রাসুলে করিমকে (সা.) নামাজ পড়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। তিনি নামাজ পড়া শুরু করলেন। আয়েশার বর্ণনাক্রমে উরওয়া ইবনে আল-জুবায়ের এবং তাঁর বর্ণনাক্রমে সালিহ ইবনে কায়সান আমাকে বলেছেন, ‘রাসুলের ওপর প্রথমে প্রতি ওয়াক্তের জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়ার নির্দেশ ছিল। পরে আল্লাহ্ বাড়ির জন্য তা বাড়িয়ে চার রাকাত করলেন আর সফরের বেলায় পূর্ববর্তী দুই রাকাতের আদেশই বলবৎ রাখলেন।’
জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, নামাজ পড়ার যখন আদেশ আসে, তখন জিবরাইল এসেছিলেন রাসুলের (সা.) কাছে। রাসুল (সা.) তখন মক্কায় পাহাড়ে অবস্থান করছিলেন। জিবরাইল তাঁর পায়ের গোড়ালি দিয়ে উপত্যকায় একটি গর্ত করেন এবং সেই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে পানির ধারা। সেই পানিতে অজু করলেন জিবরাইল আর তা পর্যবেক্ষণ করলেন রাসুলে করিম (সা.)। নামাজের আগে কেমন করে নিজেকে পবিত্র করতে হয়, তা দেখানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। জিবরাইলের অনুকরণে রাসুলে করিম (সা.) অজু করলেন। জিবরাইল রাসুলের (সা.) সঙ্গে প্রথমে নামাজ পড়লেন—রাসুল (সা.) পড়লেন তাঁর নিজের নামাজ। জিবরাইল তারপর প্রস্থান করলেন। গৃহে প্রত্যাবর্তন করে রাসুলে করিম (সা.) জিবরাইলের অনুকরণে নামাজ পড়লেন খাদিজাকে দেখানোর জন্য। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে খাদিজাও নামাজ আদায় করলেন। তারপর রাসুলে করিম (সা.) আবার নামাজ পড়লেন খাদিজাকে সঙ্গে করে, খাদিজা নামাজে তাঁর অনুসরণ করলেন।
নাফি ইবনে জুবায়ের ইবনে মুতিম হাদিস বর্ণনায় অত্যন্ত সিদ্ধকাম পুরুষ। ইবনে আব্বাসের সূত্রে এর বর্ণনাক্রমে বনু তায়মের মুক্তি পাওয়া দাস উতবা ইবনে মুসলিম আমাকে বলেছেন, ‘রাসুলে করিমের (সা.) ওপর যখন নামাজের নির্দেশ আসে, তখন জিবরাইল রাসুলে করিমের (সা.) কাছে আসেন এবং সূর্য মধ্য গগন অতিক্রম করার পর তিনি জোহরের নামাজ পড়েন। তারপর তাঁর ছায়া আপন শরীরের দৈর্ঘে্যর সমান হলে তিনি আসরের নামাজ পড়েন। সূর্য অস্ত গেলে পড়লেন মাগরিবের নামাজ। দিগন্ত থেকে সন্ধ্যার সব চিহ্ন দূর হওয়ার পর পড়লেন এশার নামাজ। ভোরের আভাস জাগার পর তিনি তাঁর সঙ্গে পড়লেন ফজরের নামাজ। তিনি আবার এলেন পরদিন দুপুরের সময়, যখন তাঁর ছায়া আপন দেহের উচ্চতার সমান হলো, তাঁর সঙ্গে পড়লেন জোহরের নামাজ। তাঁর ছায়া যখন দুজনের ছায়ার সমান হলো তখন পড়লেন আসরের নামাজ। সূর্য অস্ত গেলে পরে তিনি মাগরিবের নামাজ পড়লেন, যেমন পড়েছিলেন আগের দিন।
রাতের তৃতীয় যাম অতিক্রান্ত হলে পরে তিনি তাঁর সঙ্গে পড়লেন তাহাজ্জুদের নামাজ। পরদিন ভোর হলো, সূর্য উঠতে অনেক বাকি, তিনি আদায় করলেন ফজরের নামাজ। তারপর তিনি বললেন, ‘হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনি আজ আর গতকাল যে নামাজ পড়লেন, তা-ই হলো নামাজের সময়।’ (সুহায়লি মনে করেন, এ কথা বলা ঠিক হয়নি। হাদিসকারেরা পাঁচ বছর পর এই বলে সম্মত হন যে, এই কাহিনি রাসুলে করিমের (সা.) মিরাজের পরদিনের ঘটনা। হিজরতের আঠারো মাস নাকি এক বছর আগে এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তবে তা ওহি নাজিল শুরু হওয়ার অনেক দিন পরের ঘটনা।) ইউনুস ইবনে জুবায়ের বলেছেন যে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক তাঁকে বলেছেন, কুফার ইয়াহিয়া ইবনে আবুল আব্বাস আল-কিন্দি বলেছেন, ইসমাইল ইবনে আইয়াস ইবনে আফিফের বাবা তাঁর বাবাকে বলতে শুনেছেন, ‘আমি তখন ব্যবসা-বাণিজ্য করি। একবার, হজের সময় আল-আব্বাসের কাছে আমি এসেছিলাম। আমরা কয়েকজন একসঙ্গে বসে ছিলাম। দেখলাম একজন লোক কাবার দিকে মুখ করে প্রার্থনা করতে দাঁড়ালেন। একটু পর একজন মহিলা এলেন এবং তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রার্থনায় যোগ দিলেন। তারপর এক যুবাপুরুষ এলেন, তিনিও তাঁদের সঙ্গে প্রার্থনায় দাঁড়ালেন। আমি আল-আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এদের ধর্ম কী? কী রকম নতুন নতুন লাগছে?’
তিনি বললেন, ‘তিনি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্। তিনি দাবি করছেন, আল্লাহ্ তাঁকে এই ধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন। খোশরোস আর কায়সারের (সিজার) সমস্ত ঐশ্বর্য নাকি তাঁর জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। মহিলাটি তাঁর স্ত্রী খাদিজা। খাদিজা তাঁর ধর্ম বিশ্বাস করেন। যুবাপুরুষটি হলেন তাঁর চাচাতো ভাই আলী। তিনিও তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।’ আফিফ বললেন, ‘আহা, আমিও যদি সেদিনই তাঁর ওপর বিশ্বাস করতাম, তাহলে আমি হতাম তৃতীয় বিশ্বাসী জন।’ (এই হাদিসের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, ইবনে ইসহাক এটি আলিদদের সমর্থনে তৈরি করেছিলেন।)
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে