হজরত শোয়াইব (আ.): পর্ব ২

হজরত শোয়াইব (আ.)–এর আবির্ভাব

মাদায়েন ও আইকা বাণিজ্যিক যোগাযোগের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের ব্যবসায়ে যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল। মাদায়েনবাসী পার্থিব লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে পারস্পরিক লেনদেনের সময় ওজনে কম দিয়ে মানুষের হক আত্মসাৎ করা শুরু করে। আল্লাহ–তাআলার সঙ্গে শরিক স্থাপন করতে থাকে। তারা গাছপালা, মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। দুর্নীতি, রাহাজানি, ছিনতাই, ধর্ষণ ও মজুতদারির মতো অন্যায় কাজ তাদের সমাজের মধ্যে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজপথের ওপর বসতি হওয়ার সুযোগ নিয়ে তারা ব্যাপক আকারে ডাকাতি ও রাহাজানিতে লিপ্ত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নিজেদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অন্যান্য জাতির লোকদের নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুলেছিল। এসব পাপে তারা এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে তারা কখনো মনে করত না যে এসব অত্যন্ত গর্হিত কাজ। বরং তারা সেসব কাজ করে গর্ববোধ করত। এভাবে সমাজের মধ্যে তারা অরাজকতা সৃষ্টি করত। তাদেরকে সঠিক পথে ডাকার জন্য এবং সুপথে পরিচালিত করার জন্য–আল্লাহ তাআলা একজন নবী পাঠান তাদের মধ্যে। হজরত শোয়াইব (আ.) নবীরূপে আবির্ভূত হন।

হজরত শোয়াইব (আ.) যথারীতি তাঁর জাতির অনাচার ও অবিচার প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হয়ে ওঠেন এবং তাদের দাওয়াতের কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি বললেন, হে আমার কওম, আল্লাহর দাসত্ব করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর স্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে। তাই ওজন ও দাড়িপাল্লা পুরা করো। মানুষকে তাদের জিনিস কম দিয়ো না এবং সংশোধনের পর তোমরা দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি কোরো না। তোমরা যদি সত্যি মুমিন হও, তাহলে এর মধ্যেই তোমাদের মঙ্গল রয়েছে। যারা ইমান এনেছে, তাদের ভয় দেখানোর জন্য, তাদেরকে আল্লাহর রাস্তা থেকে ফিরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এবং সরল পথকে বাঁকা করার নিয়তে (জীবনের) প্রতিটি পথে ডাকাত সেজে বোসো না। ওই সময়ের কথা মনে করে দেখো, যখন তোমরা (সংখ্যায়) কম ছিলে, তারপর আল্লাহ তোমাদের (সংখ্যা) বেশি করে দিলেন। চোখ খুলে দেখো যে দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছে। আমাকে যে শিক্ষাসহ পাঠানো হয়েছে, এর প্রতি যদি তোমাদের এক দল ইমান আনে এবং আর এক দল ইমান না আনে, তাহলে সবরের সঙ্গে দেখতে থাকো, যে পর্যন্ত না আল্লাহ আমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেন। আর তিনিই সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী।

এ কথা শুনে তার কওমের প্রধানেরা, যারা বড়াই করত, তারা বলল, হে শোয়াইব, আমরা তোমাকে এবং যারা তোমার সঙ্গে ইমান এনেছে, তাদেরকে আমাদের এলাকা থেকে বের করে দেব। অথবা তোমাদের ফিরে আসতে হবে আমাদের ‘পন্থা’তে।

জবাবে শোয়াইব (আ.) বললেন, আমরা সম্মত না হলেও (আমাদেরকে কি জোর করে ফিরিয়ে নেওয়া হবে)? আল্লাহ আমাদের (তোমাদের পন্থা থেকে) নাজাত দেওয়ার পরও যদি আমরা তোমাদের পন্থায় ফিরে যাই, তাহলে আমরা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপকারী হয়ে যাব। আমাদের রব আল্লাহ যদি (তা-ই) চান, তাহলে আলাদা কথা। তা না হলে আমাদের পক্ষে ওদিকে ফিরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। প্রতিটি জিনিসের ব্যাপারেই আমাদের রবের ইলম আছে। আল্লাহর ওপরই আমরা ভরসা করে আছি। হে আমাদের রব, আমাদের ও আমাদের কওমের মাঝে ঠিক ঠিক ফায়সালা করে দিন। আর আপনিই তো সবচেয়ে ভালো ফয়সালাকারী। (সুরা আরাফ, আয়াত: ৮৫-৯০)

তিনি তাঁর জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, আজ আমি তোমাদেরকে ভালো অবস্থায় দেখছি। কিন্তু আমার ভয় হয় যে তোমাদের ওপর এমন দিন আসবে, যার আজাব তোমাদেরকে ঘিরে ফেলবে। যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে আল্লাহর দেওয়া উদ্বৃত্ত তোমাদের জন্য ভালো। আমি তো তোমাদের ওপর হেফাজতকারী নই।

তিনি তাদের নামাজেরও দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জাতির লোকেরা নামাজ পড়তে অস্বীকার করে। তারা জবাব দেয়, হে শোয়াইব, তোমার নামাজ কি তোমাকে এ কথাই শেখায় যে আমাদের বাপ-দাদারা যেসব মাবুদের পূজা করত, তা আমরা ত্যাগ করব? অথবা আমাদের মাল আমাদের মর্জিমতো ব্যবহার করতে পারব না? তুমিই কি একমাত্র উঁচু মনের ও সৎ মানুষ?

শোয়াইব (আ.) বললেন, হে আমার কওম, তোমরা ভেবে দেখো, আমি যদি আমার রবের পক্ষ থেকে এক সাক্ষ্যের ওপর থেকে থাকি এবং তিনি যদি আমাকে তাঁর কাছ থেকে ভালো রিজকদিয়ে থাকেন (তাহলে এরপর তোমাদের পথভ্রষ্টতা ও হারাম খাওয়ার মধ্যে আমি কীভাবে শরিক হতে পারি?)। আমি চাই না, যেসব বিষয় থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করি, তা আমি নিজেই করে বসি। আমার সাধ্যে যতটুকু কুলায় আমি তো সংশোধন করতে চাই। আমি যা কিছু করতে চাই, তা আল্লাহর তাওফিকের ওপর নির্ভর করে। আমি তারই ওপর ভরসা করে আছি এবং সব ব্যাপারে তারই দিকে ফিরে আসি। হে আমার কওম, আমার বিরুদ্ধে তোমাদের হঠকারিতা যেন এত দূর না পৌঁছায় যে শেষ পর্যন্ত তোমাদের ওপরও ওই আজাবই এসে যায়, যা নূহ, হুদ বা সালেহের কওমের ওপর এসেছিল। আর লুতের কাওম তো তোমাদের থেকে বেশি দূরে নয়। তোমাদের রবের কাছে মাফ চাও। তার দিকে ফিরে আসো। নিশ্চয়ই আমার রব বড়ই দয়ালু এবং তার সৃষ্টিকে তিনি ভালোবাসেন।

তারা তখন জবাব দেয় হে শোয়াইব, তোমার অনেক কথাই তো আমাদের বুঝেই আসে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের মধ্যে তুমি একজন দুর্বল মানুষ। তুমি যদি আমাদের বংশের লোক না হতে তাহলে কবেই তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে দিতাম। তোমার এমন শক্তি নেই যে আমাদের ওপর ক্ষমতা দেখাতে পারো। শোয়াইব (আ.) বললেন হে আমার কওম, তোমাদের সঙ্গে আমার বংশগত সম্পর্ক কি আল্লাহর চেয়ে বেশি সম্মানের বিষয় যে তোমরা (বংশকে ভয় করলে, আর) আল্লাহকে একেবারেই পেছনে ফেলে রাখলে? জেনে রাখো যে তোমরা যা কিছু করছ, আমার রব এসবই ঘিরে রেখেছেন। হে আমার কওম, তোমাদের নিয়মে তোমরা কাজ করতে থাকো। আমিও আমার কাজ করে যাব। শিগগিরই তোমরা জানতে পারবে যে কার ওপর অপমানকর আজাব আসে, আর কে মিথ্যাবাদী। তোমরাও অপেক্ষা করো আমি তোমাদের সঙ্গে অপেক্ষায় রইলাম। (সুরা হুদ, আয়াত: ৮৪-৯৪)