ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘শিশুদের জন্য বিনিয়োগই বয়স্কদের অগ্রিম সহায়তা’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৭ জুন ২০২১। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
হোসেন জিল্লুর রহমান
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা;
নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি
নাজমা মোবারেক
অতিরিক্ত সচিব, অর্থ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়
সৈয়দ গোলাম ফারুক
মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক
শিক্ষা অধিদপ্তর
টোমো হোযুমি
বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ইউনিসেফ
অসা বৃত্তা টরকেলসন
বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ইউএনএফপিএ
টুমো পোটিআইনেন
কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইএলও বাংলাদেশ
ফারাহ কবির
কান্ট্রি ডিরেকটর, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ
টি এম আসাদুজ্জামান
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, বিশ্ব ব্যাংক
আব্দুর রাজ্জাক
চেয়ারম্যান, আরএপিআইডি
এইকো নারিতা
উপ প্রতিনিধি, ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ
হাসিনা বেগম
সামাজিক সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
জনসংখ্যা আমাদের একটা সম্পদ। কারণ এ জনসংখ্যার একটা বড় অংশ হলো কর্মক্ষম মানুষ। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যেতে তাদের একটা বড় অবদান আছে। আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। এটা নিশ্চয়ই একটা বড় অর্জন। কিন্তু গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আবার আমাদের মৃত্যু ও জন্মহার কমছে। ফলে আগামীতে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়বে এবং কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমবে। আগামীতে প্রবীণদের দেখাশোনা ও তাদের পেছনে ব্যয় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য এখনই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
টোমো হোযুমি
গত কয়েক দশকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার কমিয়ে আনা তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে মৃত্যু হতো ১২১ জনের। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৪০ জনে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ, ২৭ বছরে শিশু মৃত্যুহার প্রায় ৬৭ শতাংশ কমেছে।
১৯৯২ সালে প্রতি সাত জন শিশুর মধ্যে এক জন তাদের জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যাচ্ছিল। ২০১৯ সালে এ পরিমাণ কমে প্রতি দশ জনে শূন্য দশমিক চার জন হয়েছে। এটি একটি বিশাল অর্জন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য উচ্চ প্রজনন হার থেকে নিম্ন প্রজনন হারে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে প্রজনন হার (টিএফআর) ছিল ছয় দশমিক তিন জন শিশু। যা ক্রমান্বয়ে কমছিল। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার কমে যাওয়ার পাশাপাশি সফল পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে দ্রুত ও স্থিতিশীল ভাবে প্রজনন হার কমেছে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা কমে দুই দশমিক তিন হয়। এটা বাংলাদেশের একটা অর্জন। কারণ, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জনসংখ্যার বিস্ফোরণ হওয়ার ঝুঁকি থেকে রেহাই পেয়েছে।
মোট দেশজ উৎপাদনসহ অন্যান্য নির্ধারকগুলোতে বাংলাদেশ ইতিবাচক অগ্রগতি করেছে। জনমিতিক সুবিধা অর্জনের জন্য এখন বাংলাদেশকে দুটো আন্ত-সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। একটি হলো দ্রুত প্রবীণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অন্যটি স্বল্পকালীন জনমিতিক সুযোগের পরিসর। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের পপুলেশন পিরামিডের সবচেয়ে লক্ষনীয় দিক হলো, এই সময় থেকে শিশু জন্ম নেওয়ার হার কমতে থাকে। এ পরিবর্তনের সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো চিত্রের নিচের দিক, যা কম শিশু জন্ম নেওয়ার হার নির্দেশ করে। তখন থেকেই বাংলাদেশ শিশুর সংখ্যা কমতে থাকে। ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যার পিরামিড চিত্রের উপরের দিক ভারী হবে। সে সময় প্রবীণ মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে। অর্থাৎ, ২০৫০ সালে উল্লেখযোগ্যভাবে কম সংখ্যক অল্পবয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশিসংখ্যক পরনির্ভরশীল প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দেখাশোনা করতে হবে।
৬৫ বয়োশোর্ধদের প্রবীণ নির্ভরশীল নাগরিক ধরা হয়। দেশে এ বয়সের মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ বা তার বেশি হলে তাকে বয়োবৃদ্ধ সমাজ বলে। এ সংখ্যা ১৪ শতাংশ বা তার বেশি হলে প্রবীণ সমাজ বলা হয়। ২০২৯ সালে বাংলাদেশ বয়োবৃদ্ধ সমাজ হবে। প্রবীণ সমাজ হবে ২০৪৭ সালে। এ পরিবর্তনে বাংলাদেশের সময় নেবে প্রায় মাত্র ১৮ বছর।
জাপানের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনের জন্য ২৪ বছর সময় লেগেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের এ পরিবর্তন জাপানের চেয়ে দ্রুত হবে। ফ্রান্স বয়োবৃদ্ধ থেকে প্রবীণ সমাজে যেতে ১১৫ বছর নিয়েছিল। সুইডেনে এ পরিবর্তন হতে সময় লেগেছে ৮৫ বছর। ব্রিটেন ও জার্মানি এ পরিবর্তনে সময় নিয়েছে যথাক্রমে ৪৭ ও ৪০ বছর। অর্থাৎ এসব দেশে অনেক ধীর গতিতে এ পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের মতো সিংগাপুর, সাউথ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীনে এ পরিবর্তন খুবই দ্রুত হবে। তবে এসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের তুলনায় বেশি সমৃদ্ধ।
স্বল্পকালীন জনমিতিক সুযোগ পরিসরে কর্মক্ষম মানুষের প্রাধান্য বেশি থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের কর্মক্ষম মানুষ বলে ধরা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৯৭৮ সাল থেকে নির্ভরশীল মানুষের অর্থাৎ ১৫ বছরের কম বা ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের তুলনায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০৩৩ সাল থেকে এ সংখ্যা কমতে থাকবে। অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে জনমিতিক সুবিধার স্বল্পকালীন সময়ের সূচনা হয়েছে। বাংলাদেশ এ সুবিধা ৫৫ বছর ভোগ করবে। সেই হিসেবে বলা যায়, ২০১৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশ জনমিতিক সুযোগ পরিসরের প্রায় ৭৮ শতাংশ অতিক্রিম করেছে। অন্যদিকে জাপান ৬০ বছর জনমিতিক সুবিধা ভোগ করেছে। চীন, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, সাউথ কোরিয়া, হংকং, ইন্দোনেশিয়া এ সুবিধা আরও কম ভোগ করবে। বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে ২০ জন কর্মক্ষম ব্যক্তি একজন নির্ভরশীল প্রবীণ ব্যক্তির দেখাশোনা করছিল। ২০২০ সালে একজন প্রবীণ ব্যক্তির দেখাশোনার জন্য কর্মক্ষম মানুষ কমে দাঁড়ায় ১৩ জনে। ২০৪০ সালে ছয় জন কর্মক্ষম ব্যক্তি একজন প্রবীণ নির্ভরশীল নাগরিকের দেখাশোনা করবে। ২০৬০ সালে তিন জন কর্মক্ষম ব্যক্তি একজন নির্ভরশীল প্রবীণ নাগরিকের দেখাশোনা করতে হবে। বর্তমান শিশু ও তরুণেরা পূর্বের বয়স্কদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি উৎপাদনশীল হলেই কেবল এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। সে জন্য আজকের শিশুদের জন্য সময়-সংবেদনশীল বিনিয়োগ জরুরি। এ ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশ না, বিশ্বের অন্য অনেক দেশেও ঘটছে।
১৯৯৫ সালে স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশ জিডিপির ১.২ (এক দশমিক দুই) শতাংশ ব্যয় করত। ২০১২ সালে তা কমে ০.৭৯ (দশমিক সাত নয়) শতাংশ হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবাখাতে বিশ্বের গড় ব্যয় পাঁচ শতাংশের বেশি। শিক্ষাখাতে বরাদ্দের হার কিছুটা বেড়েছে। তবে তা এখনো শিক্ষাখাতে বৈশ্বিক গড় ব্যয়ের অর্ধেকের মতো। সে জন্য বাংলাদেশে জনমিতিক সুবিধা থাকাকালেই শিশুদের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, স্যানিটেশন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। শিশুদের জন্য বিনিয়োগ কোনো চ্যারিটি নয়। এটা দেশের টেকসই উন্নয়ন জন্য আবশ্যক। এখন শিশু জন্মের হারও কমছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিটি শিশুর জন্য আলাদা বরাদ্দেরও সুযোগ আছে।
সৈয়দ গোলাম ফারুক
বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু শিগগিরই এ সংখ্যার পরিবর্তন হবে। নির্ভরশীল মানুষের অনুপাত এখন কমছে। কিন্তু খুব দ্রুতই তা বাড়বে। সরকার এসব বিষয়ে সচেতন রয়েছে। জনমিতিক সুবিধা বারবার আসে না। তাই এ সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
সে অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরও জনমিতিক এ সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ২১ শতকের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা পাঠ্যসূচি, শিক্ষা ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। সে জন্য আমরা একদিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করছি। অন্যদিকে নৈতিকতা, সৃজনশীলতা, সামাজিক প্রতিশ্রুতি, সৌহার্দ্য, আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো সফট স্কিলস বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছি। এ সফট স্কিলসগুলো অন্যান্য দক্ষতার তুলনায় বেশি স্থায়ী। ২১ শতকে এ সফট স্কিলসগুলো খুবই দরকার। এ বিবেচনায় এগুলো আমরা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করছি। আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া পরিবর্তন করছি। আমরা মূল্যায়নের ধরনও পরিবর্তন করছি।
করোনার আগেই আমরা এটা শুরু করেছি। করোনা মহামারি না হলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতোমধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যেত। করোনার কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি। সরাসরি ক্লাস এখন হচ্ছে না। এসব পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমরা নতুন উপায় বের করছি। টেলিভিশন ও অনলাইন ক্লাস এর মধ্যে অন্যতম। করোনার মধ্যে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সফট স্কিলস উন্নয়নে এ ধরণের ব্যবস্থা খুবই কার্যকর।
অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন খুবই সফল মূল্যায়ন ব্যবস্থা পদ্ধতি। এটা শুধু ভালো মূল্যায়ন ব্যবস্থাই নয়, ভালো শিক্ষা ও শিক্ষণ পদ্ধতিও। করোনার সঙ্কটের সময়ে এটাকে সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করে আমরা আরও কিছু ব্যবস্থা চালু করেছি। টিভি ও অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এখন অনেক বেশি দক্ষ। অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট ও ডিভাইসের প্রবেশগম্যতাও বাড়ছে।
শিশুদের দক্ষতা বাড়াতে সরকার কাজ করছে। শিশুদের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার কখনো কার্পণ্য করেনি। শিক্ষাখাতে সময় ও সুযোগ মতো সরকার অবশ্যই বিনিয়োগ আরো বাড়াবে। তবে এখন যতটুকু বিনিয়োগ আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
টি এম আসাদুজ্জামান
দক্ষতা উন্নয়ন এখন শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়। নতুন অনুমোদিত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়ে সরকার তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও অটোমেশনের প্রভাবে আগামীর কর্মক্ষেত্র নির্ধারিত হবে অটোমেশন ও উদ্ভাবনী দক্ষতা দিয়ে। এর ফলে সনাতনী কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ কমে যাবে। প্রযুক্তিনির্ভর নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির সুযোগ বাড়বে। আগামীতে যেসব চাকরির সুযোগ আসবে, সেখানে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের কীভাবে নিয়োগ দিতে পারি, সেদিকে জোর দিতে হবে। আগামী দিনে বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার চাহিদা বাড়বে। একই সঙ্গে সোশ্যাল ইমোশনাল স্কিলস ও অভিযোজন দক্ষতার চাহিদাও বাড়বে। সে জন্য এখনই সফট স্কিলস প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুততা। এর প্রভাব পূর্বের শিল্পবিপ্লবের চেয়ে গতিশীল হবে। সে জন্য বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার রুপান্তরে সক্রিয় প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকার ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। পাঠ্যসূচির আধুনিকায়ন করা হয়েছে, যা হয়তো আগামী বছর থেকে পড়ানো হবে। ভবিষ্যতের চাকরির জন্য শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে এটা ভালো সুযোগ। আগামীতে কম শিশু জন্ম নিবে। ফলে তাদের পেছনে সরকারের বেশি ব্যয় করার সুযোগ তৈরি হবে। এ সুযোগটাও নেওয়া প্রয়োজন।
এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল দক্ষতার উপর জোর দেওয়া দরকার। শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। কোভিড কালে এসব দক্ষতা উন্নয়নের চাহিদা দ্রুত দৃশ্যমান হয়েছে। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করাও অত্যন্ত জরুরি।
ডিজিটাল পরিবর্তনের উপকরণগুলো একইসঙ্গে সাশ্রয়ী ও বাস্তবসম্মত করতে হবে। জনমিতিক সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কোনো অনগ্রসর ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষকে বাদ দেওয়া যাবে না। সবাইকে নিয়েই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
আবদুর রাজ্জাক
২০২৯ সালের মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তির সংখ্যা ৭ শতাংশ হবে। এটাকে আমরা একটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে পারি। বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চায়। সে জায়গায় পৌঁছানোর আগেই আমরা বয়োবৃদ্ধ সমাজে রূপান্তরিত হয়ে যাব। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হবে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের অনেক অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে। কোভিডের কারণে ভবিষ্যতের আয় বৃদ্ধির হার ধীরগতির হতে পারে। ফলে ২০৪৭ সালের আগে হয়তো আমরা উচ্চ আয়ের দেশ হতে পারব না। দেশে শ্রমবাজারে কর্মক্ষম মানুষের অংশগ্রহণের হার অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে কম হওয়ায় জনমিতিক অবস্থার সর্বোচ্চ সুবিধা আমরা নিতে পারিনি। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার প্রায় ৮৫ শতাংশ। অন্যদিকে নারীদের অংশগ্রহণের মাত্র ৩৬ শতাংশ। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিদের মাত্র ৬০ শতাংশ শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করছে।
ভিয়েতনাম আমাদের মতোই উন্নয়নশীল দেশ। ভিয়েতনাম শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার আমাদের দেশের মতোই। কিন্তু নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার প্রায় ৭৩ শতাংশ। সবমিলিয়ে ভিয়েতনামের শ্রমবাজারে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের হার প্রায় ৮০ শতাংশ, যা বাংলাদেশের সঙ্গে একটা বড় পার্থক্য তৈরি করে। অধিক সংখ্যক নারী যদি শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করেন, তাহলে আমরা জনমিতিক সুবিধার সর্বোচ্চ ফল পেতে পারি। আমাদের অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত রয়েছে। এসব খাতের উৎপাদনশীলতা অনেক কম। এ খাতগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারলেও আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ বর্তমানে কৃষিখাতে কাজ করেন। কিন্তু জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান মাত্র ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ, এ খাতে অধিক উৎপাদনে সক্ষম মানুষ যুক্ত নেই। এ জন্য অন্য দেশগুলো কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের দেখা দরকার। বিশেষত উন্নত দেশগুলো কী করছে, তা দেখা প্রয়োজন।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ইংল্যান্ড ৩০ শতাংশ ব্যয় করে। তারা ১২ শতাংশ শিক্ষা ও ২২ শতাংশ ব্যয় করে স্বাস্থ্যখাতে। এ ব্যয়গুলো থেকে শিশু, কর্মক্ষম ব্যক্তিসহ প্রবীণ নাগরিকেরা সুবিধা পায়। আমরা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে খুবই সামান্য ব্যয় করি। এবারের বাজেটে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আমরা ৩.১১ শতাংশ ব্যয় করতে যাচ্ছি। এ ব্যয়ের একটা বড় অংশ খরচ হয় সরকারি অবসরপ্রাপ্ত চাকুরেদের পেনশন দিতে। এ ব্যয় থেকে আমরা শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ করতে পারছি না।
আমাদের কর্মক্ষম তরুণদের ২৯ শতাংশ শিক্ষা বা চাকরি কোনোটাতেই যুক্ত নেই। এ বিশাল সংখ্যক মানুষকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের একটা শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দরকার। এ খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। নারী ও শিশুর জন্য বিনিয়োগ করলে তা কখনো বিফলে যায় না।
ফারাহ কবির
প্রবীণ বয়সে আজকের শিশুরা আমাদের দেখাশোনা করবে, সে জন্য শিশুদের পেছনে বিনিয়োগ করতে হবে— এ ধারনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ চিন্তা থেকে পরিবারে ছেলে শিশুর প্রতি আগ্রহ বাড়ে। শিশুর জন্য বিনিয়োগ করতে হবে, কারণ এটা তাদের অধিকার। সংবিধানে বলা হয়েছে শিশুসহ সব জনগোষ্ঠীকে আমরা রক্ষা করব। খাওয়া, পরা, চিকিৎসা তাদের মৌলিক অধিকার। তাই সবসময় এটা মাথায় রেখে আমাদের এগোতে হবে।
শিশুদের জন্য বিনিয়োগ কোনো চ্যারিটি নয়। যেকোনো বিনিয়োগে অবশ্যই শিশু, নারী, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন ও সফট স্কিলস উন্নয়নের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। নিয়োগকর্তা হিসেবে কাউকে নিয়োগ দিতে গেলে এসব সফট স্কিলসের ঘাটতি দেখা যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে। বৃত্তিমূলক, দক্ষতা ভিত্তিক, উদ্ভাবনী ও উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করা উচিত।
এখন অনেক তরুণ উদ্যোক্তা আসছে। এসব উদ্যোক্তার পেছনে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। প্রবীণ নাগরিকদের দেখাশোনা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য ও সেবাখাতে বিনিয়োগ এবং এ খাত আরও উন্নত করতে হবে। সেবাখাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব না। সে জন্য বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। বাজেটের ৮০ শতাংশের বেশি বেসরকারি খাত থেকে আসে। তাই সেবাখাতে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আনতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও প্রণোদনা প্রয়োজন।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ কিশোরী ও নারীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবে। এর ফলে বাল্যবিয়ের হার কিছুটা কমবে। নারীদের শ্রমবাজারে যুক্ত করতে এমন প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে, যা অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের স্বীকৃতি দেবে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বরাদ্দ আছে, তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে? গত বছর স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের মাত্র ৩০ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে। যার বেশির ভাগ ব্যয় হয়েছে বেতন হিসেবে। এখানে প্রশ্ন করা প্রয়োজন। সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। তাই আমাদের এ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পরিবর্তন করা জরুরি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আমরা যেন আমাদের মেয়েশিশুদের কথা ভুলে না যাই। দেশে এখনো ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এ জনগোষ্ঠীর কথাও ভাবতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করা খুবই জরুরি।
নাজমা মোবারেক
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ কম থাকার বিষয়টি এসেছে। কিন্তু আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ একেবারে কম নয়। আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশ। সরকারের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা খাতে আমাদের বেশ বড় বরাদ্দ রয়েছে। এ বছরেও ১ লাখ ৭ হাজার ৬ শত ২৪ কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ হয়েছে, যা জিডিপির তিন দশমিক এক দুই শতাংশ।
সরকারের দায়িত্ব হলো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা। বর্তমানে দেশজ বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। সরকারের পক্ষে শতভাগ বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। তাই সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি খাতের এগিয়ে আসা এবং শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।
হোসেন জিল্লুর রহমান
আলোচনায় এসেছে ২৯ শতাংশ তরুণ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, চাকরিতে যুক্ত নেই। এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার। দেশের শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ৩৬ শতাংশ। এ বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
অনেক চাকরিতে বিদেশিরা নিয়োগ পাচ্ছে। কারণ আমাদের শিক্ষা বর্তমান সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না। নিয়োগকর্তারা বলছেন দক্ষ জনবল পাচ্ছেন না। তরুণেরা বলছেন তারা চাকরি পাচ্ছেন না। লোক পাচ্ছি না, কাজ পাচ্ছি না— আমরা এ প্যারাডক্সে আটকে আছি। এখান থেকে বের হতে হবে। এ জন্য একইসঙ্গে কী করতে হবে এবং কীভাবে করতে হবে, তা আলোচনা করা দরকার। এ দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কী করতে হবে— এর মধ্যে আছে বিশ্বজনীন শিশু স্বাস্থ্যসেবা, শিশু সেবার মানোন্নয়ন, নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু কীভাবে করতে হবে— সেটাই বাংলাদেশের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।
আমরা কোভিড মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে আছি। দেড় বছরের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। পুরো প্রজন্ম অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলছে। তারা শিক্ষা থেকে দূরে সরে আছে। সে জন্য কোভিডকালে মানবসম্পদ উন্নয়ন কৌশল নিয়ে কথা বলতে হবে। এ ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকের নেতৃত্ব ও মনোযোগের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এটা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয় না, কীভাবে শিক্ষা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়— সেটাও। আরেকটি বিষয় হলো মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান কমেছে। এ বিষয়েও মনোযোগ দিতে হবে। সফট স্কিলস বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এ সফট স্কিলস প্রশিক্ষণ কে দিবে? দিনশেষে ২৯ শতাংশ তরুণ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা চাকরিতে যুক্ত নেই। তার মানে হলো কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গেছে। কারিগরি শিক্ষা শুধু গরিবদের জন্য বলে দেশে একটা প্রথাগত ধারণা রয়েছে। এ প্রথাগত ধারণা থেকে বের হতে হবে।
অসা বৃত্তা টরকেলসন
বাংলাদেশে জন্মহার কমছে। তা স্বত্ত্বেও দেশের মোট জনসংখ্যা বাড়ছে। এটা মূলত দেশের জনসংখ্যার বয়স কাঠামোর জন্য হচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ার ফলে জনঘনত্বও বাড়ছে। জন্মহার কমার ক্ষেত্রে বিয়ের গড় বয়স ও জন্মনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি অন্যতম ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের সংখ্যা এখনো অনেক বেশি। এ সংখ্যা কমানোর উপর জোর দেওয়া দরকার। জনমিতিক সুবিধা কাজে লাগাতে দেশের কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সে জন্য মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রবেশাধিকার ও চাকরির সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, শিশু ও মাতৃকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
মেয়ে ও নারীদের জন্য নিরাপদ সমাজ তৈরি করতে জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। যেন তারা সবক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারে। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে বাদ রেখে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। বাংলাদেশের সেবাখাতের উন্নয়ন করা প্রয়োজন। যেন নারীরা তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সব অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ স্বীকৃতি পায়। শিশুদের জন্য বিনিয়োগের পাশাপাশি মায়ের জন্য বিনিয়োগ করা জরুরি। মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে। মাতৃমৃত্যুর এ হার আরও কমিয়ে আনতে কার্যকর প্রচেষ্টা দরকার। নারীদের সিদ্ধান্ত নিতে পারার সুযোগও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের জনমিতিক পরিবর্তনকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা ইউএনএফপিএ’র অন্যতম লক্ষ্য। জনমিতিক সুবিধা সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। কোভিড মহামারি এ ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করেছে। এটা পুরো বিশ্বের জন্যই চ্যালেঞ্জের সময়। একসঙ্গে সামগ্রিক ও সমন্বিতভাবে কাজ করলে এসব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
টুমো পোটিআইনেন
বর্তমান শ্রমবাজারের চাহিদা মেটাতে অনেককিছু করণীয় আছে। কাজের ক্ষেত্রে নারীদের জন্যে সমান সুযোগ তৈরি করতেও অনেককিছু করতে হবে। নবীনদের জন্যে কাজের আওতা বাড়াতে বিনিয়োগেরও এটিই উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশ এখন জনমিতিক সুবিধা ভোগ করছে। তবে এ সুবিধা বেশিদিন থাকবে না। আধুনিক দক্ষতা উন্নয়নে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিনিয়োগের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কীভাবে আমরা শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারি, সেটি ভাবতে হবে। এজন্যে নারীদের মধ্যে বহুমুখী দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন।
ভবিষ্যতের শ্রমবাজারের প্রয়োজন মেটাতে হলে কর্মীদের মধ্যে স্বীকৃত ও আধুনিক দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়াতে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ভবিষ্যতে আধুনিক শ্রমবাজারে জটিল যন্ত্রপাতি চালাতে জানা দক্ষ লোকবল প্রয়োজন হবে। এসব দক্ষতা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখা যাবে না; এ ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কারিগরি শিক্ষা নিয়ে সমাজে ভুল ধারণা রয়েছে যে এই শিক্ষা দরিদ্রদের জন্যে; এই ভ্রান্তি দূর করতে উদ্যোগ এবং বিনিয়োগ দরকার। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের কার্যকর ভূমিকাও দক্ষতা বাড়ানোর ব্যাপারে খুব জরুরি। করোনা পরিস্থিতিতে বোঝা যাচ্ছে, আধুনিক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি অনেক জরুরি। আর এটি নিশ্চিত করতে হলে কার্যকর শ্রম নীতিমালাও দরকার। পাশাপাশি, অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা যায়, সেটিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। এখনো বেশিরভাগ চাকরি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতায় রয়ে গেছে। মানসম্পন্ন চাকরির ক্ষেত্র বাড়াতে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।
টোমো হোযুমি
জাপান ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর পরিপেক্ষিতে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু খুব শিগগিরই কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ও অনুপাত কমতে শুরু করবে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। গত ১০ থেকে ২০ বছর ধরে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি জাপানের নীতিগত বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপানের নাগরিক হিসেবে আমি বলব, শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন দিক থেকে জেন্ডার সংক্রান্ত অনেক নির্ধারকে জাপান পিছিয়ে আছে। গত ১০ থেকে ২০ বছর ধরে এটা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হয়েছে। এমন নয় যে হুট করে আমরা জেন্ডার সচেতন হয়ে গেছি। জেন্ডার সচেতনতা অবশ্যই বাড়ছে।
সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অর্ধেক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী শ্রমবাজারের বাইরে থাকলে আমাদের পক্ষে টেকসই সমাজ তৈরি করা সম্ভব নয়। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী তাদের ইচ্ছামতো কাজে যুক্ত হয়ে পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগাতে না পারা মানে হলো— আমরা তাদের কর্মদক্ষতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। সে জন্য শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। জনমিতিক রূপান্তরের একটি বৈশিষ্ট্য হলো এ ঘটনাটি খুব নীরবে ঘটে। ফলে এ ঘটনা সমাজের যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না।
আমি আশা করছি আগামী দিনে এ সমস্যাগুলো সব স্তরের মানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে। যেন তা এসব সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন ও সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে মানুষের মধ্যে সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলে। সে জন্য ইউনিসেফ এ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে চায়। সবাইকে ধন্যবাদ।
ফিরোজ চৌধুরী
আজকের আলোচনায় শিশুদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের কথা উঠে এসেছে। বিশেষ করে কর্মসংস্থান তৈরিতে জোর দেওয়ার বিষয়টি এসেছে। মেয়ে শিশুদের জন্য বাড়তি বিনিয়োগ বা বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। এ সময়ে অনেক মেয়েশিশু বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিকল্প ব্যবস্থায় এগিয়ে নেওয়া ও ভবিষ্যতে কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে করণীয়সহ সবগুলো বিষয় আলোচনায় এসেছে। আলোচনায় অংশগ্রহণ করায় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
বাংলাদেশে জনমিতিক সুবিধার পরিসর থাকাকালেই শিশুদের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
তরুণদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে বিনিয়োগ করা দরকার।
শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
শিশুদের শিক্ষা ও প্রারম্ভিক বিকাশে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
জনমিতিক সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় প্রয়োজন।
জনমিতিক সুযোগ পরিসর কাজে লাগাতে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি।
২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুগোপযোগী পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবার জন্য শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ও স্যানিটেশনে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজনীয় উপকরণ সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হওয়া জরুরি।