাড কাজ করে। এর ফলে কৃষক, ক্রেতা, ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়। সলিডারিডাড পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চা নিয়ে কাজ করেছে। আমরা ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্র চা–এর উন্নয়নে কাজ শুরু করি।

ক্ষুদ্র চা চাষ এ অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। একসময়ের অতিদরিদ্র পঞ্চগড় এখন বাংলাদেশের মানচিত্রে একটি উন্নয়নশীল জেলা।

গত চার বছরে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখেছি ও শিখেছি। বাংলাদেশে চা-শিল্পের জাতীয়ভাবে উন্নয়ন ঘটাতে আপনাদের আলোচনা ও সুচিন্তিত মতামত থেকে একটি নীতিমালা বা নির্দেশনা পাবে।

উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় থাকতে হবে। চাহিদা বৃদ্ধি ও জোগান কমলে তৃতীয় পক্ষের উত্থান ঘটে। তারা তখন পুরো বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। উত্তরবঙ্গে একসময় ভালো চা উৎপাদিত হতো এবং কৃষকেরা ভালো দাম পেতেন। বর্তমানে জাতীয় মোট উৎপাদনের ১৮ শতাংশ চা উত্তরবঙ্গে উৎপাদিত হচ্ছে। উত্তরবঙ্গে ২৮টি কারখানা রয়েছে। আরও কিছু পাইপলাইনে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চা উৎপাদন ও চাহিদা কত বৃদ্ধি পেয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে নতুন কোম্পানির প্রয়োজনীয়তা যাচাই করতে হবে।

সলিডারিডাড চায়ের গুণগত মান বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে। আমরা চাই ভালো পাতা, ভালো চা, ভালো দাম। জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র চা-শিল্পের অবদান কোনোভাবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

চায়ের গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা করছে। চা–চাষিদের মেশিন দিয়ে পাতা কাটার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, যাতে পাতার গুণগত মান ঠিক থাকে। কিন্তু চাষিরা এটা করতে চান না। কারণ, কাচি দিয়ে আর মেশিন দিয়ে কাটা পাতার মূল্যের কোনো ব্যবধান নেই। এখানে চাষিদের বাড়তি মূল্য পাওয়ার বদলে খরচ বাড়ছে। তাই চা–পাতার গুণগত মানের ওপর চায়ের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। মান ফিরিয়ে আনতে পারলে চাষিরা ভালো দাম পাবেন। এখানে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকতে হবে। জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। ক্ষুদ্র চা-শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই যেন লাভবান হন, সে বিষয়ে সবার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

ড. মো. শহিদ-উজ-জামান

প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক, ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)

পঞ্চগড়ের চা-শিল্পকে প্রথম থেকেই বাংলাদেশের চা-শিল্পের একটা অংশ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা একটা অসম প্রতিযোগিতা। এখানে সরকারের উচিত, এই চাষিদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া। তাহলে হয়তো একটা সাম্য আসবে।

এখানে বেশির ভাগ চা–চাষি লিজ নিয়ে জমি চাষ করেন। লিজ জমির চাষি ও নিজস্ব জমিতে চা চাষ করা চাষিদের সুযোগ–সুবিধা সরকারকেই ঠিক করে দিতে হবে।

চায়ের সঙ্গে পর্যটন খাত এগিয়ে নেওয়া যায়। ইকোট্যুরিজম থেকে আয়ের একটা ভিন্ন ব্যবস্থা হবে। পঞ্চগড়ে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে।

কটেজ ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে চা চাষকে একধরনের বাজারজাতের চেষ্টা আমরা করিনি। ক্ষুদ্র চা–চাষিদের নিয়ে এ চেষ্টা করা যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে বাজার তৈরি করতে হবে। এতে ক্ষুদ্র চা-শিল্পে বিপুল সম্ভাবনাময় গতিপথ তৈরি হবে।

কামরান তানভিরুর রহমান

চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চা সংসদ

বাংলাদেশে গত বছর চা উৎপাদন ছিল ১০২ মিলিয়ন কেজি। এ সংখ্যাটা দাপ্তরিক। প্রকৃত পরিমাণ হয়তো আরও বেশি।

এশিয়া-আফ্রিকা টি অ্যালায়েন্সের একটা অনুষ্ঠান থেকে জানতে পারি, বিশ্বে মোট চাহিদার চেয়ে ৩৮০ মিলিয়ন কেজি অতিরিক্ত চা আছে। পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো দেখতে হবে। শুধু উৎপাদন বাড়ালে চলবে না। আমরা উৎপাদিত চা ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারছি কি না, ক্রেতারা সেই চা কিনছেন কি না, সেটাও দেখতে হবে।

উত্তরবঙ্গের সমস্যা আমরা শুনেছি।  চায়ের গুণগত দুর্বল মানের কারণে তাদের চা–শিল্প পিছিয়ে পড়ছে। উত্তরবঙ্গের চাষিরা কেন ভালো চা করতে পারছেন না? এটা শ্রমিকের স্বল্পতার কারণে হতে পারে। আবার চায়ের দামের কারণেও হতে পারে। কৃষক কেজিপ্রতি যে মূল্য পাচ্ছেন, এ মূল্যে ভালো মানের চা দিতে পারবেন না। আপনাদের (পঞ্চগড়) এত দারুণ চা-বাগান থেকে কেন ভালো পাতা আনতে পারছেন না, এ বিষয়টা আপনাদেরই খতিয়ে দেখতে হবে। আপনারা মানসম্পন্ন চা করতে পারলে সার্বিক ফল ভালো হবে। উৎপাদন ও মানের সমন্বয়ে ভালো চা তৈরি হবে।

প্রয়োজনে অতিরিক্ত চা করে আমরা বিক্রি করতে পারছি না। অতিরিক্ত উৎপাদন করব কেন? আমরা রপ্তানি করার মতো চা তৈরি করতে পারিনি। উত্তরবঙ্গকে উৎপাদন কমিয়ে আরও ভালো মানের চা করতে হবে। মান বাড়লে চায়ের মূল্য বাড়বে।

অনলাইনে দামাদামি করে সঠিক মূল্য তো পাচ্ছিই না, বরং আরও কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আমাদের ইন্টারনেট সমস্যা ও কারিগরি সমস্যা আছে। তাই অনলাইন প্রক্রিয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

চা খাত কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত করতে বলছি না। কিন্তু কৃষি খাতের স্বীকৃতি দেওয়া হলে চাল, ডাল, ভুট্টায় যে লোন দেওয়া হয়, আমরাও সে সুযোগ-সুবিধাগুলো পাব।

সৈয়দ আবুল মনসুর

চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বটলিফ চা কারখানা মালিক সমিতি

পঞ্চগড়ের চায়ের মান নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন ওঠে। চা যদি ভালো দামে বিক্রি হয়, তবে চাষিরাও ভালো দাম পাবেন। আর চায়ের মান ভালো হলে দামও ভালো হবে।

সিলেট ও চট্রগ্রামের তুলনায় উত্তরবঙ্গে আমরা চায়ের দাম অনেক কম পাচ্ছি। এর কারণে পণ্যের চাহিদার জোগান দেওয়া কৃষক বন্ধুরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চায়ের মান উন্নত না হলে তথা ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ চায়ের এ স্লোগান বাস্তবায়ন না হলে আগামী ১০০ বছরেও উত্তরবঙ্গের চায়ের উন্নতি হবে না। তাই ছয় পাতা, আট পাতা নয়, ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’—এটি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা চায়ের যথাযথ মূল্য পাচ্ছি না। তার অন্যতম একটি কারণ মান না বেড়ে পরিমাণ বাড়ছে। গত বছর আমাদের দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ মিলিয়ন কেজি চা বেশি উৎপন্ন হয়েছে। সেই তুলনায় এ বছর ৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন কেজি চা ঘাটতি রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে এ বছর ১০ মিলিয়ন কেজি  উৎপাদন ঘাটতি দেখা দেবে। এর কারণ কৃষক ও বাগানমালিকেরা সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না এবং তাঁরা ব্যাংকঋণ নিতে পারছেন না।

বিভিন্ন কারণে চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকলে আগামী দিনে চা-শিল্পের অবস্থা পাটশিল্পের মতো হবে। দেশীয় চায়ের উৎপাদন কমে গেলে বড় বড় কোম্পানি চা আমদানি করবে। ফলে চায়ের মূল্য দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। এতে ভোক্তারা যেমন ভুক্তভোগী হবেন, একইভাবে কৃষক, শ্রমিক, বাগানমালিক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। রাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাবে।

মূল্যহ্রাসের জন্য ক্রেতারা চা না কিনে ঝুলিয়ে রাখেন। যেমন ২০২৩ সালে আমরা ৬৫ লাখ কেজি বটলিফ চা বিক্রি করেছি। এ বছর ৩০ শতাংশ চা বিক্রি হয়েছে। ৫০ শতাংশের বেশি অবিক্রীত রয়েছে। ক্রেতারা না কিনে পরবর্তী মূল্যহ্রাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে তাঁরা তিন গুণ দামে বিক্রি করবেন। এখানে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকে যুক্ত করা উচিত।

কত টাকায় পণ্য কিনে কত টাকা লাভ করবেন ও চায়ের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। চায়ের ক্রেতা বন্ধুদের আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তাঁরা যেন আমদানি মূল্যের কাছাকাছি মূল্যে হলেও চা কেনেন। তাহলে আমাদের চা-শিল্প বেঁচে যাবে। চা-শিল্পের এই সংকট একটি জাতীয় সমস্যা। এটা নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করি।

নিয়াজ আলি চিশতি

মহাসচিব, বাংলাদেশ বটলিফ চা কারখানা মালিক সমিতি

চায়ের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য রাখতে হবে। চাহিদা কম আর উৎপাদন বেশি হলে স্বাভাবিকভাবে বাজারে দাম কমবে। পাশাপাশি মানও কমবে। ২০০১ সালে আমাদের চা উৎপাদন ছিল ৫৩.১ মিলিয়ন কেজি , বিক্রি হয়েছিল ৩৬.৯৫ মিলিয়ন কেজি আর রপ্তানি ১২.৯২ মিলিয়ন কেজি। ২০২১ সালে মোট উৎপাদন বেড়ে গিয়ে ৯৬.৫৫ মিলিয়ন কেজি হয়। আর স্থানীয় বাজারে বিক্রি বাড়ে ৯৫.২৫ মিলিয়ন কেজি। রপ্তানি হয়েছে মাত্র দশমিক ৬৮ মিলিয়ন কেজি।

আমাদের স্থানীয় উৎপাদন বেড়েছে; কিন্তু রপ্তানি অনেক কমে গেছে। এ বছর অতিরিক্ত ২০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। চাহিদার চেয়ে এত বেশি উৎপাদনের পরেও কীভাবে নতুন নতুন জেলায় চা আবাদ বাড়ানোর চিন্তা করছে?

চা বোর্ড নতুন কারখানা স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে। নতুন কারখানা অনুমোদনের ক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ থাকা বাঞ্চনীয়।  চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ভারসাম্য রাখতেই হবে।

সিলেট, শ্রীমঙ্গল, চট্টগ্রামে বিশাল জমিতে চায়ের আবাদ হয়। আমাদের সে সংস্কৃতি নেই। পঞ্চগড়ে চায়ের আবাদ নতুন শুরু করেছে। তাই সে তুলনায় আমরা ভালো হতে পারিনি। এখানে চাষাবাদ প্রক্রিয়াটি গুরুত্বপূর্ণ।

