‘নারীর জন্য হয়রানিমুক্ত কর্মক্ষেত্র ও আইএলও কনভেনশন ১৯০’ শিরোনামে ভার্চুয়্যাল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে
‘নারীর জন্য হয়রানিমুক্ত কর্মক্ষেত্র ও আইএলও কনভেনশন ১৯০’ শিরোনামে ভার্চুয়্যাল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে

নারীর জন্য হয়রানিমুক্ত কর্মক্ষেত্র চাই

কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি বন্ধে শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন করে সুনির্দিষ্ট ধারা যুক্ত করার আহ্বান

নারীর জন্য হয়রানিমুক্ত কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও সহিংসতার বিষয়গুলো শনাক্ত করে কাজের পরিবেশ উন্নয়নে বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদ ১৯০ অনুস্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করতে হবে। গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় কেয়ার বাংলাদেশের ‘প্রমোটিং ওয়ার্কার ওয়েল বিইং প্রজেক্ট’ আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা।

সংলাপে বক্তারা বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি বন্ধে শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন করে সুনির্দিষ্ট ধারা যুক্ত করতে হবে।

‘নারীর জন্য হয়রানিমুক্ত কর্মক্ষেত্র ও আইএলও কনভেনশন ১৯০’ শিরোনামের সংলাপের সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো

কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি শনাক্ত করে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার লক্ষ্যে আইএলও সনদ ১৯০ গৃহীত হয়। ২০১৯ সালের জুনে আইএলও সম্মেলনে গৃহীত সনদটিতে বাংলাদেশ এখনো অনুস্বাক্ষর করেনি।

আইন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দেন সংলাপে সম্মানিত অতিথি জাতীয় সংসদের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. মুজিবুল হক। তিনি বলেন, শ্রম আইন ২০০৬ বেশ পুরোনো। তবে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিরোধে আলাদা আইন আছে। শ্রমিক, শ্রমিকনেতা, মালিকদের আইনগুলো সম্পর্কে ধারণা কম। আইএলওর যেসব সনদ বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে সেগুলোও ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

সংসদ সদস্য শিরীন আখতার বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদেরও কীভাবে আইনের আওতায় আনা যাবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া প্রয়োজন। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে একটি রোডম্যাপ করা দরকার। কারখানায় যারা নির্যাতন–হয়রানি করেন, তাঁরা ওই শ্রমিকের মানবিক বোধ, অধিকার ও মর্যাদার কথা ভাবছেন না। তাঁদের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নারী শ্রমিকদের প্রাধান্য দিয়ে সরকার নিরাপদ ও হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সারা দেশে ৫ হাজার ৬৫১টি কর্মক্ষেত্রে এখন নারী শ্রমিকদের সন্তানের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টের একটি রায় ছিল। আইন না হওয়া পর্যন্ত ওই রায়টি আইন বলে বিবেচিত হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে সরকারকে এখন আইএলও সনদ ১৯০ অনুস্বাক্ষর করা উচিত। একটি আইন সংশোধন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অন্য আইনে নতুন ঘাটতি তৈরি হয় কি না, সেটা মাথায় রেখে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, কারখানাগুলোয় জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। নারীরা বয়স ও বৈবাহিক অবস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, শ্রম আইনের ৩৩২ ধারায় নারীর প্রতি ‘অশ্লীল ও অভদ্রজনিত’ আচরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা জেন্ডার সংবেদনশীল নয়। ধারাটি নারীর প্রতি কর্মক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের হয়রানি ও সহিংসতাকে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে না। এ ছাড়া আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির পরিমাণও সামান্য, মাত্র ২৫ হাজার টাকা, যা বাড়ানো উচিত।

করোনাকালে কারখানাগুলোয় নারী শ্রমিকদের ওপর হয়রানি বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন আওয়াজ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও শ্রমিকনেতা নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, দিবাযত্ন না থাকায় অনেক নারীকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে। নারী শ্রমিক সুস্থ থাকলে, মনে ভয়ভীতি না রেখে কাজ করলে দেশের অর্থনীতির জন্যই তা ভালো হবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রশিক্ষণ ও জেন্ডার কর্মকর্তা শিপ্রা চৌধুরী বলেন, কারখানাগুলোয় হয়রানি ও সহিংসতার ঘটনাগুলো কীভাবে শনাক্ত করা যায় ও তা রোধ করা যায়, সে লক্ষ্যে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

পোশাক কারখানা সেপাল গ্রুপের পরিচালক তানিয়া মুনশি জানান, তাঁর কারখানায় নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানির বিষয়টিতে শূন্যসহিষ্ণুতা দেখানো হয় এবং এ লক্ষ্যে যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগের চেয়ে পোশাককর্মীরাও এখন অনেক সচেতন হয়েছেন।

কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক হুমায়রা আজিজ বলেন, হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরিতে বিভিন্ন সংগঠন যেসব খসড়া প্রস্তাব করেছে, তা দ্রুত আইনে রূপ দেওয়া প্রয়োজন। আইএলও সনদ ১৯০ অনুস্বাক্ষর করলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ প্রগতিশীল রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারবে।

এ ছাড়া সংলাপে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নারী শাখার সাধারণ সম্পাদক নাসরিন আক্তার দিনা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের প্রেসিডেন্ট রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার, সবুজের অভিযান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মাহমুদা বেগম, ভিলেজ এডুকেশন রিসোর্স সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব হোসেন এবং কর্মজীবী নারীর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক সানজিদা সুলতানা।

সূচনা বক্তব্যে কেয়ার বাংলাদেশের প্রমোটিং ওয়ার্কার ওয়েল বিইং প্রজেক্টের টিম লিডার বাবুল আজাদ বলেন, ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ২ কোটি নারী শ্রমিক, যা ৩২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নারীশিক্ষা, রাজনীতি ও মাতৃমৃত্যুর হার রোধে অনেক অগ্রগতি হলেও কর্মক্ষেত্রে হয়রানি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ আরো উন্নত করা দরকার।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।