বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত

সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউনিসেফ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১০ নভেম্বর ২০২০। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

মোহাম্মদ সহিদুল্লা

চেয়ারম্যান, নবজাতক বিভাগ, বিএসএমএমইউ

সভাপতি, জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি, কোভিড-১৯

মো. শামসুল হক

লাইন ডিরেক্টর, এমএনসিএএইচ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

অ্যালিসা ওম’ইনিবোস

গ্লোবাল প্রজেক্ট লিড, পিসিসি, সেভ দ্য চিলড্রেন

অ্যান ডিটজেন

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, শিশু ও কমিউনিটি হেলথ ইউনিট, ইউনিসেফ

শামস এল আরেফিন

সিনিয়র ডিরেক্টর, আইসিডিডিআরবি

সেলিম সদরুদ্দিন

শিশু স্বাস্থ্য পরিচালক, এমসিজিএল, সেভ দ্য চিলড্রেন

মায়া ভেনডেনেন্ট

স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

রিসাল বন্দনা

ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

শিশুদের জন্য নিউমোনিয়া একটা অভিশাপ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ এবং উন্নয়নশীল অনেক দেশেই নিউমোনিয়ার কারণে শিশুর মৃত্যুহার অনেক বেশি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) এ ধরনের শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। নিউমোনিয়ায় শিশুর মৃত্যুহার কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি, সেসব বিষয় আজকের আলোচনায় আসবে।

এ ক্ষেত্রে শিশু ও বয়স্কদের ঝুঁকি বেশি। শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল এবং অন্যান্য অসুস্থতার কারণেও তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়। শিশুমৃত্যুর একটি বড় কারণ হচ্ছে নিউমোনিয়া। তবে বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে টিকার ব্যবস্থা করেছে। এই টিকা আমরা যদি সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে নিয়ে যেতে পারি এবং সবাইকে দিতে পারি, তাহলেই নিউমোনিয়ায় মৃত্যুহার অনেক কমিয়ে আনা যাবে।

যদিও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির মধ্যে এটা অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। আমরা অনেক ধরনের অসুখ-বিসুখের মধ্যেই থাকি। কিন্তু সব সময় চেষ্টা করি তা নিয়ন্ত্রণে আনতে।

বিশেষভাবে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির বড় সাফল্য আমরা দেখেছি এবং বিশ্বব্যাপী এটা স্বীকৃত হয়েছে। এখানে যদি আরও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারি, তাহলে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে পারব। সামনে আবার শীত আসছে। ঋতু পরিবর্তনের সময় সর্দি-কাশি-জ্বর হয়ে থাকে। এগুলো নিউমোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। এই জায়গায় যেন আমরা সতর্ক থাকি।

শিশুদের জন্য আরও বেশি পুষ্টি এবং তাদের প্রতি বেশি যত্ন নেব, যেন সহজে হঠাৎ করে ঠান্ডা না লাগে। এর পাশাপাশি টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করলে আমরা এটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারব। আজকের আলোচনা সচেতনতা সৃষ্টি করবে।

মোহাম্মদ সহিদুল্লা

মোহাম্মদ সহিদুল্লা

নিউমোনিয়া এমন একটা শব্দ যে চিকিৎসক ও সাধারণ জনগণ বুঝতে পারে। এটা হলো ফুসফুসের সংক্রমণ। এটা কখনো খুব মারাত্মক হয়। এটা বড়, মধ্যবয়স্ক এমনকি শিশু ও নবজাতক—সবারই হয়ে থাকে। নিউমোনিয়া শিশুসহ অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটায়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে যতটা জোর দেওয়া প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রে সেটা হয় না।

এই সময়ে আবার এল কোভিড-১৯ ভাইরাস। কোভিড-১৯–এ যেকোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। শিশুদেরও এ ভাইরাস আক্রমণ করে থাকে। কোভিড-১৯–এ নিউমোনিয়া হতে পারে।

১২ নভেম্বর বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস। এবারেরটা দশম। কোভিড–১৯–এর প্রেক্ষাপটে এবারের বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । বাংলাদেশে সোয়া চার লাখের মতো লোক এ পর্যন্ত কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষ সুস্থ হয়েছেন। ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ মানুষ মারা গেছেন। বয়সভিত্তিক বিভাজন করলে ১০ বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হচ্ছে দশমিক ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২০০ জনে ১ জন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক সায়েদা আনোয়ারের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ৪৮৮ রোগী। তঁাদের মধ্যে ১ হাজার ৮ জনের কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। ভর্তি হওয়া শিশুদের প্রায় ৩৯ জন মারা যায়। এটা ঠিক, কোভিড-১৯–এ শিশুরা কম আক্রান্ত এবং মৃতু্যহার কম হলেও এটা তাদের ওপর সুদূরপ্রসারী মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। তবে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পরও দীর্ঘমেয়াদি কিছু প্রভাব থেকে যেতে পারে।

সে জন্য এটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার। যেন এ সময়ে শিশুরা ভাইরাসে কম আক্রান্ত হয়। সে কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। যেটা যথেষ্ট ভালো সিদ্ধান্ত। কোভিডের জন্য শিশুরা ঘরবন্দী থাকায় তাদের মানসিক চাপ ও সমস্যা তৈরি হয়। সে জন্য শিশুদের কোয়ালিটি সময় দিতে হবে। শিশুরা যেন অঙ্ক, আঁকাআঁকি, পাজল, সৃজনশীল কাজ, গানবাজনা ইত্যাদি চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে শিশুদের মানসিক অবস্থার অবনতি হবে।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিশুদের মধ্যে যারা অপুষ্টিতে ভুগছে, তাদের যদি কোভিড-১৯ হয়, তাহলে তাদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি। আমরা এর মধ্যে দেখেছি যে জনস হপকিনস পৃথিবীর ১১৮টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের ওপর একটা গবেষণা করেছে। গবেষণায় এসেছে, প্রায় অনেক জায়গায় প্রয়োজনীয় যে সেবা, সেটা কমে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ৫ বছরের নিচের শিশুদের প্রায় ১২ লাখ শিশুর মৃত্যু হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), ইউনিসেফ, সাবিন ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউটের সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায় যে কমপক্ষে ৬৮টি দেশে টিকাদান সেবা ব্যাহত হয়েছে। পৃথিবীর ৬৮ দেশের এক বছরের কম বয়সী প্রায় ৮ কোটি শিশু ভ্যাকসিনে প্রতিরোধযোগ্য যে রোগ, তার সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এ দেশগুলোর মধে্য বাংলাদেশও ছিল। বিশেষ করে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে আমাদের টিকাদান কর্মসূচি ও শিশু-নবজাতক মাতৃসেবা ব্যাহত হয়েছিল। কিন্তু এটা অনুধাবন করার পর জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আবার অনেকটাই আগের মতো কার্যক্ষেত্রে ফিরে আসি।

িকন্তু আমি এখন কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করি। আমরা টিকাদান কর্মসূচিতে অনেকটা আগের মতোই ফিরে আসার চেষ্টা করছি। আমাদের গর্ভ ও প্রসবকালীন এবং প্রসব–পরবর্তী সেবা মোটামুটি ভালো চলছে। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এখন যেটুকু চলছে, সেটা যেন আবার বন্ধ না হয়।

সেলিম সদরুদ্দিন

সেলিম সদরুদ্দিন

আমার আলোচনায় প্রান্তিক পর্যায়ে নিউমোনিয়া নির্ণয় ও চিকিৎসার পর্যাপ্ততার ওপর জোর থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউনিসেফের গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর নিউমোনিয়া অ্যান্ড ডায়রিয়া অনুযায়ী নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণের অন্যতম কৌশল হলো সর্বস্তরের রোগীর ব্যবস্থাপনা করা। বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৫০ শতাংশ শিশু যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী থেকে সেবা নেয়। আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুর যথাযথ যত্ন, উপযুক্ত চিকিৎসা ও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ৯০ শতাংশ বাড়াতে পারি, তবে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী হাজারো শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব।

পরিষেবার জন্য চাহিদা বাড়ানোর পাশাপাশি আইএমসিআই এবং আইসিসিএমের নির্দেশিকা অনুসারে নিউমোনিয়া নির্ণয় ও চিকিৎসা করতে পারে, এমন সেবাদাতার পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) চিকিৎসার নির্দেশিকা দিয়ে থাকে এবং দেশগুলো সে নির্দেশিকা অনুসরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মারাত্মক নিউমোনিয়াসহ নিউমোনিয়া শনাক্ত ও চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। ২০১৪ সালে নিউমোনিয়ার কেস ম্যানেজমেন্টের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হালনাগাদ এই নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তখন মারাত্মক নিউমোনিয়া চিকিৎসার আগের নির্দেশিকা অনুসরণ করা হতো এবং নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় অ্যামোক্সিসিলিন সুপারিশ করা ছিল। এখন আমরা কোন অবস্থায় আছি?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌন, প্রজনন, প্রসূতি, নবজাতক ও কিশোর স্বাস্থ্যনীতির ওপর ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ৪৫ শতাংশ দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে চলার জন্য তাদের নিউমোনিয়া নীতিমালা পুনর্মূল্যায়ন করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্যও একই রকম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংশোধিত নির্দেশিকা প্রকাশের পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালে বাংলাদেশ তার নিউমোনিয়া নীতিমালা সংশোধন করে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সীমাবদ্ধতা থাকায় শিশুরা এসব পদক্ষেপের সুবিধা পাচ্ছে না।

চিন্তা করুন, কত শত শিশু সংশোধিত চিকিৎসা নির্দেশিকা থেকে সুবিধা পেত, যদি সেসব দ্রুত সংশোধন ও বাস্তবায়ন করা হতো। সমস্যা শুধু নির্দেশিকা হালনাগাদ ও আইএমসিআইয়ে স্বাস্থ্য সেবাদাতাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে দেরিতেই শেষ নয়, সমস্যা সেবাদাতাদের কেস ম্যানেজমেন্টের গুণগত মানেও। যদি সেবাদাতারা নির্দেশিকা না মেনে চিকিৎসা করেন, তাহলে শিশুরা উপকৃত না–ও হতে পারে।

অনুপযুক্ত চিকিৎসার ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি হতে পারে। জেলা পর্যায়ে ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব চাইল্ডহুড ইলনেসের (আইএমসিআই) অভাব রয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী এসব সংশোধন করতে হবে। সমস্যাগুলো সব জায়গায় প্রায় একই রকম। তাই সমাধানও প্রায় অনুরূপ। তাহলে সমাধান কী? জেলা ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার সঙ্গে আইএমসিআই প্রশিক্ষণ সেশন এবং ওষুধ সরবরাহ তদারকি ও পর্যবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত বরাদ্দ দিতে হবে। সেবাগুলোর অগ্রাধিকার, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও তদারকির জন্য জেলা পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র (ম্যাটারন্যাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ ওয়েলফেয়ার সেন্টার), কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে সেবাদাতাদের নতুন রোগী শনাক্ত করার সক্ষমতা বাড়াতে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কার্যকর পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। ডায়াগনস্টিক এবং ওষুধের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে এই পরিকল্পনায় প্রশিক্ষণ–পরবর্তী মান নিশ্চয়তা, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা থাকতে হবে। এ ছাড়া বেসরকারি সেবাদাতাদের জন্য একই রকম কৌশল নিতে হবে। কেননা তারা বাংলাদেশ শিশুস্বাস্থে্যর অন্যতম প্রধান সেবাদাতা।

মায়া ভেনডেনেন্ট

করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক সংকট। তবে একই সঙ্গে এই সংকটকালে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা উন্নত করার একটি সুযোগও তৈরি হয়েছে। ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (ডিএইচএস) তথ্যানুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সের ১৮ শতাংশ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

এদের ১ দশমিক ৫ জন শিশু মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। নিউমোনিয়ার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে অক্সিজেনের সরবরাহ নিয়ে ভাবা জরুরি।

