নারীর আগামী ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর আয়োজনে ‘নারীর আগামী ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

রাশেদা কে চৌধূরী

নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

রূপালী চৌধুরী

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বার্জার পেইন্টস

সাদেকা হালিম

চেয়ারপারসন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মালিহা কাদির

প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সহজ ডটকম

মাহফুজা লিজা বিপিএম

এসএস (ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স), স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ

লাফিফা জামাল

অধ্যাপক, রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইলিরা দেওয়ান

সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেনস ফেডারেশন

মানসী সাহা

সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারি, ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ—ভ্রমণকন্যা

সাজেদা আক্তার

সাফজয়ী নারী দলের ফুটবলার

নাজিফা জাবিন

শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, চারুকলা অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সঞ্চালনা

সুমনা শারমীন

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

সুমনা শারমীন

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘নারীর আগামী ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ’। আগামীর কথা তো বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়েই ভাবতে হবে। অগ্রজ প্রজন্ম পথ তৈরি করে দিচ্ছে বলেই নতুন প্রজন্ম সেই পথে হাঁটতে পারছে। আজ যেটা প্রাসঙ্গিক, কাল সেটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারে। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তির মধ্য থেকে নারীর নিরাপত্তাহীনতার দিকেও নজর রাখতে হবে। প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক বিশ্বে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই প্রযুক্তিতে নারীর সুযোগ বাড়াতে হবে। এসব বিষয় নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

লাফিফা জামাল

লাফিফা জামাল

প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের এই আলোচনা খুবই সময়োপযোগী। একসময় ধারণা করা হতো, প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি যাঁরা প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, তাঁরাও এলিট সমাজের মানুষ। এ ধারণা কিন্তু এখন ভেঙে গেছে। প্রযুক্তি যে সবার জন্য, আজ তা স্বীকৃত। প্রযুক্তি ছাড়া কোনো কিছুই কিন্তু সামনের দিকে এগোবে না। গত দু–তিন বছরে, বিশেষ করে করোনার সময় আমরা সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছি প্রযুক্তির আশীর্বাদ। প্রযুক্তির কল্যাণেই এ সময় ঘরে থাকলেও কোনো কাজ কিন্তু থেমে থাকেনি। পেশাদারেরা নিজেদের কাজ করেছেন, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। অনেক নারী বাড়িতে থেকে বাড়ির সব কাজ প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে করেছেন। উদাহরণস্বরূপ আমি আমার মায়ের কথা বলি। করোনার সময় তিনি শিখেছেন, অনলাইনে কীভাবে বাজার করতে হয়।

প্রযুক্তি ব্যবহার করতে আমাদের ডিভাইস প্রয়োজন। এখন ডিভাইসের মালিকানার দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাড়িতে যদি একটি ফোন থাকে, এর মালিক কিন্তু পুরুষ। শহর, গ্রাম বা মফস্‌সল এলাকায় চিত্র মোটামুটি এ রকমই। দেখা যায়, মেয়ে স্কুলে পড়ছে ভাইয়ের ফোন ব্যবহার করে। গৃহিণী নারী হয়তো তাঁর স্বামীর ফোন ব্যবহার করছেন। ডিভাইস শেয়ারিংকে আমি খারাপ বলছি না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বা গোপনীয়তার বিষয়গুলো অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য প্রত্যেকের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থাকতে হবে।

আমাদের আর্থসামাজিক সংস্কৃতিতে অনেক সময় দেখা যায়, নারীর জন্য বাইরে গিয়ে কাজ করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় পারিবারিক, সামাজিক নানা বাধা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের নারীদের যদি একটি ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকে, তাহলে ঘরে বসেও তিনি অনেক কাজ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নারীদের জন্য এফ কমার্স ও ফ্রিল্যান্সিং খুবই কার্যকর আয়ের উৎস হচ্ছে।

করোনার সময় আমরা দেখেছি, ফেসবুক ব্যবহার করে অনেক নারী উদ্যোক্তা হয়েছেন। এখন আমি ঘরে বসেই ৬৪ জেলার খাবার ও পণ্য পাচ্ছি। করোনার সময় এটি অনেক বেগবান হয়েছে। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা সেখানে অংশগ্রহণ করছেন। ঘরে বসে উপার্জনের এ সুযোগ কিন্তু প্রযুক্তি আমাদের নারীদের দিয়েছে।

