আইএলও (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন) বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে এবং সুইজারল্যান্ডের সহায়তায় ‘করোনা-উত্তর বিশ্বে শ্রমিক অভিবাসন: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১১ ডিসেম্বর ২০২১। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী
সংসদ সদস্য; চেয়ারপারসন, অভিবাসনবিষয়ক সংসদীয় ককাস
মীর খায়রুল আলম
অতিরিক্ত মহাপরিচালক, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো
লেটিশিয়া ওয়াইবেল রবার্টস
চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, আইএলও অভিবাসন প্রকল্প, বাংলাদেশ
সৈয়দ সাইফুল হক
কো-চেয়ার, সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্র্যান্ট আইএলও এবং চেয়ারম্যান, ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন
রাজেকুজ্জামান রতন
সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট
আসিফ মুনীর
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ
নাজমা ইয়াসমিন
পরিচালক, বিলস
কে এ এম মোর্শেদ
জ্যেষ্ঠ পরিচালক, ব্র্যাক
মো. জাফর সাদিক
জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি
অনন্য রায়হান
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, আইসোশ্যাল
রাহনুমা সালাম খান
ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার, আইএলও বাংলাদেশ
সুমাইয়া ইসলাম
নির্বাহী পারিচালক, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র (বিএনএসকে)
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
সুপারিশ
■ তরুণদের ব্যাপকভাবে প্রযুক্তিগতভাবে প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন।
■ করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে কোন দেশে কী ধরনের মানবসম্পদ প্রয়োজন, তা ঠিক করতে হবে।
■ আমাদের দেশের সনদ যেন বিদেশের কর্মক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পায়, সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
■ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতায় অভিবাসীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
■ কারোনার পর বিভিন্ন দেশের কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন অনুযায়ী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
■ ইতিমধ্যে যারা বিদেশে চলে গেছে, তাদেরও রাতের শিফটে ওই দেশের কাজের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
■ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়াতে হবে।
■ শ্রমিকদের দক্ষতার জন্য অবশ্যই অংশীদারের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
■ অভিবাসন খরচ জিরো করতে হবে। এখান থেকেই দুর্নীতি শুরু হয়।
■ আমাদের শ্রমিকের দক্ষতার সনদ বিদেশে গ্রহণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আমরা ধরে নিচ্ছি করোনা চলে যাচ্ছে। আশা করি, এটা আর বেশি দিন থাকবে না। শ্রমিক অভিবাসন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোভিডের মধ্যে প্রবাসী আয় বেড়েছে। আমাদের অর্থনীতির জন্য এটা একটি সুসংবাদ। পরে দেখা গেল অনেকে চাকরি হারিয়ে দেশে আসছেন। আসার সময় তাঁরা তাঁদের সব সঞ্চয় দেশে পাঠিয়েছেন। গত এক–দুই মাসে প্রবাসী আয় কিছুটা কমেছে। এটা আবার বাড়তেও পারে।
যাঁরা দেশে এসেছেন, তাঁদের কর্মসংস্থান করতে পারলে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যাবে। কোভিডের জন্য কিছু সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। আলোচনায় এসব বিষয় আসবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা করি।
আসিফ মুনীর
কোভিডের জন্য যে সংখ্যক মানুষের বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল, তত সংখ্যক যেতে পারেননি। কোভিডে বিদেশি শ্রমিকদের অনেক সমস্যা হয়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। কেউ কেউ কয়েক মাসের বেতন পাননি। কোভিডের জন্য যাঁরা দেশে এসেছিলেন, তাঁরা যাওয়ার সময় সমস্যায় পড়েছেন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, নাগরিক সমাজসহ অনেকেই শ্রমিক নিয়ে কাজ করেন। অভিবাসী শ্রমিকদের অনেক সমস্যা আছে। আজ আলোচনা করতে পারি, তাঁদের কোন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। অতীতে মালয়েশিয়ায় কী কী সমস্যা হয়েছে, তা উত্তরণের জন্য করোনা পরিস্থিতিকে বিবেচনা করেই উদ্যোগ নিতে হবে। মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে কোন খাতে মানবসম্পদের প্রয়োজন হবে, তা ঠিক করতে হবে। করোনার সময় নার্সিং পেশায় মালদ্বীপ বাংলাদেশ থেকে মানবসম্পদ নেবে বলে কথা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আমাদের সার্টিফিকেটের বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, সেটি দেখতে হবে। কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের উন্নতি দরকার, তা আজকের আলোচনায় আসবে বলে আশা করি।
প্রবাসী শ্রমিক ও বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় করা যায়, বিষয়টি ভাবা প্রয়োজন। আমাদের শুধু মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সাউথ আফ্রিকা, কোরিয়া, হংকং, জাপান ইত্যাদি দেশের কথা ভাবতে হবে। আর একটা বড় বিষয় হলো শুধু প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় একা কাজ করলে হবে না। এখানে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রয়েছে। সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
মীর খায়রুল আলম
এটা একটি সময়োপযোগী আলোচনা। করোনার জন্য আমার প্রায় দুই বছর পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম উৎস হলো প্রবাসী আয়। তাই প্রবাসীদের যে সমস্যা আছে, সে ক্ষেত্রে সবাইকে কাজ করতে হবে। করোনার সময় সরকার, আইএমও, আইএলওসহ সবাই একসঙ্গে কাজ করে সমস্যা অনেকটা নিরসন করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের অনেক দূর যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সম্পদের প্রয়োজন। সম্পদের অন্যতম উৎস হচ্ছে অভিবাসন। আজকের আলোচনায় এ খাতের সম্ভাবনার বিষয় আসবে। সে সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য করণীয় ঠিক করতে হবে। এখানে সবাই মিলেমিশে কাজ করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। অভিবাসন খাতের অভিভাবক আমাদের মন্ত্রী ও সচিব। তাঁরা এর উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের দিকনির্দেশনা ও কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। কাজ করছি। এটাকে আরও কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেসব বিষয় আলোচনায় আসবে বলে মনে করি।
আর্থিক দুর্নীতি ছাড়া আরও অনেক ধরনের দুর্নীতি হয়। এ বিষয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এখন অত্যন্ত জরিুর বিষয় হলো দক্ষতা। ২০২৫ সালের পর সৌদি আরব কোনো অদক্ষ শ্রমিক নেবে না। আমাদের ৬৪টি টিটিসি (টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার) ও ৬ আইএমটি (ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি) আছে। এর মাধ্যমে ৫৫টি পেশায় দক্ষতা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এ ছাড়া আমরা ভাষা শেখাই। উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ দিই। এখন থেকে সব প্রশিক্ষণ জাতীয় দক্ষতা নীতি অনুযায়ী দেওয়া হবে।
আমাদের সিলেবাস, যন্ত্রপাতি সবই পুরোনো ধারার। এখন নুতন করে সব শুরু করছি। এ ক্ষেত্রে আইএলও আমাদের সাহায্য করছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আলোকে আগামী পাঁচ বছরে ইউরোপে পাঁচ বিলিয়ন মানব সম্পদ লাগবে। এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুর এসব এখন থেকেই ভাবতে হবে। আমাদের সনদ যেন বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়, সে জন্য কাজ করছি। প্রতি উপজেলায় একটি করে টিটিসি করার পরিকল্পনা আছে। আমরা ভবিষ্যতে ভালো করার প্রত্যাশা করছি।
অনন্য রায়হান
বাংলাদেশে শ্রম অভিবাসন খাত ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র্য বিমোচনের সূচকে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছিলাম, করোনার জন্য সেটি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বড় কারণ অভিবাসন খাত। গ্রামীণ উন্নয়নে প্রবাসী আয় বড় অবদান রেখেছে। আমাদের মধ্যম আয়ের যাত্রায় মাথাপিছু আয় একটা বড় সূচক। এখানেও প্রবাসী আয় ভূমিকা রেখেছে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবাসী খাতে ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এটা লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটা বেশি। বিনিময় ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও প্রবাসী আয় ভূমিকা রেখেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বেশি আয় হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের আলোচনা। আমি দুটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেব। মার্চ ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিধিনিষেধ ছিল। এরপর আবার দ্বিতীয় ঢেউ আসে। ২০২১ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে বিধিনিষেধ ছিল। ২০২০ সালের এপ্রিল, মে ও জুন—এই তিন মাসে একজন কর্মীও বিদেশে যেতে পারেননি।
জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ বিদেশে গেছেন। কিন্তু বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর থেকে গাণিতিক হারে বিদেশ যাওয়ার লোকজন বেড়েছে। দ্বিতীয়বার বিধিনিষেধের সময়ও মানুষ বিদেশ গেছেন। কিন্তু এ বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। নভেম্বরের তথ্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে জেনেছি, এ সংখ্যা এক লাখের ওপরে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, অভিবাসনের ক্ষেত্রে যে বড় ধাক্কা এসেছিল, তা অনেক ক্ষেত্রে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬০ হাজার ৫৭৮ জন বিদেশে গিয়েছিলেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৫৮ জন বিদেশে গেছেন। এ বছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে ১ লাখ ৩৯ হাজার ২২৫ জন বিদেশে গেছেন। নভেম্বরের তথ্য যোগ করলে এ সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার।
কোভিডের সময় আমাদের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। কিন্তু এখন কোভিড তেমন নেই, তারপরও প্রবাসী আয় কমছে। এটা কি দ্রুত থেমে যাবে, নাকি এভাবে চলতে থাকবে, তা বিশ্লেষণ করা দরকার। এসব বিষয় নিশ্চয়ই আলোচনায় আসবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এখানে ২৬ শতাংশ বেড়েছে। আগামী বছরে কী হবে সেটি বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
রাজেকুজ্জামান রতন
আমাদের যত শ্রমিক বাইরে যান, তার ৪১ শতাংশ অদক্ষ শ্রমিক। অদক্ষ বলে তাঁদের কাজটাও ঝুঁকিপূর্ণ। আর তাঁদের মজুরি কম। আমরা বলছি যে ১ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিক বিদেশে আছেন। কিন্তু এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। আমরা জানি না কতজন ফিরে এসেছেন। আমাদের তরুণেরা তাঁদের যৌবন বিনিয়োগ করেছেন। এই বিনিয়োগের কী ফল পেলাম, এর সঠিক হিসাব নেই। যে অর্থ শ্রমিকেরা নিয়ে এসেছেন, সেটা কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে।
