ওয়াকফ আরবি শব্দ, এর অর্থ ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে মুক্ত কোনো সম্পত্তির হেফাজত করা। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘ভারতের মুসলমান ওয়াকফ বৈধকরণ আইন’-এ প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ওয়াকফ অর্থ কোনো মুসলমান কর্তৃক তাঁর সম্পত্তির কোনো অংশ এমন কাজের জন্য স্থায়ীভাবে দান করা; যা মুসলিম আইনে ‘ধর্মীয়, পবিত্র বা সেবামূলক’ হিসেবে স্বীকৃত।
ওয়াকফ-এর সঙ্গে রোমান আইনের ‘সম্পত্তি অর্পণ’ ও হিন্দু আইনের ‘দান’-এর তুলনা করা যায়। ধর্মীয়, শিক্ষাসংক্রান্ত বা অন্য কোনো জনহিতকর কাজের উদ্দেশ্যে কতিপয় শর্তসাপেক্ষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ওয়াকফরূপে দান করা যায়।
ওয়াকফের বৈশিষ্ট্য হলো: ১. এটি একটি স্থায়ী ব্যবস্থা, অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য করা যায় না; ২. এটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয় এবং কোনো অবস্থায়ই এটিকে স্থগিত বা মুলতবি করা যায় না; ৩. এটি একটি অপ্রত্যাহারযোগ্য আইনি চুক্তি এবং ৪. ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো বাজেয়াপ্ত করা যায় না।
ওয়াকফ তিন প্রকার: ওয়াকফ ফি লিল্লাহ, ওয়াকফ আলাল আওলাদ (অর্থাৎ ব্যক্তিগত ওয়াকফ) ও মিশ্র ওয়াকফ। কেবল ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে সৃষ্ট ওয়াকফকে বলা হয় ওয়াকফ ফি লিল্লাহ। উৎসর্গকারীর নিজের কিংবা পরিবার বা বংশধরদের ভরণপোষণ বা উপকারার্থে ওয়াকফ করা হলে তাকে বলা হয় ওয়াকফ আলাল আওলাদ। আর মিশ্র ওয়াকফে ধর্মীয় ও দাতব্য প্রকৃতির সর্বজনীন উদ্দেশ্য এবং উৎসর্গকারীর পরিবার বা বংশধরদের উপকার দুটি বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ওয়াকফ তিন প্রকার: ওয়াকফ ফি লিল্লাহ, ওয়াকফ আলাল আওলাদ (অর্থাৎ ব্যক্তিগত ওয়াকফ) ও মিশ্র ওয়াকফ। কেবল ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে সৃষ্ট ওয়াকফকে বলা হয় ওয়াকফ ফি লিল্লাহ। উৎসর্গকারীর নিজের কিংবা পরিবার বা বংশধরদের ভরণপোষণ বা উপকারার্থে ওয়াকফ করা হলে তাকে বলা হয় ওয়াকফ আলাল আওলাদ। আর মিশ্র ওয়াকফে ধর্মীয় ও দাতব্য প্রকৃতির সর্বজনীন উদ্দেশ্য এবং উৎসর্গকারীর পরিবার বা বংশধরদের উপকার দুটি বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ওয়াকফের আইনগত বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াকফকারীর পরিবারের এক সদস্য প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করলে আদালত পরলোকগত দানকারীর পক্ষে রায় দেন।
পরিবার ও সন্তানসন্ততির কল্যাণার্থে ব্যক্তিগত ওয়াকফ-ব্যবস্থা ইসলামে গোড়া থেকেই স্বীকৃত ছিল। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে আবুল ফাতা মোহাম্মদ বনাম রসময় মামলার রায়ে প্রিভি কাউন্সিল ওয়াকফ-আলাল-আওলাদকে অবৈধ ঘোষণা করে। তখন এই রায়কে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের লঙ্ঘন বলে ভারত সরকারের কাছে অভিযোগ করা হয়। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমান ওয়াকফ বৈধকরণ আইন পাস হয়; যার ফলে প্রিভি কাউন্সিলের ওই রায়টি অকার্যকর গণ্য হয়। পরে বেঙ্গল ওয়াকফ অ্যাক্ট ১৯৩৪ দ্বারা ওয়াকফ ভূসম্পত্তির ব্যবস্থাপনা কাঠামোর ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়।