আমরা স্টেম (বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-প্রকৌশল-গণিত) শিক্ষার কথা বলি। এখানে দেখা যাচ্ছে, নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। এটা কেবল আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বের চিত্র অনেকটা এ রকমই। এটা কিন্তু ধীরে ধীরে ভেঙে সামনের দিকে এগোচ্ছি। আগে আমরা দেখতাম, কম্পিউটার বা প্রযুক্তি বিষয়ে ২০-২৫ শতাংশ নারী পড়াশোনা করতেন। এখন ৩০-৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যদিও কর্মক্ষেত্রে আমরা প্রায় ১২ শতাংশের মতো নারীকে পাই, যাঁরা প্রযুক্তি খাতকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এটি কিন্তু আগের চেয়ে বাড়ছে।

আমি যখন নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেটের কথা বলি, আমাকে মনে রাখতে হবে, আমি ঢাকায় যে স্পিড পাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সুন্দরবন এলাকাতেও সে স্পিড ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তিকে সারা দেশের সব প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ সরকারের সময়ে নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে। একে আরও বেগবান করতে হবে। সবাই যেন ব্রডব্যান্ড অ্যাকসেস পান। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পাশাপাশি ইন্টারনেটও কিন্তু মৌলিক অধিকারের মধ্যে চলে এসেছে। আমরা যেন সারা দেশে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক–সুবিধা দিতে পারি এবং নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই যেন সে সুবিধা ভোগ করতে পারেন।

নাজিফা জাবিন

নাজিফা জাবিন

করোনা মহামারির সময় আমরা শিক্ষার্থীরা এক নতুন অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম। আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য আমি পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারব কি না, এ নিয়ে আমি সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকি। এখন পড়াশোনার শতভাগের মধ্যে ৫০ শতাংশেই থাকে প্রযুক্তির ব্যবহার। আমরা ঢাকায় থেকে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, গ্রামে বা যাঁদের ডিভাইস কেনার সামর্থ্য নেই, তিনি প্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছেন না। অনেক সময় তাঁরা জানেনও না।

স্কুলজীবন থেকেই যদি আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার জানি, তাহলে পরবর্তী জীবনে এটি খুব সাহায্য করবে। মেয়েরা সে ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন। ছেলেরা চাইলে মা–বাবার কাছ থেকে ডিভাইস কেনার সুযোগ পান, মেয়েরা সব ক্ষেত্রে সে সুযোগ পান না। আমার পরিচিত অনেক মেয়েকেই দেখেছি, পারিবারিকভাবে বৈষম্যের শিকার। তাদের ভাইকে হয়তো বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়। আর তাদের স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হচ্ছে।

সম্প্রতি নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আমি নিজেও ক্ষুদ্র একজন নারী উদ্যোক্তা। এ রকম যাঁরা উদ্যোক্তা আছেন, তাঁরা অনেক সময় লাইভ করেন। একটু ভুল হলেই তাঁরা অনেক সময় বুলিংয়ের শিকার হন। এই বুলিংয়ের জন্য অনেক মেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন। আমি খুব ভেবেচিন্তে ইন্টারনেটে তথ্য প্রদান করি। কিন্তু সবাই এ কাজগুলো করছেন না। এ বিষয়গুলো করা গেলে ইন্টারনেট ব্যবহার অনেক নিরাপদ হবে।

মাহফুজা লিজা

মাহফুজা লিজা

দশকের পর দশক আমরা নারীর নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কথা বলছি। তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ। নারী ও শিশুদের অফলাইন ও অনলাইনে নিরাপত্তা বিধান করা বাংলাদেশ পুলিশের একটি প্রয়োরিটি। আমাদের পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন নামে একটি ফেসবুক পেজ আছে। যাঁরা সেবাপ্রত্যাশী, অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিজনিত অপরাধের শিকার হয়ে এখানে রিপোর্ট করছেন, তাঁদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ পরবর্তী সময়ে আর আইনি পদক্ষেপ নিতে রাজি হন না। এই দুই বছরে আমরা মাত্র ১২ শতাংশ নারীকে পেয়েছি, যাঁরা আমাদের পরামর্শ অনুসারে সাধারণ ডায়েরি বা মামলা করতে রাজি হয়েছেন।

যাঁদের জীবন সৃজনশীলতা ও প্রাণোচ্ছলতায় পূর্ণ থাকার কথা, সেই সব কিশোার/তরুণীরা কেন ভয় পাচ্ছেন? দেশে কঠোর আইন থাকার পরও তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না এর কারণ মূলত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পারিবারিক সমর্থনের অভাব।

