বদর যুদ্ধের দিন আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.) যুদ্ধের ময়দানে এমন বেপরোয়াভাবে শত্রুপক্ষের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকেন যে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু শত্রুপক্ষের এক লোক বারবার ঘুরেফিরে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। আর আবু উবাইদা (রা.) তার সামনে থেকে সরে যেতে লাগলেন, যেন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। লোকটি এবার ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করল। আবু উবাইদা (রা.) সেখানেও তাকে এড়িয়ে চললেন। অবশেষে সে শত্রুপক্ষ ও আবু উবাইদা (রা.)–এর মাঝখানে এসে বাধা হয়ে দাঁড়াল। আবু উবাইদা (রা.) তখন তাকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলেন। লোকটি মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। গড়িয়ে পড়া সেই লোকটি ছিল আবু উবাইদা (রা.)–এর কাফের পিতা আবদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ।
এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে সুরা মুজাদালাহর ২২ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি এমন কোনো সম্প্রদায় পাবে না, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, অথচ ভালোবাসে তাদের যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরোধিতা করে; হোক না তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা বা জ্ঞাতিগোত্র। আল্লাহ তাদের অন্তরে বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করেছেন ও নিজের রুহ দিয়ে তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার নিচে নদী বইবে। সেখানে তারা চিরকাল বাস করবে। আল্লাহ তাদের ওপর প্রসন্ন এবং তারাও আল্লাহর অনুগ্রহে সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর দল। দেখো, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।’ (সুরা মুজাদালাহ, আয়াত: ২২)
আরেকবার ওহুদ যুদ্ধে রাসুল (সা.)–এর দাঁত ভেঙে যায়। লৌহবর্মের দুটি পেরেক তাঁর মুখে বিঁধে গিয়েছিল। আবু বকর (রা.) সেগুলো তোলার জন্য রাসুল (সা.)–এর কাছে আসছিলেন। আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.) তাঁকে বললেন, হে আবু বকর (রা.), দয়া করে আমাকে এ কাজটি করতে দিন। আবু বকর (রা.) আবু উবাইদা (রা.)-কে অনুমতি দিলেন। হাত দিয়ে পেরেক তুললে বারবার পিছলে যেতে পারে, তাতে রাসুল (সা.)–এর কষ্ট হবে। তাই তিনি তাঁর দাঁত দিয়ে পেরেক তোলার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথম পেরেক আবু উবাইদা (রা.) নিজের সামনের একটি দাঁত ও নিচের একটি দাঁতের সাহায্যে তুলে নিলেন। কিন্তু হারালেন নিজের সামনের একটি দাঁত। আর দ্বিতীয় পেরেকটিও সামনের অপর একটি দাঁত ও নিচের একটি দাঁত দিয়ে টান দিয়ে খুললেন। এবারও হারালেন সামনের আরেকটি দাঁত।
আবু বকর (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম, সামনের দুটি দাঁত নেই এমন লোকদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন হলেন আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)।
একবার খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধিদল রাসুল (সা.)–এর দরবারে হাজির হয়ে বলল, ‘আপনার সঙ্গীদের মধ্য থেকে আপনার মনোনীত কাউকে আমাদের সঙ্গে পাঠান, যিনি আমাদের কিছু বিতর্কিত সম্পদের ফয়সালা করে দেবেন।’
রাসুল (সা.) জবাবে বললেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে একজন আমানতদার ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তিকে পাঠাব।’ নবী করিম (সা.)–এর কথা শুনে সাহাবিদের প্রত্যেকে কামনা করছিলেন যেন তাঁকে পাঠানো হয়। হজরত উমর (রা.) বলেন, ‘জীবনে শুধু সেদিনই আমি নেতৃত্বের জন্য লোভ করেছিলাম। এর একমাত্র কারণ ছিল, আমি যেন হতে পারি রাসুল (সা.)–এর প্রশংসার পাত্র।’
উমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের সঙ্গে জোহরের নামাজ শেষ করে ডানে–বাঁয়ে তাকাতে লাগলেন। আর আমিও তাঁর নজরে পড়ার জন্য আমার গলা সামান্য উঁচু করতে লাগলাম। রাসুল (সা.) তাঁর চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে একসময় আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)–কে দেখতে পেলেন। তাঁকে ডেকে তিনি বললেন, ‘তুমি তাদের সঙ্গে গিয়ে সত্য আর ন্যায়ের ভিত্তিতে তাদের বিতর্কিত বিষয়টির ফয়সালা করে দাও।’ তখন আমি মনে মনে বললাম, আবু উবাইদা (রা.) মর্যাদাটি ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে কুরাইশ কাফেলার গতিবিধি অনুসরণের জন্য একদল সাহাবিকে পাঠিয়ে আবু উবাইদাকে তাঁদের আমির নিযুক্ত করেন। ওহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা পরাজয়ের মুখে পড়লে এবং ‘মুহাম্মদ কোথায়? মুহাম্মদ কোথায়?’ বলে অবিশ্বাসীরা জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকলে আবু উবাইদা বুক পেতে রাসুল (সা.)-কে অবিশ্বাসীদের তির থেকে রক্ষা করেছিলেন। এই কাজে তিনি ছিলেন ১০ জনের একজন।
হজরত আবু বকর (রা.) খলিফা হওয়ার পর আবু উবাইদা (রা.) তাঁর উপদেষ্টা ও সাহায্যকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হিজরি ১৩ সনে আবু বকর (রা.) সিরিয়ায় অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। আবু উবাইদাকে সিরিয়ার হিমস, ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ানকে সিরিয়ার দামেস্ক, শুরাহবিলকে জর্দান এবং আমর ইবনুল আসকে ফিলিস্তিনে যাত্রার নির্দেশ দেন। সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন আবু উবাইদাকে। দামেস্ক, হিমস, লাজোকিয়া প্রভৃতি শহরে বিজয় আসে আবু উবাইদা (রা.)–এর হাতে।