আইসিডিডিআরবি ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘প্রারম্ভিক শিশু-বিকাশে বিনিয়োগ: উন্নত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৭ নভেম্বর ২০২৪। আলোচকদের বক্তব্যের সারকথা এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
শবনম মোস্তারী,
যুগ্ম সচিব ও প্রকল্প পরিচালক (২০টি দিবাযত্ন স্থাপন কেন্দ্র), মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
ডা. জেনা দেরাখশানি হামাদানি,
ইমেরিটাস বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ,
অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিটিউট।
সায়কা সিরাজ,
কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল।
ডা. শাহনাজ বেগম,
পুষ্টি কর্মকর্তা, ইউনিসেফ বাংলাদেশ।
ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা,
সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সুচিত্রা সরকার,
শিশু অভিভাবক প্রতিনিধি ও কর্মজীবী মা।
সৈয়দা সাজিয়া জামান,
প্রধান, প্রারম্ভিক শিশু-বিকাশ বিভাগ, ব্র্যাক আইইডি।
মো. তারেক হোসেন,
কান্ট্রি রিসার্চ ম্যানেজার, অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্ট।
ওমর ফারুক,
প্রকল্প পরিচালক, শিশুদের জন্য,
সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ।
শেখ জামাল হোসেন,
সহযোগী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি।
সঞ্চালনায়: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
শবনম মোস্তারী
যুগ্ম সচিব ও প্রকল্প পরিচালক, দিবাযত্ন স্থাপন কেন্দ্র প্রকল্প,
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর
প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু দিবা যত্ন কেন্দ্র কর্মজীবী নারী কিংবা ‘সিঙ্গেল ফাদারদের’ জীবন পরিবর্তনকারী সুবিধা দেয়। এ–সংক্রান্ত নীতিমালাগুলোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীতিমালা বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নীতিমালা প্রণয়নে খুব কম জড়িত থাকেন। সে জন্য নীতিমালা প্রণয়নের প্রতিটি পদক্ষেপে সব অংশীজন ও নীতি বাস্তবায়নকারী ব্যক্তিদের যুক্ত করতে হবে।
শিশু দিবাযত্ন স্থাপন কেন্দ্র প্রকল্পের ছয়টি উদ্দেশ্য রয়েছে। এর মধ্যে সারা দিন শিশুর পরিচর্যা, শিশুর খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, টিকা কর্মসূচি এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশ অন্যতম; কিন্তু প্রকল্পের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো নির্দেশিকা (গাইডলাইন) নেই। শিশুর বিকাশ–সংক্রান্ত সব কটি বিষয়ই আন্তসম্পর্কযুক্ত। মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রায় সব সমস্যাই অল্প বয়সে শুরু হয়; কিন্তু শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে এ–সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা নেই। আমি কানাডায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সেবা গ্রহীতা ছিলাম। আমরা আমাদের দেশের কর্মজীবী নারীদের ঠিক একই মানের সেবা দিতে চাই।
২০১৩ সালের একটি সমন্বিত নীতিমালা হয়েছে। এ নীতিমালায় শূন্য থেকে তিন বছরের শিশুরা বাদ পড়েছে। অথচ এ সময়েই শিশুর প্রায় ৯০ শতাংশ মস্তিস্কের বিকাশ হয়। আমাদের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনায় খাদ্য, পুষ্টি, তথ্য সহায়িকা, প্রাক্–প্রারম্ভিক শিক্ষা, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র নকশা ও কারিগরি নির্দেশিকাসহ ১২ নীতিমালা প্রয়োজন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে সবার পক্ষে এ সেবা নেওয়া সম্ভব হয় না। আমাদের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনার দক্ষ জনবল প্রয়োজন। কিন্তু জনবল দক্ষ করে গড়ে তোলার মতো প্রশিক্ষক পাওয়া যায় না।