চার্চিল বলেছিলেন, ‘কোনো সংকট অব্যবহৃত থেকে যেতে দিয়ো না।’ আলোচনায় প্রতিরোধের গুরুত্ব ও নিরাময় যত্নের বিষয় এসেছে। আমি অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জোর দেব। নিউমোনিয়া নিরাময়ে যোগ্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং ওষুধের সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি। নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা তদারক করতে হয়, যা পালস অক্সিমিটার দিয়ে করা হয়। এটি খুবই সাধারণ সরঞ্জাম। ফলে অল্প দক্ষ কর্মীরাও এটি ব্যবহার করতে পারেন এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা জেনে বিপদ আঁচ করতে পারেন।

বিপদের আশঙ্কা থাকলে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবার জন্য সুপারিশ করা যাবে। বর্তমান সংকটে এক হাজারের বেশি পালস অক্সিমিটার কেনায় ইউনিসেফ সরকারকে সহায়তা করেছে। যেটা এ ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করবে। হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তত সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে আরও বড় পরিসরে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

অক্সিজেনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের যত্ন ও ব্যবহারের সময় জীবাণুমুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি করতে প্রত্যেক নিউমোনিয়া রোগী বিশেষত মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীর দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। এটি জীবনরক্ষাকারী হলেও বিপজ্জনক হতে পারে। সে জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

রিসাল বন্দনা

মহামারি একটি বৈশ্বিক সংকট। এ সংকট সত্ত্বেও শিশুদের সবচেয়ে বেশি সংক্রামক নিউমোনিয়াকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ঘণ্টায় পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় একটির বেশি শিশু নিউমোনিয়া মারা যায়, যা মারাত্মক প্রভাব ফেলে। নিউমোনিয়ায় শিশুমৃতু্য কমার হার অত্যন্ত কম।

তবে সরকার এ বিষয়ে অনেক কাজ করেছে। একই সঙ্গে নিউমোনিয়ায় শিশু আক্রান্তের হার ও মৃত্যুহার কমিয়ে আনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে চাই। সরকার বলছে, ইতিমধ্যে কৌশলগত নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এখানে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিরোধযোগ্য শিশুমৃত্যু কমাতে ১০ ধরনের প্রক্ষেপ এবং ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার জন্য সমন্বিত বৈশ্বিক পরিকল্পনা (ইন্টিগ্রেটেড গ্লোবাল অ্যাকশন ফর নিউমোনিয়া অ্যান্ড ডায়রিয়া) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এসব প্রক্ষেপ ইতিমধ্যে বিদ্যমান স্বাস্থ্য কর্মসূচির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু ধীরে ধীরে কমে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে আরও কাজ করতে হবে। আইএমসিআই, ইপিআর ও পুষ্টি বিষয়ে কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেন এসব মোকাবিলায় বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। নিউমোনিয়ায় শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে এসব কর্মসূচি চলছে। আমরা যেখানে সম্ভব সরকারের নীতিমালা শক্তিশালী করতে কাজ করব। আমাদের অর্জিত বৈশ্বিক দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী কাজে লাগাব। আমরা নিশ্চিত করতে চাই, পঞ্চম জন্মদিনের আগে প্রতিরোধযোগ্য রোগে কোনো শিশুর মৃত্যু যেন না হয়। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেভ দ্য চিলড্রেন এই চ্যালেঞ্জগুলো একসঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য সরকারি সংস্থা, মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএসএআইডি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো গবেষকদের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছে।

শামসুল হক

শামসুল হক

আমাদের বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা দুই রকমের। একটা হলো নিরাময়মূলক, অন্যটি প্রতিরোধমূলক। আমাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মাধ্যমে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। এ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অসুস্থ শিশুদের ভর্তি, চিকিৎসা এবং বহির্বিভাগে শিশুদের অত্যাবশ্যকীয় সেবা, মাঠপর্যায়ে টিকাদান কার্যক্রম ও অপুষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ১৯৯০–এর দশক থেকে চালু হওয়া আইএমসিআইয়ের কর্মসূচির অধীনে সারা দেশে শিশুদের নিউমোনিয়া রোগ ব্যবস্থাপনা সেবা দেওয়া হয়। এ ছাড়া পিসিভি টিকা প্রদানের মাধ্যমে শিশুদের নিউমোনিয়া প্রতিরোধ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯–এর জন্য মার্চ মাস থেকে লকডাউন শুরু হয়। এর প্রভাবে শিশুস্বাস্থ্য কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল এপ্রিল ও মে মাসে। সে সময় টিকাদান কেন্দ্রের কার্যক্রম ঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে আমাদের হিসাবে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার শিশু অন্ততপক্ষে একটি ডোজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। এ সময়ে আইএমসিআই কর্নার থেকে প্রায় ৬৮ শতাংশ এবং কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিশুর সেবা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা আসতে পারেনি। শিশুরা অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও অভিভাবকেরা তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসেননি। এমন পরিস্থিতিতে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষত ইপিআইয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে একটা পরিকল্পনা তৈরি করা শুরু করি। যেটা হলো কোভিড-১৯ অ্যাড্রেস প্ল্যান।

এর মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি কীভাবে দ্রুত গতিশীল করা যায়, সে পরিকল্পনা তৈরি করি। একই সঙ্গে আইএমসিআই কার্যক্রম চালাতে হবে এবং এ–সম্পর্কিত একটা নীতিমালা তৈরি হয়। যেসব শিশু টিকা কর্মসূচির বাইরে রয়ে গেছে, তাদের তালিকা তৈরি করতে স্বাস্থ্য সহকারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমাদের স্বাস্থ্য সহকারীদের কাছে টিকা গ্রহণকারী শিশুর অভিভাবকদের মোবাইল নম্বর থাকে। মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাদের আউটরিচ টিকাদান কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করি।

জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে তত্ত্বাবধান ও তদারকি জোরদার করা হয়। যেসব জায়গায় বেশি শিশু টিকার আওতার বাইরে ছিল, সেখানে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পুনরায় তদারক করা হয়। এসবের মাধ্যমে আমরা দ্রুতই ফল পেয়ে যাই।

জুন ২০২০ থেকে ইপিআই কাভারেজ অনেক বেড়ে যায় এবং এটা শতভাগের কাছাকাছি চলে যায়। আইএমসিআই সেবায় সার্বিক উন্নতি হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শিশুস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের দ্রুত উন্নতি করতে পেরেছি। আমরা আশা করছি, যেসব শিশু ইপিআই কার্যক্রমের আওতার বাইরে চলে গিয়েছিল, বছর শেষে তাদের টিকাদান কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারব।

শামস এল আরেফিন

শামস এল আরেফিন

কোনো শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়া মানে হলো তার মারাত্মক নিউমোনিয়া ছিল। সে ক্ষেত্রে তার হাসপাতালে থাকা উচিত ছিল। অথচ তথ্যানুযায়ী এসব শিশুর অর্ধেকের কম হাসপাতালে এসেছিল এবং হাসপাতালে মারা গেছে। বাকিরা বাসায় বা পথে মারা গেছে। সেটা কেন হবে? কোভিড–১৯–এর কারণে শিশুদের নিউমোনিয়ার চিকিৎসা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। এটিকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। নিউমোনিয়া হলেও অভিভাবকেরা শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন না। এটা বহুদিন ধরে ঘটছে। অথচ আমরা উত্তর জেনেও সমাধান করতে পারছি না। আরেকটি সমস্যা হলো, আস্থার অভাব। আমি যেখান থেকে সেবা নেব, সেখানে আমার আস্থা কতটুকু আছে? কোভিড-১৯–এর কারণে গত কয়েক মাসে এই আস্থার অভাব বেড়েছে। আমরা দেখেছি, শিশু ও বয়স্কদের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার প্রবণতা কমে গেছে। শিশুর নিউমোনিয়া হলে হাসপাতালে যাওয়া উচিত। একটি জরিপে এসেছে, বাংলাদেশে ৫ শতাংশের মতো হাসপাতাল শিশুদের চিকিৎসার জন্য তৈরি আছে। বাকিগুলো তৈরি নেই। এটা কেন হবে? শিশুদের নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বছরের একটি দ্রুত জরিপে এসেছে, বেশির ভাগ হাসপাতালে নির্ভরযোগ্য অক্সিজেন সরবরাহের অভাব রয়েছে। অক্সিজেন সমস্যাটা এবার কোভিড-১৯–এর কারণে হয়তো সমাধান হয়ে যাবে। অনেক সময় মনে করা হয়, হাসপাতালের দালান, চিকিৎসক, ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিলে শিশুদের চিকিৎসা হয়ে যাবে। এটা ঠিক নয়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসার পর প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক ও অক্সিজেন পেতে অনেক সময় লেগে যায়। এটার মূল কারণ হলো সিস্টেমের ত্রুটি। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের প্রটোকলের অভাব থাকলেও যেসব প্রটোকল আছে, তার আবার যথাযথ প্রয়োগেরও ঘাটতি আছে। বহির্বিভাগে আসা অসুস্থ শিশুদের কিছু শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে হয়। ওই শিশুদের সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা না গেলে তাদের বাঁচানোর সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে বহির্বিভাগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অন্তর্বিভাগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে আমাদের একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা দরকার।

অ্যান ডিটজেন

অ্যান ডিটজেন

গত বছর বিশ্বে আট লাখের বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এটি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর সবচেয়ে বড় সংক্রামক কারণ। ২০৩০ সালের মধ্যে জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুর মৃত্যুহার ১ হাজার জনের মধ্যে ২৫ জনের কম করতে চাইলে এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

এ ছাড়া জানুয়ারিতে নিউমোনিয়ার অবসান করতে দ্রুত প্রক্ষেপ এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ ও বহুপক্ষীয় সংস্থার প্রতিনিধি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অলাভজনক সংস্থা, পঞ্চাশের বেশি দেশের একাডেমিক প্রতিষ্ঠান মিলে গ্লোবাল নিউমোনিয়া ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়।

দেশের প্রতিনিধিত্ব করা সদস্যরা ঐকমত্য পোষণ করেন যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শিশুমৃত্যু কমানোর মূল কৌশল। সেখানে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু কমাতে ছয়টি কৌশলগত প্রক্ষেপের ঘোষণা তাঁরা সমর্থন করেন। গ্লোবাল নিউমোনিয়া ফোরাম হওয়ার কিছুদিন পরই কোভিড-১৯ মহামারি ঘোষণা করা হয়, যা ফোরামে তৈরি হওয়া কর্ম–উদ্দীপনা ব্যাহত করে। ফলে নিউমোনিয়া ভিন্নভাবে বিশ্ব অ্যাজেন্ডায় আসে।

২০১৮ সালের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে স্বাস্থ্যসেবার তিনটি স্তম্ভকে শক্তিশালী করে নিউমোনিয়ার সমস্যা সুরাহার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রথমে আছে সমন্বিত, প্রতিরোধ ও নিরাময়মূলক স্বাস্থ্যসেবা; দ্বিতীয়ত, মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন; তৃতীয়ত হলো, জনগোষ্ঠীকে যুক্ত ও ক্ষমতায়ন করা।

মানুষকে শুধু স্বাস্থ্যসেবা দিলেই হবে না, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় উন্নতি করেছে। নিউমোনিয়া প্রতিরোধে খাদ্য ও পুষ্টির দিকেও নজর দিতে হবে। নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। সে জন্য ইউনিসেফ ৯০টির বেশি দেশে ১৫ হাজারের বেশি অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর পাঠিয়েছে।

অ্যালিসা ওম’ইনিবোস

অ্যালিসা ওম’ইনিবোস

সেভ দ্য চিলড্রেনের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কৌশলগত লক্ষ্য রয়েছে। সেটা হলো, কোনো শিশু যেন প্রতিরোধযোগ্য রোগে মারা না যায়, তা নিশ্চিত করা। যেহেতু নিউমোনিয়া শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় সংক্রামক রোগ, সে জন্য শিশু নিউমোনিয়াকে অগ্রাধিকার না দিয়ে এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না। সেভ দ্য চিলড্রেনের শতবর্ষপূর্তির অংশ হিসেবে আমরা নিউমোনিয়া মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। নিউমোনিয়া প্রতিরোধে চিকিৎসা, রোগনির্ণয়, গবেষণা ও উদ্ভাবনে উৎসাহিত করছি।

