হিব্রু ‘আদম’ শব্দের অর্থ মানুষ। বাইবেল ও পবিত্র কোরআন অনুসারে প্রথম মানব। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মমতে, আদম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া (আ.) থেকে সমগ্র মানবজাতির সৃষ্টি। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির আগে ফেরেশতা ও জিন সৃষ্টি করেন। এমনকি চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ও পৃথিবীর বৃক্ষ-লতা, জীবজন্তু ইত্যাদিরও সৃষ্টি মানুষের আগেই। তারপরও আল্লাহ পৃথিবীকে আবাদ করার ইচ্ছা থেকে মানুষ সৃষ্টি করেন।
ফেরেশতা আল্লাহর নূর থেকে এবং জিনরা আগুন থেকে সৃষ্ট। কিন্তু আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেন মাটি দিয়ে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা হিজর-এর ২৬ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তো ছাঁচে-ঢালা শুকনা ঠনঠনে মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছি।’
এই মাটির তৈরি মানুষকেই যখন আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেন, তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন, মানুষ তো দুনিয়ায় গিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করবে। জবাবে আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেন, ‘আমি যা জানি, নিশ্চয়ই তোমরা তা জানো না।’
আল্লাহ আদমকে (আ.) এমন জ্ঞান দান করেন, যা জিন ও ফেরেশতাদের অনায়ত্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দেন আদমকে (আ.) সিজদা করতে। তাঁরা সবাই আল্লাহর আদেশ পালন করেন। কেবল একজন ইবলিস ছাড়া। অবাধ্যতার শাস্তি হিসেবে আল্লাহর আদেশে সে শয়তান হয়ে যায়।
পবিত্র কোরআনের সুরা আ’রাফ-এর ১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর আমি বললাম, হে আদম! তুমি তোমার সঙ্গিনীকে নিয়ে জান্নাতে বাস করো ও যেখানে ইচ্ছা যাও বা যা ইচ্ছা খাও, কিন্তু ওই গাছের কাছে যেয়ো না, গেলে তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’
এদিকে আদম (আ.) বেহেশতে সব রকম আরাম-আয়েশ ও সুখৈশ্বর্যের মধ্যে দিন কাটালেও একজন সঙ্গীর অভাবে পীড়িত হচ্ছিলেন। আল্লাহ তাঁর মনের কথা বুঝতে পেরে একদিন আদমের (আ.) নিদ্রিত অবস্থায় তাঁর বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। আল্লাহ তাঁদের দুজনকে একটি গাছ দেখিয়ে এর ফল খেতে বিশেষভাবে নিষেধ করেন।
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা আ’রাফ-এর ১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর আমি বললাম, হে আদম! তুমি তোমার সঙ্গিনীকে নিয়ে জান্নাতে বাস করো এবং যেখানে ইচ্ছা যাও বা যা ইচ্ছা খাও, কিন্তু ওই গাছের কাছে যেয়ো না, গেলে তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’
কিন্তু ইবলিস বা শয়তানের প্ররোচনায় আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) ওই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে ফেলেন। আর তখনই তাঁরা উপলব্ধি করেন যে তাঁরা নগ্ন। তাঁরা গাছের পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁদের অবাধ্যতা বা সীমা লঙ্ঘনের শাস্তিস্বরূপ তাঁদের দুজনকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেন।
লোকবিশ্বাস মতে, আদম (আ.) সরণ দ্বীপে (বর্তমান সিংহল) ও হাওয়া (আ.) জেদ্দায় পতিত হন। আর এই লোকবিশ্বাস থেকেই শ্রীলঙ্কার ‘অ্যাডামস পিক’ বা ‘আদমগিরি’ মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই পবিত্র বিবেচিত হয়।
আদমের (আ.) ইবাদতে সন্তুষ্ট হয়ে অবশ্য আল্লাহ দীর্ঘদিন পর আদম (আ.) ও হাওয়াকে (আ.) পুনর্মিলিত করেন। উভয়ের মিলনে প্রতিবার তাঁদের এক জোড়া করে সন্তান (একটি কন্যা ও একটি পুত্র) জন্মে। এই পুত্র-কন্যাদের (ভাই-বোন) মধ্যে বিয়ে হয় এবং এভাবে তাঁদের সন্তানসন্ততি দিয়ে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ব্যাবিলনীয় পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে মানবসৃষ্টি সম্পর্কে এই সেমিটীয় বিবরণীর অনেক মিল রয়েছে। ওন্ড টেস্টামেন্টে অবশ্য আদম বা প্রথম মানব সৃষ্টির বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘পরে ঈশ্বর আপনার আদলে মানুষ সৃষ্টি করলেন; তাদের পুরুষ ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করলেন’ এবং ‘সদা প্রভু ঈশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে আদমকে নির্মাণ করলেন এবং তাঁর নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণবায়ু প্রবেশ করালেন। তাতে মানুষ সজীব প্রাণী হলো।’
ধারণা করা হয়, আদম (আ.) পৃথিবীতে প্রায় এক হাজার বছর বেঁচে ছিলেন।
সূত্র: ‘আদম’, যার যা ধর্ম, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