চায়ের গুণগত মান ৯৫ শতাংশ নির্ভর করে পাতার ওপর। পাতা গুণগত মানসম্মত না হলে কোনো অবস্থাতেই চায়ের মান ভালো করা সম্ভব নয়। পঞ্চগড়ের কারখানাগুলো বাংলাদেশে যেকোনো কারখানার তুলনায় অত্যাধুনিক। শুধু পাতার কারণে আমরা ভালো মানের চা বানাতে পারছি না।

প্রথমত, কৃষকেরা পাতা বড় করে নিয়ে আসেন। কাঁচি দিয়ে ধান কাটার মতো করে চা-পাতা কাটেন। এতে পাঁচ থেকে আটটি পাতা চলে আসে। এদিকে সিলেট, শ্রীমঙ্গল, চট্টগ্রাম অঞ্চলে নখ দিয়ে পাতা চয়ন করা হয়। এতে তিনটি পাতা আসে। এখানেই চা-পাতার মানের পার্থক্যটা চলে আসে। তা ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে সার ব্যবহার করা হয়।

আমাদের পঞ্চগড়ের বাগানে ছায়াবৃক্ষ নেই। ছায়াবৃক্ষ রেইনট্রির মতো বড় গাছ থাকে। সেগুলো ছায়া দেয়। এটি চায়ের পাতার জন্য খুব দরকার। ছায়াবৃক্ষ না থাকার কারণে পাতাগুলো খরার মধ্যে বেশি বড় হয়ে যায় এবং গুণগত মান হ্রাস পায়। বাংলাদেশ চা বোর্ড যদি যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক সার প্রয়োগ, মেশিনের ব্যবহার ও চাষিদের দক্ষ করে তোলার ব্যাপারটি নিশ্চিত করে, তবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হবে।

আমিরুল হক খোকন     

সভাপতি, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র চা-বাগান মালিক ও চা ব্যবসায়ী সমিতি, পঞ্চগড় 

আমাদের এখানে চায়ের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। উত্তরাঞ্চলে চায়ের ইতিহাস মাত্র দুই যুগের। প্রথমে সরকার ও চা বোর্ডের চ্যালেঞ্জ ছিল উত্তরাঞ্চলের সমতলে চা চাষ করা। এ দুই যুগের অর্ধেক গেছে চাষের সম্প্রসারণে এবং বাকি সময়টা গেছে চা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে; অর্থাৎ আমরা এখন উৎপাদন ও বিক্রি করতে পারছি।

চায়ের নিম্নমানের কারণে আমরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আর দ্বিতীয়ত, আমরা ঠিকমতো সরকারি সহায়তা পাচ্ছি না। চা–শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন। এই মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ার জন্য কৃষি বিভাগের ঋণ, সার, ওষুধ ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। তাই চা–শিল্পকে কৃষি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে অথবা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুযোগ–সুবিধা দিতে হবে।

পঞ্চগড়ের ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ে চা চাষের যাত্রা একই সঙ্গে শুরু হয়। খাগড়াছড়িতে ঋণ সুদহার ৫ শতাংশ নির্ধারণ হয়। আর পঞ্চগড় সুদের হার নির্ধারণ করা হয় ১০ শতাংশ।  এ কারণে কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেননি। ব্যাংকঋণে কাগজপত্র জমাসহ নানা জটিলতা থাকায় চাষিরা ঋণ নিতে পারছেন না। উত্তরবঙ্গের চা বাংলাদেশে ২০ মিলিয়ন কেজি চায়ের জোগান দিতে সক্ষম হয়েছে। তা না হলে এ ২০ মিলিয়ন চা আমদানি করতে হতো। এখানে আমদানি শুল্ক সাশ্রয় হয়েছে। সরকার সে অর্থ দিয়েই তো আমাদের চাষিদের সহযোগিতা করতে পারে। কারখানাগুলো উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে, যা উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ হচ্ছে। এই জায়গায় সরকারকে সদয় হতে হবে।