প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি, তার জন্য আমরা এখনো তৈরি হতে পারিনি। পরিবারে ছোটবেলা থেকে যদি শিশুদের নারীকে সম্মান করতে না শেখাতে পারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সাইবার সচেতনতা তৈরি না করতে পারি, তাহলে পরিচয় লুকিয়ে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে তাঁদের বিরক্ত, অবমাননা, সম্মানহানী, বিব্রত করার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। নারীদের জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিত করতে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সাইবার নিরাপত্তার জন্য বিনিয়োগকে প্রয়োরিটি দিতে হবে।

ইন্টারনেট ব্যবহারে কীভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা যায়, নারীদের সে বিষয়ে সচেতন করে তোলা জরুরি। কারণ, আমরা তো আর প্রযুক্তিকে এড়িয়ে চলতে পারব না। সব ধরনের সরকারি সেবা ও বেসরকারি খাতের অনেক সেবা আমরা অনলাইনে পাচ্ছি। আগে যে নারী-পুরুষ বৈষম্য ছিল, এখন সে বৈষম্য এক ধাপ এগিয়ে এমন দাঁড়াবে যে একদল প্রযুক্তি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে জানেন, আরেক দল প্রযুক্তি ব্যবহারে অক্ষম। তাহলে এ বিভেদটা কিন্তু ক্রমাগত বাড়বেই।

সাধারণত নারীদের টার্গেট করে সংঘটিত প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধগুলো এক ক্লিকের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে লাখ লাখ অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এ কারণে অনেক নারীই ক্যারিয়ার বা জীবন নিয়ে সামনে এগোতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। সামাজিকভাবে অবমাননাকর পরিস্থিতিতে পড়ে একজন নারী বা কিশোরী তার ভবিষ্যৎ গড়তে বাধা পাচ্ছে। এটি অপূরনীয় ক্ষতি। এই ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে এবং আরো ১০ জন নারীকে সুরক্ষিত রাখতে আমাদেরকে নিরাপদে প্রযুক্তি ব্যবহারের উপায় জানতে হবে। ভুক্তভোগীদের বিদ্যমান আইনি সহায়তা নিতে এ ধরনের ক্রাইম রিপোর্ট করতে হবে, এর মাধ্যমে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। কারণ, যখন অপরাধীরা দেখে যে কিছুই হচ্ছে না, এতে তাঁদের সাহস আরও বেড়ে যায়। আরও ১০ জন নারীকে তাঁরা শিকারে পরিণত করতে পারেন। প্রযুক্তি নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির সুফল আরও ব্যপক হারে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে পৌঁছে দিতে হবে।

ইলিরা দেওয়ান

ইলিরা দেওয়ান

প্রযুক্তি আমাদের চিন্তাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছু জানার প্রয়োজন হলে আমরা গুগল করি, নিজে মনে রাখি না। করোনাকালে আমরা প্রযুক্তির সঙ্গে এতটা জড়িয়ে গেছি যে এতে আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের অনেক পাহাড়ি মেয়ে তাদের চিন্তা-পরিকল্পনাকে অনলাইনের সাহায্যে ব্যবসায় রূপ দিয়েছেন। এখন অনলাইনের মাধ্যমে পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় খাবার পাওয়া যায়। অনলাইন ব্যবসা নারীদের আর্থিকভাবে যেমন স্বাবলম্বী করছে, মানসিকভাবে তেমনি আত্মপ্রত্যয়ী করেছে।

করোনাকালে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করেছেন। আমরা ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ফোর–জি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছি, কিন্তু পাহাড়ে তো এখনো টু–জি নেটওয়ার্ক রয়ে গেছে। এ রকম ধীর নেটওয়ার্কে অনলাইনে ক্লাস করা যায় কীভাবে? সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অভিভাবকেরাও তো ইন্টারনেটের ব্যবহার বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন। এরপর ভাষাগত সমস্যাও একটি বিষয়। ফলে করোনাকালে পাহাড়ি শিশুরা অনেক পিছিয়ে গেছে।

প্রযুক্তির ব্যবহারে সমান সুযোগের বিষয়টি খুবই জরুরি। পার্বত্য তিন জেলা সদরে ফোর–জি পাওয়া গেলেও উপজেলা পর্যায়ে নেটওয়ার্ক অনেক ধীরগতির হয়ে যায়। বাংলাদেশ নব্বইয়ের দশকে মোবাইল নেটওয়ার্ক এসেছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক এসেছে ২০০৮ সালে। স্বাভাবিকভাবে পাহাড়ের মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে দেরিতে পরিচিত হয়েছেন। শিক্ষার হার কম হওয়ার কারণে তাঁদেরও এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছে।

আমরা তো ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কথা বলছি। একটা অংশকে আঁধারে রেখে আমরা কখনো এগিয়ে যেতে পারি না। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও প্রযুক্তির বিকাশ নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে, আলাদা বরাদ্দ দিতে হবে।

সাজেদা আক্তার

সাজেদা আক্তার

আমার গ্রামের বাড়ি একদম পাহাড়ি এলাকায়, ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামে। সেখানে কেউ আমাদের খেলতে দিতে চাইতেন না। মেয়েরা খেলাধুলা করছে! তাঁরা অবাক হতেন। গ্রামের মানুষজন অনেক কটূক্তি করতেন। আমরা ওসবে কান না দিয়ে নিয়মিত খেললাম। অনেক সময় পরিবারও অনাগ্রহ দেখাত। দেশের জন্য জয় আনার পর সবাই আসছেন দেখার জন্য, ছবি তোলার জন্য। অনেকে অভিনন্দন জানানোর জন্য আসছেন।

আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন খেলাধুলা শুরু করি। এখন আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমরা তিন ভাই, দুই বোন। বাবা কৃষক, মা বাসায় কাজ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি চতুর্থ। আমি জাতীয় দলে যোগ দেওয়ার পর যে বেতন পেতাম, তা দিয়েই আমার পরিবার চলত। আমরা কিছুদিন আগে নেপালে সাফ ফুটবল বিজয়ী হয়ে দেশের জন্য একটি শিরোপা জয় করেছি। এখন আমি লিগের ক্লাবগুলোয় খেলছি। মাঝখানে কিছুদিন পরীক্ষা ছিল। খেলাধুলায় বিরতি পড়েছে।

বর্তমানে আমি বাড়িতেই আছি। কিছুদিন আগে এসএসসি পরীক্ষা ছিল। একটা বিষয়ে ফল খারাপ এসেছে। আমি ওই একটা পরীক্ষায় পাস করতে চাই। পরিবার যেহেতু আছে, তাদের জন্য ভালো কিছু করতে চাই। আমি পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাই, ওখানেই ফুটবল খেলা চালিয়ে যেতে চাই।

মানসী সাহা

মানসী সাহা

আমি পেশায় একজন চিকিৎসক। এর পাশাপাশি ভ্রমণ করা আমার শখ। ভ্রমণের শখ সবারই থাকে। ছোটবেলায় বইয়ের পাতায় যা পড়েছি, তা চোখে দেখার মজাই অন্য রকম। কিন্তু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারীর ভ্রমণে বের হওয়া সহজ নয়। বাবা-মায়েরা বলেন, বাইরে গেলে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতে হবে। ভ্রমণের কথা বললে তাঁরা বিয়ের পর বরের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেন। এই কথাগুলো আমরাও শুনেছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আমরা বান্ধবীরা এ বাধা অতিক্রম করার চিন্তা করি। এ জন্য আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার জন্য একটা কমিউনিটি তৈরি করি। একসঙ্গে সবাই গেলে পরিবার হয়তো নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত থাকবে না। এভাবেই ২০১৬ সালে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ—ভ্রমণকন্যার যাত্রা শুরু হয়।

প্রযুক্তি আমাদের সবাইকে সুতার মতো গেঁথে রেখেছে। শুরুর দিকে আমরা অল্প কিছু মানুষকে পেয়েছি। এখন আমাদের সদস্যসংখ্যা ৭০ হাজারের মতো। তারা আমাদের সঙ্গে প্রযুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ওয়েবসাইট, মুঠোফোন ইত্যাদি। ভ্রমণে আমরা কোথায় যেতে চাই, তা জানানোর পর যাঁরা যাবেন, তাঁরা আমাদের নিশ্চিত করেন। এটি পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর। এরপর তাঁরা অনলাইনে টাকা পাঠান, এটিও একধরনের প্রযুক্তি। পরবর্তী সময়ে আমরা অনলাইনে টিকিট কাটি। এটিও প্রযুক্তির সাহায্যে সম্পন্ন হয়।

মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আমার সহপাঠীদের অর্ধেক ছিল নারী, বাকি অর্ধেক পুরুষ। কিন্তু যখন চিকিৎসক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর দেখা যায় নারীর সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশে নেমে আসছে, বাকি ৭৫ শতাংশ বা এর বেশি পুরুষ। এ ধারণার পরিবর্তন খুবই জরুরি।

নারী দিবস বা যেকোনো বিষয়ে আমরা নারীরা বসে কথা বলি। আমরা আমাদের জন্য যেমনভাবে কথা বলছি, পুরুষদেরও আমাদের বিষয়ে তেমনিভাবে কথা বলা জরুরি। ‘হি ফর শি’(He for she) ধারণা বাস্তবায়ন না করতে পারলে আমরা একটা বাবলের মধ্যেই থেকে যাব। এখন আমরা সে সময়ে এসেছি, যেখানে বিদ্যমান গ্যাপ পূরণে পুরুষেরাও আমাদের জন্য কথা বলবেন, অ্যাডভোকেসি করবেন। তাঁরা আমাদের সহযোগিতা করবেন, সেটা হোক নারীত্বে, পর্যটনে, স্বাস্থ্যে কিংবা প্রযুক্তিতে।

মালিহা কাদির

মালিহা কাদির

বাংলাদেশে ইন্টারনেটের খরচ অনেক বেশি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এটা অনেক অনেক বেশি। ওয়াই–ফাই সেবার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এটি ইন্টারনেট ব্যবহারে বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। সরকারের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। সরকার অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার ফলে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়বে। কিন্তু ইন্টারনেটের উচ্চ মূল্য এখানে সমস্যার সৃষ্টি করবে। ফোনের দাম কিন্তু অনেক কমে এসেছে।

আমি প্রযুক্তির প্রতি মানসিকতা নিয়ে বলতে চাই। অনেকে বলছেন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে তাঁদের ভয় হয়। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করে দেয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যত প্রযুক্তি এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে এমএফএস (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস)। কারণ হচ্ছে আর্থিক প্রয়োজন। এটি মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সাহায্য করে। প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা উপার্জন করি। এটি আর্থিক স্বাধীনতা দেয়, যা নারীদের জন্য ভীষণ প্রাসঙ্গিক। একটা মুঠোফোন একধরনের বিনিয়োগ। বিষয়টি যদি একজন নারীর স্বামী বোঝেন যে ফোন দিয়ে পরিবারের কী উপকার হবে, তাহলে তিনি বাধা দেবেন না। কারণ, ফোন দিয়ে শিশুরা পড়ালেখা করছে, নারী হয়তো কোনো উপার্জনের কাজে লাগাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রচারণা কম। এটি ছড়িয়ে দিতে হবে।

নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও নানা রকম মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। ইউটিউব দেখেও অনেক কিছু শেখা যায়। একজন মেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর মা–বাবা কোনোভাবে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে ওই মেয়ে ইন্টারনেটে সব খুঁজে অনলাইনে আবেদন করেছেন এবং তিনি স্কলারশিপও পেয়েছেন। পরে মা–বাবা কিছু বলতে পারেননি; কারণ, তাঁদের তো কোনো টাকাই দিতে হয়নি। প্রযুক্তি আমাদের এভাবে তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। আমি বলছি, প্রযুক্তিতে কঠিন কিছু শেখার দরকার নেই। জানতে হবে, কীভাবে তথ্য খুঁজতে হয়।

শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসতে হবে। আমি সবাইকে কম্পিউটারবিজ্ঞান পড়তে বলছি না। কিন্তু প্রযুক্তির প্রাথমিক ব্যবহারগুলো জানতে হবে। তাহলে একজন নারী ঘরে বসে দমবন্ধ হয়ে মরবেন না। তিনি অনলাইনে কোর্স করে ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন এবং উপার্জন করতে পারেন। সুতরাং আমাদের জানতে হবে, কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে অনলাইনে তথ্য খোঁজা যায় এবং কীভাবে অনলাইন জীবনের প্রতিটি ধাপে সাহায্য করতে পারে। সুতরাং নারী-পুরুষ সমতার জন্য প্রযুক্তি বড় একটি নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।

রূপালী চৌধুরী

রূপালী চৌধুরী

একজনের জন্মের সময় যা বিদ্যমান ছিল, তা তার জন্য প্রযুক্তি নয়। যেমন আমার জন্মের সময় টেলিভিশন ছিল, টেলিভিশন আমার জন্য প্রযুক্তি নয়, এটা জীবনের অংশ। পরে যেসব বিষয় উদ্ভাবিত হয়েছে, সেটা আমার জন্য প্রযুক্তি। প্রতিনিয়ত উন্নতি করা আমাদের শেখার অংশ। সর্বশেষ প্রযুক্তির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক থাকাও একটা চ্যালেঞ্জ।

আমরা যখন চাকরির সাক্ষাৎকার নিই, আমাদের চেষ্টা থাকে যেকোনো অবস্থানের জন্য পাইপলাইন ঠিক রাখা। আমাদের বেশির ভাগ নিয়োগ হয় সেলস বা প্রোডাকশন বিভাগে। এখানে নারীদের নিয়োগ দিতে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু মাঠকর্মী হিসেবে মেয়েদের নিয়োগ দিতে আমরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় পাই। আমরা যদি আগামীর কথা ভাবি, তাহলে আমাদের স্কুলগুলোতে কেবল ভাসা ভাসা প্রযুক্তিজ্ঞানের পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহারিক শিক্ষা দিতে হবে।

মেয়েরা এখন কাজে অনেক মনোযোগী। কারণ, তাকে তো সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতে হবে। সে জন্য তারা নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত তার শতভাগ মনোযোগ দিয়েই কাজ করে।

আমাদের মধ্যবিত্তরাই কিন্তু বৈষম্য বেশি করছে। পোশাক খাতে যে ২২ লাখ মেয়ে কাজ করে, তারা দেখিয়েছে, কাউকে না চিনে শহরে এসে টিকে থাকা যায়। আমাদের মধ্যবিত্তের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। এ জন্য প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এখন অনেকেই বুঝছেন, ছেলের চেয়ে একজন মেয়ের পেছনে ব্যয় করা ভবিষ্যতে তাঁদের জন্যই মঙ্গলজনক। সুতরাং আমি মনে করি, মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

এ ছাড়া মেয়েদের সফলতার গল্পগুলো প্রচার করতে হবে। এ জন্য গণমাধ্যমকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে নেতিবাচক বিষয়গুলোই বেশির ভাগ স্থান পায়। এ বিষয়ে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। এটা হওয়া উচিত। আমাদের নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে কম। এটি বাড়াতে হবে।

সাদেকা হালিম

সাদেকা হালিম

আমি কিছু আশার কথা দিয়ে শুরু করতে চাই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। তার পেছনে অনেকগুলো উপাদান কাজ করেছে। এর মধ্যে প্রযুক্তিও কিন্তু একটা বড় উপাদান। বিশেষ করে করোনাকালীন দুই বছর আমরা গৃহবন্দী ছিলাম, সীমিত আকারে অফিসসহ অন্যান্য কাজ করেছি। আমি তখন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তখন অনলাইনে পাঠদান ও পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এটি সম্ভব হয়েছিল কেবল প্রযুক্তির কারণে।

প্রযুক্তি নিয়ে ভীতি থাকা স্বাভাবিক। জেন্ডার ইকুইটির দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়েছি। নারীরা কিন্তু ইতিমধ্যেই একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। নারীকে কীভাবে প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়ে ইউনেসকোর গবেষণা বলছে, সাংস্কৃতিক জগতের একটা পরিবর্তন করতে হবে। তারা নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের কথা বলছে। ২০২০ সালে মাত্র ১২ শতাংশ নারী আইসিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁরা শুরু ও মধ্যম পর্যায়ের কাজে যুক্ত। তাঁরা আইসিটি খাতে নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় যেতে পারেননি।

আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তিন ধরনের পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এমনকি মা নিজেও অনেক ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছেন। কেননা, একটা সিস্টেম তৈরি হয়ে গেছে। ওই সিস্টেমকে না ভাঙলে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। পিতা-মাতা হয়তো গর্ব করে বলছেন, ‘আমার মেয়ে বুয়েটে পড়ে, বা আইসিটিতে পড়ে।’ কিন্তু যখন তাঁকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ও কিন্তু আর সব সময় কাজ করতে পারছেন না।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশ এজেন্ডা কেবল পুরুষের জন্য নয়। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ নারী। এই নারীরা কিন্তু বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত। কেউ পাহাড়ি, কেউ সমতলের বাসিন্দা, দলিত আছেন, হরিজন আছেন, যৌনকর্মীরা আছেন। সবাইকে আমরা কীভাবে প্রযুক্তির সুফল ভোগ করতে একই ছাতার নিচে আনব? এটি বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে অনেক এনজিও কাজ করছে। এখানে একটা সমন্বয়ের প্রয়োজন।

চ্যালেঞ্জগুলো দূর করার সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে শিক্ষা। এমডিজিতে ঝরে পড়ার হার বেশি ছিল। ব্যানবেজের উপাত্ত বলছে, জুনিয়র লেভেলের শিক্ষার্থীদের ৫৪ দশমিক ৪১ শতাংশ নারী। কিন্তু মাস্টার্স লেভেলে এটি কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ৭৮। আশার কথা হচ্ছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালে টারশিয়ারি লেভেলে ৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী পড়াশোনা করতে গেছেন। এই শিক্ষা নিয়ে কত দূরই–বা যাওয়া যাবে!

সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে কুসংস্কার। এটি অত্যন্ত প্রবল। আমি যখন ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট নির্বাচন করি, আমাকে বলা হয়েছিল, রাতে ছাত্রদের মারামারি হলে আমি কীভাবে আসব! মেয়েরা পারবে না—এ রকম অপপ্রচার অনেক বড় সমস্যা তৈরি করে।

নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টিও অনেক জটিল। এখন নতুন ধরনের সহিংসতা দেখা যায়। সেটি হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। এটি বেড়েছে। সাইবার ক্রাইমের ভুক্তভোগী নারীরা মনে করেন, এগুলো জানাজানি হলে তাঁদের অনেক সামাজিক সমস্যা হবে। আবার পুরুষ পুলিশরা সবাই তাঁকে এক চোখে দেখেন না। অনেক সময় উল্টো তাঁকেই ব্লেমিং করা হয়। আমি নিজে একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। আমি নিজেও অনেক পরিমাণে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছি। ডিবি পুলিশকে জানালে তারা বলে সব ফেক আইডি। এখন এই ফেক আইডি কীভাবেতৈরি হচ্ছে, তা তো আমার দেখার কথা না, সেটা পুলিশ দেখবে। নারীদের প্রযুক্তি অপব্যবহার করে যতক্ষণ হয়রানি, নিরুৎসাহিত করা হবে, ততক্ষণ কিন্তু তাঁরা প্রডাক্টিভ হতে পারবেন না। নারীদের সাইবার নিরাপত্তা দিতে হবে।

রাশেদা কে চৌধূরী

রাশেদা কে চৌধূরী

আমরা সবাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সমাবেত হয়েছি। আমি কয়েকটি তথ্যের কথা উল্লেখ করতে চাই। ইউনেসকোর গত বছরের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বব্যাপী ২৫ বছর পর্যন্ত তরুণ-তরুণীদের এক–তৃতীয়াংশের ইন্টারনেটে অ্যাকসেস নেই। অনুন্নত দেশগুলোর মাত্র ৩১ শতাংশ পুরুষ ও ১৯ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন। ইউনেসকোর আরেকটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে ২৮ শতাংশ নারী প্রকৌশল পেশায় আছেন, যার ৪০ শতাংশ কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট। এ বৈষম্য তো সারা বিশ্বেই আছে। সুতরাং আমরা ধরেই নিতে পারি বাংলাদেশে লিঙ্গসমতার ক্ষেত্রে নানা দিক থেকে বৈষম্য আছে।

প্রযুক্তি কী করে সবার জন্য উন্মুক্ত করা যায়, তা ভাবতে হবে। লৈঙ্গিক সমতাও জরুরি। এখন আমরা বলছি, প্রযুক্তি ছাড়া উপায় নেই। মেয়েরা যে কীভাবে এগোচ্ছেন! আমার গৃহপরিচারিকাও এখন ইউটিউব দেখে রান্না শেখেন। প্রযুক্তিতে নারীকে একটু অ্যাকসেস দিলে তিনি অনেক কাজ করতে পারেন। কিন্তু সেখানে যে ঝুঁকি থাকে, তা আমরা প্রশমন করতে পারছি না। ইউটিউবে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, বিদ্বেষ ছড়ান হচ্ছে। আমরা একে কীভাবে প্রতিরোধ করব? প্রযুক্তিকে ভয় পাওয়া যাবে না। কীভাবে ব্যবহার করা যাবে, সেটা জানতে হবে, শিখতে হবে, বুঝতে হবে। এটি খুবই জরুরি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি—এ দুই জায়গায় দৃষ্টি না দিলে তো হবে না।

শিক্ষার চার অংশীজন—শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসন। আমরা তো কেবল আমাদের শিক্ষার্থীদের কথাই বলছি। শিক্ষকেরা নিজেরাই তো শিক্ষক প্রশিক্ষণে নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ পান না। তাঁরা যদি নিজেরাই না জানেন, তাহলে শ্রেণিকক্ষে শেখাবেন কীভাবে? এই জায়গায় আমাদের গুরুত্ব বেশি দেওয়া উচিত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো মেয়েদের হেনস্তাসংক্রান্ত বিষয়ে কমিটি হওয়ার কথা। কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কমিটি গঠিত হয়েছে, তা জানা প্রয়োজন। এটি হওয়া উচিত, মহামান্য আদালতেরও নির্দেশনা আছে। কিন্তু হয়নি এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ জায়গায়। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ইন্টারনেটের ধীরগতি। তেঁতুলিয়া, সুনামগঞ্জ হাওরে, চা–বাগানে বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ জায়গায় রাষ্ট্রের বড় দায়িত্ব ইন্টারনেটের গতি বাড়ানো। মুঠোফোনের দাম হয়তো কমেছে, কিন্তু এত উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদি মাসে ৫০০ টাকার ডেটা কিনতে হয়, তাহলে ব্যবহার করা যাবে কীভাবে?

আরেকটি বিষয়ে বলি। এ বছর বইমেলায় কি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগোষ্ঠীর ভাষায় বই এসেছে? একটি–দুটি যদি হয়েও থাকে, আমরা তা প্রোমোট করিনি। সারা পৃথিবীতে আমরা মাতৃভাষাকে এত গৌরবময় অবস্থান দিয়েছি। মাতৃভাষা তো কেবল মূলধারার জনগণের নয়, এটা সবারই হওয়া উচিত। এদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আর প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করা উচিত।

আর আমাদের সবার মাথায় আছে—নারী দুর্বল। কিন্তু নারী ও পুরুষ একসঙ্গে পানিতে ডুবে গেলে ফায়ার ব্রিগেড আগে পুরুষকে সহায়তা দেয়। কারণ, নারী বেশিক্ষণ বাঁচেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের কাজ সন্তান জন্মদান। নারী এ কষ্ট সহ্য করেন। তারপরও নারীকে আমরা কেন দুর্বল ভাবি! সরকার সারা দেশে শেখ রাসেলের নামে ১০ হাজার কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে। কিন্তু প্রশিক্ষক নেই বেশির ভাগ জায়গায়। শ্রেণিকক্ষের চালিকা শক্তি শিক্ষককেই যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ না দেওয়া হয়, তাহলে ল্যাব করেও কোনো লাভ হবে না।

শিক্ষার বাজেটে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জিডিপির হারে আমাদের শিক্ষা বাজেট দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নিম্নতম। এত দূর এগিয়েছি, তারপরও কেন আমরা শিক্ষা বাজেট বাড়াচ্ছি না? বেশির ভাগ টেকনিক্যাল ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইনস্ট্রাক্টর নেই, খালি পড়ে আছে। অথচ আমরা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কথা বলছি। কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় গ্রামের একটি শিশু সেভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পায় না, যা হয়তো শহরের একটি শিশু পায়। এ বৈষম্যগুলো আমাদের দূর করতে হবে।

সুমনা শারমীন

আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ।

সুপারিশ

■ প্রযুক্তিতে নারীর সুযোগ বাড়াতে হবে

■ নারীর জন্য প্রযুক্তির ভাষাকে সহজ করতে হবে

■ নারীকে অনলাইন সহিংসতা ও হয়রানি থেকে সুরক্ষিত রাখতে ব্যবস্থা নিতে হবে

■ সাইবার সচেতনতা বিষয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া বাঞ্ছনীয়

■ নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি হবে

■ শিক্ষার বাজেটে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে

■ প্রযুক্তিভীতি কাটাতে স্কুল থেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে শিশুদের পরিচিত করতে হবে

■ প্রযুক্তির বিস্তারের ক্ষেত্রে পাহাড়ের মানুষদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি

■ দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট সেবা শক্তিশালী করতে হবে

■ ইন্টারনেট ব্যবহারের উচ্চ খরচ কমানো জরুরি