আর্ক ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৩০ নভেম্বর ২০২৪। আলোচকদের বক্তব্যের সারকথা এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশ হলো।
মো. হুমায়ূন কবির, সাবেক সিনিয়র সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
ডা. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন, সদস্য, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
ড. রুমানা হক, প্রধান নির্বাহী, আর্ক ফাউন্ডেশন ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ডা. দীপা বড়ুয়া, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, আর্ক ফাউন্ডেশন।
আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমরুল কায়েস চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
ডা. খালেদা ইসলাম, সাবেক পরিচালক, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা , স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
ডা. শামস এল আরেফিন, ইমেরিটাস বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি।
ড. রাশিদ জামান, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, ব্রিটিশ হাই কমিশন ঢাকা।
ডা. সুব্রত পাল, ফোকাল পয়েন্ট, ইউএইচসি এবং ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট।
সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
মো. হুমায়ূন কবির
সাবেক সিনিয়র সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
দেশের স্বাস্থ্য খাতে একটা বড় বিভাজন রয়েছে। এ বিভাজন শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলের। শহরেও অনেক ধরনের হাসপাতাল রয়েছে। গ্রামীণ পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা দিচ্ছে। তবে সব কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যকর্মীদের সঠিক প্রশিক্ষণ নেই। প্রতিটা ইউনিয়ন পরিষদে একটা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র সুবিধা আছে। এগুলো ১০ থেকে ২০ শয্যাবিশিষ্ট করা হয়েছে। অনেক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে জনবলসংকট রয়েছে।
নতুন ভাবনার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সক্ষমতার দুটো দিক আছে। একটি জনবল ও কারিগরি সক্ষমতা, অন্যটি অর্থনৈতিক সক্ষমতা। তবে এখানে কারিগরি সক্ষমতার বিষয়টি আগে আসবে।
ডিজিটাল মাধ্যমে ভ্যালু ক্রিয়েশন হয়, যা জিডিপিতে বিশাল একটা অবদান রাখতে পারে। জাতীয় অবকাঠামোয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ডেটা শেয়ারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পৃথিবীতে অনেক দেশেই ‘হেলথ আইডি বা মাই হেলথ’ ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো ডেটা শেয়ার করতে পারে। এখানে আমরা একটি বড় ধরনের সুযোগ দেখছি। রোগীর চিকিৎসাসংক্রান্ত সব তথ্যই তথ্যভান্ডারে থাকবে। যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেবাপ্রদানকারীরা তা অ্যাকসেস করতে পারবে। সে জন্য একটা অবকাঠামো দরকার।
আমাদের স্বস্থ্যসেবায় অনলাইনের মাধ্যমে ওয়ান–স্টপ সার্ভিস করা দরকার। আমাদের রোগীরা এত টাকা খরচ করে কেন বিদেশে যাচ্ছে, তা ভাবতে হবে। একই মানের সেবা নিতে দেশের বাইরে বেশি খরচ হলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দেশে সেবা নেবে।
সদস্য, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো এ–সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর পর্যবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্ব পেলেও প্রয়োজনীয় সহায়তা ও অর্থায়নে তাদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ২৫ বছর ধরে চলমান প্রকল্পের কোনো স্থায়িত্ব নেই। অর্থায়ন বন্ধ হলে সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ‘আরবান হেলথ কেয়ার ফর পুওর ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্ট হিসেবে একটি খসড়া তৈরি করেছিলাম। এখানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল স্টাফ, নার্স ও প্যারামেডিকদের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন কাজ করার সুযোগ তৈরি করা হতো। তবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নিয়মে স্বাস্থ্যসেবার কোনো উল্লেখ নেই।
সাম্প্রতিক কালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় একটি বাজেট পরিকল্পনা করেছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী থোক বরাদ্দ থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু অর্থ স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রদান করছে। কিন্তু বাস্তবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো দৃশ্যমান কাজের পেছনে অর্থ ব্যয় করতেই বেশি আগ্রহী। এ থোক বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের কন্ট্রাক্ট ম্যানেজমেন্ট দক্ষতার অভাব রয়েছে। এ অভাব কাটাতে না পারলে বেসরকারি খাতের সঙ্গে কার্যকরভাবে যোগাযোগ বা পরিচালনা সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্যবিমার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, অর্থায়নের মডেল কী হবে—এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি।
আমাদের মান উন্নয়নে ঘাটতি রয়েছে। পর্যবেক্ষণ ও পরিমাণগত বিশ্লেষণ সম্ভব হলেও গুণমান নিশ্চিত করা যায় না। গুণমানের জন্য সরাসরি পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনকেও সংযুক্ত করতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্য–সুবিধাগুলোকে জলবায়ু সহনশীল ও অভিযোজিত করতে হবে। এ ছাড়া পুষ্টি সমস্যার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে; কারণ, অপুষ্টির কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশ প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা লোকসান করে।
এসডিজি লক্ষ্য সামনে রেখে গুণগত মান ও কাভারেজ বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের সব পরিকল্পনা এ লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
প্রধান নির্বাহী, আর্ক ফাউন্ডেশন ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নগর স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে (পিপিপি) সেবা প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আলোচনায় এসেছে। এ ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক পারচেজিংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য একটি সুস্পষ্ট পিপিপি নীতিমালা বা গাইডলাইন প্রণয়ন জরুরি। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালা নির্ধারণও অপরিহার্য।
স্বাস্থ্যসেবায় অঞ্চলভিত্তিক, আয়শ্রেণি এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করতে হবে। বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে একটি স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং এ সুবিধা জনগণের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবকাঠামো এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় রেখে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ এবং বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আধুনিক করতে ‘ওয়ান হেলথ অ্যাপ্রোচ’ গ্রহণ করা হয়েছে, যা মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের স্বাস্থ্যকে একটি সমন্বিত পদ্ধতিতে দেখার ওপর গুরুত্ব দেয়।
সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার মান নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেবার মান উন্নত করতে স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সেবা প্রদানের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। রোগীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন ও সেবা প্রদানে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে চিকিৎসক, নার্স ও অন্য পেশাজীবীদের উপস্থিতি; প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামের প্রাপ্যতা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর স্বীকৃতি ও তালিকাভুক্তি জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য এখন একটি উপযুক্ত সময়। রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার পর তাঁদের মতামত সংগ্রহের একটি শক্তিশালী ফিডব্যাক মেকানিজম তৈরি করতে হবে। এর মাধ্যমে একদিকে জনগণের মতামত সরাসরি নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে, অন্যদিকে সেবার মান নিয়ে অসন্তোষ থাকলে তা সমাধান করা যাবে।
অবশেষে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতি ও তাঁদের গুণগত মান নিশ্চিত করতে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। সব পদক্ষেপ মিলিয়ে রোগীদের প্রতি সংবেদনশীল ও আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
আহ্বায়ক, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ
১২ ডিসেম্বর সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দিবস পালিত হয়ে থাকে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা মূলত মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোর সহজলভ্যতা, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা—এ তিনটি ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের দুই জায়গায় সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে খরচ হয়। এ পরিমাণ দ্বিগুণ করা হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বেশির ভাগ খরচ বহন করা সম্ভব। থাইল্যন্ড সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বাস্তবায়নের ফলে থাইল্যন্ডের অর্থনীতি মোটেও প্রভাবিত হয়নি। বরং এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। বাংলাদেশে এমন এক অবস্থায় আছে যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে আমাদের সামনে নতুন সুযোগ এসেছে। আমাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবে বলে আশা রাখছি।
আগামী এক বছরে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ জিডিপিরর ১ শতাংশ করতে হবে। বরাদ্দের এ অতিরিক্ত অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় হবে, তা স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে খুঁজে বের করতে হবে। তাহলেই ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন করতে পারব।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের কাঠামো নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা প্রশাসনের পুনর্গঠন করা যেতে পারে। ১৯৯০ সালের স্বাস্থ্যনীতিতে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়েছিল। এটি অনুসরণ করলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন করতে পারব। এ ছাড়া বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদানের বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
তৈরি পোশাকশ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিমা দেওয়ার ক্ষেত্রে বারডেম তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে কাজ করছে। এটি একটি সফল মডেল। এটিকে আরও দক্ষ করা তোলার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যবিমা চালু করা সম্ভব। সরকারের বাইরেও কাজ করার অনেক সুযোগ আছে।
ব্র্যাকসহ আরও অনেক এনজিও স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে
পরীক্ষা করছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সফল হতে পারেনি। এ দেশে ৩ কোটি মানুষ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার সদস্য। গ্রামীণ, ব্র্যাক ও আশার মতো বড় তিনটি সংস্থার সঙ্গে প্রায় ১০ কোটি মানুষ জড়িত। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা, স্বাস্থ্যসুবিধাভোগী ও সরকার—এই তিন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করার
মাধ্যমে ১০ কোটি লোকের জন্য অতি সহজেই স্বাস্থ্যসুবিধা দেওয়া সম্ভব।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের তৃতীয় তফসিলে নগরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর অর্পিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতায় শহুরে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এ সেবার বাইরে রয়ে গেছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন করতে হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা দুটি প্রধান খাতে বিভক্ত। প্রথমটি আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট (ইউপিএইচসিএসডিপি), যা বর্তমানে চতুর্থ প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। এ প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এডিবির অর্থায়নে সময় বৃদ্ধি পেয়ে তা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত চলবে। এ প্রকল্প চারটি সিটি করপোরেশন ও ১৮টি পৌরসভায় চলছে। তবে প্রকল্পটি উত্তর সিটির শুধু ৫০ শতাংশ এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করে।
উদ্বেগের বিষয় হলো ২০২৫ সালের পর এডিবির অর্থায়ন বন্ধ হলে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে। সিটি করপোরেশন এ প্রকল্পের শেষে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে কাজ করে যাচ্ছে। প্রশ্ন থাকে যে, সিটি করপোরেশন একা এ দায়িত্ব নিতে সক্ষম?
এ প্রকল্পে স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রবিন্দু হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য। অথচ জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ পুরুষ এবং বিরাট অংশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এ সেবার বাইরে। ব্র্যাক, সূর্যের হাসি ও বাপসার মতো এনজিওগুলোর নাগরিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর সিটি করপোরেশনের কোনো মনিটরিং বা সমঝোতা নেই।
সরকারি আউটডোর ডিসপেনসারিগুলোর সংখ্যা ও কার্যকারিতা সীমিত। সম্পূর্ণ নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সিটি করপোরেশনের জনবলসংকটও একটি বড় সমস্যা।
আমার মতে স্বাস্থ্যসেবায় মনিটরিং–ব্যবস্থা জোরদার করা, সেবা প্রদানে সমন্বয় সাধন এবং সিটি করপোরেশনকে আর্থিক ও মানবসম্পদে সক্ষম করে তোলা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে ২০২৫ সালের পর নাগরিক স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা বড় সংকটে পড়তে পারি।
অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার কথা মাথায় রেখে কাজ করার জন্য আমাদের হাতে আর মাত্র পাঁচ বছর আছে। এ পাঁচ বছরে নতুন কোনো পদ্ধতিতে গিয়ে সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাই ২০৩০ সালভিত্তিক পরিকল্পনা বদলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্য কমিশন হয়েছে। স্বাস্থ্য কমিশনের কাছে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রত্যাশা করছি। স্বাস্থ্য কমিশনের এ পরিকল্পনা ২০ থেকে ৩০ বছর মেয়াদি হতে হবে।
আমরা স্বাস্থ্যবিমাভিত্তিক পদ্ধতিতে এখনই যেতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত বড় বাধা। দেশের ২৭ শতাংশ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে
নিয়োজিত। এখান থেকে টাকা আদায় করা সম্ভব নয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক, পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর—এ তিনটিকে একত্র করে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে।
প্রতিটি পরিবারকে ‘জেনারেল ইম্প্রেশন কেয়ার’ –এর জন্য এক লাখ টাকার কার্ড দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। এ কার্ডে সেবা নিতে চাইলে উপজেলা পর্যায়ের সুবিধা নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। কেউ তা না করে জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ থেকে সেবা নিতে চাইলে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে সেবা নিতে হবে। এ ধরনের পদ্ধতি ছাড়া বাংলাদেশের রেফারেল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা বাড়বে।
আমাদের ১৫ কোটি মোবাইল ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রত্যেক ব্যবহারকারীর কাছ থেকে মাসে ১০ টাকা করে নিলে দেড় হাজার কোটি টাকা আসবে। আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালসহ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) খাতের অর্থ থেকে মাত্র ১ শতাংশ টাকা দিলেই চলবে। প্রবাসীদের এ জায়গায় অর্থ দিতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এখানে প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার ফান্ড জোগাড় করা গেলে এ জরুরি অবস্থার বা স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, আর্ক ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের আলমা-আটা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী দেশ। এ ঘোষণার অঙ্গীকার ছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার মাধ্যমে ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা মূলত গ্রামীণ অঞ্চলের জন্য সাজানো হয়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলে কমিউনিটি, ইউনিয়ন ও উপজেলা— এ তিন স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো রয়েছে। শহরাঞ্চলে এ রকম কোনো কাঠামো নেই। পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রামে (এইচপিএনএসপি) শহরাঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আর্ক ফাউন্ডেশন অসংক্রামক রোগ, মানসিক স্বাস্থ্য, আন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স, স্বাস্থ্য বরাদ্দ, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবাসহ অনেক বিষয়ে অগ্রগতির সুযোগ চিহ্নিত করেছে। শহরাঞ্চলে মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতা বাড়ানো দরকার। এসব সেবা প্রদানে ন্যাশনাল হেলথকেয়ার প্রটোকল মেনে চলতে হবে। এ জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মধ্য শক্তিশালী সমন্বয় করতে হবে।
বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যানসারের মতো অসংক্রামক রোগে হয়ে থাকে। তা সত্ত্বে জাতীয় স্বাস্থ্য বরাদ্দের মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ অসংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করা হয়। এ ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আর্ক ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘ন্যাশনাল হাইপারটেনশন অ্যান্ড ডায়াবেয়াটিস ম্যানেজমেন্ট প্রটোকল’ বিষয়ে শহরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ১৬০টির বেশি সেবাপ্রদাকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যার পরিধি আরও বাড়ানো দরকার।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২৬ হাজার ২০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে হওয়া এসব মৃত্যু কমাতে ‘ওয়ান হেলথ অ্যাপ্রোচ’ গ্রহণ করা জরুরি।
বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দের পরিমাণ জাতীয় বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ২ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্যবিমা রয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় প্রতিনিয়তই বাড়ছে। তাই এ সেবার দাম নিয়ন্ত্রণ ও সাশ্রয়ী করতে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করা দরকার।
বাংলাদেশে এখন ‘স্মার্ট হেলথ ফর স্মার্ট বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল হেলথ আর্কিটেকচার’, স্বাস্থ্যবাতায়নসহ বিভিন্ন ডিজিটাল স্বাস্থ্য কর্মসূচি চলমান রয়েছে। আর্ক ফাউন্ডেশন ডিজিটাল ‘এমহেলথের’ মাধ্যমে তথ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থপনা, সেবা বিষয়ে রোগীদের মতামত, উন্নত সেবাপ্রদান নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। ২০২৩ সালে ঢাকার গড় বায়ু মান ছিল ১৭১, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। ২০০০ সাল থেকে বন্যা, সাইক্লোন, শৈত্যপ্রবাহ, তাপপ্রবাহের মতো চরম আবহাওয়া বিপর্যয়ের ঘটনা বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। ভারী বর্ষণ ও আর্দ্রতার কারণে ডেঙ্গু মহামারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ তৈরি করেছে।
জলবায়ু, স্বাস্থ্য ও জেন্ডারবিষয়ক সমস্যাগুলো সব সময় উপেক্ষিত থাকছে। এ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে শক্তিশালী সমন্বয় ও দক্ষ জনবল তৈরির কর্মসূচি দরকার। এ ছাড়া জলবায়ুসংক্রান্ত স্বাস্থ্যকৌশলে নারী ও প্রান্তিক মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। এ জন্য কমিউনিটিভিত্তিক পরিকল্পনা ও জেন্ডার সংবেদনশীল তদারকি কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে।
সাবেক পরিচালক, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা , স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান চিত্রটি খুবই হতাশাজনক। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার প্রকৃত ধারণাটি আমরা অনেকেই ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি না। রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়টি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে এ প্রাথমিক সেবার আওতায় রুট ক্যানেল বা হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা অন্তর্ভুক্ত নয়।
স্বাস্থ্য খাতে জনবল–সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সংকট মোকাবিলায় টাস্ক শেয়ারিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব কাজ প্যারামেডিক বা নার্স দিয়ে সম্ভব, সেগুলো ডাক্তারদের ওপর নির্ভর না করে তাঁদের দিয়ে করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নার্স, প্যারামেডিক ও টেকনোলজিস্টদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের কার্যকর টিমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় রোগীর বহুমুখী সমস্যার সমাধান এক জায়গায় করার ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শহর ও গ্রাম—উভয় স্তরেই প্রটোকলভিত্তিক সেবায় রূপান্তর করতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এখন একটি বড় জনস্বাস্থ্য সংকট। জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি না হলে এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।
বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা প্রটোকল অনুসারে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকলের ভিত্তিতে জাতীয় প্রটোকল তৈরি করা হয়েছে। এখন এটি গ্রাম ও শহরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিয়ে আমরা একটি টেকসই ও কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, ব্রিটিশ হাই কমিশন ঢাকা
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ শিশুর জন্ম সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাইরে হয়। সুতরাং বেসরকারি খাতকে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বে চার ধরনের মৌলিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হলেও বেসরকারি সেবা প্রদানকারীরা প্রায়ই এ ব্যবস্থার বিভিন্ন ধরনের সঙ্গে জড়িত থাকতে দেখা যায়। এ জন্য বেসরকারি খাতের জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা ও একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা তৈরি করা খুবই প্রয়োজন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্যসেবা মডেল রয়েছে। কিছু দেশে রাষ্ট্রই সব স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বহন করে। এ ছাড়া মানুষের বেতনের একটা অংশ কেটে রেখে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মডেলও রয়েছে। কানাডা ও সাউথ কোরিয়ার মতো দেশে স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা আছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠীকে একটা বিশেষায়িত মডেলের আওতায় এনে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। এখানে এনজিওগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আছে। দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ভিন্ন মডেল করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের অনেক সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান রাতারাতি হবে না। স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতকে উপেক্ষা না করে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এনে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা দরকার।
ইমেরিটাস বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার ১৪টি সূচক নিয়ে একটি ইনডেক্স রয়েছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার একটি সাধারণ লক্ষ্য ঠিক করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশ
বিশ্বের সবচেয়ে ‘আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার’ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ বিষয়টি মাথায় রেখে একটি লক্ষ্য ঠিক
করা যেতে পারে। সামর্থ্যবানেরা বেসরকারি খাতে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন, সে বিষয়ে কোনো কথা বলব না। সরকারি
হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো নগদ লেনদেন হতে পারবে না। এর মানে চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে হবে, সে রকম নয়। কারণ, এ নগদ লেনদেন খুবই বৈষম্যমূলক। এ জায়গাটি পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে এগোনো প্রয়োজন। এটা খুবই সহজ লক্ষ্য। এ
লক্ষ্য অর্জন করা গেলে আমরা অনেক দূর এগোতে পারব।
ফোকাল পয়েন্ট, ইউএইচসি এবং ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট
স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে যেন ‘আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার’ না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। কী উপায়ে ‘আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার’ কমানো যায়, তা আমরা জানি। তবে এগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করব, তা জানি না। সরকারি অর্থায়ন বাড়ানোর পাশাপাশি আমাদের সর্বজনীন সুবিধার প্রস্তুতি নিতে হবে।
শহরের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে চাপ অনেক বেশি। তাই
শহরে সুবিধা বাড়ানোর ক্ষেত্রে করণীয় ভাবতে হবে। ‘আউট অব পকেট এক্সপেনডিচারের’ ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ওষুধের পেছনে চলে যায়।
সরকারি অর্থায়ন বাড়ালেই সব সমাধান হবে না। কারণ, আমরা সরকারি অর্থায়নের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। প্রতিবছর খরচ না হওয়া বাজেট দিয়েই ওষুধের চার ভাগের এক ভাগ টাকা পূরণ করা সম্ভব। এ বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।
বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে বেশি ঝুঁকছে। মানুষের পকেটে টাকা থাকলে তারা নিজ ইচ্ছায় উন্নত পরিবেশ ও ভালো চিকিৎসার প্রত্যাশায় বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। সরকারি হাসপাতালে বিনিয়োগ বাড়িয়ে সুবিধা বাড়াতে হবে যেন রোগীর পকেট থেকে খরচ না হয়। ধনীদের সরকারি সেবার আওতায় নিয়ে আসার চেয়ে সরকারের বর্তমান লক্ষ্য হওয়া উচিত দরিদ্র মানুষদের মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।
রোগীর চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট সব তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার করা প্রয়োজন
সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ‘ওয়ান হেলথ অ্যাপ্রোচ’ গ্রহণ করতে হবে
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও এনজিওকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
স্বাস্থ্যসেবা–সংশ্লিষ্ট সবার দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
সংবেদনশীল ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থা তৈরি করতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।