ইউএসএআইডির সহযোগিতায় কেয়ার বাংলাদেশের সৌহার্দ্য–iii কর্মসূচি ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘চর ও হাওরাঞ্চলে বাল্যবিবাহের বিদ্যমান অবস্থা এবং তা থেকে উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
অংশগ্রহণকারী:
রমেশ সিং
কান্ট্রি ডিরেক্টর, কেয়ার বাংলাদেশ
মো. মোকতার হোসেন
পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা), সমাজসেবা অধিদপ্তর
মার্ক নসবাহ
চিফ অব পার্টি, সৌহার্দ্য–iii কর্মসূচি, কেয়ার বাংলাদেশ
আয়শা সিদ্দিকী
উপপরিচালক (পরিকল্পনা), মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর
শাহনাজ এ জাকারিয়া
সিনিয়র অ্যাডভাইজার, হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স অফিস, ইউএসএআইডি
সৈয়দা আশরাফিজ জাহারিয়া প্রধান
অ্যাডভাইজার-উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট, সৌহার্দ্য–iii কর্মসূচি, কেয়ার বাংলাদেশ
তানিয়া হক
অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মাহীন সুলতান
সিনিয়র ফেলো অব প্র্যাকটিস, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
আলী আসগর স্বপন
পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ঢাকা
মো. ইকবাল হোসেন
মহাসচিব, বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতি
নিশাত সুলতানা
উপপরিচালক (অ্যাডভোকেসি),ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
তাহমিনা হক
প্রোগ্রাম অফিসার, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
মৌসুমী শারমিন
জেন্ডার কো-অর্ডিনেটর, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
চর ও হাওরাঞ্চলে বাল্যবিবাহের বিদ্যমান অবস্থা নিয়ে সৌহার্দ্য–iii কর্মসূচি কেয়ার বাংলাদেশ কাজ করছে। এ বিষয়ে তারা কিছু সুপারিশও করেছে। তা নিয়েই আজকের আলোচনা। এ আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা হয়তো একটা সুপারিশমালা তৈরি করতে পারব। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও কোভিডের সময় তা আবার খারাপ হয়েছে। এ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেড়েছে। বাল্যবিবাহ সব সময়ই একটা অভিশাপ।
সাত বছর ধরে কেয়ার বাংলাদেশ সৌহার্দ্য–iii কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, যেটি সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় কর্মসূচি। অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নিয়ে এ কর্মসূচির কাজ। লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক বিশ্বাস ও রীতিনীতি, লৈঙ্গিক অসমতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি না হওয়া ও দারিদ্র্য বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ।
২০২০ সালের নভেম্বরে কেয়ার বাংলাদেশ ‘গ্রাস রুট অ্যাপ্রোচেস টু প্রিভেন্ট চাইল্ড ম্যারেজ’ নামে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। বাল্যবিবাহ রোধে তৃণমূল পর্যায়ের কাঠামো পর্যালোচনা করা এর লক্ষ্য ছিল। গবেষণার এ ফলাফল বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। সৌহার্দ্য–iii কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা সামাজিক বিশ্বাস, রীতিনীতি ও জেন্ডার স্টেরিওটাইপ ভাঙতে নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানাচ্ছি।
এখানে কিশোর, পুরুষ ও ধর্মীয় নেতাদের যুক্ত করা, টেলিভিশনে আলোচনাসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানানো হয়। এসব বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে গতানুগতিক ও অনলাইন মাধ্যমও ব্যবহার করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ বাল্যবিবাহ বাড়ার ক্ষেত্রে একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এ সময় মেয়েশিশুরা স্কুলে না যাওয়া, অর্থনৈতিক দুর্দশা, চলাচলে বাধা ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে আলোচনা ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে কেয়ার বাংলাদেশ আজকের এ গোলটেবিলের আয়োজন করেছে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আমাদের জন্য সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে।