আমাদের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলোতে ‘ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার’ রয়েছে। এসব কর্নারে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর নিয়মও দেওয়া আছে। রাজস্ব বাজেটের আওতায় ৪৩টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। এগুলো সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া শিশু একাডেমির প্রকল্পের আওতায় চার শতাধিক কমিউনিটি শিশুযত্ন কেন্দ্র করা হয়েছে৷ গ্রামাঞ্চলেও আমাদের কিছু শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র আছে। সেগুলোতে বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া হয়; কিন্তু বাড়ি থেকে দূরত্বে বেশি হওয়ায় মায়েরা এ সেবা নিতে খুব একটা আগ্রহী না। সরকারি বরাদ্দ, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হতে হবে। অন্যান্য জায়গায় অংশীজনদের সহায়তা লাগবে। আলোচনায় আসা প্রায় সবগুলো সমস্যা মডেল শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছে। এখন তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়াই আমাদের কাজ।
ডা. জেনা দেরাখশানি হামাদানি
ইমেরিটাস বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি
প্রারম্ভিক শিশু বিকাশে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে যে যেসব কারণে শিশুর সঠিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, সঠিক সময়ে যথাযথ ইসিডি ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে সেসব ঝুঁকি কমিয়ে তাদের বিকাশকে তরান্বিত করা সম্ভব। শিশুর বিকাশ মায়ের গর্ভাবস্থা থেকেই শুরু হয়ে যায়। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জেমস হেকম্যান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, যত অল্প বয়সে শিশুর জন্য বিনিয়োগ করা হয়, তার প্রভাব তত বেশি হয়। সুতরাং মায়ের গর্ভকাল থেকে শিশুর তিন বছর বয়সকালে বিনিয়োগ বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিনিয়োগের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী।
২০০৩ সালে বাংলাদেশের প্রাক্–প্রাথমিক শিক্ষানীতি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিবেচনা করা হয়। ২০০৮ সালে অপারেশনাল ফ্রেমওয়ার্ক গঠিত হয়। ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয় জাতীয় শিক্ষানীতি। এসবই ছিল প্রাক্–প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে, যা শিশুর প্রারম্ভিক বয়সের জন্য প্রযোজ্য নয়। ২০১৩ সালে শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতি গ্রহণ করা হয়। ২০২১ সালে প্রণীত হয় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন। আইসিডিডিআরবি ২৫ বছর ধরে প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ নিয়ে গবেষণাধর্মী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে।
২০১৪ সাল থেকে আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। আমরা ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের সঙ্গে যুক্ত হই। রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়েও আমরা কিছু কাজ করেছি। এটি ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা এখন প্রাক্–প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘ইনক্লুসিভ প্যারেন্টিং প্যাকেজ’ ও ‘ইনক্লুসিভ চাইল্ড-প্যারেন্ট-টিচার প্রি–স্কুল প্যাকেজ’ তৈরির প্রক্রিয়ায় রয়েছি। এ কাজগুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা এবং তাদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য।
আমাদের গবেষণা কার্যক্রমে সাশ্রয়ী, বয়স উপযোগী খেলনা, ছবির বই, ছড়াগানসহ বিভিন্ন পাজল ব্যবহার করা হয়েছে। এসব সেশনে মায়েদেরকে শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিবিষয়ক তথ্য, শিশু প্রতিপালন পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া হতো। এ ছাড়া শিশুর প্রতি কীভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়, কীভাবে তাদের প্রশংসা করতে হয়, ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে সমতামূলক আচরণ করতে হয়, এ ধরনের কার্যকরী বার্তা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমরা সরকারের সঙ্গে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে বেশ কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছি। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবার আওতায় আসা শিশুরা অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি এগিয়ে থাকে। ছয় বছর পর এ প্রকল্পের আওতায় আসা শিশুদের পুনরায় পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষায় এসব শিশুর বুদ্ধিমত্তা অন্যদের তুলনায় বেশি দেখা গেছে।
জাতীয় বাজেটে প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ খাতে ১ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ হলেও তা প্রারম্ভিক শিশু বিকাশকে নিশ্চিত করে উন্নত মানবসম্পদ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা জানি, কীভাবে শিশুদের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এখন প্রয়োজন শুধু বিনিয়োগের। বিনিয়োগের মাধ্যমেই শিশুদের ঝুঁকি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ
অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
আলোচনায় এসেছে, প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশ একটি বিজ্ঞান। কিন্তু আমি মনে করি, এটি বিজ্ঞানের চেয়েও বেশি কিছু। বিজ্ঞান যেখানে শেষ হয়, দর্শন সেখান থেকে শুরু হয়। তাই আমাদের প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশের দর্শনের ওপরে বিনিয়োগ করতে হবে। পরিবারের দর্শনের জায়গা পরিবর্তন করতে না পারলে এনজিও, সরকারি-বেসরকারি সংগঠনসহ কোনো খাতই কার্যকর হবে না। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়গুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যবিবাহ রোধে আইন করা হয়েছে। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হলেও তা কমেনি। কারণ, সেখানে মূল যে দর্শন, তা পরিবর্তিত হয়নি।
আমরা প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশ বলতে বুঝি একটি শিশু বড় হবে কি না, সে কথা বলবে কি না। আর একটুখানি এগিয়ে গেলে সে জিপিএ–৫ পাবে কি না। প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশ বলতে এর চেয়ে বেশি কিছু আমার চিন্তায় আসে না। সুতরাং প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশ হলো জ্ঞান, ধারণার জগৎ, নৈতিকতা, সত্য-মিথ্যা, সৎ-অসতের ধারণা ও আবেগের বিকাশ। একটা ১২ বছরের ছেলেকে আমরা কাঁদতে দেখলে এখনো বলি, ‘তুমি মেয়ে নাকি যে মেয়েদের মতো কাঁদছ।’ তার আবেগের বিষয়গুলোকে আমরা দমন করি। একটা মেয়েকে জোরে হাসতে দেখলে বলি, এত জোরে হাসে না। মেয়েদের বলি, এভাবে বসে না, ওভাবে বসো। অর্থাৎ তার আবেগের বিকাশকে আমরা অবদমিত করছি। স্কুলে যাওয়ার সময় শুধু ফার্স্ট বয় বা ফার্স্ট গার্লের সঙ্গে মেশার পরামর্শ দিই, অন্য কারও সঙ্গে মিশতে মানা করি। শিশুর বিকাশে এই সামাজিক উন্নয়নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর সামাজিক, জ্ঞানভিত্তিক ও আবেগিক উন্নয়নকে বাদ দিয়ে তার জিপিএ–৫ ও দৈহিক বৃদ্ধি নিয়ে আমরা এগোতে পারব না।
আলোচনায় পুষ্টি কার্যক্রম কখন শুরু হবে, এ প্রশ্ন এসেছে। একটি কন্যাশিশু জন্মানোর পর থেকেই পুষ্টি কার্যক্রমের শুরু হবে। কারণ, সেই কন্যাশিশু একদিন মা হবে। তাই তার পুষ্টি জরুরি। তার পুষ্টি নিশ্চিত করার পরে তার সন্তানের বিষয়টি আসবে। আমাদের একটা নাজুক জনগোষ্ঠী আছে। কন্যাশিশু, প্রান্তিক মানুষ, দারিদ্র্য ও অশিক্ষার শিকার জনগোষ্ঠীর প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশ খুব জরুরি।
আমি দীর্ঘদিন সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। আমি সব সময় কমিটি, পলিসি, স্ট্র্যাটেজি, প্ল্যান, প্রোগ্রাম—এ শব্দগুলো ভয় পাই। কোনো কাজ দেরিতে করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একটা কমিটি করে দিতে বলেন। আর কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে না চাইলে একটা কর্মসূচি বা নীতিমালা করতে বলা হয়। কোনো কিছু বাস্তবায়নের জায়গাটা বেশ কঠিন, তা এখান থেকে বুঝতে পারি। সে জন্য বাস্তবায়ন বেশ জরুরি হওয়া দরকার।
প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশের ক্ষেত্রে প্রসব–পরবর্তী বিষণ্নতা (পোস্টপার্টাম মেন্টাল হেলথ) খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিয়ে আমাদের তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। এ জায়গাটি নিয়ে কাজ করতে হবে। আর আমাদের পরিবার, স্কুল, কমিউনিটিকে মেকানিকের পরিবর্তে মালির মতো হতে হবে। অর্থাৎ সমস্যা হলেই কেবল ঠিক করা নয়, বরং মালির মতো শুরু থেকেই পরিচর্যা করতে হবে। এ জায়গায় আমাদের চিন্তা ও দর্শন পরিবর্তনে বিনিয়োগ জরুরি।
সায়কা সিরাজ
কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল
পুষ্টি নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের কাছে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও যত্নের (ইসিসিডি) বড় একটি উপাদান পুষ্টি। শিশুর এ প্রারম্ভিক বিকাশ আসলে ঠিক কখন থেকে শুরু হয়? যখন শিশুর জন্ম হয় তখন, নাকি যখন মা গর্ভধারণ করেন তখন? সব দিক বিবেচনায় ইসিডির কাজ অনেক ব্যাপক। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে কাজ শুরু করে দিতে হবে।
বাল্যবিবাহ কিংবা অল্প বয়সে গর্ভধারণ প্রতিরোধ করতে না পারলে শিশু হয়তো অপুষ্টির শিকার হয়েই জন্ম নেবে। মায়ের গর্ভে থাকাকালেই শিশুর মস্তিষ্কের ৭০ শতাংশ গঠন সম্পন্ন হয়। বাকি অংশ গঠনের ক্ষেত্রে প্রথম তিন বছর গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিতে চাই। ‘কস্ট অব ইনঅ্যাকশন’ নামে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল একটি টুল তৈরি করেছে এ টুলে কোনো প্রয়োজনীয় উপাত্ত দিলে কোনো উদ্যোগ বা সমস্যার সমাধান করলে কি সুবিধা হবে, আর না করলে কী কী ক্ষতি হবে, তা বোঝা যায়।
শুধু অপুষ্টির সমস্যা সমাধান করা গেলে দেশে প্রারম্ভিক শিশু বিকাশসহ সব জায়গায় এর প্রভাব পড়বে। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ কর্মজীবন ও দেশের উন্নয়নসহ সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। এদিক বিবেচনায়, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
এরই মধ্যে স্কুলভিত্তিক কিশোর-কিশোরী পুষ্টি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রমে কিশোরীদের সপ্তাহে একটি আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এসব কিশোর-কিশোরীর পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু এ কার্যক্রম শুধু সরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুলে শুরু হয়েছে। মাদ্রাসাগুলোকে এ কার্যক্রমে যুক্ত করা যায়নি। অর্থাৎ একটি বড় জনগোষ্ঠীর কাছে আমরা এখনো পৌঁছাতে পারছি না।
বাল্যবিবাহ বন্ধ ও অল্প বয়সে গর্ভধারণ না হওয়া নিশ্চিত করা জরুরি। এ জায়গায় এখনো অনেক বড় কাজ করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া কিশোর ও পুরুষদেরও পুষ্টিশিক্ষা দিতে হবে৷ কারণ, এখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পরিবারের পুরুষ সদস্যের ওপর থাকে। তাদের সচেতন করতে না পারলে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে পরিবার থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া কঠিন৷
এ ছাড়া সব কমিউনিটিকে এ বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। শিশুরা দিবাযত্ন কেন্দ্রে যা শিখছে, পরিবারে তার ভিন্ন চিত্র দেখছে। ফলে শিশুরা একধরনের সংশয়ের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। তাই শুধু প্রতিষ্ঠান দিয়ে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পরিবার ও কমিউনিটিকেও সচেতন করতে হবে।
ডা. শাহনাজ বেগম
পুষ্টি কর্মকর্তা, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও যত্ন নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ২০১৩ সালে করা শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতিতে শূন্য থেকে ৮ বছর বয়সীদের শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে; কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে নেওয়া কার্যক্রমের বেশির ভাগ প্রাক্–প্রাথমিক নিয়ে। এর মধ্যে আমাদের শিশু–বিকাশ কেন্দ্র ও দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে। শূন্য থেকে তিন বছর বয়সী শিশুদের কাছে আমরা হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে পৌঁছাতে পারি। এসব জায়গায় মায়েরা বারবার আসেন। গর্ভধারণ নির্ণয় থেকে শুরু করে মাতৃত্বকালীন ও প্রসবকালীন সেবা নিতে তারা হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিতে আসেন। এখানে মায়েদের সঙ্গে শিশুদেরও পাওয়া যায়। তাই মায়েদের কাছে তাদের করণীয় সম্পর্কে বার্তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এ জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের জন্য এক ডলার বিনিয়োগ করলে ১৩ ডলার ফেরত পাওয়া যায়। তাই শিশুদের পেছনে বিনিয়োগ করার এটিই সর্বোত্তম সময়। কারণ, এ সময়ের মধ্যেই শিশুদের মস্তিষ্কের ৮০ শতাংশ গঠন সম্পন্ন হয়। এ জায়গায় শক্ত ভিত্তি তৈরি না করতে পারলে পরবর্তী পর্যায়গুলো বাধাগ্রস্ত হবে। তার শিক্ষা ও কর্মজীবনে ঘাটতির সৃষ্টি হবে। কারণ, তার বুদ্ধিমত্তার জায়গাটাই ঠিকভাবে গড়ে দেওয়া হয়নি। সুতরাং এ ভিত্তি তৈরির জায়গায় আমাদের অনেক বেশি বিনিয়োগ করা উচিত।
তারই প্রয়াস হিসেবে আইসিডিডিআরবির সহযোগিতায় ইউনিসেফের পক্ষ থেকে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও কালীগঞ্জে এবং ভোলার দুটি উপজেলাসহ মোট চারটি জায়গায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মায়েদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সামনের সারির স্বাস্থ্যসেবাদাতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ক্ষেত্রে প্রসবকালীন বা প্রসব–পরবর্তী সেবা দেওয়ার সময়টা গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা মূলত ছয় মাস থেকে ৩৬ মাস বয়সী শিশুদের কাছে যাচ্ছি। সেখানে তাদের জন্য বিভিন্ন খেলনা ও বই দেওয়ার মাধ্যমে ভাষা কার্যক্রম রয়েছে। এসবের খরচ কম; কিন্তু এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, অনেক মায়েরা নিজেরাই কম দামে এসব খেলনা বাড়িতেই তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
মায়েরা শিশুদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন। শিশুদের গুণগত মানের সময় দিতে হয়, এ বিষয়টি মায়েদের ধারণারও বাইরে। তারা তো জানেই না গুণগত মানের সময় কী ও কতটুকু সময় দিতে হয়। শ্যামনগরে ‘উজ্জীবন’ নামের স্থানীয় একটি এনজিও প্রিস্কুলিং শুরু করেছে। আমাদের যেসব শিশুর বয়স ৩৬ মাস অতিক্রান্ত হয়, তাদের আমরা প্রিস্কুলে দিয়ে দিই। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা শাখা ভালো প্ল্যাটফর্ম। কারণ, এখানে মায়েদের যাতায়াত বেশি।
ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা
সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
নতুন করে কোনো নীতিমালা নেওয়ার পরিবর্তে বিদ্যমান নীতিমালা বাস্তবায়নের দিকে বেশি জোর দিতে হবে। প্রারম্ভিক শিশুর বিকাশ মূলত গ্রাম ও শহর বা কর্মজীবী ও গৃহস্থালি কাজের ক্ষেত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হবে; কিন্তু তা না করে সবার জন্য একই জিনিস নিয়ে আসা হচ্ছে, যা সমস্যার সৃষ্টি করছে। এটা অনেকটা সব সমস্যায় প্যারাসিটামল দুই বেলা সমাধানের মতো।
গবেষণায় এসেছে অনেক পোশাককর্মী ও বাসাবাড়িতে কাজ করেন, এমন ব্যক্তিরা তাদের শিশুকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কাছে রেখে যান। তাঁরা শিশুদের খুব চমৎকার সময় দেন। তাই কমিউনিটি, সেবা প্রদানকারী, বন্ধু, পরিবার—এদের শিক্ষিত করা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাম বা শহর কোনো জায়গায়ই আমি এ কাজগুলো দেখিনি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে রূপান্তর করতে পারি কি না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। তাহলে ইট ভাঙার কাজ করেন এমন নারীরাও শিশুকে সেখানে রেখে কাজে যেতে পারবেন।
ডাউন সিনড্রোম টেস্ট করানোর মাধ্যমে শহরের সমর্থবান মানুষদের জানানো হয় যে তার গর্ভের শিশু ডাউন সিনড্রোমের দিকে যাচ্ছে কি না। কিন্তু ডাউন সিনড্রোমের একটি শিশুকে পালন করার ক্ষমতা রাখে না, এমন পরিবার এ সুবিধা পায় না। গর্ভাবস্থার শুরুতে নারীদের কিছু পরীক্ষা করা হয়, যার মধ্যে ডাউন সিনড্রোম পরীক্ষা অবশ্যই থাকা উচিত। বিবিএইচএসের ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী মাত্র ৫৫ শতাংশ নারী শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করান। বাকিদের কী হয়েছে? মাতৃদুগ্ধ পান স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। ঢাকা শহরেই পর্যাপ্তসংখ্যক ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নেই, তাহলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কীভাবে থাকবে?
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ চাপে; কিন্তু তাদের ব্যাবহারোপযোগী যথেষ্ট শৌচাগার নেই। শুধু গর্ভাবস্থায় নয়, প্রতে৵ক নারীর জন্য শৌচাগারের ব্যবস্থা গ্রহণের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ একান্ত কাম্য।
সুচিত্রা সরকার
শিশু অভিভাবক প্রতিনিধি ও কর্মজীবী মা
নবজাতক সন্তান নিয়ে শপিং মল, ব্যাংক বা বইয়ের দোকানে গিয়ে সমস্যায় পড়েছি। বাচ্চা ক্ষুধায় কাঁদত! অথচ কোথাও ‘ব্রেস্টফিডিং কর্নার’–এর ব্যবস্থা ছিল না।
শূন্য থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ নবজাতকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সামাজিক পরিবেশ এমন যেন নবজাতকের পরিপূর্ণ পুষ্টি নিশ্চিতের জন্য প্রত্যেক মাকে ঘরেই থাকতে হবে। অথচ সেটি সব মায়ের জন্য সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের যেসব জায়গায় নারীরা যাবেন, সেখানে ‘ব্রেস্টফিডিং কর্নার’ থাকতেই হবে।
মায়ের দুধে প্রায় ৩৫টি অ্যান্টিবায়োটিক থাকে। তাই কোনো শিশুকেই এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। অনেক নারীর শরীরে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় মাতৃদুগ্ধ তৈরি হয় না। আবার অনেক মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। সে ক্ষেত্রে সেই মায়ের শিশুদের খাদ্যসংস্থান কোত্থেকে হবে?
বাজারে পাওয়া শিশুখাদ্যগুলো কি শিশুদের জন্য নিরাপদ ও মানসম্মত? সুতরাং শিশুখাদ্যে বিনিয়োগ অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে নবজাতকের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ স্থাপন করা জরুরি। ২০১৯ সালে মাতুয়াইলে একটা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক তৈরি করা হয়েছিল। ২০২২ সালে যা বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকায় এসেছে, এখানে প্রায় দেড় কোটি টাকার যন্ত্র অকেজো পড়ে আছে। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা একেবারেই কম, এ সংখ্যা অনেক বাড়াতে হবে। এটি কেবল ঢাকা, কুমিল্লা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে নয়, বান্দরবান, রাঙামাটি বা খাগড়াছড়ির মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি নারীদের কর্মস্থলেই দিবাযত্ন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করলে তা সার্বিকভাবে বেশি ফলপ্রসূ হবে।
সৈয়দা সাজিয়া জামান
প্রধান, প্রারম্ভিক শিশু-বিকাশ বিভাগ, ব্র্যাক আইইডি
প্রারম্ভিক শিশু বিকাশের বিষয়টি একটি সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয়। এ ক্ষেত্রে শুধু পুষ্টি নিয়ে ভাবলে হবে না। শিশুর শারীরিক, কমিউনিটি, আর্থসামাজিক বিকাশসহ সব কটি বিষয় মাথায় রেখে এগোতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে একই সঙ্গে কাজ করতে হবে।
শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ প্রথম তিন বছরে হয়ে যায়। এ সময়েই শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের দেশে প্রায় ৬৫ হাজার স্কুলে প্রাক্–প্রাথমিক চালু রয়েছে, যা আমাদের অনেক বড় একটি অর্জন। চার বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়েও সরকার কিছু প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।
প্রারম্ভিক শিশু বিকাশে এ–সংশ্লিষ্ট সব খাতে দক্ষ জনবল তৈরি করতে না পারলে আমরা পিছিয়ে যাব। এ ক্ষেত্রে ব্র্যাক বিভিন্ন শর্ট কোর্স ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করে যাচ্ছে। শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে বিনিয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে। প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালা তৈরি থেকে শুরু সব ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করছে।
তৈরি পোশাক দেশের রপ্তানি আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব তৈরি পোশাক কারখানায় অবশ্যই শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সুবিধা থাকতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা কেবল কাগজে-কলমে কার্যকর থাকে। বিদেশি ক্রেতারা এলে কারখানামালিকেরা নামমাত্র দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করেন। অন্য সময় এসব দিবাযত্ন কেন্দ্র অকার্যকর অবস্থায় পড়ে থাকে। তবে অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান বেশ ভালোভাবেই শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সুবিধা দিচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রারম্ভিক শিশু বিকাশে গবেষণাসহ অনেক কাজ করে যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন সবার একসঙ্গে কাজ করা।
মো. তারেক হোসেন
কান্ট্রি রিসার্চ ম্যানেজার, অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্ট
মানবসম্পদ উন্নয়নে সব সময়ই বিনিয়োগ প্রয়োজন। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে শূন্য থেকে আট বছর বয়স খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশকে একটি সেবা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর যেকোনো সেবা নিশ্চিত করতে নীতিমালাগত প্রতিশ্রুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের নীতিমালাগত প্রতিশ্রুতি ও কাঠামো না থাকলে সেবা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশ ও যত্নে সরকারের নীতিমালাগত সেই প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের দিক থেকে এই নীতিমালার অনেক প্রায়োগিক উন্নয়নের সুযোগ আছে।
প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশে কতটি মন্ত্রণালয় যুক্ত এবং এ ক্ষেত্রে বছরে কী পরিমাণ বরাদ্দ আছে, তা বের করা কঠিন। তবে গত কয়েক বছরে এ বিনিয়োগ বেড়েছে বলেই মনে হয়। সরকারের বাজেট দুই ধরনের—রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেট। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের কিছু কর্মসূচি রাজস্ব বাজেটের আওতায় আনা গেলে সরকারের প্রতিশ্রুতির জায়গা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি উন্নয়নও টেকসই হবে। কেবল বিনিয়োগ বৃদ্ধি করলেই হবে না, বিনিয়োগ–ব্যবস্থাপনার দক্ষতাও বৃদ্ধি করতে হবে।
এই বিনিয়োগ কীভাবে মাঠপর্যায়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। এই সার্বিক কাজগুলো করার জন্য গবেষণা করতে হবে এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রায়োগিকভাবে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্ট এসব নিয়ে কাজ করছে।
ওমর ফারুক
প্রকল্প পরিচালক, শিশুদের জন্য, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে বিনিয়োগ প্রয়োজন, এ বিষয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। এসব শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ নেই। আলোচনায় এসেছে, এ ক্ষেত্রে জিডিপিতে অন্তত ১ শতাংশ বরাদ্দ দরকার। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয় জড়িত। তাদের প্রতিটির ফোকাল পারসন আছে। কিন্তু এগুলো আসলে কাজ করছে কি না, বাস্তবতার নিরিখে তা যাচাই করা দরকার। সরকার নিঃসন্দেহে নিজের মতো করে ভালো কিছু কাজ করছে। জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, আইসিডিডিআরবি ও এনজিওগুলো এ নিয়ে কাজ করছে।
নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া মানুষ, অন্যের বাড়িতে কাজ করা নারীদের সন্তানের প্রারম্ভিক বিকাশ এবং গ্রামের একজন কৃষকের সন্তানের প্রারম্ভিক বিকাশ ও যত্ন (ইসিসিডি) একরকম নয়। এ জায়গাগুলোতে বোঝাপড়া জরুরি।
আমাদের অসমতার স্তর প্রতিদিন বাড়ছেই। অসমতা মানুষের পুরো জীবনকে প্রভাবিত করছে, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও যত্ন (ইসিসিডি) এর বাইরে নয়। এদিক থেকে কাজ করার সুবাদে আমরা দেখেছি, শহর এলাকায় এটি বেশ জটিল। এ বিষয়ে শহরের অভিভাবকদের সচেতন করা কঠিন। কারণ, এসব অভিভাবকের অনেকে বাসাবাড়িতে বা তৈরি পোশাক খাতে সারা দিন কাজ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর শিশু আরেকটি শিশুর তত্ত্বাবধানে থাকে। এ বিষয়গুলো আলোচনায় আসা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারত্ব ও সহযোগিতার অনেক সুযোগ আছে।
শেখ জামাল হোসেন
সহযোগী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি; গবেষক, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন
এসডিজির ৪.২ লক্ষ্য পূরণে শূন্য থেকে আট বছরের সব শিশুর মানসম্মত প্রারম্ভিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাক্–প্রাথমিকে শিশুর উন্নয়নবিষয়ক তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাত থেকে বিনিয়োগ করা জরুরি। কারণ, স্বাস্থ্য খাতের যে জনবল ও কাঠামো আছে, তা দিয়ে বড় আকারের কাভারেজ সম্ভব। সুতরাং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নেতৃত্বের জায়গায় আনতে হবে।
শহর ও গ্রামের মধ্যে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যবধান রয়েছে। ইসিডি সেবা প্রদানের জন্য একক সেক্টরে নয়, বিভিন্ন সেক্টরের মাধ্যমে এ সেবা ছড়িয়ে দিতে হবে। শহরে সামাজিক নিরাপত্তায় প্যারেন্টিং কার্যক্রমে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
শহরভিত্তিক সমাজকল্যাণ প্রোগ্রামগুলোর সঙ্গে শিশু–বিকাশ কার্যক্রমকে সমন্বিত করতে হবে। তা না হলে শহরের কাভারেজ খুবই কম থাকবে। মায়ের সুস্বাস্থ্য ছাড়া প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশ কখনোই সফল হবে না। তা ছাড়া বাবাকেও আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় শিশু–বিকাশের অবস্থা খুবই খারাপ। এর কারণ মায়ের ভগ্নস্বাস্থ্য। কারণ, তাঁকে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের রেসপনসিভ কেয়ারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি নেই। রেসপনসিভ কেয়ারই হলো প্যারেন্টিং বা ইসিডি। আমাদের সবাইকে নিজ অবস্থান থেকে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রারম্ভিক শিশু–বিকাশের ক্ষেত্রে বিনিয়োগে সরকারকে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের অগ্রগণ্য ভূমিকা থাকা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে কার্যকর সমন্বয় অপরিহার্য।