কিশোরী ও নারীর জন্য নিরাপদ অনলাইন বিষয়ে সংলাপে নানা প্রশ্নের জবাব দিলেন মনোরোগ চিকিৎসক, শিক্ষক ও পুলিশ কর্মকর্তা।
‘আমার ১০ বছরের ছোট বোন ইউটিউবে কিছু দেখার সময় অনেক সময় ১৮+ বিজ্ঞাপন কনটেন্ট চলে আসে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?’ ‘অনলাইনে হয়রানি করার মানসিকতা কেন তৈরি হচ্ছে?’ ‘অন্যের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়ে আমিও প্রতিশোধ হিসেবে অনলাইনে হয়রানি করেছি, কেন দায়িত্বশীল আচরণ করলাম না?’
তরুণদের এমন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন মনোরোগ চিকিৎসক, শিক্ষক এবং পুলিশ কর্মকর্তা। জবাবে তাঁরা জানিয়েছেন, কীভাবে অনলাইনের বিশাল দুনিয়ায় নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে, সাইবার বুলিং বা হয়রানি থেকে পরিত্রাণ পেতে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে এবং কীভাবে হয়রানির শিকার হলেও হতাশ না হয়ে ঘটনাগুলো উপেক্ষা করতে হবে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘কিশোরী ও নারীদের জন্য গড়ি নিরাপদ অনলাইন’ শিরোনামের যুব সংলাপে উঠে আসে এমন নানা সমস্যা ও প্রতিকারের উপায়। যুব সংলাপের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও কিশোর আলো। এতে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির প্রেসিডেন্ট লাফিফা জামাল বলেন, ইন্টারনেটে প্রচুর পরিমাণ থার্ড পার্টি আছে, যেগুলোর মাধ্যমে অযাচিত কনটেন্ট ফিল্টার করা যায়। শিশুদের বয়স উল্লেখ করে ই–মেইল অ্যাকাউন্ট করে সেই অ্যাকাউন্টে ইউটিউব দেখলে অযাচিত বা প্রাপ্তবয়স্ক কোনো কনটেন্ট আসবে না। তবে অভিভাবকদের অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহারে এসব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা জানেন না। তিনি জানান, ৭০ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর কাছে অনিচ্ছাকৃতভাবে পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট চলে আসে।
কয়েক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে উপেক্ষা করতে জানলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়। নিজের প্রতি সম্মানবোধ না থাকলে অন্যকে সম্মান করা যায় না। আমাদের দেশে যৌনতাকে কলুষিত করে ফেলা হয়েছে। এ ব্যাপারে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সহজাত কৌতূহল মেটাতে অভিভাবকদের বিষয়গুলো বয়স অনুপাতে বুঝিয়ে বলতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহ্ফুজা লিজা এক প্রতিবেদন উপস্থাপনের মাধ্যমে জানান, সাইবার অপরাধের শিকার হলেও ৩০ শতাংশ জানেন না কীভাবে অভিযোগ করতে হয়, ২৫ শতাংশ মনে করেন অভিযোগ করলে লাভ হবে না, ২৩ শতাংশ আরও হয়রানির ভয়ে অভিযোগ করেন না, ১৭ শতাংশ সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ন হবে ভেবে অভিযোগ করেন না এবং ৫ শতাংশ প্রভাবশালী অপরাধীদের ভয়ে অভিযোগ করেন না।
মাহ্ফুজা লিজা বলেন, অনলাইনে কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না—এই নীতি অনুসরণ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপরিচিত ব্যক্তিদের বন্ধু বানানো যাবে না। ফোন ও ল্যাপটপসহ সকল ব্যক্তিগত ডিভাইস সুরক্ষিত রাখতে হবে। কারও প্রলুব্ধকারী কথা বা কোন আকর্শণীয় সুবিধা প্রদানের প্রস্তাবের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।
১৯৯৩ সালে ঢাকা দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর অরলা মার্ফি বলেন, বাংলাদেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের গতি ধরে রাখতে হবে। দেশের একটি বড় অংশ তরুণ। তরুণদেরই ভাবতে হবে ও গড়ে তুলতে হবে দেশকে তাঁরা যেমনভাবে দেখতে চান।
এক প্রশ্নের জবাবে ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহেরীন বলেন, শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট গড়ে তুলতে ইউনিসেফ বারবারই সুপারিশ করেছে। এখন সরকার পাঠ্যক্রমে ইন্টারনেটে কীভাবে সুরক্ষিত থাকা যাবে, সে বিষয়গুলো এ বছর অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ১০৯৮ হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করে শিশুরা অভিযোগ জানাতে পারে যেকোনো হয়রানির বিরুদ্ধে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, প্রত্যেক পর্যায়ের ব্যক্তিদের ডিজিটাল জ্ঞান বাড়াতে হবে। মা–বাবার দায়িত্ব রয়েছে, তাঁর সন্তান অপরাধী, ভুক্তভোগী নাকি দায়িত্বশীল হবে। একটি ঘটনা বড় আকার ধারণ না করা পর্যন্ত কেউ মনোযোগ দেয় না। ইন্টারনেটে হয়রানি বন্ধে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও রাষ্ট্র সবাইকে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সাইবার হয়রানির বিরুদ্ধে নড়াইলে তরুণদের নিয়ে গড়ে তোলা সাইবার টিনস্–এর প্রতিষ্ঠাতা এবং আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারজয়ী সাদাত রহমান বলেন, অনলাইনে হয়রানি বন্ধে তাঁদের তৈরি অ্যাপটি এখন ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে দিতে চান। এ জন্য ইউনিসেফ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থাকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
তরুণের নতুন ভাবনা, জ্ঞান ও তারুণ্য এবং প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে একত্র করে প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি বলেন, ইন্টারনেটে শুধু ছোটরা নয়, বড়রাও নিরাপদ নয়। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানও নিরাপদ নয়। প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে নিরাপদ ইন্টারনেট গড়ে তোলা জরুরি।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, কোভিড মহামারিতে পড়াশোনা, কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন অনেক কাজ অনলাইননির্ভর হয়ে উঠেছে। ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে হয়রানি। নিরাপদ ইন্টারনেটের বিষয়টি প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন কিশোর আলোর প্রদায়ক সামিয়া শারমিন।
তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন মোনালিসা মৌ, রোজলিন জাহান প্রভা, সদেব চন্দ্র নাগ, আল ইমরান, জিনাত আমীন, নাবিলা আহসান, ফাইজি নুজহাত, মুশফিকা রহমান, মারজুকা বিনতে আফসান, তাসনিম সাবাবা নূর, সাফা জেরিন সুকন্যা, জাহিন যাঈমাহ্ কবির, ফাইজা বিনতে মোজাম্মেল, আব্দুল্লাহ-আল-মুয়াজ, সরদার আকিব লতিফ ও এশনা বিনতে আলী।