কোনো নারী বা কিশোরীর সফলতা মানেই একটি জনপদের সফলতা। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমাদের মেয়েরা সব জয় করতে পারে। সাফ গেমসে জয় এর অন্যতম উদাহরণ। চর ও হাওরাঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক জায়গায় আমাদের বলিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। বিয়ে ও জন্মনিবন্ধনের ডিজিটাল সনদ এবং দ্বিস্তরবিশিষ্ট যাচাইয়ের প্রক্রিয়া চালু করা এর মধ্যে অন্যতম।
আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে দুটি জায়গায় জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, জন্মনিবন্ধন সনদ সঠিক কি না, তা প্রমাণ করা। দ্বিতীয়ত, বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে যেন বর ও কনের জন্মনিবন্ধন সনদ দ্বারা বয়স যাচাই করতে পারি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ ও বিয়ে নিবন্ধনের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।
স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ বয়স যাচাই করবে। আমাদের প্রস্তাব বাল্যবিবাহ রোধ আইন কমিটি যেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সৌহার্দ্য–iii কর্মসূচিতে আমরা আটটি জেলায় কাজ করি। তার মধ্যে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও রংপুরে এ কমিটি করার একটা প্রচেষ্টা হয়েছে। এ কমিটিগুলোর ভূমিকা হবে সঠিক জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করা। দুই ধাপের নিরাপত্তার কাজটিও হচ্ছে কি না, তা তারা নিশ্চিত করবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয় করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই এখন দারিদ্র্যের কশাঘাত দেখা যাচ্ছে। এ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে অভিভাবকেরা নিজের মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে অন্যের বাড়িতে পাঠাচ্ছেন।
এখানে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জরিপ করে আর্থিক ও সাধারণ প্রণোদনা প্যাকেজ চালুর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ প্রণোদনা পেলে অভিভাবকেরা বাল্যবিবাহের প্রতি নিরুৎসাহী হবেন। পাশাপাশি মেয়েশিশুরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবে। মেয়েশিশুদের বোঝা মনে করা পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করা দরকার। এসব পরিবারকে মুঠোফোনে আর্থিক সেবার মাধ্যমে সুরক্ষা খাতের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।
বাল্যবিবাহ রোধে ধর্মীয় নেতা, স্থানীয় বিয়ে নিবন্ধক ও স্কুলের শিক্ষকেরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া, যেন তাঁরা বাল্যবিবাহের কুফল, মেয়েদের উপযুক্ত বয়সে বিয়ের গুরুত্ব এবং মেয়েদের ক্ষমতায়নের সুফল নিয়ে সচেতনতার বার্তা প্রদান করতে পারেন। প্রতিটি গ্রামে মেয়েদের দল করা যেতে পারে। তারা যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে একত্রে কাজ করবে।
২০০৫ সালে সৌহার্দ্য প্রকল্পটি শুরু হয়। সৌহার্দ্য–i শুরুর সময়ে প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলে খুব বেশি উন্নয়ন সহযোগী ছিল না। সমস্যাগুলোও চিহ্নিত ছিল না। এ কারণে প্রথম দিকে সৌহার্দ্য প্রকল্পের মডেল বাস্তবায়ন এত সহজ ছিল না।
তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে এ প্রকল্প শুরু হয়। আলোচনায় অনেক সুপারিশ এসেছে, যা কারও একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টায় উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে সহায়তা করছে। মূলত, সমস্যাগুলো সমাধানে বাংলাদেশ সরকার নিজেই সক্ষম। উন্নয়ন সহযোগীরা এ সমস্যা সমাধান ত্বরান্বিত করা ও সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে।
বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণ করছে। এটা এক দিনে হয়নি। এখনো প্রায় ৫০ শতাংশ বাল্যবিবাহ হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো এ সংখ্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব। মানুষের মধ্যে বাল্যবিবাহ নিয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
এটা একটা বড় সাফল্য। আইনের পরিবর্তন হয়েছে। একটা সময় জন্মনিবন্ধন, মেয়েদের স্কুলের যাওয়ার ব্যাপারগুলোই ছিল না। এখন আমরা জন্ম ও বিয়ে নিবন্ধনের কথা বলছি। এই সবই সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে সম্ভব হয়েছে। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা পরের ধাপে পৌঁছাতে পারব।
বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে নিকাহ নিবন্ধনের বিষয়টি চলে আসে। নিবন্ধন ছাড়া আমরা বিয়ে পড়াই না। একসময় ইমামরা বিয়ে পড়াতেন আর কাজিরা তা নিবন্ধন করতেন। বর্তমান সরকারের আইন অনুযায়ী নিবন্ধন ছাড়া বিয়ে অবৈধ। তাই কাজি–ইমামরা নিবন্ধন ছাড়া বিয়ে পড়ান না।
আমরা জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া বিয়ে নিবন্ধন করি না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি আমাদের এ বাল্যবিবাহ পড়াতে চাপ দেন।
কিছুদিন আগে এ রকম একটি বাল্যবিবাহ হয়। স্থানীয় চেয়ারম্যান কাজিকে চাপ দিয়ে এ বিয়ে পড়ান। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানতে পারেন। এ কারণে তিনি সব যাচাই করে সেই কাজিকে এক মাসের জেল দেন।
অনেক খবরই গণ্যমাধ্যমে আসে না। বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আমরা জন্মনিবন্ধন সনদ ব্যবহার করি। তবে আমি মনে করি, বয়স প্রমাণের জন্য জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে স্কুল সার্টিফিকেট দেখা উচিত। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫ হাজার ৮৫০ জন নিকাহ রেজিস্ট্রার আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বয়স্ক। তাঁরা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করেন না। তাই তাঁরা যাতে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন যাচাই করতে পারেন, সে জন্য সরকার থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে বাল্যবিবাহ অনেক কমে যাবে।
সমাজে প্রচলিত নিয়মগুলো পরিবর্তন প্রয়োজন। ১৬ বছর মানেই বয়স হয়ে যাচ্ছে, তা পরিবার, সমাজ ও প্রতিবেশীরা যেন না ভাবে। একটা মেয়ে স্বাধীনভাবে চলা মানে তার ও পরিবারের জন্য হুমকি—এ মনোভাব অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। এ পরিবর্তন মেয়েরা বা পরিবার এককভাবে করলে হবে না। কমিউনিটি ও সরকারের সহায়তা না পেলে এটা করা সম্ভব হয় না।
কমিউনিটি পর্যায়ে এ সহযোগিতা করা হলে মেয়েদের ও পরিবারের মধ্যে প্রচলিত নিয়মগুলো পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত, যেমন মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, পড়তে চাওয়া, কাজ করতে চাওয়া।
গণমাধ্যমেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অনেক সময় বলা হয়, দারিদ্র্যের কারণে বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের গবেষণায় এসেছে, এটা একটা অজুহাত। এটা বলে তারা বাল্যবিবাহকে সামাজিকভাবে বৈধ করতে চায়। এসব মেয়েকে আয়মূলক কাজ দেওয়া গেলে তাদের সাহস বাড়ে। পাশাপাশি পরিবারও ভাবে যে বিয়ে না দিয়েই তো মেয়ের একটা জীবিকার ব্যবস্থা হচ্ছে।
কাজিরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিবন্ধন করছেন কি না, তা তদারকি করা দরকার। বাল্যবিবাহ ঠেকালে জনপ্রতিনিধিদের ভোট কমে যাবে না বরং বাল্যবিবাহ ঠেকালে তো বেশি ভোট পাওয়া উচিত।
রাজনীতিকদের মধ্যেও প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর পরিবর্তন করা দরকার। বাল্যবিবাহ ঠেকানোকে তাঁদের একটা বড় অর্জন মনে করা উচিত।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য হলো নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষা এবং তাদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সামগ্রিক উন্নয়ন ও মূল স্রোতোধারায় সম্পৃক্ত করা। আমাদের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন হয়েছে। এ আইনের ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ কর্মপরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সের কন্যাশিশুর বিবাহ নির্মূল করা। পাশাপাশি ১৮ বছরের কম বয়সের কন্যাশিশুর বিয়ে এক-তৃতীয়াংশে নিয়ে আসা। ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণভাবে নির্মূলের লক্ষ্য রয়েছে।
একা কোনো কাজই হয় না। সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও সব উন্নয়ন সহযোগী মিলে আমরা এসব বাস্তবায়ন করব। আমাদের সঙ্গে সৌহার্দ্য হাওরাঞ্চলে অনেক কাজ করে থাকে। হাওরাঞ্চলে কন্যাশিশুদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য আমাদের কিছু প্রকল্প আছে।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আমরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে এগিয়ে আনব। এ জন্য চর ও হাওরাঞ্চলের ওপর আমরা জোর দিয়েছি।
আমাদের ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট প্রোগ্রাম (ভিডব্লিউবিপি) কর্মসূচি রয়েছে। ঘরে কিশোরী মেয়ে থাকলে পরিবারগুলো এ কর্মসূচি থেকে সুবিধা পায়। সে ক্ষেত্রে মেয়েকে বাল্যবিবাহ না দেওয়া ও স্কুলে পাঠানোর শর্তে পরিবারগুলোকে অঙ্গীকার করতে হয়। সারা দেশেই এ কর্মসূচি আছে। এটি একটি সফল কর্মসূচি।
অভিভাবকদের সচেতন করার বিষয়টি এসেছে। আমরা এগুলো অহরহ করে থাকি। সরকারের জনবলের সীমাবদ্ধতা আছে। এ জন্য আমরা এখানে এনজিওগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ করছি। সেসব কাজের তদারকিও করা হয়ে থাকে। বাল্যবিবাহ নির্মূল মানেই দেশের উন্নয়ন। আমাদের কিশোর-কিশোরী ক্লাব আছে। কিশোর-কিশোরীদের বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নীরবতা ভাঙতে এটা সহায়তা করে। কোনো এলাকায় বাল্যবিবাহ হওয়ার উপক্রম হলে তারা তা আমাদের বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটিকে জানায়।
অনেক সময় বাল্যবিবাহ হওয়ার পর অভিভাবক ছেলের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন। মেয়েকে আদালতে হাজির করা হলে বিভিন্নমুখী চাপের কারণে, তাকে কেউ অপহরণ করেনি বলে স্বীকারোক্তি দেয়। তখন এ মামলার আর কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। কখনো মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁরা ফিরে আসেন। তখন আদালত বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। কেবল জন্মনিবন্ধনের ওপর ভিত্তি করে বিয়ে নিবন্ধন বন্ধ করলেই হবে না। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন করা যায়। এ জন্মনিবন্ধন সনদ উপস্থাপন করলে আদালতের কিছু করার থাকে না। আদালতে তখন তাকে প্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য করা হয়। সে জন্য বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কেননা, ১৮ বছর না হলে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া খুব দুষ্কর।
বিয়ে নিবন্ধন ফর্মে জাতীয় পরিচয়পত্রের নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর চেয়ে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অভিভাবকেরা বিয়ের আয়োজন করেন। কিন্তু ধর্ষক কখনো স্বামী হতে পারে না। বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারসহ আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করব।
নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাল্যবিবাহ একটি চলমান ঘটনা। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি, যা এখন নিয়মিত রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মেয়ের বিয়ে একটি সামাজিক বিষয়। মেয়ের বিয়ে নিয়ে পরিবারের চেয়ে পাড়া–প্রতিবেশীর বেশি চিন্তা। এটা সব শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে একই রকম। হাওরাঞ্চলগুলো প্রত্যন্ত এলাকায়। সেখানে দারিদ্র্যের হার বেশি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন তেমন হয়নি। ফলে সেখানে দক্ষ মানুষ তৈরি করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এ ছাড়া মা–বাবা এখনো মনে করেন, বৃদ্ধকালে ছেলের কাছে থাকতে হবে। মেয়ের বাড়িতে থাকাকে তাঁরা অসম্মানের মনে করে থাকেন। অভিভাবকের ছেলে ও মেয়েকে সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মেয়েরাও বয়স্ক মা-বাবার দায়িত্ব নিতে পারে। বাল্যবিবাহ সমস্যা তৈরির অংশীদারদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করা প্রয়োজন।
চর ও হাওরাঞ্চলে সমস্যাগুলোর সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় কাউকে পেছনে না ফেলে এগোনোর বিষয়টি যুক্ত আছে। সে জন্য এসব এলাকার প্রেক্ষাপট উপযোগী নিয়মনীতি করতে হবে। বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণভাবে জেন্ডারভিত্তিক রীতিনীতি ও বিশ্বাসের (নর্মস) সঙ্গে জড়িত।
ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা কেন উতলা হই? সামাজিক রীতিই এর জন্য দায়ী। একটা মেয়ের কুমারিত্বকে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ফলে তার এ কুমারিত্ব হরণকারীর কাছে বিয়ে দিয়ে আমরা তা জায়েজ করতে চাই।
চর ও হাওরাঞ্চলে অর্থনৈতিক সমস্যা থাকলে আমাদের করণীয় কী? সে জন্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা খাতগুলোর সমন্বিত বাস্তবায়ন দরকার। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় এবং সমাজসেবা মন্ত্রণালয়সহ অন্য অনেক মন্ত্রণালয়ের সামাজিক সুরক্ষা খাত রয়েছে।
প্রথমে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা পরিবার ও এলাকাগুলো চিহ্নিত করা দরকার। তারপর মন্ত্রণালয়গুলো থেকে তাদের জন্য সমন্বিত একটা সুরক্ষা প্যাকেজ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি এটা তদারকের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। যেন এর প্রভাবটা মেয়েদের জীবনে পড়ে।
এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সদস্যরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। পরিবার উপযোগী নীতিমালার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যবিবাহ রোধে আমাদের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন টু এন্ড চাইল্ড ম্যারেজ) আছে। সেখানে ২৪টি মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় খুবই জরুরি।
বাল্যবিবাহ অবশ্যই একটি সমস্যা। ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়েশিশুর বিয়ে হতে পারবে না। কিন্তু বাল্যবিবাহ কি একমাত্র সমস্যা? এর আগে তো প্রতিটি শিশু নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েশিশু নানা রকম যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। শিশুর সর্বোত্তম বিকাশ, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য বিয়ে ঠেকানোর আগেই অনেক কিছু করণীয় আছে।
পড়াশোনা করলে রাষ্ট্র তার জন্য কী ধরনের সুরক্ষা, নিরাপত্তা দেবে? তার স্বপ্ন দেখার জন্য কী প্রক্রিয়া চালু আছে? ফলে বিয়ে ঠেকানোর বাইরেও অনেক করণীয় আছে। যেগুলো করলে বাল্যবিবাহ এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।
হাওরাঞ্চলে একটি পরিবারে পাঁচ থেকে সাতজন সন্তান একটি নিয়মিত ঘটনা। তাদের পুষ্টির অবস্থা খুব শোচনীয়। এখানে অনেক করণীয় আছে। এখানে পুরুষদের এগিয়ে আসা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ে যে কোনো সমাধান নয়, এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি খুব দরকার। এ বিষয়ে পত্রিকার অনেক পরিসংখ্যান আসে, যা আমার কাছে খণ্ডিত মনে হয়। পরিসংখ্যানের বাইরেও অনেক ঘটনা থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে চাইলে টাকা দিয়ে জন্মনিবন্ধন করে ফেলা যায়। এ সুযোগগুলো থাকা উচিত নয়। এ বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বাল্যবিবাহ একটি সর্বজনীন সমস্যা। ১৯২৯ সালে প্রথম বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস হয়। তখন হয়তো ৮০ শতাংশের ওপরে বাল্যবিবাহ হতো। ২০১৭ সালে আবার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস হয়। তখনো বাল্যবিবাহ ছিল এবং এখনো আছে। আমরা প্রায় গতানুগতিক একটা প্যাকেজ দিয়ে বাল্যবিবাহ মোকাবিলার চেষ্টা করছি।
চর ও হাওরাঞ্চলের শিশুদের অবস্থার পরিবর্তনে সৌহার্দ্য কাজ করছে। কিন্তু এ সমস্যা শুধু চরাঞ্চলের নয়। ঢাকার বস্তিগুলোতে আরেক ধরনের সমস্যা আছে। উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপট আবার আলাদা। সেখানকার বাল্যবিবাহ রোধে আরেক ধরনের কার্যক্রম দরকার।
বাল্যবিবাহ রোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় এ এলাকাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আলাদা কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো উদাহরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন এ নিয়ে কাজ করছে। তাদের শিক্ষাগুলো নিয়ে সরকার কাজে লাগালে, তা ভালো উদ্যোগ হতে পারে। কারণ, গতানুগতিক প্যাকেজ দিয়ে বাল্যবিবাহের মতো বড় একটা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচারণায় আমরা একটি নির্দিষ্ট দল বেছে নিচ্ছি। আমরা কিশোর-কিশোরী ও তাদের মা–বাবাকে নিয়ে হয়তো কাজ করছি। এর বাইরে একটা দল বাল্যবিবাহ বাড়ার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। প্রবীণদের দল তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রবীণেরা পরিবারে বড় ভূমিকা পালন করেন। মা–বাবাকে তাঁরা অনেক প্রভাবিত করেন। তাই আমাদের প্রচারণার সঙ্গে এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা খুব জরুরি।
প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে, বাল্যবিবাহের মূল কারণ কী। প্রাচীনকাল থেকেই বাল্যবিবাহ চলে আসছে। সেখান থেকে আমরা এখন অনেক ভালো অবস্থায় এসেছি। এখন মেয়েদের বিয়ের জন্য ন্যূনতম ১৮ বছর হতে হয়। এর কম বয়সে বিয়ে করলে তা আইনসিদ্ধ হবে না কিন্তু এর মধ্যে একটি ফাঁক আছে। ১৮ বছরের নিচে বিশেষ অবস্থায় বিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
সমাজসেবা বিভাগের কার্যক্রমের কিছু নিয়ম আছে। যেমন ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হওয়া নারী বিধবা হলে তাঁকে আমরা বিধবা ভাতা দিতে পারি না। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকহীন মেয়েদের সহজেই মামা-চাচারা বিয়ে দিয়ে দেন।
আমাদের সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় শিশু পরিবার আছে। সেখানে এসব শিশুকে রেখে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারপর বিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে পরোক্ষভাবে বাল্যবিবাহ রোধে এ শিশু পরিবার অবদান রাখছে।
বাংলাদেশ জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অন্যতম। জলবায়ুর সঙ্গে বাল্যবিবাহের একটা সম্পর্ক আছে। সাতক্ষীরায় আইলা-সিডরের কারণে অনেক মানুষ ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। আসার সময় তাঁরা ভাবেন, আমার ১৪ বছরের মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে কোথায় রাখব। তার চেয়ে বরং তাকে বিয়ে দিয়ে দিই। শ্বশুরবাড়ি লোকেরা দেখবেন। অর্থাৎ, পরোক্ষভাবে হলেও জলবায়ুর একটা প্রভাব বাল্যবিবাহের ওপর পড়ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে চতুর্থ। এর সঙ্গে কিছু সামাজিক রীতিনীতিরও বিষয় আছে। সব ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ধর্মীয় নেতাদের দিয়ে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে মানুষকে বোঝাতে হবে। অনেক মসজিদের ইমাম মেয়ে সাবালিকা হলেই বিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। ফলে অভিভাবকের ভেতর ধর্মীয় বিষয়গুলো কাজ করে। তখন তাঁরা রাষ্ট্রীয় আইন ও অর্থনীতির বিষয়টি খেয়াল রাখেন না। বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা দরকার।