পঞ্চগড়ের চা–শিল্পকে বাঁচাতে চাষিদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করার ব্যবস্থা করা হোক। সরকার ডাল চাষে ২ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। চা–শিল্পেও এ সুদহারে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন।

উত্তরাঞ্চলে সামগ্রিকভাবে ধান, পাট, ভুট্টা, গমের পাশাপাশি চা একটি অর্থকরী ফসল। এখন মানুষ এর ওপর নির্ভরশীল। পঞ্চগড়ে সিলেটে ও চট্টগ্রামের মতো এখানে দক্ষ শ্রমিকের নেই। কৃষিশ্রমিকদের আমরা চা-শ্রমিকে রূপান্তর করেছি। তাঁরা চুক্তিভিত্তিক একবেলা কাজ করেন, পরের বেলায় কৃষি বা শ্রমজীবী পেশায় ফিরে যান। ফলে তাঁদের চুক্তি হিসেবে বেশি পারিশ্রমিক দিতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। শ্রমিকের অদক্ষতায় পাতা নষ্ট হয়।

চা বোর্ড উত্তরবঙ্গের জন্য নিলামের মূল্য ১৬০ টাকা নির্ধারণ করেছে। ১৬০ টাকা হলে চাষি ২০ টাকা মূল্য পাবেন। আমরা আলোচনা করে এটা ১৭ টাকা নির্ধারণ করেছি; কিন্তু সেটিও বাস্তবায়িত হয়নি। সলিডারিডাড ও চা বোর্ড  প্রুনিং, পাতা কর্তনে ও ব্যবস্থাপনার জন্য যান্ত্রিক সহযোগিতা দিচ্ছে। পঞ্চগড়ের শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করা যাবে না, তাই শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। এ যান্ত্রিকীকরণে সহায়তা, সুদের হার ও মন্ত্রণালয়ের মারপ্যাঁচ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে হবে।

এম শাহ আলম

ডিরেক্টর অব অপারেশন, ডানকান ব্রাদার্স (বাংলাদেশ) লিমিটেড এবং সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চা সংসদ

শ্রীলঙ্কায় অনেক মানের চা আছে। আমাদের এখানে নেই। আমাদের এখানে শ্রীলঙ্কান চায়ের মান পাওয়া যায়। দার্জিলিংয়ের চা এখানে হবে না।

আগে আমরা ইংল্যান্ড থেকে চা আমদানি করতাম। তখন আমাদের দেশের মানুষ চা এত খেতেন না। এখন চা খাচ্ছেন। উৎপাদন বাড়ছে। আমাদের এখানকার সমস্যাগুলো শুধু উত্তরবঙ্গের নয়, পুরো চা–শিল্পের।

আজকের সমস্যার মূল চায়ের গুণগত মান। চাহিদা ও জোগানের ঠিক নেই। এটাই বড় সমস্যা। বিভিন্ন দেশে ধরন অনুযায়ী চায়ের দাম নির্ধারণ করা হয়। আমাদের এখানে কোনো শ্রেণিবিভাগ নেই। কিন্তু ভালো দাম পেতে হলে মান অনুযায়ী শ্রেণীকরণ করতে হবে। মালিকপক্ষকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

মধ্যস্বত্বভোগীর বদলে সরাসরি কৃষক থেকে চা কিনতে হবে। পাতার মান নির্ভর করে বপন, পরিচর্যা ও তোলার ওপর। চায়ের মান ঠিক করার ক্ষেত্রে চা বোর্ডের কাজ করতে হবে।

সিলেটে চা–শ্রমিকেরা নখ দিয়ে পাতা ওঠান না। ওঠানোটা গুরুত্বপূর্ণ। হাত কাঁচির মতো ব্যবহার করতে হয়। আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কোভিডে একটা বড় ধস গেছে। বিক্রি ও দামের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। 

চা–শিল্প কীভাবে টিকে থাকবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এখানে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। এখন সবকিছুর দাম বাড়ছে, কেবল চায়ের দাম কমছে। তাই চায়ের মান বাড়িয়ে শ্রেণি অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করতে হবে। 

ফোরাত জাহান সাথী

চা–চাষি ও চা ব্যবসায়ী, পঞ্চগড়

আমাদের পঞ্চগড়ে চাষিরা কাঁচি দিয়ে চা কাটেন। ফলে পাতার সঙ্গে ডাঁটা আসে। এতে পাতার গুণ নষ্ট হয়।

আমাদের ভালো চা পেতে গেলে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র বিকল্প কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। পঞ্চগড়ের চা–চাষিরা ছোট ছোট জমি নিয়ে চা চাষ করেন। তাঁরা আগে বিভিন্ন ধান, পাট, আখের খেতে কাজ করতেন। তাই চা চাষে তাঁদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই।

সলিডারিডাড অনেককেই পাতা কাটা যান্ত্রিকিকরনের জন্য উৎসাহিত করছে, কিন্তু ভাল দাম না পাওয়ায় কৃষক মেশিনের ব্যবহার বাড়াচ্ছেন না। কৃষকের মাঠ থেকে কারখানায় পাতা সরবরাহের জন্য যথাযথ পরিবহনব্যবস্থা নেই। আবার ওজনের মেশিনও আমাদের নেই। ফলে কারখানায় পাতা পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় ব্যাহত হয়। এতে পাতার মান হ্রাস পায়।

কিছু কিছু কারখানাতে চাষি চা–পাতা জমা দেওয়ার পর তাঁকে স্লিপ দেওয়া হয়। এই স্লিপের মেয়াদ ১৫ থেকে ৪০ দিন। আমরা ক্ষুদ্র চাষি। চা–পাতা বিক্রির টাকায় পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে হয়। কিন্তু আমাদের দীর্ঘ সময়ের জন্য স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়। তখন দালালেরা আমাদের থেকে অল্প দামে এ স্লিপ কিনে নিয়ে যান। আমরা বাধ্য হয়ে কম মূল্যে বিক্রি করে দিই। এখানে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি তাঁর আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে।

এই দালালেরা অবৈধভাবে চা বিক্রি করে আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন। তাই এই স্লিপ দেওয়া বন্ধ হওয়া উচিত। 

আমরা পরিমাণ নয়, গুণগত মানসম্পন্ন চা চাই। যেন আমাদের চা–শিল্প বিশ্বদরবারে দাঁড় করাতে পারি।

শাহেদ ফেরদৌস

সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর, ট্রেড ক্র্যাফট এক্সচেঞ্জ

ট্রেড ক্র্যাফট ভারতে চা চাষ শুরু করে। আমরা বাংলাদেশেও চা চাষ শুরু করতে চেয়েছিলাম। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের চায়ের প্রতি নজর দেওয়া শুরু করেছিলাম।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পার্থক্য আছে। ভারতের ও বাংলাদেশের ছোট বাগানের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। আমরা চার হাজার লোককে চা চাষে উদ্বুদ্ধ করেছি। চা চাষের জন্য তাঁদের প্রায় ৬৫ লাখ চারা দিয়েছি। এই চারার দাম সাড়ে তিন থেকে চার কোটি টাকা।

আমরা দুই কোটি টাকা ‘ওয়ার্কিং লোন’ দিয়েছি। দরিদ্র্য চা–চাষিরা চা চাষ ও তোলার মধ্যবর্তী সময়ে অর্থসংকটে ভোগেন। সে জন্য দুই কোটি টাকা লোন দেওয়া হয়েছে।

আমি ১০ বছর ধরে  ওই এলাকায় কাজ করেছি। চা–চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। প্রতিটি উপজেলায় আমাদের ২০ জন প্রশিক্ষক আছেন। কীভাবে চায়ের চারা লাগাতে হয়, সেসব দেখিয়েছি। 

২০০৬ সালে আমরা পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরু করেছি। সে সময়ের সঙ্গে আজ পঞ্চগড়কে তুলনা করলে বিশাল পার্থক্য দেখা যাবে।  তখন ১০ মাইল রাস্তা হাঁটার পর একটি চায়ের দোকান পাওয়া যেত। এখন সে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

চা চাষ টিকে থাকতে হলে অংশীদারত্ব দরকার। ছোট ছোট সব চা–চাষি একসঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে চা চাষ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ময়মনসিংহে ধানচাষিদের এটা করিয়েছিলাম। কিন্তু পঞ্চগড়ে চেষ্টা করেও সমন্বয় করাতে পারিনি।

চা চারার বয়স কমবেশি ৬০ বছর। কাঁচি দিয়ে কাটলে এর বয়স ৩০ বছর চলে আসে। আবার যে জমিতে ধান হয়, সে জমিতে চা চাষ করা যাবে না। এ বিষয়ে অনেক জরিপ দরকার।

ফয়জুল মতিন

উপদেষ্টা, সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া

উত্তরবঙ্গের চা–শিল্পের জন্য একমাত্র গুণগত মানের উন্নতি প্রয়োজন। চা উৎপাদনে বাগান ও কারখানা পর্যায়ে গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সিলেট, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজারে যতবার চা–পাতা উত্তোলন করা হয়, সেখানে উত্তরবঙ্গে বেশি বার ও বেশি বয়সী পাতা উত্তোলন করি। পাতার গুণগত মান উত্তোলনের সংখ্যা দ্বারা সহজেই বিচার করা যায়। এ ক্ষেত্রে করণীয়গুলো ইতিমধ্যে আলোচনা হয়েছে।

শ্রমিকঘাটতির ক্ষেত্রে চা চয়নে আমরা আধুনিক যন্ত্র যুক্ত করতে পারি। পাতা চয়নের পর সেগুলোর পরিবহনব্যবস্থার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। চা–পাতা উত্তোলনের পর প্রায়ই তা খড়ের গাদার মতো স্তূপ করে রাখা হয়। ফলে এখানে অনেক তাপ উৎপাদিত হয়। ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপে চা–পাতার এনজাইমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে চা–পাতা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চা পরিবহনের ক্ষেত্রে গাড়িতে ৫০০ কেজি ওঠানোর বদলে দুই হাজার কেজি ওঠানো হয়। এতে চা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উত্তরবঙ্গে চা–শিল্পের জন্য অত্যাধুনিক মেশিন রয়েছে, যা দিয়ে সর্বোচ্চ মানের চা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো কাঁচামাল। চা–বাগান থেকে ভালো চা না এলে কারখানায় আধুনিক যন্ত্র দিয়েও ভালো চা উৎপাদন করতে পারবে না। চা–বাগানে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না।

এ ছাড়াও গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন গ্রিন ফিল্ড টি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফয়জুল ইসলাম (হিরু),  সুপ্রিম টি লিমিটেডের তৌফিক হাসান, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র চা বাগান মালিক ও চা ব্যবসায়ী সমিতির (পঞ্চগড়) সহ সভাপতি এ বি এম আখতারুজ্জামান, ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগ্যানাইজেশনের (ইএসডিও) টি এন্ড এসোসিয়েটেড ক্রপস বিভাগের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মো. আতিকুজ্জামান, সলিডারিডাড নেটওয়ার্কের পলিসি অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসোর্স মবিলাইজেশন লিড ইপ্সিতা হাবিব, সলিডারিডাড নেটওয়ার্কের লিয়াজোঁ অফিসার মো. মাহমুদুল আলম। এছাড়া ক্ষুদ্র চা চাষীদের প্রতিনধি হিসেব উপস্থিত থেকে পঞ্চগড়ের চাচাষীদের সমস্যা তুলে ধরেন শাহজাহান খান, মো. রফিকুল ইসলাম, ইমরান আলি চৌধুরী, আবু হানিফা, কবিরুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান তরিকুল, দেওয়ান রহমান ও মো. রফিকুল ইসলাম। সবশেষে চা শিল্পের বিকাশে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান।