হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার

স্বাস্থ্যসেবা হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার

স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরনের সেবা পাওয়া হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার। এ বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন সেবা পেতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয় বা সেবা পায় না। সরকারের আইন থাকলেও হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য সরকারের স্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার ‘হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও অধিকার’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে এসব কথা বলা হয়। ইউএসএআইডির সহযোগিতায় এই গোলটেবিল আয়োজন করেছে সুখী জীবন প্রকল্প, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল। আয়োজনে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো

গোলটেবিলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার অনেক কাজ করেছে এবং আরও কাজ করার আছে। এই জনগোষ্ঠীকে সামাজিকভাবে মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমবিডিসি) ও লাইন ডিরেক্টর টিবি-লেপ্রোসি ও এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম (এনএএসপি) ডা. মো. শামিউল ইসলাম বলেন, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সেবা উন্মুক্ত। সরকারের সব সেবাকেন্দ্র থেকেই তারা সেবা পাবে। তবে এই জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা করেও সেবাকেন্দ্র আছে। সরকারি সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের সেবা পাওয়া নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ করবে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ-সার্ভিসেস) ও লাইন ডিরেক্টর (এমসি-আরএএইচ) ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, শনিবার থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গণটিকাদান কার্যক্রমে এই জনগোষ্ঠীর বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টদের অবহিত করবেন বলে জানান।

ইউএসএআইডি সুখী জীবনের প্রকল্প পরিচালক ও পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্যারোলিন ক্রসবি জানান, তাঁরা হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দিতে সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

গোলটেবিলে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের কিশোর-কিশোরী ও যুব বিশেষজ্ঞ ডা. ফাতেমা শবনম গোলটেবিলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, দেশে এখন ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজারের মতো হিজড়া জনগোষ্ঠী আছে। হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীরা যৌন সংক্রমণের ঝুঁকিতে বেশি থাকে। তারা নানান সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হন। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে তারা সহজে ভালো সেবা পায় না। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতেও এই জনগোষ্ঠীর বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকে না। তিনি আরও বলেন, এই গোষ্ঠীকে সেবা দিতে হলে একটি স্পষ্ট গাইডলাইন থাকা দরকার।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি) ডা. নুরুন নাহার বেগম বলেন, নিবন্ধন খাতায় নারী ও পুরুষের বাইরে অন্য কোনো লিঙ্গের বিষয়ে উল্লেখ না থাকায় ওই দুটোর কোনোটিতে তাদের লিপিবদ্ধ করে সেবা দেওয়া হয়। তাদের নিজ জনগোষ্ঠীর লিঙ্গ হিসেবে নিবন্ধন না থাকায় তাদের সেবার হিসাব আসে না। এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন বা নীতি প্রণয়ন করলে সেবা দিতে সহজ হবে।

লাইট হাউসের কাউন্সিলর (জেন্ডার ডাইভারস পিপলস প্রোগ্রাম, কক্সবাজার) ও ট্রান্সজেন্ডার প্রতিনিধি তানিশা চৈতী করোনার টিকা নিতে গিয়ে নিজ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর পুরুষ নাম দেওয়া, যেটাতে তিনি পরিচিত হতে চান না। কেন্দ্রে তাঁকে কোন কক্ষে টিকা দেওয়া হবে, তা নিয়েও তিনি বিড়ম্বনায় পড়েন। এ ছাড়া নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষ সহজে চিকিৎসাসেবা নিতে যান না বলেও জানান। তানিশা বলেন, সরকার হিজড়াদের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী বাদেও ট্রান্সজেন্ডার রয়েছে, যাদের স্বীকৃতি প্রয়োজন।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিক ড্যানিয়েল বাকম্যান জানান, বাংলাদেশে এসে তিনি নানা বৈচিত্র্যের মানুষের সঙ্গে কাজ করেছেন। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় অনেকেই কাজ করছেন বলে জানান।

ইউএসএআইডি বাংলাদেশের জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষা কার্যালয়ের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সামিনা চৌধুরী বলেন, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর ইতিহাস বহুযুগের হলেও তারা এখনো এই সমাজে প্রান্তিক হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু সমাজে সব ধরনের অধিকার তাদের আছে।

হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির স্বাস্থ্যসেবাতে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেন ইউএসএআইডি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সুমনা বিনতে মাসুদ।

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার নানা সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু তাদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া কমাতে হবে, শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।

ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারপারসন ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, আইনকে বাস্তবায়ন করতে হলে একটি নীতি থাকতে হবে। সব পর্যায়ে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা করে দিতে হবে।

লাইট হাউসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মো. হারুন অর রশিদ বলেন, এই জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ ছোট থেকেই পরিবারছাড়া হয়ে গুরুদের কাছে বড় হয়। যেসব সংস্থা তাদের নিয়ে কাজ করে, তাদের ওই সব গুরু বা যে সংগঠনের অধীনে থাকছে, সেখানে বিনিয়োগ করলে হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডারদের রাস্তায় নামতে হবে না। একটি স্বাভাবিক জীবন পাবে।

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কানাই সরকার হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।