আমাদের অর্থনীতির চারটা খুঁটি। কৃষি, অভিবাসী শ্রমিক, পোশাক খাত, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। আমাদের অর্থনীতির প্রায় ৫০ শতাংশ আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের থেকে। তাঁরা ঋণ নেন। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁদের বিশাল ভূমিকা আছে। কিন্তু তাঁরা উপেক্ষিত। আমাদের পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল থেকে আমাদের অভিবাসনের খরচ বেশি। কেন বেশি, কোন কোন জায়গায় বেশি, সেটা আলোচনা হওয়া দরকার। হতদরিদ্র মানুষ যঁারা বিদেশে যান, তাঁদের জন্য কি বিশেষ কোনো ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে পারি না? যাঁরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠান, তাঁরা ২ শতাংশ ইনসেনটিভ পান।
একজন ব্যক্তির জন্য এটা বড় কিছু না। কিন্তু সরকারের জন্য অনেক টাকা। এটা না করে যদি তাঁদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়া যায়, সেটা তাঁদের অনেক বেশি উপকার হয়। তাহলে সরকারের সঙ্গে একটা বাধ্যবাধকতা থাকে। সরকারের কাছ থেকে যাঁরা বিনা সুদে টাকা নিয়ে বিদেশ যাবেন, তাঁরা আবার সরকারি চ্যানেলে টাকা পাঠাবেন। তাঁরা ভাববেন যে রাষ্ট্র আমাদের পাশে আছে। কারোনার সময় সঠিক চ্যানেলে টাকা পাঠানোর জন্য আমাদের প্রবাসী আয় অনেক বেড়েছিল। এখন হয়তো হুন্ডির মাধ্যমে আসছে।
বিদেশে দূতাবাসের জন্য অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছে কিন্তু তাঁদের থেকে বিদেশি শ্রমিকেরাই বেশি মানুষ বিদেশে নিচ্ছেন। বিদেশি শ্রমিকদের ঢাকায় একটা বড় ডরমিটরি করা অত্যন্ত জরুরি।
নাজমা ইয়াসমিন
গত দুই বছর আমাদের যে প্রবাসী আয় বেড়েছে, ভবিষ্যতে এই প্রবাহ থাকবে না। এ বিষয়টি বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। আমাদের শ্রমিকেরা যে দেশে যাবেন, সে দেশে তাঁদের কী দক্ষতা প্রয়োজন, সেটা নিয়ে কাজ করা উচিত। শ্রমিকদের জন্য সরকার ঋণের ব্যবস্থা করেছে। তাঁরা যেন সহজে এ ঋণ নিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু শ্রমিকেরা থাকেন গ্রামে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে যদি রিক্রুটিং এজেন্সি নেওয়া যায়, তাহলে তাঁদের অনেক ভোগান্তি কমে। আইএলও কনভেনশন-১৮৯-এর ১০ বছর হয়েছে। এখন এটা রেটিফাই করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। আজকের এই আলোচনা থেকে সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছি, আইএলও কনভেনশন যেন অনুসমর্থন হয়। এটা হলে কোনো দেশে আমাদের শ্রমিকেরা নির্যাতনের শিক্ষার হলে সেই দেশের আইন অনুযায়ী তাঁকে সুরক্ষা দেওয়া যাবে। করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। কেয়ার গিভার ও নার্স প্রশিক্ষণের বিষয় অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ভবিষ্যতে এ খাতের চাহিদা বাড়বে। সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে।
সুমাইয়া ইসলাম
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র থেকে যাঁরা বিদেশি চাকরি করছেন, করোনাকালে যাঁরা ফিরে এসেছেন এবং যাঁরা যাবেন, এমন ৩৮০ জন নারীকে নিয়ে একটা গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, করোনার সময়ে নারীদের কাজের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। কারণ, এ সময় শিশু, বয়স্ক সবাই বাড়িতে ছিল। নারী শ্রমিকদের কাজের চাপ বাড়ায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। ব্যাপকভাবে তাঁদের বেতন কমে গেছে। করণ, নিয়োগকর্তা বলছেন তাঁর আয় কমে গেছে। তিনি সম্পূর্ণ বেতন দিতে পারবেন না। অনেকে কিছু বেতন দিয়েছেন। আবার অনেকে কোনো বেতন দেননি। বেতন কমায় বা অনেক ক্ষেত্রে না পাওয়ায় শুধু শ্রমিক নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হননি, তাঁর পরিবার ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনাকালে যে ভোগান্তি হয়েছে, অমিক্রন বা অন্য কিছু এলে যেন এমন ভোগান্তি না হয়, সে জন্য প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। করোনার সময় অনেক নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। সহজ শর্তে তাঁদের ঋণ দিতে হবে। প্রতিটি দেশের গণমাধ্যম, ট্রেড ইউনিয়ন, নাগরিক সমাজ একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। আমরা জর্ডানের অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। জর্ডানের জেলে যেসব নারী ছিলেন, তাঁদের সহযোগিতা করতে পেরেছি।
আমরা ছয়টা দেশে কাজ করছি। মডেল এম্বাসি করতে হবে। এটা করা খুব জরুরি। পোশাকশিল্পকে সরকার অনেক সহযোগিতা দেয়। সে তুলনায় বিদেশি শ্রমিকেরা তেমন কোনো সহযোগিতা পান না। কিন্তু তাঁরা দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখেন। প্রত্যেক নারী শ্রমিকের জন্য আড়াই থেকে তিন হাজার ডলার আগেই এসেছে। অন্য কোনো খাতে এটা হয় না। একমাত্র নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রে এটা হয়। প্রতি রিক্রুটিং এজেন্সিকে বাধ্য করতে হবে তারা শ্রমিকেরা বেতন পাচ্ছেন কি না, প্রতি তিন মাস অন্তর সেটা যেন প্রতিবেদন দেয়।
মো. জাফর সাদিক
৫০ বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে থ্রি আর ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে হলো রাইস, রেমিট্যান্স ও আরএমজি। এই থ্রি আরের একটা হলো রেমিট্যান্স। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিক বিদেশে গেছেন। বিশ্বের প্রায় ১৭ কোটি মানুষ অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এখন গৃহকর্মী বেশি যাচ্ছেন। আমাদের নার্স পাঠাতে হবে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমাদের গত ৪০ থেকে ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। নতুনভাবে সবাইকে দক্ষ করতে হবে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। যাঁরা ফেরত আসছেন, তাঁরা আবার যাচ্ছেন। এসব বিষয়কে একটা পরিকল্পনার আওতায় আনতে পারি। করোনা-উত্তর পরিস্থিতিকে চিন্তা করে এটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। একটা হচ্ছে দক্ষতাকে কীভাবে বাড়াতে হবে, আরেকটা হলো আন্তর্জাতিক দর-কষাকষির শক্তি বাড়াতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারের সঙ্গে আমাদের অন্যান্য দেশের বাজারের চাহিদামতো শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জাপান, কোরিয়াসহ অন্যান্য বাজারে চাহিদা কী, সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়গুলো আছে কি না, না থাকলে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, সেটা দেখতে হবে। আমাদের ভাগ করতে হবে কারা নতুন অভিবাসী, কারা স্থানীয় বাজারে কাজ করছেন। কারা বিদেশ থেকে ফেরত এসে আবার যাচ্ছেন। তাঁদের প্রত্যেকের আলাদাভাবে দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয় রয়েছে। অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ অনেক পরিবর্তন এনেছে। আমাদের ২০১২ ও ২০৩০ সাল ছাড়া আর কোনো নীতি নেই।
পরিবর্তিত পরিস্থিতে আমাদের আরও নীতি ও কর্মপরিকল্পনা করতে হবে।
সাইফুল হক
একজন শ্রমিককে তাঁর ভিসার মেয়াদ বাড়ানোসহ যত জায়গায় তাঁকে যেতে হয়, সব ক্ষেত্রে টাকা খরচ হয়, সব রকমের খরচ একজন অভিবাসী শ্রমিকের ওপর পড়ে। এসব কারণে এই মহাদেশে আমাদের শ্রমিকদের অভিবাসন খরচ সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বে শ্রমিক অভিবাসনের আমি চারটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। অভিবাসীদের মানবাধিকার, নৈতিক রিক্রুটমেন্ট, নিয়মিত রিক্রুটমেন্ট ও দক্ষতার স্বীকৃতি। কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে এ বিষয়গুলো বেশি আলোচিত হচ্ছে। শ্রমিক অভিবাসন উন্নত করতে হলে এসব করতে হবে।
বিদেশ যাওয়ার আগে-পরে, ফিরে আসার পর প্রায় সব ক্ষেত্রে অভিবাসীদের মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে। বছরে ৭ থেকে ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে যান, তাঁদের ৮৬ শতাংশ ভিসা কিনে আনেন। শ্রমিক অভিবাসনের খরচ বেশি হওয়ার একটা বড় কারণ হলো ভিসার ক্রয়-বিক্রয়। এ জন্য কখনো বাংলাদেশে দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি হবে না। দেশে প্রায় ৭৯ টিটিসি আছে। আরও হচ্ছে।
