বিবিসির একটি প্রামাণ্যচিত্রে ইতিহাসবিদ ও লেখক বেটানি হিউজ খাদিজা (রা.) সম্পর্কে বলেছেন, ‘স্পষ্টতই তিনি (খাদিজা) তাঁর নিজের পথ নিজে তৈরি করে নিতে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এই যে ব্যবসায়িক দক্ষতা, এটা তাঁকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেয়। খাদিজা (রা.) তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করতেন মক্কা থেকে। তাঁর ব্যবসার জন্য অনেক পণ্যবাহী যানের কাফেলা দরকার হতো, যা দিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শহরগুলোয় পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ করাতেন। স্পষ্টতই তিনি তাঁর নিজের পথ নিজে তৈরি করে নিতে অভ্যস্ত ছিলেন। (মার্গারিটা রডরিগেজ গৃহীত সাক্ষাৎকারভিত্তিক নিবন্ধ ‘বিবি খাদিজা: ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী’, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বিবিসি বাংলা অনলাইন)
যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক ফৌজিয়া বোরা লিখেছেন, ‘তিনি (খাদিজা) নিজের যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তায় একজন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিজেই কর্মচারীদের নিয়োগ করতেন। ব্যবসার জন্য কাজে লাগবে, এমন বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন লোকদের খুঁজে নিতেন তিনি। খাদিজা একজন লোকের (রাসুলুল্লাহ) কথা শুনেছিলেন, অত্যন্ত সৎ ও পরিশ্রমী বলে সুনাম ছিল যাঁর। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পর সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাঁকে একটি কাফেলার দায়িত্ব দিলেন। লোকটির (রাসুলুল্লাহ) ঐকান্তিকতা খাদিজার প্রশংসা পেল এবং কিছুকাল পর মুগ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি (খাদিজা) তাঁকে (রাসুলুল্লাহ) বিবাহ করবেন।’ (প্রাগুক্ত: বিবিসি বাংলা অনলাইন)
প্রশ্ন জাগতে পারে, ইসলামপূর্ব অন্ধকার যুগে যখন নারীরা বিভিন্ন ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন; পিতা, স্বামী ও ভাইয়ের সম্পদের কোনো অংশ পেতেন না তৎকালের নারীরা! অথচ ইতিহাসের সব গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘খাদিজা ছিলেন ধনাঢ্য নারী।’ কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? এমন একটি করুণ সময় খাদিজা এত অর্থসম্পদের মালিক হলেন কীভাবে? কোথা থেকে পেয়েছিলেন তিনি এত অর্থবিত্ত? সম্পদগুলো কি তিনি পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন নাকি মৃত স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন? কারণ, পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পূর্ণ সম্পদ পাওয়া খাদিজার জন্য সম্ভব ছিল না। কারণ, তাঁর চাচা ও ভাইয়েরা জীবিত ছিলেন। তাহলে খাদিজা (রা.) কীভাবে সম্পদশালী হলেন?
সাইয়িদা খাদিজার স্বামী আবু হালা বিন জুরারা বিন নব্বাস মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর অনেক সম্পদ ছিল। তিনি কুরাইশ বংশের ছিলেন না, ছিলেন অন্য গোত্রের; তবে ব্যবসা করতেন মক্কায়। মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা তাঁর সম্পদ নিয়ে যাননি। আর এ কারণেই খাদিজা (রা.) একাই উত্তরাধিকারসূত্রে স্বামীর সব সম্পদের মালিক হয়েছেন (খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা, ড. ইয়াসির ক্বাদি, অনুবাদ: মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, প্রচ্ছদ প্রকাশন, পৃষ্ঠা: ২১-২২)। অনেক গবেষক পৈতৃক সূত্রে খাদিজার সম্পদপ্রাপ্তির বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। পিতা ও স্বামী—উভয়ের কাছ থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদ লাভ করেছিলেন সাইয়িদা খাদিজা (রা.)।
খাদিজ (রা.)-এর ব্যবসা-বাণিজ্য ও তাঁর ব্যবসায়িক জীবন নিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন রচনায় নানা বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্রচার রয়েছে। এসব বিষয় থেকে সতর্ক থাকা জরুরি। এ ছাড়া অনেক প্রগতিশীল আধুনিকমনা লেখক খাদিজার ধনদৌলত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে অতিরঞ্জন করেন। অনেকে এমনটাও বলেন, ‘তৎকালে সুগন্ধি ও রেশমি কাপড়ের ব্যবসার বাজার একচেটিয়াভাবে খাদিজার দখলে ছিল’—ইতিহাস ঘেঁটে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া আরও অনেক লেখক এমনটাও লেখেন, ‘খাদিজার বাণিজ্য কাফেলায় উটের সংখ্যা ছিল এক হাজারের অধিক’—এ তথ্যও বানোয়াট। অনেক গবেষক আবার তাঁকে ব্যবসায়ী মানতে নারাজ। তাঁরা বলতে চান, তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি ছিলেন নিছক বিনিয়োগকারী।
মূল কথা হলো, খাদিজা (রা.) মর্যাদাসম্পন্ন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন বটে, কিন্তু অত আধিক্যপূর্ণ বাণিজ্য কাফেলার মালিক তিনি ছিলেন না। বিনিয়োগবান্ধব ব্যবসায় জড়িত ছিলেন তিনি। আবার বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যবসা তদারকও করেছেন। খাদিজা (রা.)-র ব্যাপারে তথ্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা দরকার।
মিরাজ রহমান: লেখক