মহান আল্লাহ তাআলা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে, যাতে তারা শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে এবং তাঁর দেওয়া বিধান অনুসরণ করে সমাজে ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও সৌহার্দ্য নিশ্চিত করবে।
এই মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় একটি বহু জাতির আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন বর্ণের মানুষদের নিয়ে তিনি এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করেন, যা সবার মানবিক, সামাজিক, নাগরিক, ধর্মীয় অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
বিশ্বনবী (সা.)–এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ‘মদিনা সনদ’। ইতিহাসে এটি মানবসভ্যতার প্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। এই সনদ কেবল একটি চুক্তি নয়, এটি ছিল শান্তি, মানবিকতা ও বহুজাতিক ঐক্যের একটি শক্তিশালী দলিল। এই সনদের মাধ্যমে বিশ্বনবী (সা.) দুনিয়ায় এমন একটি রাষ্ট্রের রূপ দিয়েছেন, যেখানে জাতি, ধর্ম ও বর্ণের পার্থক্য উপেক্ষা করে সবার সমানাধিকার নিশ্চিত হয়েছে।
মদিনা সনদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘদিনের গোত্রীয় সংঘাত ও অস্থিরতা দূর করা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করা। পাশাপাশি, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাও এর লক্ষ্য ছিল। এই সনদের মাধ্যমে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে এমন একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা তাদের পরস্পরকে সহযোগিতা ও নিরাপত্তা প্রদানে বাধ্য করে। মদিনা সনদে বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত অধিকার ও দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে।
মদিনা সনদে বলা হয়েছে, কুরাইশ ও মদিনার মুমিন মুসলিমগণ এবং যারা তাদের অনুগামী হয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে, তারা ভিন্ন একটি (ভৌগোলিক) জাতি হিসেবে পরিগণিত হবে। মুসলমানরা ও বনু আওফ, বনু নাজ্জার, বনু হারেস, বনু খাজরাজ, বনু আওসসহ অন্যান্য মিত্রগণ এবং জুফনা উপগোত্র, বনু শুতাইবাহসহ চুক্তিবদ্ধ সব ধর্ম সম্প্রদায় ও তাদের মিত্ররা তাদের জানমাল ও সম্মানের নিরাপত্তায় সমান অধিকার পাবে। তারা একে অপরের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করবে। অর্থাৎ মদিনার সব নাগরিক, যেই ধর্ম বা সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, তাদের জানমাল ও সম্মানের সমান অধিকার থাকবে। অপরাধের দায়ভার সম্পূর্ণভাবে অপরাধীর ওপর বর্তাবে এবং কারও অপরাধের জন্য গোটা সম্প্রদায় দায়ী হবে না।
এই সনদের মাধ্যমে মদিনার প্রতিটি নাগরিককে ন্যায়বিচার, সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে জীবন যাপন করতে উৎসাহিত করা হয়। মজলুমের পাশে দাঁড়ানো, প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা ছিল এই সনদের মূলনীতির মধ্যে অন্যতম। মদিনা রাষ্ট্রে প্রতিবেশীকে নিজের মতো করে গণ্য করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তির প্রতি অন্যায় বা জুলুম হলে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করার জন্য সব পক্ষ অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। এই সনদে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এই চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে, জুলুম করে বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, তবে রাষ্ট্রের সব নাগরিক মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করবে।
মদিনা সনদে সংকট সমাধানের একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। যদি কোনো পক্ষের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়, যা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা সমাধানের জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.)–এর দিকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
মদিনা সনদ শুধু একটি রাষ্ট্রীয় নথি নয়, এটি একটি আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা শান্তি ও সৌহার্দ্যের বার্তা বহন করে। মদিনা সনদ গোত্রীয় সংঘাত, ধর্মীয় বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা দূর করে মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করেছে।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com