তখন রাসুলে করিম (সা.)কে যারাই অনুসরণ করত, তাদের সবার প্রতি প্রকাশ্য শত্রুতা প্রদর্শন করতে লাগল। যেসব গোত্রে মুসলমান ছিল, তাদের তারা আক্রমণ করেছে, তাদের বন্দী করে, তাদের যেতে দেয়নি, পানি দেয়নি, তাদের মক্কায় তীব্র গরমে উদাম করে রেখে দিয়েছে। উদ্দেশ্য, যাতে তারা তাদের ধর্ম বর্জন করে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে হাল ছেড়ে দিয়েছে। আবার অনেকে তাদের প্রতিহত করেছে, আল্লাহ্র আশ্রয়ে থেকে।
বিলাল, যাঁকে পরে আবু বকর মুক্ত করেছিলেন, তখন বনু জুমাহর মালিকানায় ছিলেন। জন্মগতভাবে দাস। তিনি ছিলেন একজন বিশ্বস্ত মুসলমান। মনেপ্রাণে খাঁটি মানুষ। তাঁর বাবা ছিলেন রিবাহ আর মা হামামা। উমাইয়া ইবনে খালাফ ইবনে ওয়াহাব ইবনে মুজায়ফা ইবনে জুমাহ তাঁকে দিনের প্রখরতম সময়ে বের করে নিয়ে এসে খোলা মাঠে চিৎ করে শুইয়ে দিত, বুকের ওপর চাপিয়ে দিত ভারী এক বিশাল পাথর। তাঁকে সে বলত, ‘হয় এখানে এইভাবে তুমি মরবে আর না হয় মুহাম্মদকে ছাড়বে এবং আল-লাত ও আল-উজ্জাকে পূজা করবে। এমনই অত্যাচার সহ্য করতে করতে বিলাল বললেন, ‘আহাদ, আহাদ—এক, এক।’
আপন বাবার বরাত দিয়ে হিশাম ইবনে উরওয়া আমাকে বলেছেন, এমনই করে অত্যাচারের মুখে বিলাল যখন ‘এক’, ‘এক’ বলছিলেন, তখন ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন ওয়ারাকা ইবনে নওফেল। ওয়ারাকাও তখন বললেন, ‘আল্লাহ্র কসম বিলাল, এক, এক।’ তখন তিনি গেলেন উমাইয়া আর বনু জুমাহর কাছে। তারাই এই নিপীড়নের নায়ক। তাদের তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্র নামে আমি কসম খাচ্ছি, এমনি করে ওকে যদি আপনারা হত্যা করেন, তাহলে ওর কবরে আমি স্মৃতিসৌধ বানাব।’
একদিন এমনই নিগ্রহের সময় সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আবু বকর। তাঁর বাড়ি ওই গোত্রের এলাকায় ছিল। তিনি উমাইয়াকে বললেন, ‘এই বেচারাকে এমন অত্যাচার করছেন, আপনার আল্লাহ্র কোনো ভয় নেই? কত দিন চলবে এরকম?’
উমাইয়া বলল, ‘ওকে তো তোমরা নষ্ট করেছ, কাজেই তার এই অবস্থা থেকে তোমরাই বাঁচাও না কেন?’
আবু বকর বললেন, ‘তা-ই আমি করব। আমার কাছে এক কালো ক্রীতদাস আছে। এর চেয়েও জোয়ান, শক্তিশালী। ও একজন নাস্তিক। বিলালের সঙ্গে তাকে আমি বদলাব।’
যে কথা সেই কাজ। আবু বকর তাঁকে ওখান থেকে উদ্ধার করে মুক্ত করে দিলেন।
মদিনায় হিজরত করার আগে আবু বকর ইসলামের ইতিহাসের ছয়জন ক্রীতদাসকে মুক্ত করেছিলেন। বিলাল ছিলেন সপ্তম জন। তাঁদের নাম আমির ইবনে জুহায়রা, তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং বিরে মাউনার যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। উম্মে উবায়স এবং জি তিনিয়া (তাঁকে মুক্ত করার সময় তাঁর দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল, কোরাইশরা বলেছিল, আল-লাত আর আল-উজ্জা তার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু জিননিরা বলেছিল, পবিত্র ঘরের কসম, এটা মিথ্যে কথা। আল-লাত আর আল-উজ্জার ক্ষতি করার ক্ষমতাও নেই, সারাবার ক্ষমতাও নেই? তারপর আল্লাহ্ তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন)।
তিনি আন-নাহদিয়া ও তাঁর মেয়েকে মুক্ত করেছিলেন। মেয়ের মালিক ছিল বনু আবদুদ দায়ের এক নারী। তাদের মালিক তাদের ময়দা ভাঙানোর জন্য পাঠাচ্ছিল। ওই দিক দিয়ে যাচ্ছিলেন আবু বকর। মালিক মহিলা বলল, ‘আল্লাহ্র কসম, তোমাদের কখনো আমি মুক্তি দেব না।’ আবু বকর বললেন, ‘আপনার কসম প্রত্যাহার করে নিন।’ মালিক বলল, ‘ঠিক আছে, প্রত্যাহার করলাম। আপনারাই তাদের নষ্ট করেছেন, কাজেই আপনারাই তাদের মুক্ত করুন না কেন?’ দাম একটা ধার্য হলো। আবু বকর বললেন, ‘আমি ওদের কিনে নিলাম। ওরা এখন মুক্ত।’ মেয়ে দুটো বলল, ‘ময়দাটা ভাঙিয়ে ওকে এনে দিয়ে যাব না আমরা?’ তিনি বললেন, ‘সে তোমাদের অভিরুচি।’
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে