রাসুল (সা.)–এর স্ত্রী সাফিয়া (রা.)–এর জীবনধারা

হজরত সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাব (রা.) ছিলেন অভিজাত ইহুদি বংশের মেয়ে। তাঁর প্রথম বিয়ে হয়েছিল ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজার বিখ্যাত কবি ও নেতা সালাম ইবনে মাশকামের সঙ্গে। সে বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে হয় হিজাজের বিখ্যাত সওদাগর কিনানা ইবনে আবিল হুকাইকের সঙ্গে। তাঁর সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল অনেক। সাফিয়া (রা.)-এর বাবা হুয়াই ইবনে আখতাব মদিনার ইহুদিদের বিখ্যাত গোত্র বনু নাদিরের প্রধান নেতা ছিলেন। প্রাচীনকাল থেকে আরবের উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বনু কুরাইজা’ ও ‘বনু নাদির’ অন্য ইহুদি গোত্রের চেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী বলে গণ্য হতো। সাফিয়ার বাবা হুয়াইকে তাঁর গোত্রের লোকেরা অত্যন্ত মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখত। সবাই তাঁর হুকুম ও নেতৃত্ব বিনা প্রশ্নে মেনে নিত।

সপ্তম হিজরির ঘটনা। খাইবারের যুদ্ধে ইহুদিরা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এ যুদ্ধে তাদের গোত্রের বিখ্যাত লোকেরা নিহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাফিয়ার বাবা, ভাই ও স্বামী ছিল। খাইবারের যুদ্ধে ইহুদিরা পরাজিত হলে মুসলিমদের হাতে প্রচুর ধনসম্পদ গনিমত হিসেবে হস্তগত হয়। বিশাল ধনী হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা সাফিয়াও যুদ্ধবন্দী হিসেবে মুসলিমদের কবলে আসে।

গনিমতের মাল বণ্টনের সময় সব বন্দীকে হাজির করা হলো। দাহহিয়া কালবি (রা.) নামের সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে একজন দাসীর আবেদন করলে তিনি সাফিয়াকে হস্তান্তর করতে বললেন। এতে সাহাবিরা আপত্তি জানান। তখন রাসুল (সা.) দাহহিয়া কালবির কাছে অন্য একজনকে তুলে দিয়ে সাফিয়াকে মুক্ত করে দেন। পরে রাসুল (সা.) সাফিয়া (রা.)-কে বিয়ে করে তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন।

মদিনায় আসার পথে রাসুল (সা.) সাফিয়া (রা.)-কে নিজের উটের পিঠে বসিয়ে পর্দা টানিয়ে তাঁকে ঢেকে দেন। এভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় যে সাফিয়া (রা.) দাসী নন, বরং তিনি রাসুল (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেছেন। বিয়ের সময় সাফিয়া (রা.)-এর বয়স ছিল ১৭ আর রাসুল (সা.)-এর বয়স ৬০ বছর।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর সাফিয়া (রা.)-এর জীবনের ধারা বদলে যায়। তিনি লেখাপড়া জানতেন। আত্মীয়দের কাছে চিঠি লিখে তাঁদের ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাতেন। এতে বহু ইহুদি ইসলাম কবুল করেন। সাফিয়া (রা.)–এর প্রচুর ধনসম্পদ ছিল। ছিলেন অত্যন্ত উদার ও দানশীল।

সাফিয়া (রা.)-এর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি ছোট শিশুদের খুব আদর করতেন। তাদের নানা রকম পোশাকে সাজাতে পছন্দ করতেন। রাসুল (সা.) তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সব সময় খুশি রাখার চেষ্টা করতেন।

সাফিয়া (রা.) ছিলেন ইলম ও ফিকাহ শাস্ত্রের কেন্দ্র। প্রায় সময়ই বহু নারী সাহাবি ও নারী তাবেঈন তাঁর ঘরে বিভিন্ন মাসয়ালা জানতে ভিড় করতেন। সাফিয়া (রা.)-এর বর্ণনা করা ১০টি হাদিস পাওয়া গেছে।

সাফিয়া (রা.) ছিলেন স্পষ্টবাদী। একবার এক দাসী খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর কাছে সাফিয়া (রা.)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে, এখনো তাঁর মধ্যে ইহুদি মনোভাব বিদ্যমান। কারণ, তিনি শনিবারকে মানেন এবং ইহুদিদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। দাসীর কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হজরত উমর (রা.) লোক মারফত সাফিয়া (রা.)-কে অভিযোগের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন।

সাফিয়া (রা.) জবাব দেন, ‘যখন থেকে আল্লাহ আমাকে শনিবারের বদলে জুমা দান করেছেন, তখন থেকে শনিবার মানার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। আর ইহুদিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকার কারণ হলো, তাদের মধ্যে আমার আত্মীয়স্বজন আছে। সে সম্পর্ক আমাকে বজায় রাখতে হয়।’

হিজরি ৩৫ সনে বিদ্রোহীরা হজরত উসমান (রা.)-কে গৃহবন্দী করে, তাঁর বাসায় সবকিছুর সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং বাসাটির চারদিক ঘেরাও করে রাখে। সেই কঠিন সময়ে সাফিয়া (রা.) তাঁর দাসীর মাধ্যমে উসমান (রা.)-এর ঘরে খাবার ও পানি পৌঁছে দিয়েছিলেন।

হিজরি ৫০ সনের রমজান মাসে ৬০ বছর বয়সে হজরত সাফিয়া (রা.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। মসজিদে নববির কাছে জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়।