শক্তিশালী দিগ্বিজয়ী সম্পর্কে যা তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন, ‘এবং তারা তোমাকে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। তুমি বলো, আমি তার বিষয় তোমাদের কাছে বর্ণনা করব। আমি পৃথিবীতে তাকে ক্ষমতা দিয়েছিলাম এবং সমস্ত বিষয়ের উপায় ও পন্থা নির্দেশ করে দিয়েছিলাম। সে সেই পথ অবলম্বন করেছিল।’ গল্প প্রসঙ্গ এখানেই সমাপ্ত।
বলা হয়, তিনি যে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন, মরলোকের আর কেউ তা করতে পারেনি। সমস্ত পথ ছিল তাঁর সামনে প্রসারিত, তিনি পূর্বে পশ্চিমে সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমণ করলেন। পৃথিবীর যে দেশেই তিনি পা রেখেছেন, সে দেশেরই কতৃর্ত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে। তারপর এমনি করে সৃষ্টিজগতের শেষ সীমায় তিনি পৌঁছেছিলেন।
বিদেশিদের সামনে পারসীয়দের গল্প বলত এক লোক। সে গল্প লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ত সবখানে। সে লোক আমাকে বলেছিল যে, জুলকারনাইন ছিলেন একজন মিসরীয়। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মাজুর্বান ইবনে মারজাবা। মারজাবা গ্রিক ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিল ইউনান ইবনে ইয়াফিজ ইবনে নুহ।
খালিদ ইবনে মাদান আল কালাইয়ের সূত্রে সাউর ইবনে ইয়াজিদ আমাকে বলেছেন, রাসুলে করিমকে (সা.) জুলকারনাইন সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘তিনি ছিলেন এক ফেরেশতা, দড়ি দিয়ে সমস্ত পৃথিবী জরিপ করেছিলেন।’ এই সাউর ইসলামি যুগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
খালিদ বলেছেন, উমর একজন লোককে অন্য কাকে যেন জুলকারনাইন বলে সম্বোধন করতে শুনেছিলেন, এবং তখন রাসুলে করিম (সা.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করুন, তোমরা ফেরেশতার নামে ছেলেমেয়েদের নাম রাখছ কেন, নবীদের নামে নাম রেখে আর বুঝি সুখ পাচ্ছ না?’
নবী করিম (সা.) এ কথা সত্যি সত্যি বলেছিলেন কি না, তা একমাত্র আল্লাহ্ বলতে পারবেন। যদি বলে থাকেন, তাহলে যথার্থই বলেছিলেন।
আত্মা সম্পর্কে তারা যে প্রশ্ন করেছিল, সে বিষয়ে আল্লাহ্ বলেছেন, ‘তারা আপনাকে আত্মা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে। আপনি বলুন, আত্মা আমার প্রভুর আদেশ থেকে উদ্ভূত আর এ বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান খুব অল্প।’
ইবনে আব্বাসের বরাত দিয়ে আমাকে কে একজন বলেছে, তিনি (ইবনে আব্বাস) বলেছেন যে রাসুলে করিম (সা.) মদিনা এলে পরে ইহুদি র্যাবাইরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এই যে আপনি বললেন, এ বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান খুব অল্প, এতে কি আমাদের কথা বলেছেন, নাকি আপনার গোত্রের লোকদের কথা বলেছেন?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আপনাদের উভয়ের কথা।’ তাঁরা বললেন, ‘তথাপি আপনি যে গ্রন্থ আনয়ন করেছেন, তাতে আপনি পাঠ করবেন যে, আমাদের তাওরাত গ্রন্থ দেওয়া হয়েছিল এবং সে গ্রন্েথ সব রহস্যের সন্ধান আছে।’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, আল্লাহ্র জ্ঞানের তুলনায় তা কিছুই নয়। অবশ্য যা ছিল, তা মানলে তা-ই তাঁদের জন্য যথেষ্ট ছিল। তাঁরা যা জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ আয়াত নাজিল করেছেন। বলেছেন, ‘যদি পৃথিবীর সমস্ত গাছ কলম হয়, সমুদ্র হয় কালি, আর সেই সমুদ্রে সপ্ত সমুদ্র যুক্ত হয়, তাহলেও আল্লাহ্র গুণগান লিখে শেষ করা যাবে না।
নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শক্তিশালী এবং জ্ঞানী।’ তার অর্থ হলো আল্লাহ্র জ্ঞানের তুলনায় তাওরাত কিছুই না। তার লোকজন নিজেদের স্বার্থে কিছু কিছু জিনিস চেয়েছিল, যেমন পাহাড় সরিয়ে নিতে হবে, মাটি সমান করে দিতে হবে, তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সে বিষয়েও আল্লাহ্ ওহি নাজিল করেছেন। বলেছেন, ‘যদি এমন কোনো কোরআন থাকত, যা দিয়ে পাহাড় সরানো যায়, মাটি সমান করা যায়, মৃতকে দিয়ে কথা বলানো যায়, তাহলে সে হতো এই কোরআনই, কিন্তু সব জিনিসের অবস্থানের মালিক আল্লাহ্।’ এর অর্থ হলো, যা তোমরা করতে বলছ, তা আমি যখন ইচ্ছা করতে পারি, কিন্তু এখন আমি করব না। তারা বলেছিল, ‘তোমার জন্য নাও।’ অর্থাৎ, তোমার জন্য বাগান বানাও, প্রাসাদ বানাও, সম্পদ সংগ্রহ করো, আল্লাহ্কে বলো একজন ফেরেশতা পাঠাতে, যে এসে সাক্ষ্য দেবে তুমি যা বলছ তা সত্য এবং দরকার হলে তোমাকে রক্ষা করবে। এ বিষয়েও আল্লাহ্ বাণী পাঠিয়েছেন। বলেছেন, ‘এবং তারা বলল, এ কেমন রাসুল, খায়-দায়, হাটে-বাজারে যায়। তার কাছে কোনো ফেরেশতা প্রেরণ করা হলো না যে তার সঙ্গে থাকতে পারত সতর্ককারীরূপে। তাকে ধনভান্ডার দেওয়া হলো না কেন, কেন একটা বাগান নেই তার, যা থেকে সে আহার করতে পারত?’ সীমা লঙ্ঘনকারীরা আরও বলে, ‘তোমরা তো এক জাদুগ্রস্ত লোকের অনুগামী হচ্ছ। দেখো, ওরা তোমার কেমন উপমা দেয়, ওরা পথভ্রষ্ট, ওরা পথ খুঁজে পাবে না। তিনি কত মহান, তিনি ইচ্ছা করলে এর চেয়েও অনেক উৎকৃষ্ট বস্ত্ত দিতে পারেন—দিতে পারেন উদ্যান, যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহর। দিতে পারেন প্রাসাদ।’ অর্থাৎ, যাতে রাসুল (সা.)-কে বাজারে যেতে না হয় জীবিকা অর্জনের জন্য।
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে