কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে শিশু-তরুণদের দক্ষতার সঙ্গে বেড়ে উঠতে কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগ বাড়াতে হবে।
করোনাকালে নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে অনেক শিশু ও তরুণ উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে তাদের এই মানসিক সমস্যা যতটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত, ততটা পায়নি পরিবারের কাছে। দীর্ঘদিন শারীরিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে থাকা শিশু-তরুণদের মানসিক অবস্থা শিক্ষকদের কাছেও তত গুরুত্ব পায়নি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সংকট তুলে ধরে এসব কথা বলেন। তাঁদের মতে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিশু-তরুণদের দক্ষতার সঙ্গে বেড়ে উঠতে কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগ বাড়াতে হবে। মানসিক সমস্যাকে অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করে সচেতনতা বাড়াতে এলাকায় এলাকায় ‘প্যারা কাউন্সেলর’ সৃষ্টি করতে হবে।
‘কোভিড-উত্তর বাংলাদেশে শিশু ও তরুণদের কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন’ শিরোনামের গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে যৌথভাবে এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশন ও ডিজ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশন।
শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা প্রকল্পের আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল ও সহযোগী উন্নয়ন সংস্থার পরিচালিত জরিপের তথ্য তুলে ধরে গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ৭৪ শতাংশ শিশু ও তরুণ কোনো চিকিৎসা নেননি। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের বেশির ভাগই জানেন না তাঁদের এলাকায় মানসিক সমস্যার চিকিৎসার জন্য কোথায় সেবা পাওয়া যাবে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, কোভিড তাদের শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করেছে। ২৫ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের জীবনের আনন্দ-বিনোদনের ওপর প্রভাব ফেলেছে কোভিড। গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে পরিচালিত জরিপে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার ৪টি ওয়ার্ড, যশোর সিটি করপোরেশনের ৪টি ওয়ার্ড ও একটি ইউনিয়ন পরিষদ এবং বাগেরহাট জেলার ৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ৬০০ জন অংশ নেয়। পাশাপাশি কথা বলা হয় সমানসংখ্যক অভিভাবকদের সঙ্গে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী মূল প্রবন্ধ ও জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, দেশে ৩০ হাজার মানসিক রোগীর জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন। স্বাস্থ্য বাজেটের ১ শতাংশের কম বরাদ্দ রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য খাতের জন্য। বেশিসংখ্যক মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা গেলে চাহিদা ও সেবার মধ্যে ভারসাম্য আসবে। সমাজে কোভিডে সৃষ্ট অসমতা মানুষের মধ্যে দুর্বলতা তৈরি করেছে। এটা মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আলোচনায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) মো. সাইদুর রহমান বলেন, পরিবার থেকে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের মতো করে কৌশল উন্নয়ন করতে হবে। সরকার মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় জনবল বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানান তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি) অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, মানসিক সমস্যাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত না করা পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হবে না। মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে দুটো উপজেলা এবং জেলা হাসপাতালে মডেল প্রকল্প নেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার জন্য আইন ও কৌশলগত যেসব উপকরণ ও প্রস্তুতি প্রয়োজন, তার সবই দেশে রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যকে দেখতে হবে বড় প্রেক্ষাপটে।
মানসিক স্বাস্থ্যে অসমতা ও বৈষম্যের প্রভাব কোভিড সময়ে আরও স্পষ্ট হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার। তিনি পরিবার ও সমাজের উচিত বৈষম্যহীনভাবে এই শিশুদের যথাযথভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা এবং তাদের মানসিক সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের জাতীয় পরামর্শক (মানসিক স্বাস্থ্য) হাসিনা মমতাজ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং লোকজনকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হেলথ নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন প্রোগ্রামের পরিচালক মোর্শেদা চৌধুরী বলেন, মানসিক রোগী অনুসারে দক্ষ চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ঘাটতি পূরণে মধ্যবর্তী সময়ের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এলাকাভিত্তিক প্যারা-কাউন্সেলর নিয়োগ করা যেতে পারে। মানুষ মানসিক চিকিৎসার জন্য কোথায়, কার কাছে যাবে, তা জানাবেন এই প্যারা-কাউন্সেলররা।
ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পেশাদারদের সহায়তা নিতে সমাজের লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে বিভিন্ন মডেল প্রকল্পের মাধ্যমে।
আলোচনায় আরও অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জোবেদা খাতুন, ডিজ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাসরিন জাহান, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, যশোর থেকে নাসরিন, ঢাকা থেকে মুক্তি প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সদস্য রফিক মৃধা এবং ডিজ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের সদস্য শিরিন আকতার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।