প্রতিটি দেশ আলাদা। নিউমোনিয়া মোকাবিলায় তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই এখনো এ রোগ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এ ক্ষেত্রে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইউনিসেফ ও বাংলাদেশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছি। এসব বিষয়ে দ্রুত অগ্রগতি আনতে আমাদের বৈশ্বিক অংশীদারত্বও রয়েছে।

কোভিড-১৯–এ আমরা বড় একটা ধাক্কা খেয়েছি। তবে এটা একই সঙ্গে সুযোগও তৈরি করেছে। অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। নিউমোনিয়া মোকাবিলায় সরকারের নীতিসহায়তা ও অর্থ বরাদ্দ জরুরি। এ ক্ষেত্রে একটি দেশ অন্য দেশের সফলতার অভিজ্ঞতা জানতে পারে। এ ছাড়া আগামী ১০ বছরের চেষ্টা, প্রক্ষেপ ও কর্মকাণ্ড থেকে আমরা শিখতে চাই এবং সেগুলো বৈশ্বিক পর্যায়ে জানাতে চাই।

মোহাম্মদ সহিদুল্লা

শিশুরা আমাদের খুব প্রিয়। কারণ, ওরা পৃথিবীতে এসেছে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন কাটিয়ে এবং সেবা দিয়ে যেন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে একটা জাতিকে। সেই শিশুরা যদি নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মানসিক অসুস্থতায় ভোগে, কষ্ট পায় অথবা মারা যায়, এটা অনেক কষ্টের। একটি শিশুও যেন নিউমোনিয়া বা কোভিড-১৯ আক্রান্ত না হয়। এটা হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হলো, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আক্রান্ত হলে যেন সঠিক সেবা পায়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য আইএমসিআই ও টিকাদান কর্মসূচি ঠিকমতো হলে অনেক শিশুই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হবে না।

কোভিড-১৯ কবে যাবে, তা আমরা জানি না। সে জন্য কোভিড অ্যাডাপটেড কর্মসূচি ও টিকাদান কর্মসূচি চালু রাখতে হবে। পালস অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন মাপতে পারলে অনেক ভালো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

সে জন্য শুধু শহরে নয়, উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত পালস অক্সিমিটার থাকতে হবে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত অক্সিজেনের প্রাপ্যতা ঠিক থাকা চাই। বড় হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ চালু হয়েছে। এটা যেন চালু থাকে। নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে আমাদের একটি জাতীয় নির্দেশনা প্রয়োজন আর দরকার আমাদের সবার অঙ্গীকার।

ফিরোজ চৌধুরী

অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি আলোচনা হলো। নিউমোনিয়া নিরাময়ে বিশেষজ্ঞরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। আশা করি, নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে নিউমোনিয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ।

আলোচনায় সুপারিশ

  • বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের নির্দেশিকা অনুসারে আইএমসিঅাই কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা দেশে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃতু্য প্রতিরোধ কার্যক্রম চলমান থাকলেও বর্তমানে সরকারি কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে।

  • ২০৩০ সালের মধ্যে জীবিত জন্ম নেওয়া শিশু মৃত্যুহার ১ হাজারে ২৫ জনের কম করতে চাইলে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে জোর দিতে হবে।

  • গর্ভ ও প্রসবকালীন এবং প্রসব–পরবর্তী সেবার উচ্চহার দ্রুত ফিরিয়ে আনা দরকার।

  • পরিষেবা চাহিদা বাড়ানোর পাশাপাশি নিউমোনিয়া রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা করতে পারে এমন আইএমসিঅাই ও আইসিসিএমে প্রশিক্ষিত সেবাদাতার পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা এবং অ্যামোক্সিসিলিন ওষুধের সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি।

  • নিউমোনিয়ায় শিশুমৃতু্য প্রতিরোধে একটি সময়োপযোগী ও কার্যকর জাতীয় নিউমোনিয়া স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ জরুরি।

  • কোভিড-১৯–এর জন্য ইপিআই কার্যক্রমের বাইরে থাকা শিশুদের দ্রুত টিকাদান কার্যক্রমে আনতে হবে।