সাহাবিদের যুগে বিয়ে

সাহাবিদের যুগে বিয়ে ছিল বেশ বৈচিত্র্যময়। বিয়ের আয়োজন ছিল সাদামাটা, প্রস্তুতি ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার। সকালবেলা একজন সাহাবি ছিলেন অবিবাহিত। কবে বিয়ে করবেন, কাকে বিয়ে করবেন, সেটা সকালেও জানা ছিল না। সন্ধ্যায় তিনি সংসার শুরু করতেন! বিয়ের কারণে পাড়াপড়শির নির্ঘুম বিরক্তি সাহাবিদের যুগে ছিল না।

বিয়ের প্রথম ধাপ হচ্ছে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া। পুরুষ সাহাবিরা নিজেদের বিয়ের প্রস্তাব সরাসরি পাত্রীপক্ষের কাছে নিয়ে যেতেন। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। তিনি প্রথমে সংকোচ বোধ করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে অভয় দেন। এরপর নবী–কন্যা ফাতেমাকে (রা.) বিয়ে করেন আলী (রা.)।

সম্ভ্রান্ত নারীরাও কারও মাধ্যমে নিজেদের বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারতেন। খাদিজা (রা.) তাঁর বান্ধবী নাফিসা (রা.)-র মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। এমনকি কয়েকজন নারী সাহাবিও সরাসরি এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এমন একজন প্রস্তাবকারী ছিলেন খাওলা বিনতে হাকিম (রা.)। তাঁর স্বামী উসমান ইবনে মাজউন (রা.) ইন্তেকালের পর তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বিয়ে করেননি।

একজন নারীর রাসুল (সা.)–কে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার ঘটনা চৌদ্দ শ বছর পর বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কিন্তু সাহাবিদের সময় এটা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তবে সাহাবিরা যখন তাঁদের সন্তানদের কাছে ঘটনাটি বলেন, তাঁরা অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন, সেই নারী কীভাবে রাসুল (সা.)–কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন!

নারীরা নিজেদের বিয়ে নিয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারতেন। কোনো কারণে পাত্র পছন্দ না হলে ‘না’ করে দিতে পারতেন। পাত্র ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক মর্যাদার অধিকারী হলেও নারীদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হতো।

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি, খলিফাতুল মুসলিমিন। তিনি আবু বকর (রা.)-র মেয়ে উম্মে কুলসুম (রাহি.)-কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু ওমরের (রা.) মেজাজের কারণে সে নারী বিয়েতে রাজি না হয়ে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব পরে অন্য এক উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন আলীর (রা.) মেয়ে উম্মে কুলসুম বিনতে আলী (রাহি.)।

সাহাবিদের বিয়েতে প্রথমদিকে মোহরানা অনেক কম ছিল। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) খলিফা হওয়ার পর মুসলমানদের অর্থনৈতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে। তখন বিয়েতে মোহরানার পরিমাণ বেড়ে যায়। খলিফা মোহরানা কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করতে চেয়েছিলেন। তাতে এক নারী আপত্তি জানান। তিনি কোরআনের একটি আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, এটা তিনি করতে পারেন না। খলিফা সেই নারীর আপত্তি আমলে নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ মোহরানা নির্ধারণ করা থেকে বিরত থাকেন।

তিনি উম্মে কুলসুম বিনতে আলীকে বিয়ে করার সময় মোহরানা হিসেবে ৪০ হাজার দিরহাম দেন। সাহাবিদের যুগে ১২ দিরহাম দিয়ে একটি ভেড়া কেনা যেত।

সাহাবিদের মধ্যে অন্যতম ধনী সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) স্ত্রীকে মোহরানা বাবদ ৩০ হাজার দিরহাম দিয়েছিলেন।

সাবিত ইবনে কায়স (রা.) তাঁর স্ত্রীকে মোহরানা হিসেবে একটি বাগান দেন, যা সেই যুগ হিসেবে মোটা অঙ্কের মোহরানা।

সাহাবিদের যুগে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছিল সীমিত। এ কারণে বিয়ে ছিল সহজ। বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত দিতে হবে, না দিলে কে কী মনে করবেন—এমন মনোভাব তখন ছিল না। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সাহাবিদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। তাই বলে রাসুলুল্লাহকে (সা.) প্রত্যেক সাহাবিই বাধ্যতামূলকভাবে বিয়েতে দাওয়াত দিতেন না। কখনো কখনো এমনও হতো, কোনো সাহাবির বিয়ের কয়েক দিন পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সে খবর পেতেন। এমনটা হয়েছিল আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) এবং জাবির ইবনে আব্দিল্লাহ (রা.)-র সঙ্গে।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও মোটেই এ প্রত্যাশা করতেন না যে প্রত্যেক সাহাবিই তাঁকে বিয়ের দাওয়াত দেবেন বা তাঁকে জানিয়ে বিয়ে করবেন। এ যুগে যেসব সামাজিক বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে আমরা বিয়ের আয়োজন করি, সে সময় মোটেও সেসব ছিল না।

আরিফুল ইসলাম: লেখক