দেশে কিশোরীদের জন্য এইচপিভি টিকা কার্যক্রম শুরু করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
দেশে প্রতিবছর ৮ হাজার নারীর জরায়ুমুখের ক্যানসার শনাক্ত হচ্ছে। এই ক্যানসারে আক্রান্ত নতুন ও পুরোনো রোগী মিলিয়ে বছরে ৫ হাজার নারীর মৃত্যু হয়। কিশোরী মেয়েদের টিকা দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধব্যবস্থা নিলে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষার (স্ক্রিনিং) মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত ও চিকিৎসার মাধ্যমে সহজেই নির্মূল করা সম্ভব জরায়ুমুখ ক্যানসার।
গতকাল রোববার স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এ আয়োজনের সায়েন্টিফিক পার্টনার ছিল ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। অনুষ্ঠানের প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য দায়ী। বাল্যবিবাহ এই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। রোগটিকে আগেভাগে শনাক্তের জন্য দেশে ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশন অব দ্য সারভিক্স উইথ অ্যাসেটিক অ্যাসিড বা ভায়া পরীক্ষা চালু থাকলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ স্ক্রিনিং করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন পর্যন্ত দেশে ভায়া পরীক্ষার মাধ্যমে ২০ শতাংশ স্ক্রিনিং করা সম্ভব হয়েছে। যত বেশি স্ক্রিনিং হবে, তত বেশ রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হবে। এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম বলেন, জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে—অতিরিক্ত সাদা স্রাব, রক্তমিশ্রিত স্রাব, সহবাসের পর রক্তস্রাব, অনিয়মিত মাসিক ও তলপেটে ব্যথা। অন্তত এক ডোজ টিকা দিয়ে হলেও দেশব্যাপী জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে টিকা কার্যক্রম শুরু হোক।
ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকেও বিনা মূল্যে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালুর জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
ওজিএসবির সভাপতি ও ইলেক্ট অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, টিকা দিলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। দেশে সরকারিভাবে এই টিকা প্রদানের ব্যবস্থা নেই। গাজীপুরে পাইলট প্রকল্পে সারা দেশের মাত্র ১০ শতাংশ কিশোরীকে বিনা মূল্যে টিকা দেওয়া গিয়েছিল। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ৯০ শতাংশ মেয়েকে টিকার আওতায় আনা দরকার।
বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন ওজিএসবির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা। তিনি জানান, জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলে ৯০-৭০-৯০ সংখ্যাটিকে অনুসরণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ ৯০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনা, ৭০ শতাংশকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা এবং ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধ ও ক্যানসার–পূর্ববর্তী চিকিৎসাব্যবস্থা নেওয়া।
বৈঠকে স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম জরায়ুমুখ ক্যানসারের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দেন।
টিকা চালুর বিষয়ে ওজিএসবির উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন ওজিএসবি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট অব রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নিজামুল হক বলেন, ক্যানসার শনাক্তের সাত–আট সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসা শেষ করতে হয়। যত দেরি হবে, তত চিকিৎসা ব্যর্থ হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) অ্যান্ড সার্ভিলেন্সের উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. তানভীর হোসেন জানান, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনসের (গ্যাভি) কাছ থেকে টিকা পেয়ে এ বছরের মধ্যে ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের এইচপিভি টিকা দেওয়া চালু করার ব্যাপারে সরকার আশাবাদী।
দেশে জরায়ুমুখ ক্যানসার শনাক্তে স্ক্রিনিং অবস্থার কথা তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গাইনি অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা। তিনি জানান, ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৪২ লাখ নারীকে (২০ শতাংশ) বিনা মূল্যে ভায়া পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রতি ১০০ নারীকে পরীক্ষা করলে ৫ জনের ক্যানসার শনাক্ত হয়।
বিএসএমএমইউর গাইনি অনকোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন বলেন, ভায়া পরীক্ষা ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগ শনাক্তে ভুল ফল (ফলস পজিটিভ) দিতে পারে। তাই আধুনিক এইচপিভি ডিএনএ পরীক্ষা চালু করা দরকার।
তবে এ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ভায়া পরীক্ষাই বেশি উপযোগী উল্লেখ করে বিএসএমএমইউর গাইনি অনকোলজি বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শিরিন আক্তার বেগম বলেন, এইচপিভি ডিএনএ পরীক্ষা আধুনিক হলেও ব্যয়বহুল।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গাইনি অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাহানা পারভীন জানান, তাঁর হাসপাতালে জরায়ুমুখ ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে আসা নারীদের ৯০ শতাংশই গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আসেন।
ক্যানসার শনাক্ত ও চিকিৎসায় কর্মকৌশল তৈরির জন্য দেশজুড়ে ক্যানসার নিবন্ধন করার ওপর জোর দেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গাইনি অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. বেগম রোকেয়া আনোয়ার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অনকোলজি বিভাগের ইউনিট প্রধান অধ্যাপক ডা. নাজমা হক বলেন, গ্রামে বসেও একজন ক্যানসার রোগী যেন উন্নত চিকিৎসা পান, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ফারহানা লাইজু বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান এইচপিভি টিকাসহ নতুন নতুন ওষুধ বাজারে নিয়ে আসছে।