মৃত্যু কি শেষ, মৃত্যু আসলে কী

জীবনের চিরসত্যের নাম মৃত্যু। চাইলেও মরতে হবে, না চাইলেও মৃত্যু আসবে। মানবজীবনের সব মিথ্যার মধ্যে একটি বিষয় যদি চিরসত্য হয়ে থাকে, তবে সেটা মৃত্যু। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মরণশীল।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ১৮৫ ও ৩৫; সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৫৭) জন্ম লাভ করেছি মানে মৃত্যু একদিন আসবেই। এই পৃথিবীতে কোনো প্রাণীই অমরত্ব লাভ করতে পারেনি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘হে নবী! তোমার পূর্বেও আমি কোনো মানুষকে অমরত্ব দান করিনি। তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরকাল বেঁচে থাকবে?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩৪)

মৃত্যু কী? মরে যাওয়া মানে কী শেষ হয়ে যাওয়া, নাকি নতুন কোনো কিছুর সূচনা? মরে যাওয়া মানে কি হারিয়ে যাওয়া, নাকি বেঁচে যাওয়া? প্রকৃত জীবনের সূচনা ঘটা?

মৃত্যু মানে ইহলৌকিক জীবনের ইতি টেনে পারলৌকিক জীবনে প্রবেশ করা। রুহ বা আত্মার জগতে স্থানান্তর। ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনে যাত্রা। মৃত্যু মানে জীবনের রূপান্তর। মৃত্যু হওয়া মানে হারিয়ে যাওয়া কিংবা শেষ হয়ে যাওয়া নয়; বেঁচে যাওয়া কিংবা চিরস্থায়ী জীবনে প্রবেশ করা।

মরতে যখন হবেই, তাহলে জন্ম কেন হলো? এই জীবনে কেন এলাম আমরা? ভিন্ন একটি জগতে কেনই বা আবার যেতে হবে আমাদের? একটি জগতের জন্যই মূলত এতগুলো জগতের সৃষ্টি। জন্ম লাভ করা, আবার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। যাত্রাটা অনেকটা এমন: মনে করুন আপনি সৌদি আরব যাবেন। উদ্দেশ্য হজব্রত পালন করা। বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলেন। এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেনে বসলেন। এরপর সৌদি আরব পৌঁছে আবার বাস বা গাড়িযোগে হোটেলে গেলেন। সর্বশেষ কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য সফল হলো—আপনি হজব্রত পালন করতে সক্ষম হলেন। প্রতিটি মানুষের প্রকৃত গন্তব্য আখিরাত।

পরকালীন জীবনে আপনি কেমন থাকবেন না থাকবেন, তার প্রস্তুতিস্থল এই পৃথিবী। পৃথিবী একটি যাত্রাপথ। যেন সামান্যক্ষণের বাসযাত্রা বা উড়োজাহাজ ভ্রমণ। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য পুনরুত্থিত হওয়া, ওপারের জীবনে সফল হতে পারা। পুনরুত্থিত হতেই হবে। এটাই চিরসত্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ–তাআলা এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন তিনিই।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৬৬)

পৃথিবী হলো দারুল আমল, আমাদের কর্মক্ষেত্র। আখিরাত হলো দারুল জাজা, সেটি প্রতিদানের জগৎ। এই দুটির মাঝখানে মৃত্যু হলো ‘দারুল আমল’ থেকে ‘দারুল জাজা’য় যাওয়ার দরজা। কর্মের জগতে রয়েছে কর্ম; রয়েছে অকর্মের অবকাশ। কর্মজগতের কর্ম আর অকর্মের ভিত্তিতে সজ্জিত হবে প্রতিদানের জগৎ। সেখানে থাকবে শুধু প্রতিদান। থাকবে না কোনো কর্ম বা অকর্মের অবকাশ।

আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর তোমাদের কর্মফল তো পূর্ণমাত্রায় বুঝিয়ে দেওয়া হবে কিয়ামতের দিন। এরপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হবে, সেই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন তো ছলনাময় ভোগ ছাড়া কিছুই নয়। (সুরা আল ইমরান, আয়াত: ১৮৫)

গোটা মানবজীবনটাই একটি পরীক্ষাকেন্দ্র। সীমিত প্রশ্ন। সুনির্দিষ্ট উত্তর। পরীক্ষা শেষে অপেক্ষমাণ চূড়ান্ত সফলতার হাতছানি অথবা শাস্তি। আল্লাহ–তাআলা এরশাদ করেন, ‘পুণ্যময় তিনি, যাঁর (কুদরতের) হাতে রাজত্ব। তিনি সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন; কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, মহাক্ষমাশীল।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ২)

সুতরাং প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে পরীক্ষার হলের সময়টুকুকে যথার্থ মূল্যায়ন করে এবং সঠিক উত্তর প্রদানের মাধ্যমে চূড়ান্ত সফলতা অর্জনে সচেষ্ট হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সে, যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য উপার্জন করে। আর অক্ষম সে, যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে এবং আল্লাহর প্রতি অলীক প্রত্যাশা পোষণ করে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৪৫৯)

হজরত ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোক কে? তিনি (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি অধিক হারে মৃত্যুকে স্মরণ করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত থাকে।’ (ইবনে মাজাহ)

পরীক্ষাকেন্দ্রে বা পরীক্ষার হলে কি কেউ সব সময় থেকে যায়? সেখানে কি থেকে যাওয়া যায়? যায় না। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে মনে হয়, বেঁচে গেলাম। এ জন্যই ইহজগৎকে কারাগারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার আর কাফিরের জন্য জান্নাত।’ এর মানে কারাগারে যেমন মানুষ সব সময় থাকে না, থাকতে চায় না; দুনিয়াও মুমিনের সব সময় থাকার স্থান নয়। দুনিয়া হলো কেবলই আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং প্রকৃত জীবনের পাথেয় তৈরিতে ব্যস্ত থাকা।

মিরাজ রহমান: লেখক ও গবেষক