একজন মুসলমান তাঁর সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি ইচ্ছাপত্রমূলে কাউকে দিতে পারেন না ও সেভাবে কাউকে সম্পত্তি দিলেও ইচ্ছাপত্রকারীর মৃত্যুর পর কোনো ওয়ারিশ তাতে আপত্তি করলে তা কার্যকর হয় না।
১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ওয়াকফ অধ্যাদেশের অধীন ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইনের আরও কিছু সংশোধন করা হয়। ১৯৮৮ সালের ওয়াকফ অধ্যাদেশ ও ১৯৯৮ সালের ওয়াকফ অধ্যাদেশ দ্বারাও ওই আইনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্তমানে একটি ওয়াকফ ডাইরেক্টরেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে।
১৯১৩ সালের ওয়াকফ বৈধকরণ আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো মুসলমান যখন তাঁর কোনো সম্পত্তি ধর্মীয় বা দাতব্য কাজ বলে মুসলমান আইনে স্বীকৃত কোনো উদ্দেশ্যে স্থায়ীভাবে উৎসর্গ করেন, তখন সেই উৎসর্গকে ওয়াকফ বলা হয়। ওয়াকফ অবশ্যই স্থায়ী হবে। ওয়াকফ আইন অনুসারে স্থাবর ও অস্থাবর যেকোনো ধরনের সম্পত্তি ওয়াকফ করা যেতে পারে। যেকোনো সুস্থ মনের সাবালক মুসলমান ওয়াকফ করতে পারেন।
ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপনাকে মুতওয়াল্লি বলা হয়। তিনি আল্লাহর অনুমোদিত প্রতিনিধি হিসেবে ওয়াকফ সম্পত্তির দেখভাল করেন। তাঁকে মৌখিকভাবে কিংবা যে চুক্তি বা দলিল অনুযায়ী ওয়াকফ করা হয়েছে তার দ্বারা নিয়োগ দেওয়া হয়।
ওয়াকিফ অর্থাৎ ওয়াকফকারী নিজেকেও মুতওয়াল্লি হিসেবে নিযুক্ত করতে পারেন। ওয়াকফ দলিলে তিনি মুতওয়াল্লি-পরম্পরার রীতি-নিয়মও করে যেতে পারেন। ওয়াকফের মাধ্যমে সম্পত্তি পুরোপুরি আল্লাহর মালিকানায় স্থানান্তরিত হওয়ায় ওয়াকিফ কিংবা ট্রাস্ট সম্পত্তির ব্যবস্থাপক আর সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারেন না। ওয়াকফ দলিলে অনুরূপ বিধান থাকলে সে ক্ষেত্রে মুতওয়াল্লি নিজেও উত্তরাধিকারী নিয়োগ করতে পারেন।
ওয়ারিশ, উত্তরাধিকারী কেউ যদি কোনো ইচ্ছাপত্র না রেখে মারা যান, তবে প্রচলিত বিধান অনুযায়ী তাঁর স্ত্রী, সন্তানসন্ততি কিংবা নিকট-আত্মীয়ের মধ্যে যাঁরা, তাঁরা তাঁর সম্পত্তির মালিক হন। সাধারণত ইচ্ছাপত্র রেখে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে ইচ্ছাপত্রের নির্দেশ অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির মালিক হতে পারেন। যদিও মুসলমানদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ইচ্ছাপত্র খুব বেশি কার্যকর হয় না।
কারণ, একজন মুসলমান তাঁর সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি ইচ্ছাপত্রমূলে কাউকে দিতে পারেন না এবং সেভাবে কাউকে সম্পত্তি দিলেও ইচ্ছাপত্রকারীর মৃত্যুর পর কোনো ওয়ারিশ তাতে আপত্তি করলে তা কার্যকর হয় না।
সূত্র: ‘ওয়াকফ’, যার যা ধর্ম, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