বাল্যবিবাহ বন্ধে অভিন্ন তথ্যভান্ডার জরুরি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্যভান্ডারের তথ্যগুলোর সমন্বয় (সিনক্রোনাইজ) করতে হবে।
এখন আমাদের এ গোলটেবিল বৈঠকগুলোর প্রভাব নিয়ে ভাবতে হবে। আমি প্রায়ই বলি, আমরা যা আজ করছি, তা গতকালই করা উচিত ছিল। সরকারে শর্তযুক্ত প্রণোদনার কথা এসেছে, যা বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে একটি বাধা তৈরি করবে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণ একটি অজুহাত হিসেবে আলোচনায় এসেছে। এর সঙ্গে আমি একমত।
আইনের বাস্তব অবস্থা, সরকারের কার্যক্রম এবং স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে তা মোকাবিলা করে, সে বিষয়গুলো বাস্তব উদাহরণসহ এসেছে। বাল্যবিবাহ অনেক সমস্যার মধ্যে অন্যতম। এ বাল্যবিবাহের সমস্যা রোধ করা গেলে লৈঙ্গিক সমতার অর্জনের একটি পথ তৈরি হবে। বাল্যবিবাহ ও অল্প বয়সে গর্ভধারণ করা শিশু তার পরিবারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে প্রমাণের অভাব নেই। সমাজবিজ্ঞানে অনেক গবেষণা আছে। যেখানে এসেছে নারী ও শিশু উপযুক্ত সুযোগ পেলে ও ক্ষমতায়ন হলে শুধু সে নারী উপকৃত হয়, বিষয়টি এমন নয়। পুরো পরিবার, কমিউনিটি ও দেশ আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়।
বিষয়টি বাল্যবিবাহ রোধে আমাদের পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করবে। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই বেশ ভালো অগ্রগতি করেছে। জন্মহার নিয়ন্ত্রণ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম উদাহরণ। প্রথমত, যথাযথ প্রায়োগিক আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নিবন্ধনসহ যেসব বিষয়ে
ফাঁক রয়েছে, সেগুলো শক্তিশালী করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক বিশ্বাস ও রীতিনীতি পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সমাজে নারী ও শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আজকের গোলটেবিল বৈঠকে চর ও হাওরাঞ্চলে বাল্যবিবাহ নিরসনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এসেছে। সরকারি–বেসরকারি সবার সমন্বিত উদ্যোগে এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
জন্ম ও বিয়ে নিবন্ধনের ডিজিটাল সনদ প্রক্রিয়া চালু এবং বিয়ের সময় বর–কনের জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই করতে হবে।
স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বয়স নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে
জাতীয় পরিচয়পত্রের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা দরকার।
চর ও হাওরাঞ্চলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্কুল, কলেজ, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি করা জরুরি।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, আন্তমন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় ও কমন ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে।
অনলাইনে জন্মনিবন্ধন যাচাইয়ের জন্য কাজিদের প্রশিক্ষণ জরুরি।
জেলা-উপজেলায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
মেয়েদের ক্ষমতায়নের বার্তা প্রদানে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
দরিদ্র শিশুদের স্কুলে পাঠানো এবং বিয়ে না দেওয়ার শর্তে সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতা বাড়ানো জরুরি।