একটা গবেষণা প্রয়োজন যে এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কতজন বিদেশে গেছেন। প্রায় অধিকাংশ রিক্রুটিং এজেন্সি ভিসা ট্রেডিংয়ের সঙ্গে জড়িত। কিছু ভালো রিক্রুটিং এজেন্সিও আছে। এরা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। একজন বললেন যে তিনি বিদেশের এক প্রতিষ্ঠান থেকে ভিসা আনেন। ওই প্রতিষ্ঠান তাঁকে প্রতি ভিসার জন্য টাকা দেয়। কিন্তু তিনি বললেন যে এখন সেখানে কয়েকজন বলেছেন যে তাঁদের ভিসা দিলে প্রতি ভিসায় এসব এজেন্সি এক হাজার রিয়াল তাদের দেবেন। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে কীভাবে চলবে।
সরকার, ট্রেড ইউনিয়নসহ কেউ এটা বন্ধ করতে পারবে না। একমাত্র ওই শ্রমিক যদি বলেন যে আমি যাব না, তাহলে এটা বন্ধ হওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা কি সম্ভব? যাঁদের দক্ষতা নেই, তাঁরা চার লাখ, পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে বসে আছেন যাওয়ার জন্য। যাঁরা পাইপ ফিটার, ইলেকট্রিশিয়ান, টাইলস লাগান, তাঁরা দেশেই মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করেন।
রাহনুমা সালাম খান
আইএলও নিরাপদ অভিবাসন ও অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও কল্যাণে কাজ করে। আইএলও নিরাপদ অভিবাসনের উদ্দেশ্যেই ইন্টারন্যাশনাল লেবার স্ট্যান্ডার্ডসকে সামনে রেখে দেশে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য রাইট বেজড আইন–বিধি ও নীতিমালা প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করে আসছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের টেকসই প্রবাহ একটি চ্যালেঞ্জ। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও টেকসই করার জন্য ফরমাল চ্যানেলকে আরও আকর্ষণীয় করতে হবে। প্রবাসী কর্মীদের হয়তো ফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণে ভীতি কাজ করতে পারে। সে ভীতি দূর করার জন্য ফরমাল চ্যানেলকে আরও অভিবাসী কর্মীবান্ধব করা দরকার। এর জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে। এমনকি আরও ইনসেনটিভ দেওয়া যায় কি না দেখা দরকার। মোবাইল ব্যাংকিংকে আরও ব্যাপক করা যেতে পারে। তবে তার জন্য সঠিক মনিটরিং প্রয়োজন। মূল বিষয় হলো ফরমাল চ্যানেলকে অন্য সব চ্যানেল থেকে আকর্ষণীয় করতে হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের অনেকেরই পর্যাপ্ত মূলধন নেই। এ বিষয়কেও গুরুত্ব দিয়ে ব্যাংকিং খাতকে আরও অভিবাসী কর্মীবান্ধব করা দরকার। আমাদের দেশে ওয়েজ আর্নার্সের বন্ড বলে একটি বন্ড রয়েছে। অভিবাসী কর্মীরা সেই বন্ড কিনতে পারেন কি না, করলে কতটুকু পারেন, সে বিষয়ে মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। করোনাকালে অভিজ্ঞতা থেকে অভিবাসী কর্মীদের সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য ইনসেনটিভ দিতে হবে। করোনার মতো মহামারি যেকোনো সময় আবার আসতে পারে। এর জন্য আমাদের অভিবাসী কর্মীদের সঞ্চয় বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া দরকার। কোভিড নানাবিধ ঝুঁকি ছাড়াও কিছু সুযোগও সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাপী ‘কেয়ার গিটার’ খাতসহ স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনেক কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও কূটনীতি এখনই শুরু করতে হবে। তা না হলে এ খাতে কর্মসংস্থানের অনেক বড় সুযোগ আমরা হারাতে পারি। শ্রম অভিবাসন কূটনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের এ বিষয়ে আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এবার করোনাকালে আমরা দেখেছি অভিবাসীরা কত রকম বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অভিবাসী কর্মীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও পুনরেকত্রীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অভিবাসী কর্মীরা যেন সামাজিক সুরক্ষা স্কিমের স্বত্বভোগী হতে পারেন, সেদিক দেখতে হবে। অভিবাসী কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিকে একটি শেয়ার্ড হিসেবে চিহ্নিত করে এ ক্ষেত্রে জোর কূটনীতি চালাতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অভিবাসী কর্মীদের অন্তর্ভুক্তি সময়ের দাবি। বিদেশফেরত অসুস্থ, পঙ্গু বা সহায়সম্বলহীন অভিবাসী কর্মীদের অবশ্যই ‘সামাজিক সুরক্ষা’ বলয়ে আনা উচিত বলে মনে করি। বাংলাদেশ সরকার এখানে উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেছে এবং এ বিষয়ে আইএলও তার কারিগরি সহায়তা প্রদান করতে পেরে গর্বিত। তবে গৃহীত আইন-বিধি ও নীতিগুলোর যথার্থ বাস্তবায়ন না হলে এ খাতের চ্যালেঞ্জ থেকেই যাবে।
কে এম মোরশেদ
প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক দেশে এসেছেন। কিন্তু এক কোটি শ্রমিক ফিরে এলে কী হতো। যাঁরা ফেরত এসেছেন, প্রণোদনার ঋণ নিতে গেছেন, তখন নিশ্চয়তা প্রদানকারীকে চেক দিতে বলা হয়েছে। এ দায় কেউ নিতে চায় না। এ জন্য তাঁরা অনেকে ঋণ পাননি। এসব জটিলতা সহজ করতে হবে।
দক্ষতার অভাবে অন্যান্য দেশের শ্রমিকের মতো আমাদের শ্রমিকেরা বিদেশের নাগরিক হবেন না। তাঁরা তাঁদের যৌবন পার করে ফেরত আসবেন। তাঁদের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। এবারের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁদের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
যেকোনো সংকট কিছু সুযোগও তৈরি করে। এই সরকার অনেকগুলো শ্রমবাজার খুঁজে বের করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কম্বোডিয়া, অ্যাঙ্গোলা, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভাকিয়া—এসব জায়গায় নতুন বাজার সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করছি। সরকারের এটা একটা দারুণ উদ্যোগ।
সবকিছু আগের মতো থাকলে এই বাজার খোঁজা হতো না। অন্য কেউ এটা দখল করত। একজন শ্রমিক যখন রিক্রুটিং এজেন্সিতে আসেন, ইতিমধ্যে তিনি কয়েক হাত বদল হয়েছেন। সেখানে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সবার সঙ্গে আলোচনা করে ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছে। এ জন্য প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
একজন শ্রমিকের বিদেশ যাওয়া থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তাঁর আর্থিক ব্যবস্থাপনা এমনভাবে করা উচিত যেন তাঁর ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
লেটিশিয়া ওয়াইবেল রবার্টস
অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে যেমন সমস্যা হয়েছে, তেমনি সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিষয় আলোচনায় এসেছে। এ পরিকল্পনায় আগামী দিনের লক্ষ্যমাত্রার উল্লেখ আছে। গত দুই বছরে কোভিড থেকে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটা কাজে লাগাতে হবে।
অভিবাসনের ক্ষেত্রে যে ১০টা অ্যাজেন্ডা আছে, সেটার বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। অংশীদারির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশ থেকে শ্রমিক পাঠানো হয় এবং যে দেশে পাঠানো হয়, দুই দেশের মধ্যে অংশীদারির বিষয়টি খুব জরুরি। শ্রম অভিবাসনের প্রতিটি পর্যায়ে আলোচনা, পরিস্থিতি বিবেচনা, বিশ্লেষণ প্রয়োজন। শ্রমিকের দক্ষতা, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এসব ক্ষেত্রে আইএলও ভূমিকা রাখতে পারে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এর উল্লেখ আছে।
জবাবদিহির বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসনের প্রতিটা ক্ষেত্রে জবাবদিহি থাকতে হবে। বিদেশে শ্রমিকেরা যে প্রতিষ্ঠানে যাবেন, তাদেরও জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। কোভিডে যাঁরা ফেরত আসছেন, তাঁদের ফেরত আসার কোনো প্রস্তুতি, পরিকল্পনা কিছুই ছিল না। তাঁরা করোনা পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেকে কোনো প্রকার আর্থিক সুবিধা ছাড়াই আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের ফেরত যাওয়ার ক্ষেত্রে যত ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন, সেটা করা দরকার।
টেকসই শ্রম অভিবাসন ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অংশীদারি ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। টেকসই রি-ইন্টিগ্রেশন পলিসির ক্ষেত্রে আইএলও সহযোগিতা দেবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী
তিন বছর ধরে অভিবাসনের সঙ্গে কাজ করছি। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক—অভিবাসনের বিষয়ে তাঁরা অসাধারণ কাজ করে যাচ্ছেন। সীমিত সম্পদ ও লোকবল নিয়ে সর্বোচ্চ কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিবছর ১০ লাখ অভিবাসী যাচ্ছেন। এর জন্য আমরা কী করেছি। এর জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও দায়ী নয়। কারণ, অনেক বিষয়ে তাদের হাতে নেই। যেমন টিকিটের দাম এত বেশি। তারা কী করবে। এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিটের বেশি দামের জন্য সব সময় একটা অংশ ব্লক করে রাখে।
বাংলাদেশ বিমানের সব সেবা বন্ধ করে এখন মধ্যপ্রাচ্যে সেবা দেওয়া উচিত। অন্যরা যেকোনো এয়ারলাইনসে বিদেশে যেতে পারবেন। সবার আগে শ্রমিকদের সুযোগ দিতে হবে। বিএমইটিও খুব ভালো কাজ করছে। মাত্র ৭৪টি টিটিসি আছে। আমরা যদি ৭ হাজারও করি, তাও যথেষ্ট নয়। এখন আরও ৫০০টি টিটিসি করা হবে।
বিদেশে এমবাসিতে প্রবাসীদের সেবা দেওয়ার জন্য একটা ডেস্ক আছে। এখানে হয়তো পাঁচ থেকে সাতজন ব্যক্তি কাজ করেন। এর মাধ্যমে একটি দেশের কয়েক লাখ প্রবাসী শ্রমিককে কি সেবা দেওয়া সম্ভব? অন্তত ৩০টি দেশে বিএমইটি বা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ভবন ও অফিস থাকা উচিত। যাঁরা ইতিমধ্যে বিদেশে চলে গেছেন, তাঁদেরও সেখানে রাতের শিফটে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়াতে হবে। কোটি কোটি মানুষের কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছি। সরকারের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। শ্রমিকদের দক্ষতার জন্য অবশ্যই অংশীদারের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জাপান উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ চাচ্ছে। আমরা পাঠাতে পারছি না।
১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব দিলে তারা জাপানে কাজ করার উপযোগী এক লাখ মানবসম্পদ তৈরি করে দিতে পারবে। অভিবাসন খরচ শূন্য করতে হবে। এখান থেকেই দুর্নীতি শুরু হয়। একজন শ্রমিক যদি গড়ে পাঁচ লাখ টাকা দেন, তাহলে ৭ লাখ শ্রমিকের ৩৫ হাজার কোটি টাকার বাজার। যে খাতের এত বিশাল আয়, তাদের তদারক করা সম্ভব নয়।
আমাদের দেশের শ্রমিকেরা দক্ষতার জন্য যে সনদ অর্জন করেন, বিদেশে সেটা গ্রহণ করে না। এ ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আশির দশকে একজন ইতালিয়ান বলেছিলেন, পোশাকশিল্প বাংলাদেশে বাড়বেই। কারণ, ওদের যে দাম দেওয়া হবে, সে দামেই কাজ করতে হবে। আমাদের রিকশাওয়ালা আয় করেন ২৫ হাজার টাকা। আর দেড় লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে একজন শ্রমিক আয় করেন ১৬ হাজার টাকা। কারণ, আমাদের কোনো সমঝোতার শক্তি নেই। শেষ কথা, দক্ষতা অর্জন করতেই হবে। এটা থাকলে আমাকে বাজার খুঁজতে হবে না। বাজার আমাকে খুঁজে নেবে।
ফিরোজ চৌধুরী
করোনা-পরবর্তী সময়ে অভিবাসনের যেমন চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি সম্ভাবনাও আছে। প্রায় সব আলোচকই শ্রমিকদের দক্ষতার কথা বলেছেন। সঠিক দক্ষতা থাকলে বিশ্বের অনেক দেশেই কাজের সুযোগ হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে আশা করি।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।