সুরা মায়িদায় বিশ্বাসীদের জন্য নির্দেশ

সুরা মায়িদা পবিত্র কোরআনের পঞ্চম সুরা। ষষ্ঠ হিজরিতে হুদাইবিয়ার চুক্তির পর মদিনায় অবতীর্ণ। ১৬ রুকু, ১২০ আয়াত। এতে ধর্মনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নির্দেশনা রয়েছে। হজের সময় হালাল-হারাম, অজু, গোসল ও তায়াম্মুম, মদ্যপান, জুয়া সম্পর্কে বিধান রয়েছে। মরিয়মপুত্র ঈসা ও হাওয়া বিবির উল্লেখ করা হয়েছে।

সুরাটির ১ থেকে ৫ আয়াতে বলা হয়েছে অঙ্গীকার রক্ষা, ইহরাম অবস্থায় শিকারে নিষেধোজ্ঞা, নিষিদ্ধ প্রাণী, ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা, হালার জিনিসের পবিত্রতা, সতী মেয়েদের বিয়ে এবং শিকারের বিধান নিয়ে। ৬ আয়াতে রয়েছে নামাজের জন্য অজু ও তায়াম্মুমের বিধান। ৭ থেকে ১১ আয়াতে রয়েছে মুমিনদের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বনের নির্দেশ। ১২ থেকে ২৬ আয়াতে রয়েছে বনি ইসরাইলের প্রতি উপদেশ এবং তাদের সীমালঙ্ঘনের ইতিহাস। ২৭ থেকে ৩১ আয়াতে রয়েছে আদমের এক পুত্রের হাতে আরেক পুত্র হত্যার ঘটনা। ৩৩ থেকে ৩৪ আয়াতে রয়েছে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের জন্য বিধান। ৩৫ থেকে ৩৭ আয়াতের বিষয় তাকওয়া, অছিলা ও জিহাদ। ৩৮ থেকে ৪০ আয়াতে চোরের দণ্ড। ৪১ থেকে ৫০ আয়াতে রয়েছে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করার নির্দেশ। ৫১ থেকে ৮৬ আয়াতে রয়েছে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক ও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে মুমিনদের প্রতি নির্দেশনা।

৮৭ থেকে ১০৮ আয়াতে রয়েছে মুমিনদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিধান। ১০৯ থেকে ১২০ আয়াতে রয়েছে ঈসা (আ.)–এর রিসালাত, মাজেজা ও দাওয়াত। কিয়ামতের দিন তাঁকে আল্লাহর প্রশ্ন।

অঙ্গীকার পূরণ করার নির্দেশ

সুরার শুরুতে মানুষ-মানুষের মধ্যে সব বৈধ চুক্তি ও অঙ্গীকার পূরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করবে। যেসব জন্তুর কথা তোমাদেরকে বলা হচ্ছে তা ছাড়া চতুষ্পদ গবাদিপশুকে তোমাদের জন্য হালাল করা হলো, তবে এহরামরত অবস্থায় (হজ বা ওমরাহর সময়) শিকার হালাল মনে করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ যা ইচ্ছা আদেশ করেন।’

বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! অবমাননা কোরো না আল্লাহর নিদর্শনের, পবিত্র মাসের, কোরবানির জন্য কাবায় পাঠানো পশুর, গলায় মার্কামারা মালা পরানো পশুর আর তাদের যারা পবিত্র ঘরে আসে তাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির আশায়। যখন তোমরা এহরামমুক্ত হবে তখন শিকার করতে পারো। তোমাদের মসজিদ-উল-হারামে বাধা দেওয়ার জন্য কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন কখনো তোমাদেরকে সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও আত্মসংযমে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অপরকে সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ্ তো শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ১-২, কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)

হারাম খাদ্য–পানীয়

আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত পশু, রক্ত ও শূকর মাংস, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নামে জবাই-করা পশু আর গলা-চিপে-মারা জন্তু, বাড়ি-খাওয়া মরা জন্তু, পড়ে মরা জন্তু, শিঙের ঘায়ে মরা জন্তু ও হিংস্র পশুতে যাওয়া জন্তু, তবে তোমরা যা জবাই করে পবিত্র করেছ তা ছাড়া। আর স্মৃতি পূজার বেল। ওপর বলি দেওয়া আর তির দিয়ে তোমাদের ভাগ্য নির্ণয় করা, এসব অনাচার। আজ অবিশ্বাসীরা তোমাদের ধর্মের বিরোধিতা করতে সাহস করছে না, তো তাদেরকে ভয় কোরো না, শুধু আমাকে ভয় করো। আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম মনোনীত করলাম। তবে যদি কেউ ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়, কিন্তু ইচ্ছা ক'রে পাপের দিকে না ঝোঁকে (তার জন্য) আল্লাহ তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’

আল্লাহ আরও বলেছেন, ‘লোকে তোমাকে প্রশ্ন করে, তাদের জন্য কী হালাল করা হয়েছে? বলো, সমস্ত ভালো জিনিস তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে, আর শিকারি পশুপাখি যেগুলোকে তোমরা শিকার শিক্ষা দিয়েছ, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, তারা যা তোমাদের জন্য ধরে তা খেতে পারবে। আর এতে তোমরা আল্লাহর নাম নেবে ও আল্লাহকে ভয় করবে। আল্লাহ্ হিসাবগ্রহণে অত্যন্ত তৎপর।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৩-৪, কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)

অজু ও গোসলের নিয়ম

আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নামাজের জন্য দাঁড়াও তখন তোমাদের মুখ হাত কনুই পর্যন্ত ধোবে ও তোমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে নেবে, আর গিট পর্যন্ত ধোবে। যদি তোমরা অপবিত্র থাকো তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। যদি তোমরা অসুস্থ থাকো বা সফরে থাকো বা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে। আসো কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে সংগত হও, আর পানি না পাও, তবে তাইয়াম্মুম করবে। পরিষ্কার মাটি দিয়ে এবং তা মুখে ও হাতে বুলিয়ে নেবে। আল্লাহ্ তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না এবং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান ও তোমাদের ওপর তাঁর অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে পারো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৬, কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)

হাবিল-কাবিলের ঘটনা

হজরত আদম (আ) এর দুই ছেলে হাবিল-কাবিলের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। কাবিল আপন ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল।

আল্লাহ বলেন, ‘আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদের ভালো তবে শোনাও। যখন তারা দুজনে কোরবানি করেছিল তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে খুন করবই। অপরজন বলল, আল্লাহ্ সংযমীদের কোরবানি কবুল করেন।

‘আমাকে খুন করার জন্য তুমি হাত তুললেও তোমাকে খুন করার জন্য আমি হাত তুলব না; আমি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালককে ভয় করি।

‘আমি চাই, তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বইবে ও বাস করবে আগুনে। আর এটাই জালিমদের কর্মফল। তারপর তার মন তাকে ভাইকে খুন করতে উত্তেজিত করল ও সে (কাবিল) তাকে (হাবিলকে) হত্যা করল, তাই সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো।

‘তারপর আল্লাহ্ পাঠালেন এক কাক যে তার ভাইয়ের লাশ কীভাবে গোপন করা যায় তা দেখাবার উদ্দেশ্যে মাটি খুঁড়তে লাগল। সে বলল, হায়! আমি কি এ কাকের মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি। তারপর সে অনুতপ্ত হলো। (সুরা মায়িদা, আয়াত: ২৭–৩১, কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)

ডাকাত, রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিশৃঙ্খলাকারীদের শাস্তি

কোরআনে আছে, ‘যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ও পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করে তাদের শাস্তি এই যে তাদেরকে হত্যা করা হবে বা ক্রুশবিদ্ধ কর হবে বা উল্টো দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে বা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। পৃথিবীতে এ-ই তাদের লাঞ্ছনা, আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।’

আল্লাহ আরও বলেছেন, ‘তবে, তোমাদের আয়ত্তে আসার পূর্বে যারা তওবা করবে তাদের জন্য (এ-শাস্তি) নয়। সুতরাং জেনে রেখো যে আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত ৩৩-৩৪, কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)