অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শোয়েব, সদস্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
শওকত ওসমান, ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ক্রপস উইং), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, ইনচার্জ, বাংলাদেশ অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার নেটওয়ার্ক, বারি।
ড. আবু জায়েদ, অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি ও কার্যকরী সদস্য, এফআইভিডিবি।
আসফিয়া আজিম, ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ।
ড. আলী আব্বাস মোহাম্মদ খোরশেদ, সহযোগী অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
এ জি এম রেজা সুমন, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন)।
মো. ওসমান গনি, সভাপতি, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি।
কানিজ ফাতেমা, কো–অর্ডিনেটর, রাইট টু ফুড নেটওয়ার্ক।
পঙ্কজ কুমার, কান্ট্রি ডিরেক্টর (বাংলাদেশ), ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে।
তাহমীনা শৈলী, নারী উদ্যোক্তা, শৈলী ক্রিয়েটিভ স্টুডিও।
আমিনুল ইসলাম বাবু , সম্পাদক, বাংলাদেশ সেভ ফুড অ্যালায়েন্স।
মো. কামাল উদ্দিন, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদক, সুনামগঞ্জ।
মামুনুর রশিদ, হেড অব প্রজেক্ট, ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে।
সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শোয়েব
সদস্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
নিরাপদ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার মানুষের মৌলিক অধিকার। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গত বছরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মানুষের তৈরি দুর্যোগ ও প্রাকৃতিক কারণে সারা বিশ্বে মানুষ খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির অভাবে ভুগছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গেও খাদ্যনিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট। কেমিক্যাল ঝুঁকি, জৈবিক ও শারারিক মাধ্যমে খাদ্য দূষণ হতে পারে। এ অনিরাপদ খাবার খাওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। সারা বিশ্বে ৬০ কোটি মানুষ অনিরাপদ খাদ্য দ্বারা আক্রান্ত
হচ্ছে। আইসিডিডিআরবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে ক্যানসার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিটি মানুষেরই নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
আইন অনুযায়ী জনগণের নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হবেই। এ জন্য ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তৈরি হয়। উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ প্রতিটি ক্ষেত্রে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করব। আমরা এককভাবে কিছু করতে পারব না। পোলট্রি, পশুপালন, মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। কৃষকেরা সকালে কীটনাশক ব্যবহার করে বিকেলে ফসল তোলেন। এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।
আমরা নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে রেস্তোরাঁ ও বেকারি কর্মীদের প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমরা প্রায়ই বিএসটিএআই, ভোক্তা অধিকার, কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কাজ করি। এ মন্ত্রণালয়গুলো খাদ্যসংক্রান্ত ও খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকের মতামত নেয়। খাদ্যনিরাপত্তায় আমাদের একটি দল রয়েছে। আমরা বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়মিত খাদ্য নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করি। খাদ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন ধরনের নীতিমালাও করা হয়েছে। এভাবে সবার সহযোগিতায় নানা ধরনের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সর্বদা সোচ্চার হয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
শওকত ওসমান
ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ক্রপস উইং), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর কৃষককের অভিভাবক হিসেবেই পরিচিত। বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশে কয়েকটা হটস্পট রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট বা হাওর অঞ্চল ও চর অঞ্চলের কৃষির জন্য কিছু আলাদা ধরনের কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে আরেক ধরনের চাহিদা রয়েছে। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের ২২টি জেলায় কোস্টাল কালচার ইকোলজি বিদ্যমান। বিভিন্ন হটস্পটে কৃষি ও কৃষকের চাহিদা ভিন্ন। এদের সঙ্গে আলাদা কৃষিপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি। এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো কৃষকের উৎপাদন বাড়ানো ও তাদের কাছে টেকসই কৃষিপ্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২ অর্জনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি মানুষ বুঝতে শিখেছে। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশ এখনো একটু পিছিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে ২ কোটি ১৭ লাখ কৃষককে স্মার্ট কৃষি কার্ড দেওয়ার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। অনেক কৃষককে বৈজ্ঞানিক কৃষিপ্রযুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষকেরা ভুলবশত বেশি পরিমাণে কীটনাশক ও গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করছে। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী এ সুযোগটা নিচ্ছে। এসব বিষয় একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে জাতীয় পর্যায়ে পরিবীক্ষণ কমিটি করা হচ্ছে। এটা করা গেলে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য বিভিন্ন বিদেশি বাজারেও শোভা পাবে। এটা কৃষি বিভাগ ‘পার্টনার’ নামে একটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর অধীনে কৃষকদের ভালো চাষাবাদ বিষয়ে হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর প্রভাব বাড়বে।
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষকদের ভালো চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সবাই মিলে কাজ করলে সফল হওয়া সম্ভব।
ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
ইনচার্জ, বাংলাদেশ অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার নেটওয়ার্ক, বারি
খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিরাপদ হলে খাদ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাবে। খাদ্যের উৎস মূলত দুটি। একটি উদ্ভিজ্জ, অপরটি প্রাণিজ উৎস। খাদ্যের মূল উৎপত্তি মাটিতে। মাটিকে অনিরাপদ খাবার দেওয়া হলে গাছও তাই গ্রহণ করবে। মৃত্তিকা সম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশের ৭০ ভাগ মাটির জৈব পদার্থ ১ শতাংশের কম। অথচ এটা ৩ দশমিক ৫ শতাংশের কম। এ বাস্তবতায় খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন করা কঠিন। মাটিকে সুস্থ রাখতে পারলে অন্য ব্যাপারগুলোতেও পরিবর্তন আসবে।
খাদ্যনিরাপত্তায় ধানকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। ধান ঘরে থাকলে কৃষক নিজেকে নিরাপদ মনে করেন। সত্তরের দশকের পরপরই কৃষিব্যবস্থায় সবুজ বিপ্লবকে ধারণ করা হয়েছে। আমরা ক্ষুধা নিবারণে সবুজ বিপ্লবকে আঁকড়ে ধরে কাজ করে যাচ্ছি।
খাদ্য ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপেই কোনো না কোনোভাবে ভেজাল প্রক্রিয়া চলমান। উদ্দেশ্যপ্রবণভাবেও ভেজাল প্রক্রিয়া চলছে। তা ছাড়া অসচেতনতার জন্য ভেজাল প্রক্রিয়া থামানো যাচ্ছে না। পুরো খাদ্যব্যবস্থায় উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও মোড়কায়নে কোথাও একটি ভুল হলেই খাদ্যটি অনিরাপদ হয়ে যায়।
আচরণগত ও সামাজিক পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত নিরাপদ খাবারের বিষয়টি উপক্ষিত থাকবে। এটা একটা সামাজিক বিন্যাস। খাদ্যনিরাপত্তা উৎপাদন ও প্রক্রিয়া অঞ্চলের অংশীদারেরাই নিশ্চিত করবে। এ ক্ষেত্রে আমরা একটি মডেল তৈরি করেছি। এ মডেলে একদল কৃষক অন্য আরেক দল কৃষকের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এখানে সবাইকে যুক্ত করে এগিয়ে যেতে পারলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য গ্রাম পর্যায়ে নারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দেওয়া জরুরি। মাঠপর্যায়ে এই সচেতনতা তৈরিতে সংবাদমাধ্যমগুলো ভূমিকা রাখতে পারে।
ড. আবু জায়েদ
অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি ও কার্যকরী সদস্য, এফআইভিডিবি
আমরা ওয়েল্ট হ্যাঙ্গার হিলফের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে সুনামগঞ্জ জেলায় কাজ করছি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে অংশীদারত্ব নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কৃষকদের জন্য মার্কেট অ্যাকসেসের ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে। কৃষকদের জৈব উৎপাদনের সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করারও চিন্তা করা হচ্ছে।
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে আমাদের খাদ্য নিশ্চিতকরণের বিষয়টি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর ১৮ অনুচ্ছেদে পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্যের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় ৫৪ বছরেও খাদ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গ্রহণ করা যায়নি। সাউথ আফ্রিকা বা ইউক্রেনের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও তাদের জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।
২০১৩ সালে আইনের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তার সব দায়দায়িত্ব এক প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তৈরি করা হয়। আগামী বছর এ প্রতিষ্ঠান ১০ বছর পার করবে। এ সময়ে আইন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় রকমের কিছু মৌলিক সমস্যা রয়ে গেছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কোনো সাংবিধানিক সংস্থা নয়। এটা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি কমিশন। মন্ত্রণালয়ের অধীনে তারা আসলে কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে? অনেক ক্ষেত্রে অহেতুক বেআইনি হস্তক্ষেপও করা হয়। এতে আইনের কার্যকারিতা খর্ব করা হয়েছে।
খাদ্যনিরাপত্তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বড় রকমের ঘাটতি আছে। আবার এদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের কোনো ব্যবস্থাও নেই। এ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের জন্য সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ না করলে একটা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে খাদ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফল হওয়া সম্ভব নয়।
আসফিয়া আজিম
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ
পুষ্টি সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ‘খাদ্যের কথা ভাবলে পুষ্টির কথা ভাবো’। জন্ম থেকে ৫ বছর পর্যন্ত শিশুকে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সে সুযোগটা কতটুকু। বিভিন্ন সরকারি গবেষণায় এসেছে, মাত্র ৩৮ শতাংশ শিশু বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার খাওয়ার সক্ষমতা রাখে। তবে সিলেটে এর পরিমাণ আরও অনেক কম। খুব কমসংখ্যক শিশু প্রতিদিন তিন-চার ধরনের খাবার খেতে পারে। শিক্ষিত মায়েরা শিশুদের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার দিতে পারে। একদম নিরক্ষর মায়েরা তা পারছেন না। আবার আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী নিচে থাকা পরিবারগুলো শিশুদের কম বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার দিচ্ছে।
আবার কিশোরী, নারী, প্রসূতি নারীদের পুষ্টির অবস্থা আরও খারাপ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মোট ৩ ভাগের ১ ভাগ কিশোরী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। তারা একধরনের বঞ্চনার শিকার। সরকার বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টিনীতি ২০১৫ আবার নবায়ন করছে। আমাদের সামনে এটা খুবই ভালো একটা সুযোগ। পুষ্টিনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিরাপদ খাবারের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। ‘নিউট্রিশন ফর গ্রোথ’ নামে ২০২৫ প্যারিস সম্মেলন হবে। সেখানে পুষ্টির উন্নয়নে বাংলাদেশ কী কর্মপন্থা নেবে, সে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসতে হবে। পরবর্তী পাঁচ বছর এ নিয়ে কাজ করতে হবে।
এই সামাজিক সুরক্ষার মধ্য দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে পারি। এটার মাধ্যমে আমরা যদি তাদের কাছে নিরাপদ খাবার পৌঁছে দিতে পারি। তাহলে পরে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সহজ হবে।
ড. আলী আব্বাস মোহাম্মদ খোরশেদ
সহযোগী অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। উৎপাদক একা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারবে না।
চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদক জৈব খাদ্য তৈরি করে দিলেও সেটা পরিবহন ও ব্যবসায়ীদের হাত হয়ে বাজারে যাবে। এ প্রক্রিয়ায় খাদ্য আর নিরাপদ থাকছে না। সুতরাং প্রতিটি জায়গায় কাজ করতে হবে। ক্রয়ের পর খাবার খাওয়ার আগপর্যন্ত খাদ্য নিরাপদ রাখার দায়িত্ব ভোক্তার। তাই এখানে উৎপাদক, ভোক্তা, বিপণনকর্মীসহ সব অংশীদারের দায়িত্ব আছে। এমন একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার, যেখানে সমতা, পুষ্টি, উৎপাদন, বাজারজাত—এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
অর্গানিক পণ্য স্বাভাবিকভাবে চকচকে হবে না। চকচককে হলেই তা সতেজ খাবার, এটা ভুল ধারণা। অর্গানিক পণ্যের দাম একটু বেশি হয়। খরচ অনুযায়ী পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে হবে। পণ্য কেনার সময় ভোক্তাদের একটা ভূমিকা আছে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে ফুড লেবেলিং বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এ নিয়মগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। যথাযথ লেবেলিং না হলে ভোক্তা পণ্য না কিনলে উৎপাদকেরা তা ঠিকমতো করতে বাধ্য হবেন।
এখানে সমতার কথা আসছে। যার যতটুকু দরকার, তার জন্য সে পরিমাণ পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। একটা কমন প্ল্যাটফর্ম থাকলে সবাই সবার মতামত, পরামর্শ ও সমস্যাগুলো জানাতে পারবেন।
হুমায়ূন কবির ভুইয়া
সাধারণ সম্পাদক, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
সুনামগঞ্জের প্রকল্পের সঙ্গে অনেক দিন ধরে কাজ করছি। গেইন ও বিএসটিআইয়ের সঙ্গেও আমরা কাজ করে। ভোক্তা হিসেবে ভোক্তার অধিকার আদায়ে আমরা ভোক্তা অধিকারসহ অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করি।
গ্রামীণ পর্যায়ে মানুষ খাবারের মূল্যবৃদ্ধি ও অন্য অনেক কারণে খাবারই পাচ্ছে না। খাবার পাওয়ার পর নিরাপত্তার বিষয়টি আসে। তাই গ্রামীণ মানুষের কাছে শব্দটি বিলাসিতা মনে হয়। পোলট্রি খাতে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। মুরগির শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পর নিয়ম মেনে অপেক্ষা না করেই দু-এক দিন পর তা বাজারজাত করা হচ্ছে। আমরা এসব মুরগি বাজার থেকে কিনে খাই। এতে অনেক মানুষের শরীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে যাচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতারও ঘাটতি রয়েছে। কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে খাবার পৌঁছানোর যেকোনো পর্যায়ে তা অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে। বেশির ভাগ কৃষকই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের সঠিক নিয়ম ও পরিমাণ জানেন না। জানেন না বলেই তিনি অনিরাপদ খাবার উৎপাদন করেন। এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
এ জি এম রেজা সুমন
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভমড নিউট্রিশন (গেইন)
সব খাদ্যই তো নিরাপদ না। খাবার যদি নিরাপদ না হয়, তবে সেটা খাবার না। সুনামগঞ্জে ২ হাজার ৫০০ কৃষক জৈব কৃষি উৎপাদন শুরু করেছে। এটা খুবই ভালো একটা ব্যাপার। আমাদের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে এবং জৈব পণ্যের চাহিদা তৈরি করতে হবে। নিয়মিত পণ্য কেনাবেচা করার কাঁচাবাজারগুলো অনিরাপদ। মাছ, মাংস, সবজি একসঙ্গে বিক্রি করা হয় এবং কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলা হয় না। বাজার নিষ্কাশনব্যবস্থাও ভালো নয়।
এ নিয়ে মোহাম্মদপুর টাউন হল ও মহাখালী কাঁচাবাজারে কাজ করেছি। এখানে নিষ্কাশনব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপদ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। পুরো বাজারে এখন চমৎকার পরিবেশ রয়েছে। সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ সমিতির সঙ্গেও কাঁচাবাজারের নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। বাংলাদেশে পোশাক কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা অনেক। তাঁরা এ জৈব পণ্য বা নিরাপদ পুষ্টিকর খাদ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন না। তাঁদের কাছে পুষ্টিকর খাদ্য মানে দামি খাবার। কিছু কারখানায় সুলভ মূল্যের দোকান চালু করেছি। যেন পোশাকশ্রমিকেরা এখানে নিরাপদ খাদ্য পান। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ অনেক কম। কারণ, তাঁরা বিষয়গুলো জানেন না। এ চাহিদা বাড়াতে আমরা কাজ করছি। সরকার থেকেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আশা করি।
মো. ওসমান গনি
সভাপতি, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি
খাবার সুস্বাদু করার জন্য টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করার কথা এসেছে। বাবুর্চিদের টেস্টিং সল্ট ব্যবহার না করার জন্য বলা হয়। টেস্টিং সল্ট অনিরাপদ। তাহলে আমাদের দেশে টেস্টিং সল্ট পাওয়া যাবে কেন? ফসলে রাসায়নিক ও কীটনাশক দেওয়া হয়। আমাদের গ্রামে তো কোনো রাসায়নিক তৈরি হয় না। তবে এগুলো কোথা থেকে আসে? এই দেশে অনিরাপদ জিনিস আসতে পারবে না, বিক্রি হবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে।
৮০ শতাংশ হোটেল যেভাবে যেখানে প্লেট ধোয়, তা দেখলে আপনি খেতে পারবেন না। ফুটপাতে কীভাবে প্লেট ধোয়? ওই পানিতে তো আপনি পা–ও ধোবেন না। মতিঝিলে এক জায়গায় প্রায় ৫০টা হোটেল আছে। ওখানে বৃষ্টি ও নর্দমার পানি একাকার হয়ে যায়।
কিন্তু ওই পানি দিয়েই সব কাজ চলছে। ৮ বা ১০ ফুটের রুমে টিফিন বাটির খাবার তৈরি হয়। একটা রুম, তিন–চারজন লোক ঘামে ভিজে একাকার, নোংরা পরিবেশ—এর মধ্যেই খাবার তৈরি হয়। এটা বেশি অনিরাপদ। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আছে। তারা গত ছয় মাসে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলেনি। আপনারা খাদ৵দূষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দেন, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কানিজ ফাতেমা
কো–অর্ডিনেটর, রাইট টু ফুড নেটওয়ার্ক
নিরাপদ খাদ্য সবার জন্য জরুরি। যখন সবার খাদ্য প্রাপ্তিটাই একটা চ্যালেঞ্জ, সেখানে নিরাপদ খাদ্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। প্রথমত, কৃষককে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য তাঁদের ন্যায্যমূল্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তা হিসেবে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করার মানসিকতা থাকতে হবে।
বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা শ্রেণি ও লিঙ্গভিত্তিক সমাজে নানা ধরনের বিভাজন আছে। সেখানে কি সবার জন্য সমবণ্টন হচ্ছে? এ বণ্টন নীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। এর
মধ্যে নারী ও শিশুরা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় ৪০ শতাংশ নারী পুষ্টিকর খাদ্য ও রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। অর্থাৎ আমরা ঝুঁকিপূর্ণ একটা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের কৃষি খাতে পুরুষদের সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ। এটা নানা কারণে কমে যাচ্ছে । আর নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি বাড়ছে। বাংলাদেশের
নীতি কাঠামোয় নারী এখন পর্যন্ত কৃষক হিসেবে স্বীকৃত নয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের পথে এগিয়ে যেতে সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
পঙ্কজ কুমার
কান্ট্রি ডিরেক্টর (বাংলাদেশ), ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে
জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ এনজিওগুলো কাজ করছে। ফসলে অতিরিক্ত রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহারের বিষয়টি এসেছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টির শিকার। এটা নারী ও শিশুদের ওপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে।
বিভিন্ন ধরনের খাদ্যে অতিরিক্ত রাসায়নিক ও কৃত্রিম রঙের ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া টেকসই কৃষিচর্চার অভাব রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে ভোক্তাদের জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব আছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে জাতীয় পর্যায়ে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
কৃষকদের জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে উৎসাহিত করার পাশাপাশি প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। জৈব চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত কৃষকদের তথ্যভান্ডার তৈরি করা দরকার। এ ছাড়া মানদণ্ড অনুযায়ী কৃষকদের সনদ ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিরাপদ খাবার গ্রহণ করার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা একটি বড় কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে এসব বিষয়ে নিয়মিত প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সবার সম্মিলিতভাবে কাজ করা জরুরি।
তাহমীনা শৈলী
নারী উদ্যোক্তা, শৈলী ক্রিয়েটিভ স্টুডিও।
একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা বলি। শিশুদের একটা কর্মশালায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, মাছ কোথায় থাকে? একটা শিশু উত্তর দিল, ফ্রিজে। এই জেনারেশনের শিশুদের পিৎজা, বার্গার খাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর এটা তাদের দোষ নয়। কারণ, পুরো ব্যবস্থাই খুব জটিল। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য কথাটা শুনে আমার মনে অর্গানিক শব্দটি এসেছে। আর অর্গানিক শব্দটি শুনলেই অনেক দামি খাবার বলে মনে হয়।
সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে জৈব প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে পাওয়া খুব জরুরি। প্যাকেট, প্লাস্টিক লেবেল—এগুলো নিরাপদ না হলে তা দোকান থেকেই প্রত্যাহারের নীতিমালা করা হোক। বাসায় এনে রান্না বা পণ৵ ব্যবহার বিষয়ে সবার একটা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অতিরিক্ত সময় নিয়ে রান্না করা, বেশি সেদ্ধ করা, কয়েক দিনের খাবার একসঙ্গে রান্না করে সংরক্ষণ করে খাওয়া—এর ফলে কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না, তা জানা জরুরি।
আমিনুল ইসলাম বাবু
সম্পাদক, বাংলাদেশ সেভ ফুড অ্যালায়েন্স
আমরা মাঠপর্যায়ে জৈব চাষাবাদে খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপদ খাদ্য চিন্তাচেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকদের সঙ্গে কাজ করি। গত ২৪ নভেম্বরও বাংলা একাডেমিতে ‘বাঁচলে কৃষক বাঁচবে দেশ’ শিরোনামে কৃষি সম্মেলন করেছি। কৃষকদের সঙ্গে কাজ করায় তাঁদের সমস্যাগুলো কাছ থেকে জানতে পারি। কিন্তু সমস্যাগুলো সমাধানে কী করণীয়, এ বিষয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হলেও বাস্তবায়নের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
খাদ্যের নিরাপত্তায় উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবারের প্লেট পর্যন্ত খাদ্যকে নিরাপদ করার জন্য অনেক কাজ করতে হবে। উৎপাদনই বিষাক্ত হলে যতই প্রক্রিয়াজাত করা হোক না কেন, খাবার নিরাপদ থাকবে না। কৃষিব্যবস্থায় অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে গেছে। এতে খাদ্য বিষাক্ত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ, মাটি, পানি, বাতাস—সব বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য কৃষকদের স্বাস্থ্যহানি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। ভোক্তারাও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। এ জন্য ভোক্তাদের সচেতনতার ব্যাপারে সব মহলকেই কাজ করতে হবে।
মো. কামাল উদ্দিন
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদক, সুনামগঞ্জ
আগে আমরা রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করতাম। এফআইভিডিবি প্রকল্পের লোকেরা আমাদের গ্রামে একটি জৈব চাষি দল তৈরি করার কথা বলেন। আমরা গ্রামের সব মানুষকে নিয়ে একটি মিটিং করলাম। এখান থেকে আমরা ৩০ জন সদস্য জোগাড় করেছি। তাঁদের নিয়ে আমরা জৈব চাষ করার কথা ভাবি। জৈব চাষ করতে প্রত্যেকের গরু লাগবে। গরু ছাড়া জৈব চাষ হবে না। আমরা গরুর গোবর, ধানের চিটা, মেয়াদোত্তীর্ণ পাউরুটি, পচা ডিম ইতাদি দিয়ে জৈব সার তৈরি করেছি। আর এফআইভিডিবি জৈব সার তৈরিতে সালফার, ম্যাগনেশিয়াম, বোরিক অ্যাসিড, পটাশ ইত্যাদি দিয়েছি। কীভাবে জৈব সার তৈরি করতে হয়, তারা দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা এখন জৈব চাষ করি। এটাতে খরচও বেশি হয় না৷ কারণ, গোবর আমরা এমনিতেই ফেলে দিই। জৈব চাষের খাবার সবার জন্য নিরাপদ। আমাদের পরিবারও এখন নিরাপদ খাবার খায়।
মামুনুর রশিদ
হেড অব প্রজেক্ট, ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে
ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে প্রান্তিক কৃষকদের জৈবপদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে একটি স্থায়িত্বশীল ও সহনশীল স্থানীয় খাদ্যব্যবস্থা কৌশল বাস্তবায়ন করছে, যেখানে টেকসই উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং টেকসই খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। বৈশ্বে ২ দশমিক ৩ বিলিয়নের বেশি মানুষ পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে ভুগছে। ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যয় বহন করতে পারছে না। ২০১৭ সালের পর থেকে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। এশিয়া অঞ্চলে ৪২৫ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টির শিকার। এ অঞ্চলের এক-চতুর্থাংশ মানুষ মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বাংলাদেশে ১৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টির শিকার এবং ১২০ মিলিয়নের ওপরে মানুষ পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের ব্যয় বহন করতে পারে না।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে এসেছে, ৪০ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল রয়েছে। এ ছাড়া বাজারে পাওয়া ৬০ শতাংশ শাকসবজিতে অতিরিক্ত কীটনাশক পাওয়া গেছে। ভেজাল খাদ্য ৩৩ শতাংশ মানুষের বিভিন্ন রোগ এবং পাঁচ বছর বয়সের নিচে ৪০ শতাংশ শিশুর অসুস্থতার প্রধান কারণ। ভেজাল ও দূষিত খাদ্য মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার মাটিতে প্রয়োজনীয় জৈব উপাদানের অভাবের কারণে অনিরাপদ ফসল উৎপাদন খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। প্রকল্পটি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পাঁচটি কৌশল অবলম্বন করেছে। যেমন: ১. পার্টিসিপেটরি গ্যারান্টি সিস্টেম প্রবর্তন, ২. জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি চর্চা, ৩. জৈব কৃষক দল গঠন ও জৈব চাষাবাদে সহায়তা, ৪. সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীসহ স্থানীয় সেবাদানকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ৫. কমিউনিটির সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের প্রচার।
আমাদের প্রকল্প এলাকায় ৫৫ শতাংশ কৃষক জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার ও চর্চার মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ জৈব ফসল উৎপাদন করছেন। ৬৮ শতাংশ পরিবারের মধ্যে খাদ্যে বৈচিত্র্য বেড়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ৪৫ শতাংশ কৃষকের মধ্যে ২০ শতাংশের আয় বেড়েছে। আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এসব কার্যক্রম এগিয়ে নিতে চাই, যার মাধ্যমে কৃষক, খাদ্য উদ্যোক্তা, ভোক্তাগোষ্ঠী, সার্টিফিকেশন সংস্থা, সুশীল সমাজ এবং সরকারি খাতের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের জন্য একটি নেটওয়ার্ক/প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করা যায়।
সুপারিশ
* সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।
* জৈব চাষের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
* কাঁচাবাজারে নিষ্কাশনব্যবস্থা ও নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।
* কৃষকের খেত থেকে ভোক্তা পর্যন্ত খাদ্য পৌঁছানোর সব পর্যায়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি।